তোমার চোখে স্বর্গ কাঁপে
এইতো অতি নিকট কালেও তোমার কাছে
ছুটে যেতাম নেচে ওঠা হৃদয় নিয়ে
হরহামেশা প্রীতিঘেরা এক নিবাসে।
তোমার পায়ের পাতা পড়তো আমার ঘরে,
ফুল্ল আমার হৃদয়পুরে।
তোমার দীপ্তি হাসির ছটায় স্টাডি আমার
প্রায় রোজনা ক্ষণে ক্ষণে
হতো নিবিড় উদ্ভাসিত।
তোমার স্নিগ্ধ চোখ-জুড়ানো রূপের জ্যোতি
পথ দেখাতো রুক্ষ এবং হিসহিসে সব অন্ধকারে।
কিছুকালের মধ্যে যেন একটি দেয়াল
উঠল গড়ে কার খেয়ালে,
তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না একটি দিনও
আমার ডেরায়, তুমি ভীষণ দূরে থাকো।
তোমায় দেখার তৃষ্ণা আমার বালির ঝড়ে,
তোমার নানা বিরূপতায় পায় যে আরও প্রখরত।
তবু তোমার পাই না দেখা কোনও মতে,
প্রেত-প্রেতিনী আমার মনের কবর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে
হিঁচড়ে আনে ক’খানা হাড় মাথার খুলি।
পচা গন্ধে বমি আসে, মুখ ফিরিয়ে দিই উগরে কিছু স্মৃতি।
ভয়-দেখানো অনেক ছায়ার ভূতুড়ে সব খেলা দেখে,
শ্যামল ছায়ার বাগানজোড়া পুষ্পশোভার স্মৃতি এখন
নতুন করে বাঁচার তীব্র ইচ্ছেদ্যুতি আমার মতো
হৃদরোগীকে মাতাল ছন্দে নাচিয়ে তোলে বারংবার।
তোমার নরম হাতের ছোঁয়া আমার শিরায়
ফসলভরা নৌকা ভাসায়, নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন
জাগায় গুণীর জ্ঞানের মতো এবং দেখি
আমার মদির আলিঙ্গনে তোমার চোখে স্বর্গ কাঁপে।
২৪.১১.৯৯
ত্রঁদো ডোবা থেকে সামুদ্রিক মোহনায় যিনি
মহীয়সী সুফিয়া কামাল স্মরণে
আপনি প্রথম চোখ খুলে
পাড়াগাঁর আঁধার আঁতুড়্ঘরে দেখলেন না-জানা সামান্য
বস্তু কিছু। আপনার রাঙা
ক্ষুদে অস্তিত্বের নম্র রূপ নিমেষেই
কেড়েছিল মন সকলের। আপনার জন্মলগ্নে
কানের ভেতরে কোরানের সুরধরা যে মুরুব্বি তার
বিশ্বাসের দৃঢ়তায় বইয়ে দিয়েছিলেন, সেই সুর জেগেছিল
আপনার শেষ
চেতনাস্পন্দিত প্রহরেও, মনে হয়। ছিল না কি?
পাড়াগাঁর শ্যামনিমা, মধুর গোধূলি, জ্যোৎস্নারাত,
নদীর চঞ্চল ঢেউ, ঝোপঝাড় আপনার প্রিয় ছিল খুব।
যৌবনের ঊষালগ্নে সৌন্দর্যসন্ধানী দু’টি চোখ ঢাকা পড়ে
বোরখার আড়ালে, অথচ ব্যর্থ হয়
আপনার অন্তর্দৃষ্টি মুছে দিতে বোরখার কৃষ্ণ স্বৈরাচার। বাঙালির
ঘরে স্মিত ভূমিষ্ঠ হয়েও বহুদিন
মাতৃভাষা বনবাসে গেছে, উর্দুচর্চা
ছিল বটে আবশ্যিক! আপনি লুকিয়ে মাতৃভাষা
জপেছেন ক্ষণে ক্ষণে, গোপনে ফুটিয়েছেন রূপ
তার কিছু খাতার পাতায়। সেই থেকে
সাঁঝের মায়ার বীজ ক্রীড়াপরায়ণ
কিশোরীর ধরনে দিয়েছে উঁকিঝুঁকি।
নিজ গাঁয়ে প্রকৃতির বরিশালী রূপে অতিশয় মুগ্ধ হয়ে
কেটেছে জীবন কিছুকাল, বরং পশ্চাৎপদ পাড়াগাঁর
ছমছমে অন্ধকার মাথা কুটে মরেছে, পারেনি
কিছুতে দখল করতে আপনাকে কোনও ছলেবলে। ফুঁসে উঠে
এঁদো ডোবা আপনার যাত্রার উদ্যোগে ক্রুদ্ধ হয়ে
চেতনার দৃপ্ত ভেলা ভাসিয়েছিলেন ঝড়ক্ষুব্ধ
নদীতে, ভীরুতা আর সংকোচের বাধাগুলি গেছে উড়ে দূরে
দুরন্ত হাওয়ায় আর ভেলা ভিড়ে গেছে প্রগতির সামুদ্রিক
মোহনায়।
২২.১১.৯৯
দাঁড়ালে টলতে থাকি
দাঁড়ালে টলতে থাকি, খানিক হাঁটতে
চেষ্টা করলেই রুক্ষ ধূসর ধুলোয়
স্রেফ মুখ থুবড়ে পড়ি, আবার কখনও
খাবি খাই
থকথকে কাদায়, এখন
আমার এমনই হাল। শক্ররা চৌদিকে
ফেটে পড়ে ঠা ঠা অট্রহাসিতে এবং বন্ধু বান্ধব বেজায়
মনোকষ্টে ভোগেন আমার অবাঞ্ছিত
এ দুর্দশা দেখে।
লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি, নিজেকে লুকোতে ইচ্ছে করে,
যেমন আহত জন্তু খোঁজে অন্ধকার গুহা। এই শারীরিক অক্ষমতা
জানিনা ভোগাবে কতদিন, কতকাল
আমাকে রাখবে ফেলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হিংস্র
ঘোর অমাবস্যার দখলে। কারও করুণার পাত্র
হয়ে থাকা, বুকে হেঁটে পথ চলা, ব্যথিত দু’চোখে
তাকানো, কম্পিত ঠোঁটময়
করুণ অথচ তুচ্ছ আবেদন নিয়ে বেঁচে থাকা
আত্মায় গ্লানির ছাপ সেঁটে নিত্য হামাগুড়ি দেয়া
কেবল আপনকার মাংস নিজ দাঁতে ক্ষিপ্র ছেঁড়ারই শামিল।
যখন ভোরের আলো চুমো খায় আমাকে এবং
পূর্ণিমা সপ্রেম করে আলিঙ্গন
আমার ক্ষতের ছেঁড়া ন্যাকড়াগুলো খসে যায়, কোথাও সরোদ
সুর বোনে, আমার সত্তার ঘটে রূপান্তর, আমার নমিত
কেশগুচ্ছ হয়ে ওঠে স্যামসনের কেশর এক লহমায়-
এবং মশকরা প্রিয় লোকজন পালাবার পথ খুঁজে মরে।
২.১.২০০০
দূর থেকে
দূর থেকে দেখা যায় সকল ঋতুতে
শহরের নাক উঁচু প্রান্তিক পাড়ায়
একটি দোতালা বাড়ি রূপসীর মতো নিরিবিলি
দাঁড়ানো বছর তিন। সে বাড়ির বাশিন্দা খুবই ছিমছমা
একটি যুগল, নাম উহ্য থাক, বর বধূ বটে। প্রায়শই
বেড়ায় মোটরকারে এদিক সেদিক
কখনও পার্টিতে যায়, ঘরে ফেরে মধ্যরাতে, বেঘোর ঘুমায়
একই বিছানায়।
সে বাড়িতে নীরবতা জুড়ে রয় প্রায় সারাক্ষণ,
সেখানে শোনে না কেউ শিশুর রঙিন কলরব
কোনওদিন। শুধু দু’টি শাদা খরগোশ, ভোরবেলা
অথবা বিকেলে খেলা করে বাড়িটার
পেলব সবুজ লনে। খরগোশ যুগল রোদ্দুর
আর ছায়া মেখে নেয় অস্তিত্বের ভাঁজে।
কলহের রেশ কেউ কখনও পায়নি টের। পরিচারিকার
মুখ থেকে খসেনি ওদের বিবাদের
কথা ও কাহিনী কোনও। তবু কেন একদিন বধূটি মর্গের
টেবিলে নিঃসাড় পড়ে থাকে গাঢ় অন্ধকারে?
অথচ নিবাসে তার খরগোশ যুগল সানন্দ খেলা করে
রোদ্দুর চুম্বন করে বাড়ির সবুজ লনটিকে।
১১.১২.৯৯
দূরত্ব
এ এক এমন কাল, অন্ধকার কালো হতে কালোতর হয়ে
কালোতম হয়ে যায়। দূরত্ব কেবলি বেড়ে যায় ক্রমান্বয়ে
মালী আর গোলাপের মধ্যে। উদাসীনতায় উদ্যানের শোভা
আজ পলাতক আর পুষ্পবিকাশের
আয়োজন ভয়াবহভাবে লোপ পায়
কাঁটাগুল্ম আর বুনো ঘাসের তাণ্ডবে।
আমিও ছিলাম মালী অপরূপ এক বাগানের। এখন সে
উদ্যান এবং
দণ্ডিত আমার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা হামাগুড়ি দেয়
শজারুর ধরনে, দেখছি ক্রোধী ভীমরুল আর বিষপোকা
কী দ্রুত ক্ষইয়ে দিচ্ছে ফুলের যৌবন, নিচ্ছে লুটে
প্রবল সন্ত্রাসে নিরুপমা বাগানের
স্মিত, স্নিগ্ধ রূপ আর আমার নিজেরই
প্রবেশাধিকার নেই, দূরত্ব বিপন্ন করে এই আমাকেই।
বসে থাকি চুপচাপ আপন ঘরের
চেয়ারে প্রায়শ, নিঃসঙ্গতা বয়ে যায়
আমার অস্তিত্ব তীব্র ছুঁয়ে, উপরন্তু বারবার
নির্দয় নির্ঘুম রাতে যখন ঝিমুনি আসে, কিছু
বিকট বীভৎস মুখ, লাশকাটা ঘরের গুমোট,
খুব ঠাণ্ডা বিভীষিকা নেচে ওঠে, কারা যেন আমাকে বল্লমে
খোঁচাতে খোঁচাতে অন্ধ, হাহাকারময়
কোনও বধ্যভূমিতে পশুর মতো দ্রুত নিয়ে যায়।
চতুর্দিকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেও
কেন জানি অকস্মাৎ অবচেতনের
মেঘালয়ে অভাজন আমার ভেতরে একজন,
যে আমার অন্তর্গত কেউ,
‘আনন্দ, আনন্দ’ বলে ফুলের নীরব উন্মীলন,
মানবীর অলোকসামান্য রূপ, জেদী প্রবীণের
বেঁচে থাকবার দীপ্র সংগ্রাম, শিশুর স্নিগ্ধ হাসি,
জ্যোৎস্না চমকিত সরোবর দেখে জেগে ওঠে আজও।
২২.৪.৯৯