যখন অগাধ অন্ধকারে
যখন অগাধ অন্ধকারে হব বিলীন, তখন
দেখতে পাব না নীল আসমান, পায়রার ঝাঁক,
পারব না বলতে, ‘গোলাপ, তুমি অপরূপ রূপটানে আছ
কী সজীব। জোহরাকে মধ্যরাতে জ্বরতপ্ত স্বরে
কখনও হবে না বলা, ‘এক গ্লাস পানি দাও, গলা
ভীষণ শুকিয়ে যাচ্ছে। টিয়ার মধুর
হাসি দেখব না আর। নয়না, দীপিতা
আমার স্টাডিতে এসে কখনও আমাকে নয়, এক
খাঁ খাঁ শূন্যতাকে পাবে। দেয়ালের ফটোগ্রাফে টিকটিকি দেখে
দূরে সরে যাবে।
গৌরী, তুমি আমার নিষ্প্রাণ ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে শত চুম্বনের
তাপেও নিশ্চিত ব্যর্থ হবে, হায়, শৈত্যময় আমাকে জাগাতে।
৩.৩.৯৯
যাত্রার আগে
আমি তো শিগ্গিরই চলে যাব, বড় একা
যাব চুপচাপ, তোমাদের কাউকেই
সহযাত্রী করব না নিরুদেশ যাত্রায় আমার। জেদ করে
লাভ নেই, আমাকে যেতেই হবে তোমাদের ফেলে।
না আমি এখন কোনও কিছুই নেব না সঙ্গে
এই নিঃসঙ্গ যাত্রায়, খামোকাই স্যুটকেস
করছ বোঝাই এটা সেটা দিয়ে; আমার বাছাই-করা প্রিয়
পুস্তক দিও না গুঁজে পেটমোটা স্যুটকেসে; প্রয়োজন নেই,
একবার চোখও বুলাব না। পাসপোর্ট
ঘুমাক নিটোল রুদ্ধ দেরাজে আমার।
এখন একটিবার শুধু আমাকে দেখাও সেই শস্যরাশি
যা আমার নিরন্তর শ্রমে,
মেধায় ফলেছে নিরিবিলি। হা কপাল,
এই সব কী এনেছ সমুখে আমার? তবে আমি কি কেবলি
নির্জীব, হতশ্রী শস্য ফলিয়ে তৃপ্তির মদিরায়
বুঁদ হয়ে ছিলাম নিজের আস্তানায়? এই দৃশ্য চোখে নিয়ে
যেতে হবে ভেবে বোবা হাহাকার জেগে ওঠে প্রাণে। অনুরোধ,
তোমরা আমার এ যাত্রাকে ভারাক্রান্ত কোরো না কিছুতে আর।
৯.৪.৯৯
শ্রদ্ধেয়া সুফিয়া কামালের জন্যে পঙ্ক্তিমালা
গাছপালা, পাতাদের কাঁপন হাওয়ার
ভোরে কি দুপুরে অথবা রাত্তিরে, বাগানের
পুষ্পমেলা, খোলা পথ, উদার বিস্তৃত মাঠ, নদী,
কাছের সুরেলা পাখি, দূরের নক্ষত্র মেলা, নারী ও পুরুষ-
সবাই একান্ত প্রিয় ছিল জানি, নির্মল কবির।
তোমার প্রতিও ওরা ছিল অনুরক্ত সীমাহীন,
তবু ওরা কেউ
পারেনি ছিনিয়ে নিতে মৃত্যুর ছোবল থেকে সর্বশক্তি দিয়ে।
হেমন্ত-সকালে ক্রূর মৃত্যু তোমাকে ছিনিয়ে নিল, শুধু
তোমার বাহ্যিক সত্তা নিল আমাদের ফাঁকি দিয়ে
লক্ষ কোটি মানব ও মানবীকে প্রতারিত আর
প্রভূত বঞ্চিত করে, কিন্তু কবির প্রকৃত সত্তা আজও
রয়ে গেছে সবার স্মৃতিতে, চেতনায়
তাঁর যৌবনের
‘সাঝের মায়ায়,’ নারী জাগরণ আর প্রগতির
রৌদ্রোজ্জ্বল ইতিহাসে, মানবতাবাদী পতাকায়।
২১.১১.৯৯
সগীর বাউল এবং একটি পোড়ো জমির কথা
গভীর রাতে পোড়ো জমির কিনারায় বসে দোতারা বাজিয়ে আপন মনে
আশ্চর্য তন্মায়তায়
গান গাইছিলেন সগীর বাউল। হঠাৎ কী যে হলো, তার তন্মায়তাকে ছিন্ন
করে জেগে ওঠে
একটি দৃশ্য, যা তার সুরের তাল লয় সবকিছুকেই থমকে দেয়। তার
হাতের দোতারা
শিউরে ওঠে। পোড়ো জমির বুক ফুঁড়ে বের হতে থাকে অনেকগুলো
মাথার খুলি,
ভাঙাচোরা কঙ্কাল। মাথার খুলিগুলির কদর্মাক্ত ওষ্ঠে থেকে নিঃসৃত হয়
একের পর এক
অনেক কথা। সেসব কথা শুনে সগীর বাউল বারবার কেঁপে উঠছিলেন,
বেদনার্ত হয়ে
উঠছিলেন বিবরণের করুণ ভয়াবহতায়। মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে যায় নিজের
কাছেই হাতেই
দোতারা, সঙ্গীতের তরঙ্গমালা। যেন তিনি এক পাথরের মূর্তি।
কিছুক্ষণ পর পোড়ো জমির মাথার খুলিসমূহ, ভাঙাচোরা কঙ্কালগুলি যেন
হাওয়ায় মিলিয়ে
যায়। পরদিন ভোরবেলা সগীর বাউল কিয়দ্দূরবর্তী এলাকার প্রধান
ব্যক্তিদের কাছে গত
রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তার বিবরণ কেউ কেউ বিশ্বাস করল, কেউ
কেউ
বাউলের মাথা বিগড়ে গেছে ভেবে প্রচুর হাসাহাসি কতল। দমলেন না
সগীর বাউল।
তাদের সেই দৃশ্য দেখাতে না পারলে বিরান হয়ে যাবে তার সুরেলা কণ্ঠ
সেই জমিনের
মতো, উন্মাদ হয়ে যাবেন তিনি।
সগীর বাউল এবং দূরবর্তী এলাকার তার অনুগামীরা পৌষ রাত্তিরে সেই
পোড়ো জমির
কাছে পৌঁছেতেই মরা জ্যোৎস্না নেমে আসে চারদিকে থেকে। জমি ফুঁড়ে
বেরিয়ে আসে
অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কাল। দূরবর্তী এলাকার লোকজন ভয়ার্ত
মূর্তি যেন। পোড়ো
জমির জাগ্রত করোটিসমূহ এবং কঙ্কালগুলি বহু মানব-মানবীর নিখুঁত
আকার ধারণ করে।
তাদের পাশে ঘনিষ্ঠ দাঁড়ানো অনেক শিশু-কিশোর। সেসব মানব-মানবীর
অনেকেই
যুবক-যুবতী, কিছু প্রৌঢ়, ক’জন বুড়োসুড়ো লোক এবং মধ্যবয়সী নারী।
অনেকেই
ধর্ষিইতা। পোড়ো জমির ভেতর থেকে উঠে আসা নরনারী বজ্রের আওয়াজ
ধার করে
একসঙ্গে উচ্চারণ করে-‘একাত্তরের নরঘাতকদের শিকার আমরা।
দখলদার,যুদ্ধবাজ
সেনারা এবং তাদের তাঁবেদার দালাল, রাজাকার, আলবদরেরা পৈশাচিক
নির্যাতন চালিয়ে
আমাদের হত্যা করেছে। সেই সব যুদ্ধপরাধী আর ওদের সহযোগী
নরপশুদের বিচার
চাই। ওদের বিচার না হলে, ওদের পাশবিক নির্যাতনের শাস্তি না হলে
একদিন সারা
বাংলাদেশ পোড়ো জমিনে রূপান্তরিত হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই,
বিচার চাই।
পৌষ-রাত্রির মরা জ্যোৎস্নায় মানব-মানবীর কণ্ঠে বজ্রপাততুল্য শব্দাবলী
সগীর বাউল এবং
দূরবর্তী এলাকার আগন্তুকদের বিস্ময় বিহ্বল, ভয়াবহভাবে প্রশ্নাতুর,
প্রত্যয় দৃঢ় করে
তোলে। নিমেষে পোড়ো জমিতে অনেক করোটি, ভাঙাচোরা কঙ্কালের
কোলাহল।
অনন্তর থমথমে নীরবতা, পোড়ো জমির বুক জুড়ে অদ্ভুত চাঁদিনীর খাঁ খাঁ!
৬.২১.৯৯