একটি কলমের পথযাত্রা
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই আমার কলম
চোখ কচলাতে কচলাতে টেবিল থেকে গলিপথে
নেমে গেলো। কী খেয়াল হলো ওর, সে
হেঁটে হেঁটে একটা পুরোনো দিঘির কিনারে পৌঁছে
পদ্মকে প্রশ্ন করলো, ‘পদ্ম, তুমি কি আমার কেউ হবে!’
পদ্ম মাথা নেড়ে সাফ জবাব দিলো,
‘অসম্ভব, তুমি আমার কেউ নও। আশাহত
কলম ধরলো অন্য পথ।
হাঁটতে হাঁটতে কলম হাজির হলো
রূপসী এক গাছের কাছে। কলমের ব্যাকুল সওয়াল,
‘তুমি কি আমাকে নিবিড় ভালবাসবে ? গাছ
মৃদু হেসে বলে, ‘আমার ভালোবাসা তোমাকে
ছায়ায় রূপান্তরিত করবে। তুমি সইতে পারবে সেই
রূপান্তরের যন্ত্রণা?’ কলম সেখান থেকে বিদায় নেয় নীরবে।
আমার কলম এবার ক্লান্ত শরীরে গিয়ে বসলো
নদীর কিনারে। নদীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে
সে প্রশ্ন করে, ‘ওগো নদী, তুমি কি
আমার হতে পারবে?’ নদী প্রখর ধারায় বয়ে
যেতে যেতে বলে, ‘আমি কারও জন্যে অপেক্ষা করতে জানি না।
ক্লান্ত কলম সত্তায় নৈরাশ্য নিয়ে শুরু করে পথ চলা।
আখেরে পথের ধুলোকে জিজ্ঞেস করে আমার
পথচারী কলম, ‘ওগো ধুলো তুমি কি আমার
প্রিয়তমা হবে?’ ধুলো জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, হতে
পারি এক শর্তে, যদি আমাকে স্বর্ণচূড় বানাতে পারো। সেই থেকে
আমার পরিশ্রমী কলম দিনরাত ধুলোকে সোনা
বানানোর সাধনা করছে। সফল হচ্ছে কি হচ্ছে না, বোঝা দায়!
১২.১২.৯৯
একটি প্রাচীন গ্রস্থ
একটি প্রাচীন গ্রন্থ কী নিঝুম শুয়ে আছে একা
নিশীথে টেবিলে, যেন তার
দু’চোখে ছিল না ঘুম বহুকাল। পুরোনো নিদ্রার গাঢ় ঘ্রাণ
বুঝি বা ছড়ানো সারা ঘরে; সে কি ক্ষণিক তুলেছে
হাই কিংবা আড়মোড়া ভাঙলো খানিক
না কি কিছুক্ষণ
আছাড়ি পিছাড়ি করে ঢলে পড়ে ঘুমে। অকস্মাৎ
প্রাচীন গ্রন্থটি যেন কারও মুখ হয়ে তীক্ষ্ণ
তাকায় আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে। পুস্তকের
পাতাগুলি কোথায় গায়েব হলো চোখের পলক
পড়তে না পড়তেই? বই থেকে জেগে-ওঠা মুখমণ্ডলের
জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে চতুর্দিকে।
টেবিল টেবিল নয় আর, যেন কানও সাধকের
ধ্যানমগ্ন উদার আসন, যাতে ঠাঁই পেয়ে যাবে
সারা বিশ্বাব্রহ্মান্ড এবং
যদি স্বর্গ সত্য হয়, তা-ও। জ্যোতির্ময় সেই মুখ
রেখেছে আয়ত দৃষ্টি তার বিস্মিত আমার দিকে, ধীরে
আওড়ায় কিছু উদাত্ত নিবিড় কণ্ঠস্বরে
আর কোনও নির্দেশ ছাড়াই
আমার নিজের উচ্চারণ তার উচ্চারিত শ্লোক
হয়, হয় প্রতিধ্বনি। ক্ষণকাল পরে
টেবিলের দিকে যাই, যা এখন সাধকের বিমূর্ত আসন।
প্রাচীন গ্রন্থটি খুঁজি তন্ন তন্ন করে। ক্লান্ত চোখে দেখি
হঠাৎ কোত্থেকে সেই পুশিদা পুস্তক
আমার কম্পিত হাতে এসে যায়, পাতা উল্টে পাল্টে
পড়তে ভীষণ ব্যর্থ হই, বর্ণমালা, ভাষা, সবকিছু
অচেনা, রহস্যময় আগাগোড়া অনন্তর কেতাব উধাও,
শুধু এক অপরূপ সুর গুঞ্জরিত হতে থাকে ঘরময় মধ্যরাতে।
৩০.১২.৯৯
একটি হারিয়ে যাওয়া কবিতার জন্যে
একটি কবিতা আজ হারিয়ে ফেলেছি গোধূলিতে, যাকে আর
পাবো না কখনও খুঁজে কোনওদিন। এসেছিল সবুজাভ পাতা
যেমন গাছের ডালে আসে সাবলীল। আমি তার
আবির্ভাবে নক্ষত্র বৃষ্টিতে ভিজে আপাদমস্তক
যেন চলে গেছি উড়ে সব পেয়েছির দেশে। আনন্দ, আনন্দ
ধ্বনি বুকে বেজে উঠেছিল আর কবিতার খাতা
অপরূপ, অনিবার্য শব্দাবলী পাওয়ার আগেই
কোথায় হারিয়ে গেল ক্ষুধিত তিমিরে। গোধূলির
রঙ মুছে গেল সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীর রাত্রি এল,
আমার মগজ শূন্য করে লব্ধ শব্দাবলী প্রত্যাবর্তনের
রীতি ভুলে গেছে ফের বহুদিন পর। অকস্মাৎ চিত্তপটে
ঝড় ওঠে, মনে জাগে পুরোনো দিনের কথামালা।
ঢের আগে পুরোনো ঢাকার গলিবাসী বহুকাল
ছিলাম মনের সুখে। শৈশব, যৌবন, আদি প্রৌঢ়ত্বের ঋদ্ধ
কিয়দংশ কেটেছে সেখানে। যৌবনের এক মধ্যরাতে
চকিতে আমার খুব কাছে এসে, হঠাৎ কোথায়
আন্ধারে হারিয়ে গেল অপরূপ একটি কবিতা। জানি না তো
কী করে ফিরিয়ে আনা যায় তাকে; সমস্ত শরীরে
ফুটছে অজস্র কাঁটা, অনুশোচনায় হতবুদ্ধি বললেন
অশ্রুপাত করে আর কিছুক্ষণ পরে, কী আশ্চর্য, কাগজের শূন্য
পাতা জুড়ে ফুটে ওঠে পলাতকা কবিতার রূপ।
অথচ এখন এই শহরতলিতে মাথা খুঁড়ে মরলেও
আমার হারিয়ে-যাওয়া কবিতাকে কোথাও পাবো না,
শুধু অতিদূর থেকে অস্পষ্ট আসবে ভেসে কারও ক্রূর হাসি।
২৯.১১.৯৯
এখনও জানি না
সেই কবে থেকে পথ চলছি, কখনও
চলছি সমঝে সুমঝে, কখনও বেপরোয়া
আমার পা ফেলার ছন্দ। হোঁচট যে খাচ্ছি না,
এমন নয়। কখনও কখনও অতর্কিতে
কাঁটা বিঁধে রক্তাক্ত আমার পা। তখন মনে হয়,
কোথাও গাছতলায় বসে খানিক
জিরিয়ে নিই। কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। খোঁড়াতে
খোঁড়াতে চলতে থাকে আমার পদযাত্রা।
ওপরের দিকে তাকিয়ে এক সময়
আকাশকে দেখতে পাই নীল সমুদ্রের মতো।
মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হয়
হাত বাড়িয়ে ছুঁই দূরের আকাশকে। কখনও
হঠাৎ আবার চোখে পড়ে আকাশের
আলাদা চেহারা, যেন এক রাগী দেবতা
মেতে ওঠে অপ্রত্যাশিত হিংস্রতায়। মনে হয়,
এক্ষুণি আমাকে অজস্র খণ্ডে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে
জ্বলন্ত বর্শা কিংবা নির্দয় পাথর। কেন যেন
ভাবি, তার ফুৎকারে ছেঁড়া কাগজের একরত্তি
টুকরো মতো একরোখা হাওয়ার চড়চাপড়
খেতে খেতে অজানা কোথাও গায়েব হয়ে যাবে।
আমার এই চলার পথে ক্ষণে ক্ষণে
কত কিছুইতো আচমকা ভয় দেখায়
আমাকে। দুঃস্বপ্নের পর দুঃস্বপ্ন কামড়ে ধরে, আজব
দৈত্য-দানো আমার বিপন্ন অস্তিত্ব নিয়ে প্রায়শ
লোফালুফি করে। আমি কি সব সময়
ওদের অসহায় ক্রীড়নক হয়ে থাকবো? আশ্চর্য আমার
এই মন! কোনও বিরূপতাই ওকে যাত্রা থেকে
থামিয়ে রাখতে পারে না, এমনই অদম্য এই মন।
এক গা ছমছম করা জায়গায় এসে
থমকে দাঁড়াই। রোদ চুমো খাচ্ছে চতুর্দিকে ছড়ানো
অনেক মাথার খুলি এবং হাড়গোড়কে। আমার
আগে যারা অনেক বাধাবিপত্তি, অনেক জুলুম সয়ে
এখানে এসে পৌঁছে ছিলেন, তাদের
সংহার করা হয়েছিল এখানে হায়,
কাঙ্ঘিত গন্তব্যে তারা পৌঁছতে পারেননি
অগ্রগতির শক্রদের হিংস্রতায়।
আমি কি এই ক্ষতবিক্ষত পা কাছের হ্রদের
স্বচ্ছ পানিতে ধুয়ে আমার যাত্রা
শেষ করতে পারবো? পৌঁছতে পারবো
সেই স্থানে, যেখানে প্রতিটি ভবন ধারণ করছে
স্বর্ণচূড়া, যেখানে শান্তি ও কল্যাণের জয়গাথা
সবার কণ্ঠে। আমি কি শেষ অব্দি পৌঁছতে
পারবো সেখানে? জানি না তার আগেই
বন্য হিংস্রতার শিকার হবো কিনা এখনও জানি না।
১৯.১২.৯৯