সাম্প্রতিক ভাবনা
আবু হাসান শাহরিয়ার প্রীতিভাজনেষু
এ শহরে চারজন অন্ধ চৌরাস্তায় পথনির্দেশক আজ
পথচারীদের; কে কোথায় যেতে চায়
না জেনেই অঙ্গুলি নির্দেশে সদা তৈরি কী নিখুঁত ভঙ্গিমায়,
অথচ বেজায় দিকজ্ঞানহীন ওরা নিজেরাই। অগণিত
বধির সাগ্রহে শোনে ইতস্তত তাকিয়ে প্রত্যহ চারবেলা
কতিপয় মূকের ভাষণ, মানে অব্যক্ত ভাষার
ফুলঝুরি! দেখে নেয় মজাদার অঙ্গ সঞ্চালন। হাসি ফোটে
ঠোঁটে, তবু হাসির হুল্লোড়
কখনও শোনে না কেউ। তিনজন ঘোর কৃষ্ণবেশী
ক্রূর ঘোড়সওয়ার ছড়ায় দশদিকে মারী আর মড়কের বীজ।
অসহায় চেয়ে থাকি, মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ রাখি
মনের ভেতরকার দৃশ্যাবলী দেখার আশায়
কিছুক্ষণ। অকস্মাৎ ধ্যান ভেঙে গেলে দৃশ্যপট
আড়মোড়া ভেঙে ভিন্ন রূপে প্রতিভাত; দেখি কোন্
অমাবস্যা থেকে জন্ম নিয়ে
সাতটি কংকল ঢাল তলোয়ার হাতে এঁকে বেঁকে
এগোয়া আমার দিকে। আমি প্রশ্নাকুল
হলে তীক্ষ্ণ, কর্কশ হাসিতে কেঁপে ওঠে সাতটি কংকাল আর
নিমেষে ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা খসে যায়। মনে
হঠাৎ ঝল্সে ওঠে শিশুর মধুর চিত্তহারী হাসি আর
চিরায়ত কবিতার পঙ্ক্তিমালা। পলেস্তারা
ফিরে আসে দেয়ালে, ঘরের পরিবেশ হেসে ওঠে রূপসীর মতো।
সাতটি কংকাল, ঘোর কৃষ্ণবেশী তিন ঘোড়সওয়ার এবং
চারজন অন্ধ পথ নির্দেশক-সবাই গায়েব।
এইতো জীবন সুদর্শন তরুণের ধরনে পতাকা হাতে
দৃপ্ত হেঁটে যায় খোলা পথে
এবং আমার এই ধূসর, বিস্তর বয়সেও
মনের গহনে লাল পদ্ম হয়ে ফুটে ওঠে আরও বেশি বাঁচবার সাধ।
৫.৮.৯৯
সিকান্দার আবু জাফর স্মরণে
হায়, কোথায় উধাও আজ সেসব ডানাঅলা
গভীর রাত? কোথায় সেই মদির মুহূর্তের জীবনচোঁয়ানো
বুদ্বুদ-সমুদয়? মনে পড়ে, কোনও কোনও প্রায় প্রত্যূষছোঁয়া প্রহরে
নিরিবিনি ঘরে ফেরা মগজময় কত অস্ফুট পঙ্ক্তি নিয়ে।
আপনার অপ্রতিরোধ্য আহ্বা, ভালবাসার বসন্তবাহার এমন
ঘরকুনো আমাকেও করেছে ঘরের বাহির, এনেছে
হার্দিক, বৌদ্ধিক জ্বলজ্বলে আসরে। সংগ্রাম, শান্তিকল্যাণ,
মানবতা, আকাশের গর্ভের নিমীলিত আকাশ
জপেছি আমরা ক’জন যে যার ধরনে। সুন্দরের ধ্যান
আমাদের সত্তায় গড়েছে অপরূপ বল্মীক।
আজও পড়ন্ত বেলায় নিষ্করুণ খরার পরে যখন
আমার শ্যামল অঙ্গনে নাচের নানা মুদ্রা এঁকে
দেখা দেয় চিত্ত মাতাল-করা কোনও কোনও রূপসী,
উঠে আসে আমার খাতার বিরান পাতায়
সুস্থির, অতল কালো দু’চোখে তার
রহস্য অপার, সমস্ত শরীরে স্বপ্নপুরীর নিরুপম আভা,
পায়ে নূপুরের ঝংকারহীন ঝংকার, নিটোল
আঙুরের মতো স্তনচূড়া, চেয়ে থাকি মুগ্ধাবেশে।
আমার এই অক্ষরচিত্রিত পাতা নিয়ে কালবেলায়
যাব কার কাছে? আপনার চেয়ার সেই কবে থেকে
ভীষণ খাঁ খাঁ। কোথায় আপনার চোখের আড়ালে আরেক চোখের দ্যুতি,
যার দাক্ষিণ্য আমার সামান্য কাগজের কামিনীর রূপ
করবে আবিষ্কার? কোথায় সে পাবে ঠাঁই? হায়,
কোন্ সাইমুমে হারিয়েছে পথ অবেলায় আপনার, আমাদের ‘সমকাল’?
৩১.৭.৯৯
সৃষ্টির মুহূর্ত
ইদানীং গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়, যেন কেউ
হঠাৎ ধাক্কায় জাগিয়ে দেয় আমাকে
তামাশায় মেতে। আর ঘুম হতে চায় না। এপাশ ওপাশ করি,
মেঘ গণনায় মনোযোগী হই, তবু পলাতক নিদ্রার
প্রত্যাবর্তনের নাম নেই। আজ জ্বালা ধরা চোখ দুটো
কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে অন্ধকার উজিয়ে
আমার পড়ার ঘরে পা রাখি। স্যুইচ টিপে বাতি জ্বালাতেই
একলা সুনসান ঘরে নিজেকে কেমন অচেনা লাগে।
নিস্তব্ধতা একটা ঘোর কালো বাইসনের মতো যেন
চাপা ক্রোধে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। আমি-নই-অথচ আমি
চাবি দেয়া পুতুলের মতো হেঁটে যাই বুকশেলফের দিকে।
চেনা বইগুলোকে কখনও অচেনা, কখনও-বা ইটের সারি
মনে হচ্ছ। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? মাথার
শাদা চুলগুলো বেশ জোরে টানলাম, যেন
লুট-হয়ে যাওয়া সচেতনতাকে ফিরিয়ে আনার এই
নৈশ মুহূর্তে আমি প্রবল চেষ্টাশীল। সে গুড়ে
বালি ছড়িয়ে আড়াল থেকে কেউ আমাকে কখনও হুতোম প্যাঁচা
বানাচ্ছে, কখনও বাদুড়, আবার কখনও লেজঅলা ক্লাউন।
আমি যে একজন কবি, যার কবিতা দীক্ষিত পাঠকগণ
এখনও ভালবেসে পড়েন, এ-কথা কিছুতেই মনে
রাখতে দিচ্ছে না আড়ালে থাকা রহস্যময় সত্তা। আমি
ক্রমাগত গাড্ডায় পড়ে খাবি খাচ্ছি, কাঁটা-বিছানো
পথে হাঁটতে বাধ্য করা আমাকে, কখনও
ক্রূশে ঝুলিয়ে পেরেক ঠোকা হচ্ছে আমাকে কপালে,
বুকে, হাতে-পায়ে। আমি চোখে নক্ষত্রের ব্যালে-নৃত্য দেখছি
বলে ভাবছি। অথচ পিশাচের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি
চৌদিকে। পিপাসায় আমার বুক চৌচির, মুখের ভেতর
গিজগিজ করছে বালি। আমার কি নিস্তার নেই?
আমি কি পড়ার ঘরের চেয়ারে বসে ক্লান্তির ভারে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? চোখ মেলে দেখি, আমার ঘর
নীরবে পান করছে ভোরবেলার প্রথম আলোর শরবত।
আমার অন্তরে হাই তুলে মঞ্জরিত হল কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
১০.৪.৯৯
স্বপ্ন গাঁথি
পদ্মপাতায় মাথা রেখে থাকবো শুয়ে,
নানা রঙের স্বপ্ন দেখবো, ইচ্ছে ছিলো।
নানা ঢঙের পদ্য লিখে কাটবে সয়ম
রঙধনুর সাঁকোয় বসে শান্তিপুরে, আশা ছিল।
হঠাৎ একি হারে রে রে আওয়াজ তুলে
চতুর্দিকে নেকড়েমুখো মানুষগুলো
আসে তেড়ে। স্বপ্নগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে দিনদুপুরে,
রাত দুপুরে রক্ত ঝরায় খোলা পথে, বন্ধ ঘরে।
ইচ্ছেগুলো স্বর্ণমৃগ, ঝলসে উঠে
হাওয়ায় মিলায়। আশা অন্ধ ডোবায় পড়ে
খাচ্ছে খাবি হরহামেশা দলে বলে।
পদ্মাপাতা পাই না কোথাও, রঙধনুর সাঁকো উধাও।
কিন্তু তবু স্বপ্ন দেখার সাধ মেটে না।
নেকড়েমুখো মানুষগুলোর মরণ-কামড়
সয়ে টয়ে ছেঁড়া কাঁথায় স্বপ্ন গাঁথি,
রঙিন সুতোয় ছবি আঁকি আশা-জাগর অগ্রগতির।
১০.১২.৯৯