বড় বেশি বাইরে ছিলে
বড় বেশি বাইরে ছিলে, ঘরে ফেরা দরকার এবার।
এক গা’ ধূলোর সর, কায়ক্লেশ
দেহমনে ঊর্ণাজাল বুনে দিয়ে স্থির; মুখ ধুয়ে
নাও তাড়াতাড়ি, ফিরে পেতে হবে শুদ্ধতা। মুঠোর
নাছোড় কাঁকর সুমুদয়
ফেলে দাও, মৃত্যুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে,
ছুঁতে হবে বিশুদ্ধ গোলাপ। অন্তর্গত
ছাইচাপা সুরের ষ্ফুরণ চাই আজ।
টানা-হ্যাঁচড়া, ঠেলাঠেলি বারবর অকাম্য তোমার,
দুর্ভাগ্যজনক, তবু হয়েছ শিকার, অনেকেই
ডেকে নিয়ে নাকে মুখে
দিয়েছে জুতোর কালি মেখে; মাদল বাজিয়ে জোরে
রটিয়েছে অপবাদ। কুকুরেরা ঠ্যাঙ উঁচু ক’রে
ছিটিয়েছে প্রস্রাব তোমার গায়ে। শাখামৃগগণ
চৈতালী জ্যোৎস্নায়
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বিকট লাফালাফি
করেছে অনেক, যাতে তুমি রাতারাতি
সহজে নাকাল হও। ফাঁদ পাতা আছে
সবখানে, বুঝে-সুঝে পা বাড়াও। ভাল হয়, যদি
ঘরে ফিরে কবিতার খাতা খুব কাছে টেনে নাও।
প্রকৃত সুফীর মতো মগ্ন হও অমোঘ শব্দের
অন্বেষণে; কবিযশঃ প্রার্থীদের নিকট তোমার
কানাকড়ি মূল্য নেই ব’লে আর বিষাদের ছায়ায় থেক না,
বাচালতা রাজত্ব করুক, তুমি বাক্সংযমে দীক্ষিত হও।
১৫।২।৯১
ভাস্বর পুরুষ
তুমি কি মিলিয়ে গেলে শূন্যতায় ভাস্বর পুরুষ?
না, তুমি নিদ্রিত দ্বিপ্রহরে;
যেন যুদ্ধ বিরতির পর কোনো পরিশ্রান্ত সেননী বিশ্রামে
ভরপুর। তোমার নিদ্রার মসলিন
কিছুতে হবে না ছিন্ন চিলের কান্নায়, প্রতিবাদী
মানুষের যৌথ পদধ্বনিতে অথবা
রক্তগোলাপের মতো পতাকার জাগর স্বননে,
জোয়ারের প্রবল উচ্চাসে।
তোমার নিস্পন্দ, প্রাজ্ঞ চোখের পাতায়
ঘুমিয়ে রয়েছে আমাদের স্বপ্নসমুদয় আর
অনেক আকাঙ্খাস্তব্ধ তোমার বাহুতে, শপথের
বাক্যগুলি নিদ্রিত ওষ্ঠের তটে পুনরায় জেগে
উঠবার প্রত্যাশায়। দশদিক থেকে
নম্র পায়ে লোক আসে অর্ঘ্য দিতে আজ
তোমারই উদ্দেশে হে নন্দিত কিংবদন্তি। সকলের
মাঝে ছিলে; কৃষক, মজুর, ছাত্র—সবার হৃদয়ে
করেছো রোপণ
মানবিক বীজ নিত্য কর্মিষ্ঠ চাষীর মতো। জাগো,
জেগে ওঠো স্বতন্ত্র মানব
পৃথিবীর রৌদ্রে ফের ঝেড়ে ফেলে মৃত্যুর তুষার।
ভাস্বর পুরুষ, সংগ্রামকে জীবনের সানসত্য
জেনে তুমি নিয়ত হেঁটেছো পথে। যেখানে তোমার পদচ্ছাপ
পড়েছে প্রগাঢ় হয়ে, সেখানেই সাম্যবাদ চোখ মেলবার
অভিলাষ করেছে প্রকাশ। কী ব্যপক মমতায়
তাকিয়েছো বার বার ভবিষ্যের দিকে। প্রগতির
প্রসিদ্ধ চারণ জাগো, জেগে ওঠে, চেয়ে দ্যাখো-
করোনি শাসন কোনোদিন তবু বাংলাদেশ আজ
তোমাকেই গার্ড অব অনার জানায়।
২।১।৯১
মগ্ন হও
নিজেই নিজেই বিরোধিতা করি ইদানীং আর
মাতি আত্মপীড়নে, অসুখে বিতৃষ্ণায় প্রায়শই
আহার রোচে না মুখে। ইতিহাস, তাবৎ দর্শন
মতিচ্ছন্ন; কবিতাও অভ্যর্থনাহীন, আলুথালু।
সন্ত্রান্ত পথিক হেঁটে গেলে রৌদ্রে, গাছের ছায়ায়
একা একা, অকস্মাৎ কুকুর চিৎকার করে ওঠে,
কখনো কামড়ে দেয়। মাঝে-মধ্যে জন্তুর জিহ্বায়
ধ্যানে জ্ঞানে ঝলসিত পংক্তিমালা লালাসিক্ত হয়।
এটাই ওদের রীতি। নিরর্থক উষ্মা, ক্ষোভ আর
বিষ্ফোরণ; মূঢ়ের অস্থির পদাঘাতে মেধাবীর
মাথা চূর্ণ হয় বার বার। হিংস্র কটুকাটব্যের
বদলে গভীরভাবে সুন্দরের মুখ তুলে ধরো।
যে যাই করুক তুমি দেহ থেকে কাদা মুছে ফেলে
রিল্কের মতোই কবিতায় নিত্যদিন মগ্ন হও।
১৮।৬।৯১
মৃতেরা কি করবে ক্ষমা
ক্রোধান্ধ দৈত্যের মতো গর্জে-ওঠা বঙ্গোপসাগর
ভয়ঙ্কর মধ্যরাতে লক্ষ লক্ষ দীন সংসারের
পায়ের তলার মাটি টেনে নেয়; হাহাকার ডোবে
তমসায়, জীবন ও ধর্মাধর্ম সমুদ্রে উধাও।
বুভুক্ষা-বিদীর্ণ নিঃস্ব মানুষেরা কাদায়, বালিতে
কিসের সন্ধানে ঘোরে? স্বজনের? কৃপণ খাদ্যের?
উদ্ভান্ত হৃদয়ে জ্বলে দাউ দাউ কান্নার আগুন
দিনরাত; গির্জের মোমের আলো বয়সিনী চোখে
নিয়ে ছুটে এসেছেন মাদার টেরেসা ছেঁড়া খোঁড়া
বাংলাদেশে। তিনি কি অপার করুণায় কোলে তুলে
কিংবা বুকে পারবেন জড়িয়ে নিতে লাশময় এই
দীর্ঘ উপকূলটিকে তাঁর নিবেদিত শুশ্রুষার হাতে?
চৌদিকে ‘কবর দাও’ আর্তনাদ, সৎকারবিহীন
মৃতেরা কি করবে ক্ষমা আমাদের মাদার টেরেসা?
৭।৫।৯১
যদি কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
যদি কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়
এখন আমার দিকে, ‘বলো, তুমি কী বলতে চাও
আজকের জন সমাবেশে? এ দেশের
প্রতি কতটুকু ভালবাসা রেখেছ সঞ্চিত বুকে,
দিতে হবে তার
বিশদ প্রমাণ’, আমি রাঙা ধুলো ওড়া
পথ, গাছে চুপ ব’সে থাকা বাদামি পাখির দিকে
কেবল ছড়িয়ে দেবো বৃষ্টি, থাকব নিরুত্তর, একা।
ধানশীষ, প্রবাসী স্বামীর জন্যে রমণীর গাঢ় মমতার
মতো টলটলে দিঘি, পানি ছুঁই ছুঁই
ডাল ছেড়ে চকিতে উড্ডীন মাছরাঙা,
সন্ধ্যায় নির্জন ঘাটে মাঝিহীন নৌকোর গলুই, গোধূলিতে
নিঝুম লাঙল কাঁধে কৃষকের ঘরে-ফেরা, রাত্রির কুটিরে
কুপির আলোয় রাঙা কৃষাণীর মুখ,
কিশোরগঞ্জের পথে গাড়ি থেকে দেখে নেওয়া ছায়াচ্ছন্ন পানের বরজ
আমার হৃদয়ে তোলে ঢেউ আজ, এই বয়সেও।
শহরের ফ্ল্যাটের চূড়ায়
জেগে-থাকা পূর্ণ চাঁদ শোনায় পাঁচালি
শ্বেত স্তব্ধতার;
পিচের মসৃণ পথে গড়ানো কাগজ মধ্যরাতে,
এবং উদ্ভিন্ন রাধাচূড়া
কুণ্ঠিত গলিকে দেয় অন্য মানে। বাণিজ্যিক কোলাহল থেমে
গেলে মধ্যত্তির ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে ঝরে
সরোদের সুর আর ডাগর দুপুরে
বারান্দায় পড়ে থাকে সদ্য যৌবনের মতো, বন্দনীয় পলাশের লাল,
পথে আঁকা ডালিম গাছের ছায়া, দেখি
চোখ ভ’রে। এখন কোথায় যাব? দূরবর্তী মেঘমালা আমাকে বানায়
রাখাল নিভৃতে মাসোহারা ছাড়া, পথ থেকে পথে
চরাই স্বপ্নের পাল। থাক,
আর কোনও কথা নয়, স্বদেশ প্রেমের প্রতিযোগিতায় এই নিভন্ত বেলায়
খেলোয়াড়ি ভঙ্গিমায় চাপিয়ে রঙিন জার্সি গায়ে
মুখর পংক্তিতে দাঁড়াবার সাধ নেই, বিশেযত
যখন নিয়ত শুনি ভন্ড ভক্ত মন্ডলীর
বেলেল্লা আসরে
হে স্বদেশ, তোমার উদ্দেশে টগবগ ক’রে ফোটে
স্তুতির বুদ্বুদ।
ওদের বন্দনা থেকে শুধু অশ্লীলতা ভেজাল তেলের মতো
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে; ইচ্ছে হয়, বমি ক’রে ফেলি।
সে ভিড়ে আমার কোনো ভূমিকা থাকার
কথা নয়, আমি শুধু একা-একা কাকডাকা ভোরে,
নির্ঘুম রাত্তিরে
করে যাব অক্ষরের চাষ, হে স্বদেশ,
কিল, ঘুষি, লাথি যত খেতে হয় খাব,
তুমি এই অভাগার মাথায় নিভৃতে
রেখ হাত, তোমার গভীর নেত্রপাত
ঝরাক অমেয় স্নেহধারা।
৪।৭।৯১