পথের পাশে কিছুক্ষণ
সড়কের এক ধারে পড়ে আছে একজন লোক,
অসুস্থ, অত্যন্ত পিপাসার্ত। বিপন্ন দু’চোখে তার
সাহায্যের কাতরতা। ভিড়ের হৃদয়
উদাসীন। কেউ কেউ প্রশ্ন করে নানা ধরনের;
কোন্ ধর্মাবলম্বী এ বেগানা লোকটা, এই মতো বিবেচনা
গুঞ্জরিত খুব অনেকের মনে। উচ্চারণে অক্ষম লোকটা
করুণ দৃষ্টিতে জটলার দিকে চেয়ে থাকে; দু’টি
নীল মাছি স্থির ওর ঠোঁটে, যেন তার
ওষ্ঠ থেকে জীবনের সবটুকু রস
নিচ্ছে শুষে সিরিঞ্জে গোপনে।
হঠাৎ উজিয়ে ভিড় একজন এসে
তৃষ্ণার্তের ঠোঁট থেকে মাছি উড়িয়ে বলেন-
‘লোকটা মানুষ, তাকে বাঁচিয়ে তোলাই
দায়িত্ব সবার; কোন্ ধর্মে সমর্পিত
বিপন্ন এ লোক, সওয়ালটি
ক্রূর বিবেচনার নিক্তিতে মাপা অধর্ম নিশ্চিত’-
এই শব্দমালা উচ্চারিত যার কণ্ঠে,
তিনি তার ফ্লাস্ক ক্ষিপ্র উন্মোচন করেন আর্তের ঠোঁটে, মুখে।
অপ্রসন্ন ভিড়ে ভাটা পড়ে, কিছু উক্তি
কাঁটার মতোই বিঁধে যায়
আর্তের ত্রাতার মনে; তবু তিনি আনন্দিত দৃষ্টি
উপহার দেন তৃষ্ণার্তকে।
৪.৫.৯৯
বন্ধ্যা মাটিতেও মুক্ত মন
সংকীর্ণ গলিতে থাকি, অথচ প্রশস্ত রাজপথ
প্রতিদিন হাতছানি দেয়, মুমূর্ষু নদীর তীরে
বসে শুনি দূর সমুদ্রের গান। সামান্য আঁচড়ে
কেটে শাদা কাগজের বুকে স্বপ্ন দেখি পিকাসো কি
শাগালের প্রতিযোগী হওয়ার, তা বলে এই আমি
হবো কি সবার কাছে নির্বোধ অথবা হঠকারী
একজন? আকাশ তো অসীমের আকাঙ্ঘা জাগায়
মানবের মনে আর ছায়াপথ, রঙধনু আর
নক্ষত্রের সুদূর আসর নান্দনিক মুক্তি আনে
জীবনের বাঁকে বাঁকে। ক্ষুদ্রতার হাঁকডাক কিংবা
পৃথিবীর পথে নানা সংকীর্ণতা-পাতা ফাঁদ মূঢ়
পিছুডাক পারে না পোড়াতে কোনওদিন প্রগতির
ভাস্বর পতাকা দীপ্ত মানবের। নিশ্চিত জেনেছি,
বন্ধ্যা মাটিতেও মুক্ত মন ফোটায় অজস্র ফুল।
১৫.১২.৯৯
বৃষ্টির অধিক বৃষ্টি
আসমান প্রাচীন কালের কোনও রূপসীর মতো
আড়াল করেছে মুখ অসিত বেকাবে। আবরণ ছিঁড়ে ঝরে
রাধার নূপুর হয়ে বৃষ্টি অবিরত
মেটাতে অধীর তৃষ্ণা শহরের। বড় একা বসে আছি ঘরে
আমাকে বৃষ্টির জাল ঘিরে ধরে চারদিকে
কী মসূণ আর নানা রঙিন মাছের চঞ্চলতা বিছানায়,
বিস্মিত তাকিয়ে দেখি। কিছু লিকলিকে
প্রাণী এসে জোটে, বুঝি অতিশয় মজা পেয়ে যায়
হঠাৎ আমাকে দেখে, এবং কদম ফুল ছায়া-ছায়া ঘরে এসে
হাসে খিলখিল, জুড়ে দেয় নাচ শূন্যে ভেসে ভেসে।
বৃষ্টিও আলাপচারী, সন্ধ্যাভাষা জানা আছে
ভাল তারও, নয় তা অবশ্য রূপায়িত মনুষ্য-ভাষার ছাঁচে
নিজ সুরে এখন সে বলছে আমার কানে কানে,
‘বৃষ্টি যে অপরিসীম ভালবেসে। এমন গহন
বর্ষায় রহস্যময় এবং ব্যাকুল হতো মন
যার, সে মানবী আজ দূর পরবাসে। রবীন্দ্রনাথের গানে
অথবা বৈষ্ণব পদাবলী কিংবা এই আমার ধারায় তাকে
পাবে না তোমার কাছে এবং উত্তর-আধুনিক কবিতারও সাধ্যাতীত
তাকে ডেকে আনা গৃহকোণে। কৃষ্ণ নও যে বাঁশির ডাকে
আসবে সে বৃষ্টিমত্ত গাঢ় কালো মধ্যরাতে সমাজের ভিত
কাঁপিয়ে,’ বলেই জলধারা অকস্মাৎ স্তব্ধতায়
ডুবে যায়, ঘরময় নামল তুষার-যুগ, রক্ত হিমপ্রায়।
বৃষ্টির অধিক বৃষ্টি ঝরে জলহীন,
ঝরে নিরন্তর, খুঁজি তার ভাষা, অথচ নিমেষে
হায়, কোথায় যে সেই আদিভাষা হয়েছে নিলীন,
জানি না কী করে! কিছুক্ষণ পর ফের বৃষ্টিধারা এসে
আমার হৃদয়ে বলে ব্যাকরণ-বহির্ভুত ছন্নছাড়া কথা-
কিছু বুঝি, কিছু বা বুঝি না; বুক হু-হুময়, আমার দু’চোখ
থেকে বৃষ্টি ক্রোক করে নিয়ে গেছে জলধারা। ক্রূর বিষলতা
গায়ে মুড়ে শুধু ধু ধু বৃষ্টি দেখি, অধিক আড়ালে রাখি শোক।
৬.৭.৯৯
বৈশাখ বিষয়ক কয়েকটি পঙ্ক্তি
বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস, তোমাকেই
বলছি, শোনো-
যদি আমি রবীন্দ্রনাথ হতাম, তাহলে তো
কথাই ছিল না। হে বৈশাখ বলে শুরু করতাম
আর এক দীর্ঘ বন্দনাগীতি রচনা করে ফেলতাম
তোমারই উদ্দেশে। জীবনানন্দের পক্ষপাত ছিল হলুদ
হেমন্তের প্রতি। তবু জীবনানন্দ হতে পারার গৌরব
অর্জন করলেও তোমার অন্তর্গত রূপের, হে বৈশাখ,
একটি মায়াবী চিত্রকল্প ধানসিঁড়ি নদীর ঢেউ অথবা
শঙ্খ চিলের ডানার ঝাপটার সহযোগিতায়
ফুটিয়ে তুলতে পারতাম দুপুরের ঝিমধরা
আভার গভীর বর্ণনায়। হায়, আমার অদৃশ্য
মুকুটে গৌরবদীপ্ত কোনও মুক্তো অথবা
হীরে জহরত নেই। আমার দীপ্তি প্রায়শই বিপথে হারায়।
হে বৈশাখ, তোমার অনন্য রূপের গুণকীর্তনে আমার
দক্ষতা শূন্যের কোঠায় বলেই ক্ষমাপ্রার্থী। আমি শুধু
তোমাকে মিনতি জানাতে পারি। জোড় হাতে
বলতে পারি, হে বৈশাখ, দয়া করে তুমি
আমাদের আপন দরিদ্রজনের ছনের ছাদ-অলা ঘরবাড়ি,
পর্ণ কুটিরগুলো লণ্ডভণ্ড কোরো না, ভেঙো না
ফলবতী গাছ, নষ্ট কোরো না আমাদের প্রাণপ্রিয় ফসল।
বরং তোমার ঝোড়ো তাণ্ডব ধ্বংস করুক সন্ত্রাস দুর্নীতি,
ভণ্ডামি,কালো কুসংস্কার, প্রাম্প্রাদায়িক আগুন, মানবিক
ক্লেদ, উগ্র মৌলবাদীদের উন্মও হিংস্রতা ধ্বংস করুক,
লুপ্ত করুক চিরতরে। তাহলে রবীন্দ্রনাথ না হওয়া সত্ত্বেও
তোমার রুদ্র গলায় পরিয়ে দেব বন্দনার গীতিমালা।
১১.৪.৯৯
ভুলতে পারিনি তাই
ভুলতে পারিনি তাই বারবার সেই একই জায়গায় যাই
হৃদয়ের কিছু রেণু ছড়িয়ে, স্মৃতির
কণাগুলো ওড়ে ইতস্তত। মনে পড়ে এখানেই
পাঁচটি বছর আগে তাকে
বলেছি ব্যাকুল স্বরে,- তোমার জন্যেই ধু ধু মাঠ
পেরিয়ে এসেছি এই ঘাটে অবেলায়।
এখনই সূর্যের আলো নিভে যাবে বৃদ্ধের মতো,
‘তোমার সময় কম,’ বারবার যাচ্ছে বলে ধোঁয়াটে আকাশে
নীড়ে ফেরা পাখির ধূসর নেকলেস। গোধূলির
দিকে কী উদাস চেয়ে থাকি, তুমিও তো
গোধূলির মতো দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছ, করোটির সাথে
খেলায় মেতেছ, যার মোহ অচিরেই যাবে কেটে।
আমি নিজে অনুপম ঘাটের খোয়াব দেখে আঘাটায়
বসে আছি। চতুর্দিক থেকে
দুঃস্বপ্নেরা ঘিরে ধরে। কে যেন অদূরে কেঁদে ওঠে
জমির সকল ধান পুড়ে গেল বলে। একজন চন্দ্রাহ্ত কবি
আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলে, ‘পাঁচটি বছর আগে
পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলে যাকে, তার কাছ থেকে দূরে
সরে গিয়ে সভায় মিছিলে মেতে আছো। এও কি কবির কাজ?’
বলি তারে দূরে নয়, কিয়দ্দূরে আছি। কবিতাকে
অনায়াসে অধিকার দিয়েছি আমার হাড় মজ্জা
চিবিয়ে নেয়ার নিত্যদিন তার মহিমা বাড়াতে।
২৩.৩.৯৯