কেবলি হারিয়ে যাচ্ছে
নিরন্তর গলিত রূপোর স্রোত বয়ে যায় আমার ভেতর,
টের পাই। আমার শৈশব,
কৈশোর যৌবন নানা রূপে মিশে আছে
সেই স্রোতে; আমার অপটু
সাঁতার, বিস্তর ডুব, ভেসে-থাকা
আমাকে এখনও কিছুকাল কেমন মাতিয়ে রাখে, নিয়ে যায়
কে জানে কোথায় অজানায়। রঙিন দুপুর
বিষণ্ন গোধূলিবেলা, সন্ধ্যারাত গল্প জুড়ে দেয়।
নিরন্তর গলিত রূপোর ছোট ছোট ঢেউ এসে
আমাকে মসৃণ ছুঁয়ে যায়, যেন বন্ধুদের ছোঁয়া
কানামাছি খেলার সময়, ঢেউগুলি
খিলখিল হেসে ওঠে, আমার সুদূর কৈশোরকে
নাচায় অবাধ সুখে যেন। হঠাৎ হারিয়ে যায়
আমাকে পিছনে রেখে। আমি কি বেগানা তবে, হায়,
শৈশবের, কৈশোরের, যৌবনের নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়?
গলিত রূপোর স্রোত, আমার মিনতি রাখো, হারিয়ে যেও না।
মনে পড়ে, কখনও কখনও ছায়াচ্ছন্ন সন্ধ্যারাতে
রূপবতী জলকন্যা, মুখ যার মানবীর, স্তনচূড়া আর নাভিমূল
থেকে যার শুরু হয় মৎস্যরূপ, দেখা দিয়ে চকিতে মিলিয়ে
যেত কারও নিরুচ্চার অথচ অপ্রতিরোধ্য নির্দেশে কোথাও
অজানায়। ঘাটে বাঁধা নৌকোগুলোর বাতিরা যেন
জোনাকির মতো দপ্ জ্বলে, নেভে।
আমার কেমন যেন মনে হয়, জলকন্যা চলে যাওয়ার পরে
একটি রূপোলি স্রোত, একটি ডাগর নদী এই শহরের
কেবলি হারিয়ে যাচ্ছে কতিপয় শহরবাসীর বেলাগাম লুণ্ঠনের,
রাক্ষুসে শোষণ আর তান্ডাবের ফলে।
আমার ভেতরে লুপ্ত গলিত রূপোর ধারা, কেবলি হারিয়ে
যাচ্ছে দ্রুত কবেকার রূপসী নদীর উচ্ছলতা।
১২.১২.৯৯
চলেই যেতাম
চলেই যেতাম;
আয়োজন ছিল ঠিকঠাক,
বেবাক নিখুঁতই বলা চলে।
তবে কোনও লটবহর ছিল না,
কিয়দ্দূরে জন্মদিন খুব মুখ ভার করে ছিল
দাঁড়ানো নীরবে এক কোণে,
যেন তাকে অতিশয় কালো মেঘ বানাবার লোভে
মরণের ফেরেশ্তা তার
হিংস্র হিম ডানা
সফেদ অপরিসর বেডে দিয়েছে ছড়িয়ে
চিৎ-হয়ে-থেকে অচেতন
আমার ওপর।
যেখানে যেতাম চলে কাউকে কিছু না বলে বড়ই নিশ্চুপ,
সেখানে, নিশ্চিত জানি, কেউ
নেই, কিছু নেই, আছে শুধু
অন্তহীন বোবা অন্ধকার, চির স্তব্ধতার হিম দীর্ঘশ্বাস।
আখেরে হয়নি যাওয়া। মিশকালো মেঘ
থেকে ঢের ধূসর মেঘের
আস্তরণ ভেদ করে ভাসতে ভাসতে
এক ঝাঁক তারা ছুঁয়ে, বিস্তর সাঁতার কেটে হ্রদে,
মেঘনা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে গইন্তা ঘাটের
ভেজা মাটি ছুঁয়ে
শ্যামলীর শান্ত গলি, রাধাচূড়া নিমেষে দৃষ্টিতে পুরে নিয়ে
কী করে যে সিঙ্গাপুরে বিরাট আরোগ্য নিকেতনে
কাশফুল্প্রায় ধবধবে বেডে প্রত্যাবর্তনের
কোমল আরামে কিন্তু বেগানা ডেরায় ফিরে এলাম, বুঝিনি।
কী আনন্দ চেনা ভুবনে আমার ফিরে এসে
চোখ মেলে তাকাবার এদিকে সেদিকে। পুনরায়
ভোরবেলা তরতাজা মাখনের মতো রোদ, আকাশের নীল,
শ্যামলীতে আমার আপন ঘরে বইয়ের মিছিল, বারান্দায়
লেজঝোলা পাখি দেখে, নয়না, দীপিতা আর অন্তরের অজস্র চুমোর
স্বাদ নিয়ে, জীবনসঙ্গিনী, তিন কন্যা, পুত্র এবং টিয়ার,
ভাইবোন সকলের দৃষ্টিতে চিত্তের প্রস্ফুটিত ফুল আর
অন্তরতমার অনুপস্থিতির বিরানায়
গুণীর তানের মতো ণ্ডঞ্জরিত অস্তিত্বে আমার।
কোথায় আমার চেনা বলপেন? কোথায় লুকালো
অভিমানে? কোথায় রয়েছে পড়ে কবিতার খাতা?
প্লিজ, খঁজে এনে দাও কাছে-
ওদের সান্নিধ্য বড় প্রয়োজন আজ।
১০.১১.৯৯
চাঁদের বিকল্পের জন্যে প্রস্তাব
গোধূলিবেলায় চায়ের আসর বসেছে
পাঁচজন যুবকের। পাঁচ রকম বিষয় নিয়ে
চলেছে আলোচনা আর মাঝে মাঝে
টেবিলে চলে আসছে গরম সিঙাড়া আর
চায়ের সধূম পেয়ালা। আলোচনা, খাদ্য আর পানীয়
সবকিছুই উপভোগ্য ঠেকছে যুবাদের কাছে।
ইতোমধ্যে হরিণের পাটল-রঙ চামড়ার মতো
গোধূলি সন্ধ্যার কাজল রঙের সঙ্গমস্পৃহায়
সমর্পিত। কিছুক্ষণ পরে আকাশে পদ্মফুলের মতো ফুটে ওঠে
গোল চাঁদ। চায়ের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে
একজন যুবক বলল, ‘চাঁদের সৌন্দর্যের কথা এত
বিজ্ঞাপিত সারা বিশ্বে কবিদের কল্যাণে, এতে বিন্দুমাত্র
সন্দেহ নেই, তবু বলল, বড়ই একঘেয়ে, ক্লান্তিকর এই রূপ।
আমার ইচ্ছে হয়, একে ত্রিকোণ এবং বেশ
লাল রঙের আকার দিই’। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা
ঝুলে থাকে টেবিল।
দ্বিতীয় যুবক একটু কেশে জানায়, ‘আমার ইচ্ছে
অন্যরকম-আমি চাই চাঁদের বদলে
হংস-হংসীময় একটি হ্রদ তৈরি করতে। এই প্রস্তাব
মনঃপূত হলো না তৃতীয় যুবার, সে ঘোষণা করে, ‘চাঁদকে
চিরদিনের মতো অর্ধচন্দ্র দিয়ে সরিয়ে তার জায়গায়
সৃষ্টি করবো কম্পিউটারখচিত এক মনোহর চিত্র। চতুর্থ যুবক
সলাজ হাসির ঢেউ তুলে বলে, ‘না হে, তোমাদের কারও
পরিকল্পনা মনঃপূত হচ্ছে না। যদি আমার বাসনার খবর
জানতে চাও, তবে বলি, আমি চাঁদকে নির্বাসনে
পাঠিয়ে তার স্থলে আঁকবো আমার
সুন্দরীতমা প্রিয়তমার মুখ। এই পরিকল্পনা মানবিক
বিবেচনা করে সবাই মাথা নাড়লো।
পঞ্চম যুবা চায়ের পেয়ালায় চামচ নাড়ছিল
নিঃশব্দে, যেন বোবা সে। বাকি চারজন
তাকে ক্রমাগত খোঁচাতে থাকে ওর প্রস্তাব শোনার
উদ্দেশ্যে। পঞ্চম যুবক দৃষ্টি অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে ছড়িয়ে
স্বগতোক্তির মতো বলতে শুরু করে, ‘চাঁদের জায়গায়
এক পাশে স্মারকচিহ্ন হিসেবে থাকবে সদ্য আবিষ্কৃত
একাত্তরের বধ্যভূমির একটি মড়ার খুলি, যার উপরে উড়বে
অগণিত প্রজাপতি। চাঁদ রূপান্তরিত হবে এক শান্তিবাগে,
যেখানে থেকে লড়াই-ফ্যাসাদ, সহিংসতা
নির্বাসিত হবে চিরতরে। থাকবে না সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা,
রক্তচক্ষু মৌলবাদীদের হাতিয়ারের হুঙ্কার। সেখানে
সগৌরবে বিরাজ করবে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বনি।
১৫.১১.৯৯