তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত?
হানাবাড়ি নয় কিংবা উৎকট ওষুধগন্ধী মর্গও নয় কোনও
তবু কেন লাশকাটা ঘরের আদল ফুটে ওঠে? শ্যামলীতে
আমার আপন ছোট ঘরও এটি নয়, তবু কেন
আমার মতোই কেউ এই মেঘাচ্ছন্ন গৃহকোণে
মেঘের শয্যায় শুয়ে আছে প্রায় নিথর নিষ্প্রাণ?
দু’চোখের পাতা বোজা মাঝে মাঝে কাঁপে শুকনো ঠোঁট।
তবে কি বাতিল, পরিত্যক্ত এ লোকটা, মানে আমি?
কী আমার অপরাধ? এই তো যে ফেরেশ্তার আধিপত্যছুট
সুর আমি মানুষের কণ্ঠে
দৈব কণ্ঠস্বর নিয়ে আমার অক্লান্ত সাধনায়
বড় বেশি মেতে উঠেছিলাম যৌবনে, এমন কী প্রৌঢ়ত্বের
প্রখর প্রহরে। দুর্বিনীত আকাঙ্ঘা আমার বুঝি
সবুজ চোখের ঈর্ষাপরায়ণ ফেরেশ্তাকে খুব অপ্রসন্ন
করেছে বলেই আমি কণ্ঠস্বর প্রায় হারিয়ে নিঃশব্দ, রুক্ষ
কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। যতই জাগাতে চাই
কণ্ঠস্বর, কণ্ঠনালী তুষারের অজস্র কণায় ঢেকে যায়।
কী নিঃসাড়, নির্বাসিত মনে হয় ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে আমার।
এমন দুঃসহ একা কখনও লাগেনি আগে, যেন
কেউ নেই, অদূরে অস্পষ্ট কয়েকটি ছায়া নড়ে চড়ে না কি?
চোখ খুলি, চোখ বুজি, কবিতার পঙ্ক্তি
স্মরণে আনতে চাই। সব হিজিবিজি
মনে হয়। দ্বিপ্রহরে বিশ্রাম হেলায় ফেলে, বুকের শোণিত
পানি করে
অগণিত রাত্রিকে বানিয়ে ভোর লিখেছি কত না পদাবলী,
অথচ এখন এই ঘোর তমসায় কেউ আসছে না আমার নিকট,
দিচ্ছে না বুলিয়ে হাত কপালে অথবা অনুরাগে
আমার তৃষিত ওষ্ঠে চেপে ধরছে না ঠোঁট, শুধু
দূরে অন্ধকার গায়ে মেখে উড়ে উড়ে চলে যায়
সম্ভবত ঈর্ষান্বিত ফেরেশ্তার ভয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় আমার
অবসন্ন, মুমূর্ষ দুর্দশা দেখে। মনে হয়, শুধু
আমার প্রথমা কন্যা আর তার কর্মিষ্ঠ জীবনসঙ্গী ঝুঁকে
আছে এই শীর্ণ, প্রায় নিশ্চেতন অস্তিত্বের দিকে অসহায়
উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে। দূর থেকে ক’জন ফেরেশ্তা, যারা দৈব
কণ্ঠস্বর হয়ে স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে বাতিল চিঠির মতো, অট্রহাসি
আমার সকল কাব্যগ্রন্থকে পাঠায় নিরুদ্দেশে?
১৪.১১.৯৯
তিমিরবিনাশী একজন
বস্তুত তিমিরবিনাশের ব্রত ছিল আজীবন
তার, বুঝি তাই মুখে আর
কলমের ডগায় ঝরাতো নিত্যদিন
আলোর অদম্য ঝর্নাধারা। নিজস্ব প্রাপ্তির কোনও মরীচিকা
বিভ্রান্ত করেনি তাকে কস্মিনকালেও। অন্তরের
দীপ্ত স্রোত দুর্নিবার টানে তাকে পৌছে
দিয়েছে নির্ভুল সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের খুব কাছে। সাধনার
পথে সে থামেনি বেশুমার প্রেতযোনির তাণ্ডবে।
তিমির লালন করে যাদের এবং যারা তিমিরের
হিংস্রতার উপাসক, তারা
তাকে হননের ক্ষিপ্ত অভিলাষে মেতে পাশব উন্মত্ততায়
যূপকাঠে ঠেলে দেয়। তিমিরবিনাশী
উদার প্রদীপ্ত প্রাণ রক্তাক্ত, নিস্পন্দ পড়ে রয়
নিশ্চতন, নির্বাক ধুলোয়।
তিমিরবিনাশী লোকটার বাসগৃহে বেধড়ক
অন্ধকার নেমে আসে, গৃহিণীর বুক চিরে ওঠে
বেদনা, কান্নার রোল। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধগণ
স্তম্ভিত, শোকার্তে, অতঃপর খবরের কাগজে বিশাল
শিরোনাম, ফটোগ্রাফ, বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রতিবাদী
মিছিলের ক্ষুব্ধ ঢেউ নানা স্থানে। আখেরে সুস্থির
নীরবতা সবখানে। শুধু শব্দ সাধকের গৃহকোণে
মাঝে মাঝে চাপা কান্না, খেলায় নিমগ্ন তার তিন বছরের
পৌত্রীর কোমল গালে রৌদ্রছায়া নাচে আর তিমিরবিনাশী
লোকটার বিপন্ন বিধবা সংসারের অন্ধকারে আলো খোঁজে।
১৭.২.৯৯
তুমি যে বড়ই একা
আবেদ খান প্রিয়বরেষু
তুমি যে বড়ই একা, চাদ্দিকে প্রেতের আনাগোনা-
বুঝতে পারো কি? যতদূর জানি, ওরা
অভিন্ন ধাতুতে নয় গড়া; তবু একই ঘাটে এসে
জুটেছে চকিতে কিছু অঘটন ঘটাবার সাধে।
তোমাকে সতর্কবাণী শুনিয়েছি বারবার, অথচ কদাপি
কথায় পেতেছ কান। দেখলে না এখানে সেখানে
কত ফাঁদ পাতা আছে আর চোরাগোপ্তা হামলায়
নন্দি-ভৃঙ্গিগণ বিলক্ষণ নিত্য হাত
পাকায় সোৎসাহে। হায়, যতই ওদের
মিত্র বলে আলিঙ্গন করো দুই বেলা, তোমাকে পাঠাবে ঠিক
মজা পুকুরের তলে। তুমি নিম বামে হাঁটো, ওরা
অতি ডানে সর্বক্ষণ। সামনেই চোরাবালি প্রতারক শান্তি
নিয়ে আছে বেখেয়াল পথিককে গিলে খেতে নীরব ক্ষুধায়
দিনরাত। কে অজ্ঞাত জল্লাদ তোমার কাছে পাঠায় মিত্রের
কাটামুন্ডু পুরোনো সংবাদপত্রে মুড়ে ঘোর অমাবস্যা রাতে
এবং তোমার শোক বোবা আর্তনাদ।
তুমি যে বড়ই একা, নানা দিক থেকে ধেয়ে আসে
অগ্নিবাণ, কোথায় বাড়াবে হাত উদ্ধারের দড়ি
দৃঢ় হাতে ধরবার আকাঙ্ক্ষায় আজ
পড়ন্ত বেলায়? জানি তোমারই আসরে
উদার নিয়েছ ডেকে বহুরূপী ইয়ারবক্সিকে; দেখছ না
তোমার গলায় মালা দুলছে কেউটে হয়ে উচ্ছুসিত গোধূলি বেলায়?
ঢের প্রতীক্ষার পর, বহু শ্রমক্লান্তি সয়ে এই
আসন পেয়েছ তুমি ঢের ডামাডোল, অন্ধকার
উজিয়ে, অথচ দেখ তোমাকে আসন ছাড়া করবার সাধ
মানের পানির মতো খলখল করে
তাদের বিচিত্র মনে, ঊর্ণাজাল বোনা হয় টেবিলে বৈঠকে।
তুমি যে বড়ই একা, হে বান্ধব, ব্যূহের ভেতর। এই ব্যূহ
ভেদ করবার মন্ত্র ভুলেছ কি ব্যাপক সন্ত্রাসে? অতীতের
প্রেতগুলি তোমার স্বপ্নের বুকে বেজায় দিয়েছে জুড়ে নাচ।
২২.৩.৯৯
তোমার কাছ থেকে
মা, মা আমার, মা গো, কতদিন তোমার
কবরের কাছে যাই না আমার আশৈশব
সকল স্মৃতিকে আবৃত্তি করার উদ্দেশ্যে,
আলিঙ্গন করার জন্যে। এই আবৃত্তি, এই আলিঙ্গনের
আকাঙ্ক্ষায় আমার সামান্য পুঁজি উজাড় করে
বাঁধিয়েছিলাম তোমার নশ্বর অস্তিত্বের অন্তিম
আশ্রয়, যে অস্তিত্বের কপাল আর হাত ছুঁয়ে
পা দু’টি চুম্বন করে শান্তি পেয়েছি বহুবার।
আম্মা, অথচ কতদিন যাই না কবরস্থানে। কখনও
বৃষ্টিবাদল, কখনও নিহত হওয়ার আশঙ্কায়,
কখনওবা কুকুরের জিভ-বের-করা দৌড়ের মতো
ব্যস্ততা, হায়, তোমার অযোগ্য পুত্রের নিরর্থক, শোচনীয়
ব্যস্ততা আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। তোমার কবরের
পাশে এসে কিছুক্ষণ শান্তি লাভের সিদ্ধান্ত
কতবারই না ভেসে গেছে বানের খড়কুটোর মতো। নিশ্চিত
জানি, তোমার ভেতর জীবনের স্পন্দন থাকলে, কখনঅ
নারাজ হতে না তুমি, বরং হাত নেড়ে বারণ করতে
তোমার অসীম আদম যত্নের বাচ্চু’র কষ্ট হবে ভেবে।
মা, ধিক আমাকে, বৃক্ষ রক্ষার মিছিলে দাঁড়ানো, সকল
সন্ত্রাসের বিপক্ষে উচ্চস্বরে আমার প্রতিবাদ জানানো,
সদ্য মসজিদ সংলগ্ন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা
একাত্তরের ঘাতক দালালদের নির্যাতিত
নারী-পুরুষের কঙ্কাল, করোটি, হাড়গোড়,
শিশুর হাতের মৃত্তিকা-দংশিত রুলি, কাপড়-চোপড়,
কত অশ্রুত, রক্তাক্ত হাহাকার, আর্তনাদ, তুরস্কের
ভূমিকম্পের হাজার মানব-মানবীর
জীবন্ত কবর, হিরোশিমায় মানুষের বিরুদ্ধে
মানুষের প্রধান, ভয়ঙ্কর সংহারতাণ্ডব,
আজও যা শিরায় শিরায় বইয়ে দেয় শৈত্যপ্রবাহ-
আম্মা, তোমার সুন্দর, নিরীহ কবরের কাছ থেকে তোমার
অপদার্থ সন্তানকে কেবলি দূরে সরিয়ে রাখছে। মা গো,
আমি আমার অপরাধের এই পাহাড় কোথায় লুকাবো?
২৪.০৮.৯৯