আমার স্বপ্নগুলো
এক ঘুম থেকে আলাদা ঘুমে মিশে যেতে যেতে
তিন হাজার বছরের কিছু স্বপ্নকণা
আলগোছে কুড়িয়ে নিই হাতে। বাইসনের চোখ,
ভালুকের মাথা, ঘোড়ার পা, গোটা গণ্ডার
ঝলসে ওঠে নিদ্রার প্রান্তরে। গুহার দেয়ালে
আঁকতে থাকি নানা চিত্র, আমার পরনে সিংহের চামড়ার
নেংটি। চিত্র থেকে চিত্রে ঘুমের পর্দার রেশম
সময়হীনতার স্তর রচনা করে পশুর চর্বির তৈরি আলোয়।
আমার স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে রাখি
স্মৃতির কন্দরে, অথচ ওলট পালট হয়ে যায় সব,
একটির গলায় আরেকটি পা রাখে
জল্লাদের ভঙ্গিতে, একটি ভবঘুরের মতো হঠাৎ উধাও
অজানা বন্দরে। দু’তিনটি অসুস্থতায়
ধুঁকে ধুঁকে মরে যায় ঘোর অমাবস্যায়। ওদের
কবর দেয়ার মতো কেউ কোথাও থাকে না; ওরা
বাজে পদ্যের মতো স্মৃতির উদার দাক্ষিণ্য থেকেও বঞ্চিত।
কখনও কখনও স্বপ্নলোকে নিয়ে আর পারি না।
বলা কওয়া নেই অবাঞ্ছিত অতিথির মতো হাজির,
বকবকিয়ে আমার সময় খায়, স্ফীত হতে থাকে
কপালের দু’পাশের রগ, এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে
আমার বিছানায়। ওদের তাড়াতে পারলে বাঁচি,
অথচ দূর দূর করে হটিয়ে দেয়াও মুশকিল, এমনই
বেআক্কেল, বেহায়া। কোনও কোনও স্বপ্ন যখন ডানা দোলাতে দোলাতে
কবিতা হয়ে ওঠে, কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ টলটলে হ্রদ।
১.৭.৯৯
এ কোথায়
এ কোথায় পড়ে আছি ভাবলেশহীন? কারা আমাকে
নিয়ে এসেছে এখানে? গুচ্ছের ঘাস
আমার নাকের ভেতর ঢুকছে, পিঁপড়ের ঝাঁক
চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হরেক রকমের
শব্দ আসছে কানে। কারা কী বলছে
মাথামুণ্ডু কিস্স্ বুঝতে পারছি না।
আমার সত্তর বছরের অস্থিচর্মসার শরীরে
এক রত্তি প্রাণ আছে কি নেই,
এ নিয়ে বড়ই ধন্দে পড়েছি। চিৎ হয়ে পড়ে-থাকা
আমি দেখি, আমার বাবা কালো শেরওয়ানি আর
সফেদ পাজামা পরে বসে আছেন আমার পাশে। তাঁকে
বলতে চাইলাম জালে আট্কে পড়া মাছের ভাষায়,
আপনি তো অনেক অনেক বছর আগে দুনিয়াকে
সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন, তাহলে এখানে
এলেন কী করে? তবে কি আমি মৃত্যুপুরীতে পড়ে আছি?
বাবা নিরুত্তর, আমার পরলোকবাসিনী মাকে কাছে ডেকে
আনলেন তাঁর দৃঢ়, ঋজু হাতের ইশারায়। আবছা পূর্ণিমা
এবং ঘোর অমাবস্যায় দুলতে থাকি ঝড়ে-পড়া নৌকার মতো।
অন্ধকারের জটিল জাল ছিঁড়ে কয়েকটি ঝাপসা
শব্দ আমার বন্দী শরীরের
চৌদিকে চক্কর কাটে। অনেক পুরোনো একটা
ডোবার পচা, দুর্গন্ধময় লতাপাতার ভেতর থেকে
শামসুর রাহমান নামটি জলপোকার মতো তাকায়।
কে এই শামসুর রাহমান? ঘাসফড়িং
গুবরে পোকা আপন মনে উড়ে, ঘরে বেড়ায়, পরস্পর
কথা কয়, ‘কোন্ দেশী লোক সে? কোথায় নিবাস?’
মনে হয়, অন্ধকারের বর্ষা নয়, অনেক
শতাব্দীর সোনালি বৃষ্টির মতো আলোর বান ডেকে যায়,
বসে আছি বোধিদ্রুমতলে, ন্যাড়া মাথা, কঙ্কালসার
পেটপিঠ একাকার, চারদিকে প্রণত
নানা জন, আমি উপবিষ্ট ঠায়
ধ্যানী গৌতম বুদ্ধের মুদ্রায়।
অন্ধকার ভয়ানক পিচ্ছিল পথে সেই কবে থেকে
ক্রশ টেনে চলেছি। আমার পিঠে
চাবুকের হিংস্রতার রক্ত ঝরানো অগণিত দাগ।
আমার মাথায় কাঁটার মুকুট, মুকুটের
প্রতিটি কাঁটা সকল আর্তজনের হয়ে অশ্রুপাত
করছে। আমার বেদনার আলোয় উদ্ভাসিত সারা পথ।
আমার বেডের চারপাশে দাঁড়ানো এরা কারা?
কেউই তো আমার চেনা নয়। তবে কি
আমি এক গহন ষড়যন্ত্রের শিকার? চকিতে
একটি কি দু’টি মুখ কেমন আপন মনে হয়। অথচ
ওদের কিছু জানাবার মতো ভাষা আমার অজানা। অথই
জলের স্রোতে কাঠের তক্তা আঁকড়ে ধরে, নাকে মুখে
পানির চড় চাপড় খেয়ে ভাসছি, ডুবছি। কয়েকটি অচেনা,
হিংস্র, ক্ষুধার্ত পাখি আমার ওপর কেবলি চক্কর কাটছে।
৩১.১০.৯৯
একজন নদীর উদ্দেশে
একজন নদীর ভেতরকার নদী
আমার সুদূর ছেলেবেলা,
প্রখর যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের ধূসরিম ভেজা
মাটি ছুঁয়ে ছেনে
কাহিনীকাতার হয় খুব। আমি তার গল্প শুনি
কোনও কোনও ভোরবেলা, দুপুরে অথবা
গোধূলিবেলায় আর কখনও কখনও
সন্ধ্যারাত পেরিয়ে নিশীথ হয়ে যায়।
একজন নদীর ভেতরকার নদী
মেঘনা নামের অন্তরালে বয়ে যায়, রূপ যার
আমার বালক পিতা, যুবা পিতামহ, মাতামহ,
প্রবীণ প্রপিতামহ, তাঁহাদের পূর্বপুরুষেরা
দেখেছেন চোখ ভরে কতকাল, দেখবেন আরও
আমার দু’চোখ দিয়ে, যতদিন আমি বেঁচে আছি।
মাতামহ, পিতা নব্য জীবিকার টানে গ্রাম বাংলার ছোট
পাড়াতলী ছেড়ে, থই থই ধানশোভা,
মেঘনার তটভূমি, তরঙ্গে তরঙ্গে রৌদ্র-চাঁদিনীর ব্যালে
অনেক পেছনে রেখে ইট পাথরের
বেগানা শহরে ডেরা বাঁধলেন। শর্ষেখেতময় প্রজাপতি, ঘুঘু,
মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গীত রক্তে দিয়েছে অদম্য কত দোলা।
কখনও দুপুরবেলা ভৈরবের বিস্তীর্ণ কিনার থেকে আর
কখনওবা আমার আপন গ্রাম পাড়াতলীর ঘনিষ্ঠ কাছাকাছি
আলুঘাটা থেকে মেঘনার মন-নাচানো রূপের
ইন্দ্রজাল বিমুগ্ধ দেখেছি বাল্যকালে আর তুমুল যৌবনে।
একজন নদীর ভেতরকার নদী মেঘনাকে
বারবার দেখেছি তন্ময় হয়ে, এখনও তো দেখি,
যেন সে রূপসী নারী। কখনও কখনও রূপ তার
এমনই মধুর প্রতারক যে হাজার হাজার হীরার
ঝলসানি দ্বিপ্রহরে অথবা জ্যোৎস্নার বর্ষা গহন রাত্তিরে
অবিকল একই মনে হয় ইচ্ছে জাগে ওকে
পৌরুষ উজাড় করে বাঁধি আলিঙ্গনে।
মেঘনা আমার প্রিয়া কেন এমন ব্যাকুল ডাকো বারবার?
মেঘনা আমার শৈশবের, যৌবনের কতদিন করেছ হরণ
অনায়াসে, আমার ভেতরে
জাগিয়েছ কী বিপুল অগণিত ঢেউ,
আজও এই আমার নবীন বার্ধক্যের নানান প্রহরে,
ঝলসে উঠছ তুমি, কখনও কখনও
তোমার নিকট যাই, ছুঁই
তোমার শরীর গাঢ় অনুরাগে, জানি
মৃত্যুর পরেও আমি দেখব তোমাকে ভাবীকালে
যুগ যুগান্তরে বংশধরদের উৎসুক দৃষ্টিতে!
৪.১১.৯৯