- বইয়ের নামঃ ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনেকদিন থেকেই
অনেকদিন থেকেই ভাবছি একটা কিছু তাড়াতাড়ি
অদলবদল হওয়া চাই, অথচ এটাও জানি তাড়াহুড়ো
মানে খুব পাকাপোক্ত বাড়ি
বানানোর পুরো
পরিকল্পনায় খুঁত রেখে দেওয়া। তাছাড়া ব্যাপার
হলো এই : এ তো জামা নয়,
অথবা র্যায়পার
তা-ও নয় যে ইচ্ছে হলেই বিন্দুমাত্র কালক্ষয়
না করে পালটিয়ে ফেলা যাবে
ঋতুর চাহিদা মেনে, প্রচলিত রুচির প্রভাবে।
অন্ধকারে মাথা গুঁজে যে ফুল ফোটাচ্ছে, আমি তার
ফুলে ঘ্রাণ পেতে গিয়ে বস্তুত কেবলি
প্রতিহত হই আর
যে ভাবছে আঁধারকে ব্যর্থ করে দিয়ে তারাঞ্জলি
সাজাচ্ছে নিপুণ মুদ্রা এ’কে শূন্যতায়,-
আমি তার অঞ্জলিতে একরাশ রাংতার চকমকি দেখে
লজ্জানত ফিরে যাই। মুগ্ধাবেশে যে বাঁশি বাজায়
ক্রমাগত প্রকৃত নিজস্ব কোনো সুর ব্যতিরেকে,
কী করে বোঝাই তাকে একটা কিছু অদলবদল হওয়া চাই
এক্ষুণি? নইলে ধু-ধু দশদিকে উড়বে শুধু শ্মশানের ছাই।
আমি একটু ভিন্ন ধরনের ফুল ফোটানোর আশা
জ্বেলে প্রতীক্ষায় থাকি। চরাচরে প্রকৃতই তারা
নিমেষে উঠবে জ্বলে, এরকম ভাষা
নিয়ত প্রার্থনা করি। প্রতিদিন উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমার দোতারা
বাজাবে আলাদা সুর, আনবে নিকটে
ডেকে বন্য পশুপাখি নুড়ি ও পাথর
করি দাবি; কত কিছু ঘটে-
শূন্যতায় করে ভর অলৌকিক ঘর।
যেখানে ছিলাম ঠিক সেখানে আছি,
যে রকম শুনেছি বিখ্যাত গল্পে মাঝি
গাছে বেঁধে কাছি
সারারাত দাঁড় টেনে গেছে অবিরত
তাহলে কি আজই
শুরু করতে হবে ফের প্রাথমিক বিদ্যার্থীর মতো?
পুরনো গয়নাগাটি খর নদীতে গচ্ছিত রেখে
যে-নারী নির্ভার হেঁটে যায় দেখি তার কাছ থেকে
কতটুকু শিখে নিতে পারি।
পারব কি? আমার বুকের মধ্যে আছে চিরনারী!
আপস
প্রতিদিন উদয়াস্ত খুঁজি আমি তাকে,
অন্তর্গত নিভৃত সত্তাকে,
যার মধ্যে পাঁচ জন ঘুমায় সতত
যুগ যুগ ধরে
অবচেতনের স্তরে স্তরে
আসহাবে কাহাফের মতো।
বস্তুত স্বরূপে খুঁজি
অস্তিত্বের প্রকৃত ঠিকুজি।
একদা কৈশোরে আমি গোল্লাছুট আর ফুটবলে
হুল্লোড়ে ছিলাম মেতে বিকেলের মাঠে
হাস্যময় ছেলেদের দলে।
একদিন দ্বিপ্রহরে খেলাচ্ছলে এক ডাকাবুকো
কিশোর একটি পাখি করল শিকার
ঢিল ছুড়ে। তারপর থেকে আর
তার ঘরমুখো
হইনি কখনো আমি। আমাদের সখ্য গেল পাটে।
সেকালের কিশোরেরা বস্তুত এখন
নানাভাবে করে নিত্য
জীবনযাপন।
কেউ বেশুমার বিত্ত
হেলায় করছে জড়ো বাণিজ্যের অশ্বমেধে, কেউবা অকালে
বার্ধক্যের শীর্ণ ডালে
ঝোলে, কেউ কেউ দশটা-পাঁচটা করে রোজ,
মাছি মারে লেজারের পাতায় পাতায়,
কেউবা হাতায়
গৌরী সেনী টাকা, কেউ হয়েছে নিখোঁজ
সেই কবে
আসমানী অলীক বৈভবে
মেতে, কারো কারো পেনশন
শুরু হলো বলে; ওরে মন,
প্রৌঢ় মন, এ এক বিস্ময়-
আমারও খুনির সঙ্গে আজ হাত মেলাতেই হয়।
আমার অজ্ঞতা নিয়ে
এখন মাঝরাস্তায় আমি; দমবন্ধ-করা নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালিতে,
বুকে, ঊরুতে আর
বেদেনীর ভলা যৌবন হয়ে
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠেছে আমার চারপাশে।
অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয়
এখানে কোথাও তুমি আছ, ডাকলেই
সাড়া দেবে নিমেষে। তলোয়ার মাছের মতো তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।
কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আর কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখব বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা
আর ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।
অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না, যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।
এখানে কোথাও তুমি আছ, কখনোসখনো এই বিশ্বাস
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাস-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করব যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে? উৎপীড়িত মুতাজিলা-মন
আমাকে নিয়ে গেছে সংশয়ের সৈকতে। নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে
জেনেছি জ্ঞান আমার উদ্ধার; তারই অন্বেষণে
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার
উজিয়ে চলেছি। এ জন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখির পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে চলে যাব
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।
আমার অভিযোগের তর্জনী
আমার অভিযোগের তর্জনী এখন তোমার দিকেই
উদ্যত। নিঃসঙ্গতা
জ্বলজ্বলে মণিহারের বদলে লোহার শেকল হয়ে উঠলেই
উত্তুঙ্গ চূড়া ছেড়ে নিচে
নেমে আসতে হবে, এ-কথা
কে বলেছিল তোমাকে? কেন তুমি
প্রাচীন ইরানি চিত্রকরের
ছবির মতো পাখার বৈভব আর চঞ্চুর কিরীচে
স্বপ্নের সওগাত গেঁথে এই নচ্ছার মৃত্যুমাখা
ভাগাড়ে নেমে এসেছিলে?
তোমার পাখায় ছিল নীলমণির মতো আকাশের
নিঃসীম উল্লাস, চারণ কবির
মেঠো গাথার মতো বন্দনা-মুখর সহজ সৌন্দর্য,
আর সুকণ্ঠ মুয়াজ্জিনের আজানের মতো অনাবিল আহ্বান।
তোমার চোখে আশ্রয় পেয়েছিল
সেই বিল্পবীর অন্বেষা, যে তার চিরকালীন ঘর ছেড়ে
ঘুরে বেড়ায় পথে পথে ভ্রষ্ট পথিকদের
অভীষ্ট উদ্যানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
তোমার এই নিরুপম ঐশ্বর্য ভীষণ বেমানান
এখানে, এখন এ-কথা
তোমার বুঝতে বাকি নেই নিশ্চয়। মড়াখেকেদের ভিড়ে
কী গান গাইবে তুমি? ইতিমধ্যেই কি আবর্জনায়
রুদ্ধ হয়ে আসেনি তোমার কণ্ঠনালি?
তোমার হৃৎপিণ্ড কি বেরিয়ে আসতে চাইছে না
এক দুঃসহ চাপে,
যার উৎস দুর্বিনীতের আস্ফালন, নির্বোধের ক্রোধ?
ইচ্ছে হলেই এখন তুমি তোমার চিত্রিত পাখা মেলে
ফিরে যেতে পারবে না দূরের আকাশে,
যেখানে তুমি সাঁতার কাটতে পারো স্বচ্ছন্দে নানা রঙের
মেঘের রেণু ওড়াতে ওড়াতে।
যেখানে পবিত্রতার মতো শূন্যতা ছড়িয়ে আছে
তবকে তবকে। বস্তুত এই মুহূর্তে তোমার
পাখা দুটোকে ছন্দিল করে তোলার
কোন উপায় নেই। কেননা তোমার পদদ্বয়
আর পাখা শোচনীয়ভাবে আটকে গিয়েছে
রাশি রাশি তারের মতো নাড়িভুঁড়িতে।
আস্তে আস্তে চতুর্দিকে থেকে এগিয়ে আসছে
শেয়াল কুকুরে পাল,
আর তোমার বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার,
যেমন কোন শহরে চড়াও হয় দখলদার সেনাবাহিনী।
এক্ষুণি ওরা ঘিরে ধরবে তোমাকে। এই আগ্রাসী
ব্যূহ ভেদ করবার সাধ্য তোমার নেই।
তোমার একদিকে মাথা-ডোবানো গলিজ জঞ্জাল,
অন্যদিকে ক্ষমাহীন শক্রতা। বলো, হে স্বপ্নলালিত সৌন্দর্য
কোথায় পালাবে তুমি? কোথায়
তোমার পরিত্রাণ?
আমি দেখতে পাচ্ছি
ডানদিকে শোকের মতো ছড়ানো
তোমার ছেঁড়া-খোঁড়া যাবতীয় পালক, বাঁয়ে
গড়াগড়ি যাচ্ছে তোমার মুন্ড আর তখনও-স্পন্দিত
হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ শেয়ালের দাঁতে আর
নিষ্পত্র গাছে বসে হাসছে কতিপয় শকুন।
শ্মশানের ঠা ঠা রৌদ্রের মতো সেই অট্রহাসি
ব্যাপ্ত হলো দিগন্ত থেকে দিগন্তে
এবং আমার অভিযোগের তর্জনী এখন তোমার
ধ্বংসাবশেষের দিকে উদ্যত। কে তোমাকে
উদার আকাশের মেঘমালার সঙ্গ ছেড়ে,
পর্বতচূড়ার সখ্য ছেড়ে
এই ভাগাড়ে নেমে আসতে বলেছিল?
আমার দুঃখের ভারে
বারবার ভিড়ের গিয়ে প্রতিহত
ফিরে আসি, নত
মুখে গৃহ প্রবেশের অনুমতি চাই
নৈঃসঙ্গের কাছে; সকলেই করে নিরিখ, যাচাই-
পাঠায় আমাকে লখিন্দরের বাসরে,
যত বলি ঠাঁই দাও তোমাদের ঘরে,
ওরা তত সরে যেতে থাকে;
আমি ঘুরি একাকী মান্দাসে স্বত্বহীন বাঁকে বাঁকে।
ভর সন্ধ্যায় ফিরি জতুগৃহে, খর
নদী বয় মনের অতল নিচে, আমাকে জর্জর
করছে স্মৃতির কাঁকড়াবিছে, দোটানায় ভাবি-
কারুর কাছেই কোনো দাবি
করা ঠিক নয় আর। বিনাশ্রয়ে যাবে
দিন যাক; ক্ষতি নেই। আপাতত মারাত্মকভাবে
ছেঁটে ফেলা নিসর্গের কাছাকাছি
ষড়জে নিখাদে বাঁচি।
যখন আমার প্রতি ভীষণ দন্তুর শত আক্রমণ তেড়ে
আসে, নিজ ভূমি ছেড়ে
যাই না; খরিদ করি অতি দীনবেশে
ফুল ও চন্দন আমি তাদের উদ্দেশে,
যারা ক্ষিপ্র আমাকে পাঠাতে চায় পাতালে, রৌরবে।
হৃদয় আচ্ছন্ন হয় বিবাগী সৌরভে,
প্রত্যাখ্যানে জতুগৃহে মিশে থাকে কৌশিক কানাড়া;
আমার দুঃখের ভারে নত হয় শুধু পড়শি ফুলের চারা।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি
একটি পাখি রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস্, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।
পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনও তার ঠোঁটে হয়তো গচ্ছিত।
কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো নেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।
যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
আমি এক ভদ্রলোককে
আমি এক ভদ্রলোককে রোজ
দেখি। তিনি কখনো বসে থাকেন চুপচাপ
কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে, কখনো বারান্দায়
দাঁড়িয়ে কয়েকটি জালালী কবুতরের
আসা-যাওয়া দেখেন,
কখনোবা থাকেন ঘুমিয়ে।
এই যে ভদ্রলোককে দেখি, দেখে আসছি
দীর্ঘকাল থেকে, এর মধ্যে সত্যি বলতে কি
কোনো ঝলমলে
চমৎকারিত্ব নেই।যদি তাকে না দেখতাম,
তাহলে
ক্ষতির বান ডাকত বলে মনে হয় না।
ভদ্রলোক কী করেন,
কেমন করে তার সংসার চলে কিংবা
আদৌ তার কোনো সংসার আছে কিনা, এ বিষয়ে
আজ অব্দি আমি কোনো চড়ুই-চঞ্চল
ঔৎসুক্য দেখাইনি। তবে এই ভদ্রলোকটিকে নিয়ে
আমি যে একেবারেই
মাথা ঘামাইনি, এমন নয়। এমনও হয়েছে
ভদ্রলোকের কথা ভাবতে গিয়ে
তার মুখের রেখাগুলিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
আর যে কথাটা বলতে গিয়েও
এখনও বলা হয়নি তার সারাৎসার হলো
ভদ্রলোককে দেখলে
আমার ভারি ভয় হয়। তিনি যখন হাওয়ার দিকে
মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকেন, অথবা
হাতে তুলে নেন রক্তজবা, তখন আমি ভয় পাই।
কেন এই ভয়, এই প্রশ্নের
কোনো সদত্তর আমার জানা নেই।
তাকে আমি কোনোদিন কোনো মাহফিলে,
গানের জলসায় দেখিনি। কখনো
সানাই-গুঞ্জরিত বিবাহ মন্ডপে কিংবা
কোনো শবানুগমনে তিনি শামিল হয়েছেন বলে মনে পড়ে না।
একদিন চোখে পড়ল,
রোজ যেখানে
ভদ্রলোককে ব’সে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম,
সেই নির্দিষ্ট জায়গাটা ভীষণ সান্নাটা এবং
ধৃতরাষ্ট্র শূন্যতা আলিঙ্গন করল আমাকে।
এতদিন ভাবতাম, সেখানে সেই ভদ্রলোককে।
দেখতে না পেলেই
আমার ভয় কেটে যাবে। অথচ এখন
কাকতাড়ুয়ার মতো ভয় আরও বেশি ভয়
দেখাতে শুরু করল আমাকে, আমার নিজেরই জন্যে।
ইন্দ্রাণীর খাতা
(নরেশ গুহ বন্ধু বরেষু)
একে একে অতিথিরা বিদায় নিলেন। অকস্মাৎ
মঞ্চ থেকে সব আলো নিভে গেলে, নাটকের কুশীলব আর
দর্শক প্রস্থান করলে যে স্তব্ধতা নামে
যবনিকা পতনের পর, সেরকম
স্তব্ধতা আমার ঘরে প্রতিষ্ঠিত রাত বারোটায়।
শেয়ালের মুখের রোঁয়ার মতো কিছু
চোখে মুখে লাগে
এবং শিশিরভেজা ঘাসের কিরীচ স্পর্শ করে
অনিদ্রাকে। অবসাদ নাভিমূলে পদ্ম-রচনার অছিলায়
আমাকে চকিতে ঠেলে দ্যায় অন্তহীন, কানা গলির ভেতর।
কিশের আঁশটে গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে,
খাবারের প্লেটগুলি আগেই সরানো হয়ে গেছে
কিচেনে। খানিক বাদে
সেডাকশান খেয়ে গৃহিণী গেলেন শুতে,
একা বসে থাকি বারান্দায়। হঠাৎ কে নাড়ে করা
এত রাতে? ঝুঁকে দেখি একটি তরুণী
দরজায় একাকিনী, সাততাড়াতাড়ি
তাকে এনে বসালাম পাশের চেয়ারে। দেখে চেনা
মনে হলো, অথচ সঠিক
কোথায় দেখেছি তাকে এর আগে, মনে পড়ছে না।
অগাধ সৌন্দর্যে তার লেপ্টে আছে অতীতের আভা
তন্বী গাছে ডুক্রে-ওঠা কোজাগবী পূর্ণিমার মতো।
ক্যাসেট প্লেয়ারে
দরবারি কানাড়া গুমরে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, আমি
অপলক চেয়ে থাকি তার দিকে, পেটরোগা মানুষ যেমন
তাকায় থালায় রাখা জ্বলজ্বলে সুখাদ্যের প্রতি।
‘ভীষণ অবাক হয়ে গেছেন, তাই না? মধ্যরাতে
কে যেন সেতারে টোকা দিল। যদি বলতাম তাকে
বিস্ময়ের ঝালর কাঁপেনি
মনের ভেতরে এতটুকু, তবে ভুল বলা হতো।
‘ইন্দ্রাণীকে মনে নেই? এই প্রশ্ন আমার দৃষ্টিকে এ রাতের
অতিথির শরীরের অপরূপ রত্নদ্বীপ থেকে
চকিতে সরিয়ে আনে। কী করে ভুলব তাকে, মানে
ইন্দ্রাণীকে? তিপ্পানোর সাহিত্য মেলায়, মনে পড়ে,
গোধূলি বেলায় স্মিত হেসে
ইন্দ্রাণী একটি খাতা, সুখ-স্বপ্নের মতো আশ্চর্য সোনালি,
দিয়েছিল একজন বিশুদ্ধ কবিকে। আমি শুধু
দূর থেকে কাঙালের ধরনে দেখেছি সে অর্পণ। তারপর
হেঁটে চলে গেছি একা, বড় একা খোয়াইয়ের তীরে
ভাসাতে আমার হৃদয়ের কীটদষ্ট কিছু ফুল।
এতকাল পরে ফের কী ভেবে ইন্দাণী
আজ ব্রহ্মচারিণীর ধরনে এসেছে এ শহরে সঙ্গে নিয়ে বীরভূমের
একরাশ শিমুল,পলাশ? প্রত্যাশায়
রক্তে বাজে সরোদের বোল,
আমি তাকে রুদ্রাক্ষের মালা খুলে নিতে
মিনতি জানাই, অথচ সে নিরাসক্ত কণ্ঠস্বরে তুলে নিয়ে
তিপ্পনোর রেশ বলে, ‘আনিনি সোনালি খাতা, শুধু
আপনাকে দেখতে এসেছি’।
উপোসী সন্তের মতো
হাতে আর তেমন সময় নেই, কী দ্রুত ফুরিয়ে
আসছে এবং আজকাল
সম্মুখে দেখার চেয়ে পেছনের দিকে
তাকাতেই বেশি ভালো লাগে। উঠোনের রোদ
চারাগাছ, লতাগুল্ম আর
দূর নীলিমায় মেঘে মেঘে বাল্যকাল লেগে থাকে।
কখনো নিজেকে দেখি আরশি নগরে
ঘুরি একা একা
পড়শির ব্যাকুল সন্ধানে।
হঠাৎ কখনো
গভীর ঔদাস্য নামে মনে বটের ঝুরির মতো
পড়ন্ত বেলার দিকে চেয়ে, কখনোবা
আকাঙ্ক্ষার রক্তজবা ফোটে পুনরায়
কিসের মোহন টানে। অনেক নারীর দুর্নিবার সম্মোহনে
সাজিয়েছি হৃদয়ের অর্ঘ্য বারবার,
তবু আজও প্রেমের কাঙাল আমি, নিঃসঙ্গ কাঙাল।
এখন প্রলয়াভাবে পৃথিবীর কোণে কোণে
ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে লুপ্তির অঙ্গার;
উপোসী সন্তের মতো তীব্র আকর্ষণে লাভাস্রোতে
ভেসে যেতে যেতে
বাড়াব যে-কোনো তরুণীর দিকে হাত,
যদি তার চোখে, শরীরের বাঁকে মঞ্জরিত হয় অনুরাগ।
একজোড়া চোখ
একজোড়া চোখ, জ্বলজ্বলে, প্রাচীন রত্নের মতো,
ভেসে এলো ঘরের ভেতরে। চক্ষুদ্বয়
আমার শরীরে সেঁটে থাকে দীর্ঘস্থায়ী
চুমোর ধরনে।
কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে খুব মৌন
সকল সময়; মনে হয়
আমার শয্যার পাশে বসবার অনুমতি চায়, হাত নেড়ে
ডাকলে চকিতে মিশে যায় বায়ুস্তরে।
একজোড়া চোখ পাখি হয়ে
লেখার টেবিলে বসে, ডানা ঝাপটায়; পালঙ্কের
ভাঁজ থেকে অতীত ছড়িয়ে পড়ে রাত্রির মেঝেতে
জুয়াড়ীর খুচরো পয়সার মতো। পাখি ওড়ে চোখের ভেতরে।
এখানে আমার জন্যে অপেক্ষায় ছিল যে কুকুর
তার লকলকে জিভ
আমার শরীর থেকে চেটে নিয়ে ক্লান্তি শুয়ে থাকে
দরজার কাছে, যেন সে অনন্তকালে পেয়েছে আশ্রয়।
কারো স্বপ্নে নেই জানি আমার নিবাস,
যে স্বপ্নে আমার ছায়া পড়ে তা নিমেষে ভেঙে যায়। মেঝে ফুঁড়ে
মাথা তোলে কালো গাছ, তার ছায়া থেকে ক’জন উন্মাদ ঢিল
ছোড়ে আর আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে একজোড়া চোখ।
একটি নিষিদ্ধ মীড়
একটি নিষিদ্ধ মীড় জেগে ওঠে বারবার রক্তের ভিতর,
ডেকে আনে নীল ময়ূরের
শোভা চিদাকাশে আর মোহান্ত বৃক্ষের
কাছে নিয়ে জপায় ফলের লোভনীয় বর্ণমায়া।
সে লোভ দমন করে বৈরাগ্যের গৈরিক ধুলোয়
পাখির ধরনের স্নান সেরে
চলে যাব কীর্তনীয়া আখড়ায়, তেমন ঔদাস্য
আজ অব্দি আয়ত্ত করিনি।
কী গুণ যাপিত মুহূর্তে, সে প্রসঙ্গ না টেনেও
সকালবেলার
অস্পষ্ট চাঁদের মতো কিছু স্মৃতি মনের কার্নিশে
ঝুলে থাকে এবং তুমিই স্মৃতি আজ।
মনে পড়ে, ছিলে দূরে, অত্যন্ত নেপথ্যে, বলা যায়।
কবিতা নিমেষে বড় অনাদৃত সেবাশ্রম থেকে তুলে এনে
তোমাকে আমার বাম পাশে।
বসিয়ে দিয়েছে।
বস্তুত তোমাকে স্বপ্ন-গোধূলিতে আলিঙ্গন করি, চুমু খাই
এবং তোমার হাত ধরে
বাগানে বেড়াই। শোনো, কখনো তোমাকে আমি বলি না মহিলা,
যা বলি কারো তা জানা নেই, তুমিও জানো না।
এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল
আমি কি এপ্রিলে মুগ্ধাবেশে
তোমাকে রঙিন পোস্টকার্ড, বহুদূর শহরের ছবিঅলা,
পাঠিয়েছিলাম? আজ রাতে
কিছুতেই মনে পড়ছে না। কখনও তন্দ্রার মেঘ
আমার অস্তিত্বে ছেয়ে এলে,
বহু ছবি, মূলত অস্পষ্ট, ভেসে ওঠে এলোমেলো
মনের নানান স্তরে বিমিশ্র স্মৃতিতে।
একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই, আপাতত
ধারাবাহিকতা খুঁজে মেলা ভার। এই সেই মুহূর্ত যখন
একদা যা ঘটেছিল তার
হদিশ মেলে না আর যা ঘটেনি কোনো দিন,
তাকেই নিভাঁজ সত্য ঘটনার প্রতিবিম্ব মনে হয় বস্তুত আমার।
তোমার বাগানে আমি ছিলাম সে-রাতে
গোলাপ গাছের কাছে? আমি কি তোমাকে স্পর্শ করে
উচ্চারণ করেছি শপথ
নিসর্গের নামে, নক্ষত্রের নামে, হৃদয়ের নামে
সে-রাতে বাগানে উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে একাকী?
দেখেছি তোমার
বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে রুপালি পাখি চোখ
হয়ে গেঁথে গিয়েছিল আমার শরীরে? লহমায়
ফুরিয়েছে সে-প্রহর, গাড়িবারান্দায়
বিদায়ের ছায়াচ্ছন্ন ঠোঁটে জমেছিল
ক’ফোঁটা শিশির। নিসর্গের অন্তর্গত
ছিলে তুমি, ছিলে কোনো না-লেখা প্রেমের কবিতায়।
ছিল কি বাগান কোনো গোলাপে সাজানো? বাস্তবিক
ছিলে কি সেখানে তুমি সে-রাতে নবীনা? এক আমাকে বলে দেবে?
একদা জন্মেছি যে-শহরে তার হাড়-পাঁজরা সব
হয়েছে ঝাঁজরা হানাদারদের মর্টারের শেলে, শহরের
আনাচে-কানাচে
আজরাইলের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড় অবিরত
পড়েছে ব্যাপক, এমনকি শহীদের করবেও বয়ে গেছে
বুলেটের ঝড়। চৌরাহায় মধ্যরাতে
নেকড়ের চিৎকারের মতো
দুরন্ত হাওয়ায়
হাতে তুলে নিয়েছি পতাকা বেদনার্ত মহিমায়
গুলিবিদ্ধ আমি, নিইনি কি?
আমার গলিতে যে-বালক খুব উঠেছিল বেড়ে
তমালের মতো, তাকে ওরা একাত্তরে
চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে কালো বধ্যভূমিতে এবং
যাকে আমি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি প’রে হেমন্ত-বিকেলে
বারান্দায় দাঁড়াতে দেখেছি, সে তরুণী
হয়েছে ধর্ষিতা বারংবার
শক্রর শিবিরে আর আমাদের প্রেমও
হয়েছে ভীষণ গুলিবিদ্ধ কোজাগরী পূর্ণিমায়।
অনেকের স্মরণের ল্যান্ডস্কেপে নেই যেন আজ
কোনো বধ্যভূমি, লক্ষ লক্ষ খুলি, স্মৃতিসৌধ কোনো।
আমারও কি নেই? কে আমাকে বলে দেবে?
এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল বড়।
এরকম কিছু
বাড়িটা সেকেলে, কিন্তু বাসিন্দারা একালের নব্য
সামাজিতায় ঝলমলে,
সান্ধ্য আসরের টানে অনেকেই আসে; গোলাপ ঠুমরী গায়,
শাণিত বুদ্ধির ঝলকানি লাগে কথোপকথনে।
সে ছিল নিঃশব্দে ব’সে এক কোণে তক্তপোশে, তার
রূপ রহস্যের মাতৃভাষা বলে; রত্নের ঝলক
ছিল চোখে, এ ঝলক
নিয়ে যায় বহুদূরে শতাব্দী পেরিয়ে কোনোখানে
দুর্গের দেয়াল-ঘেঁষা সিঁড়িতে এবং
দেখায় প্রাচীন হ্রদ রুশোর চিত্রের মতো রঙিন জঙ্গলে।
অনাবিল গণিতে উজ্জ্বলতা অত্যন্ত একাকী
খেলা করে তার মনের ভেতরে আর
কী এক শুদ্ধতা গান হয়ে
মনীষার আভায় জড়ায় তাকে। হয়তো এরকম
কাউকেই বলা যায়, ‘তোমারই উদ্দেশে
আমার প্রতীক্ষা চোখ বিছিয়ে রেখেছে শূন্য পথে আজীবন’।
মনে পড়ে, তাকে ঘিরে সামাজিক মধুমক্ষিকার
গুঞ্জরন ছিল সারাক্ষণ, দৃষ্টির লেহন ছিল, ছিল বটে
বিয়ারের ভরা গেলাসের মতো উপচানো
আবেগ বিভিন্ন কণ্ঠস্বরে। আমি শুধু দূর থেকে
সৌন্দর্য করেছি পান; আমার দু’চোখ নিরলস
পর্যটক তার শরীরের পাণ্ডুলিপিতে, আমার অভ্যন্তরে
সাময়িক ভালোবাসা বল্মীকের মতো গড়ে ওঠে।
রাত বাড়ে, রাতের গুহায় যেন শেয়ালের ঘ্রাণ জেগে থাকে,
কিছু উদ্ভিদের জিভ ক্রমাগত চাটে আমাকে এবং আমি
কাউকে কিছু না বলে গোয়েন্দা ভঙ্গিতে
নেমে যাই গহন রাস্তায় বড় একা। শিস দিয়ে
তাড়াই মনের বাঘ, আমার ব্যাকুল
অস্তিত্বের ঝোপঝাড়ে অবিরত ডেকে যায় অনিদ্র কোকিল।
কী যে তার নাম, কিছুতেই মনে পড়ে না এখন। সে সন্ধ্যায়
তার সঙ্গে বলেছি কি কোনো কথা? আমিও কি ঝানু
বাচালের মতো আচরণে তার একাকিত্বে খুব
ধরিয়ে ছিলাম চিড় ঠুকরে ঠুকরে? মনে
নেই, ওর দুটি
চোখ ছাড়া আজ আর কিছুই পড়ে না মনে। কোনো
ভনিতা না করে বলি, মনে হয় পুনরায় সেই দুটি চোখ
দেখার আশায় বেঁচে থাকি,
বেঁচে থাকি কলরবময় এই পৃথিবীতে আজও।
সত্যি মনে হয়; নাকি এরকম কিছু ভাবতেই ভালো লাগে?
কাল থেকে ফের
বেশ কিছুদিন থেকে এই বৃষ্টিই চাইছিলাম
দিগন্ত-ডোবানো বৃষ্টি। ভুরুতে ঠেকিয়ে হাত আমি
গনগনে আকাশের দিকে কতদিন
তাকিয়েছি বারংবার, পরখ করেছি
নানান রঙের নানা আকাশের মেঘ।
কোন মেঘ বৃষ্টি নামায় এবং
কোন মেঘ জলহীন তার
আন্দাজের মুখে ফুলচন্দন পড়ে না সহজে।
আকাশ যে কীরকম প্রতারক হতে পারে, ঘটা করে
মেঘ-মেঘালির খেলা দেখিয়েও মাটিকে তৃষিত
রাখে দীর্ঘকাল,
এ-কথা অজানা নয়। প্রতীক্ষার পাথর হৃদয়ে
অন্ধের চোখের মতো থাকে
সকল সময়।
এখন আবার আসমান দিয়েছে উপুড় করে তার ভরা
কলস বদান্যতায়। খরাপোড়া খেতে
দাঁড়ানো চাষীর মতো ভিজছি, আমার রোমকূপে
ঝরে বৃষ্টিধারা, গলে যায়
আমার হৃদয়
বৃষ্টির পানির মতো, এই বৃষ্টি আমার আশ্রয়।
বৃষ্টির নূপুর থেমে গেলে কুমড়ো-ফালির মতো
চাঁদ ওঠে, উঁকি দেয় একটি কি দুটি তার আর
অকস্মাৎ একটি ভাবনা ঘুরে দাঁড়ায় ভয়ার্ত
পথিকের মতো-কাল থেকে ফের শুরু হবে না তো
একটানা ধূমায়িত খরা বহুকাল
আমার জমিতে?
কিছু কথা ছিল
চৈত্র সংক্রান্তির দুটি পাশাপাশি থাকা
ঘুড়ির ধরনে খুব কাছাকাছি ছিলাম দু’জন। আমাদের
একজন যে কোন মুহূর্তে সরে যেতে
পারি খর প্যাঁচে,
ছিল ভয় সারাক্ষণ। তোমার ভেতরকার ধু-ধু
নির্জনতা করেছি আকণ্ঠ পান সকল সময়।
যখনই তোমার চোখে চোখ
রেখেছি তখনই মৃত রাজার মিছিল নির্বাসিত
রানীদের মুখ আর রুপালি তাঞ্জাম
দৃষ্টিতে উঠেছে ভেসে। এমনকি রেকাবিতে রাখা
ফলের ভেতর আমি দেখছি তোমার রূপ আর
সর্বদা তোমার
নামের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে কিছু ধ্রুবপদ
করেছি নিবিড় উচ্চারণ।
বেশ কিছু কথা ছিল তোমাকে বলার,
অথচ তোমাকে
ভালবাসি বলার আগেই
হৃদয়কে অমাবস্যা করে নিলে চকিতে বিদায়।
কী ব্যাপক লোভে
সবকিছু খুব শান্ত আশেপাশে; বারান্দায় হাঁটি
একা একা; গৃহকোণে নিমগ্ন গৃহিণী
ভোরের নিঃসীম প্রার্থনায়। কয়েকটি কবুতর
পাশের বাড়ির ছাদে ঘোরে ইতস্তত কিছু আহার্যের খোঁজে।
আকাশে অস্পষ্ট চাঁদ, নিঝুম প্রশান্তি শুয়ে আছে
মেষ পালকের মতো। যেন কেউ দিচ্ছে উপহার
স্মিত হাসি দূর থেকে, একটি তরুণী
খোলা ছাদে, মুখের ভেতরে তার সঞ্চরণশীল টুথব্রাশ।
অকস্মাৎ কি-যে হলো, কবুতরগুলি লহমায়
চৌদিকে ছড়িয়ে পড়ে কিসের ঝাপটায়,
কাকের চিৎকারে চিড় ধরে পরিবেশে;
দেখি, প্রতিবেশী ছাদে খাদ্যান্বেষী বানরের তুমুল দঙ্গল।
দালানের নিভৃত ফোকরে পায়রার গেরস্থালি
তছনছ, সাঁড়াশির মতো হাত ঢুকিয়ে বানর আনে ডিম,
খায় ক্ষিপ্ত ব্যস্ততায়। মনে হলো, আমার আহত কবিতাকে
গিলছে ক্ষুধার্ত কাল কী ব্যাপক লোভে!
কেড়ে নেবে ওরা
তোর কাছ থেকে কেড়ে নেবে ওরা এক এক করে
সকল পালক। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতোই
দশদিক ঘুরে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবি তুই,
তখন সবাই দুয়ো দেবে তোকে। কেউ পদাঘাত
করবে হঠাৎ, কেউ ঘামে-ভেজা নমিত কেশর
লহমায় ছেঁটে তুড়ি মেড়ে ছুটে তারিফের বুড়ি
ছোঁবে আহ্বাদে আটখানা হয়ে। কেউবা হেলায়
তোর দিকে চোখ মেলে অবেলায় পর্ষদে পেশ
করবে নিখুঁত প্রস্তাব তার : ‘এ বোঝা হটাও,
কবরে নামাও; তাহলেই চুকেবুকে যাবে সব’।
এই নিগৃহীত মুখ বুজে তুই
মেনে নিবি আজ?
এর জন্যেই ঊষর জমিনে ফোটালি গোলাপ,
জুঁই ও চামেলি? করলি শূন্যে এত কারুকাজ?
পুষলি বুকের রক্ত ঝরিয়ে সুবচনী হাঁস
এর জন্যেই? তুখোড়, চতুর কতিপয় লোক
খাঁচায় বদ্ধ জন্তুর মতো খুঁচিয়ে বেড়ায়
অসহায় তোকে যখন তখন, খুব ঝলমল
আড্ডায় তোর নিন্দা রটায় নিভাঁজ রগড়ে,
তুই শুধু পড়ে থাকবি ধুলায়। আজ পথে কাঁটা,
কাল মুখ ফের ফুল চন্দন। থোড় বড়ি খাড়া,
খাড়া বাড়ি থোড়, অবিরাম এই পুনরাবৃত্তি।
গাঁওবুড়াদের মুখে
সে-কথা প্রথম শুনি গাঁওবুড়াদের
মুখে; তাঁরা গোধূলিতে পুকুরের পাড়ে বসে প্রবীণ গলায়
গাজী কালু চম্পাবতী পুঁথি সুরের
আমেজ মিশিয়ে বলেছিলেন সে-কথা, মনে পড়ে।
বালক বয়সে সবকিছু সহজে বিশ্বাসযোগ্য
হয়ে ওঠে তাই
ওদের সে-কথা শুনে তাকাতাম উত্তরের দিকে।
কেননা সেদিক থেকে তিনি আসবেন,
এ ধারণা তাদের কথায়
প্রশ্রয় পেয়েছে বারবার। বহুদিন
আমি হেঁটে চলে গেছি বহুদূরে উত্তর দিকের
নিশানা স্মরণে রেখে। অনেক পুরনো দীঘি, জামতলা আর
পাতা-ছাওয়া পথ পাড়ি দিয়ে
আবার এসেছি ফিরে, যদিও পাইনি দেখা তার,
যার কথা বলে
গাঁওবুড়াদের চোখ হতো স্বপ্নাকুল গোধূলিতে
অথবা সকালবেলা। কেউ কেউ থাকতেন খুব চুপচাপ
হুঁকো হাতে, কেউ কেউ খড়মের শব্দে তুলে যেতেন অন্দরে।
শহরেও শুনেছি সে-কথা কিছুকাল পরে; যারা
চাখানায় কিংবা আস্তাবলে
মারতেন সরস আড্ডা দিনরাত, তাদের ভেতর
কেউ কেউ গল্পচ্ছলে বলতেন তাঁর কথা, যিনি
আসবেন উত্তরে পথ বেয়ে। কেমন দেখতে তিনি আর
কীরকম পোশাক-আশাক
শোভা পাবে গায়ে তাঁর, এসব কিছুই
থাকত না সেই প্রিয় কিসসায় তাদের।
কিস্সাই বলব একে, যেহেতু আসার কথা যাঁর
তিনি তো আসেননি আজও, শুধু
কিছু কথা ভ্রমরের গুঞ্জরণ হয়ে ওষ্ঠে ওষ্ঠে
ঘোরে মাঝে-মাঝে, আমি আগেকার মতো
গভীর আগ্রহে আর শুনি না সে-কথা।
কখনো নিঃশব্দে হাসি, উদাস তাকাই কখনোবা,
চায়ের পেয়ালাটিকে ঠোঁটের নিকটে নিয়ে যাই।
আমার সংশয়ী মন যদিও এখন
উত্তরের দিকে আর নজর করে না, তবু কোনো কোনো দিন
কী-যে হয়, আমি তাঁর কথা ভাবি, আসবেন যিনি,
যিনি এদেশের মৃত্তিকার মতো, নদীর পানির মতো,
চৌরাহায় বিশাল বৃক্ষের মতো। আমি
গল্পের ভিতরে ধৈর্য ধরে আরেক কাহিনী খুঁজি।
গ্রন্থস্বত্ব
আমাকে চমকে দিয়ে কখনো কখনো
আমার ভেতরে কেউ একজন হো-হো হেসে ওঠে,
মাছে মাঝে নিঝুম গুমরে কাঁদে নিভৃত আড়ালে,
কাঁদে একা একা।
আমাকে কিছু না বলে অকস্মাৎ গহন রাত্তিরে
গৃহত্যাগী গৌতমের মতো
চলে যায় হেঁটে বহুদূরে, যেন সব
সম্পর্ক চুকিয়ে চলে যায়। কোথায় যে
যায় কত ধু-ধু বাঁক পেরিয়ে, জানি না।
যখন সে করে না বসত আর আমার ভেতর,
তখন স্মৃতিতে তার ছায়া
বড় বেশি আনাগোনা করে। দীর্ঘকাল
প্রতীক্ষায় থাকি তার; কিন্তু আসে না সহজে সেই পর্যটক
আমার ইচ্ছাকে দিতে একান্ত পুষ্পিত উপহার।
আবার এমনও হয়, এত্তেলা ছাড়াই
ধুয়ে মুছে কায়ক্লেশ ওজু করে স্বপ্নের ভেতরে বেদনায়।
তার চোখে রহস্যের ভাষা
ভাষতীত বোধ বুনে দেয়। অকস্মাৎ সে পড়শি
তর্জনী উঁচিয়ে
আমার সকল গ্রন্থস্বত্ব দাবি করে। আর গূঢ়
অনিবার্য উচ্চারণ শুনে
বিস্ময়ের পাখি ঠোকরায় আমাকে এবং আমি
ধন্দে পড়ে যাই।
ঘৃণা, তুই
ঘৃণা, তুই তোর ভ্রূকুঞ্চন,
ঠোঁটের বক্রতা আর দাঁত ঘষটানি
ফিরিয়ে নে। দ্যাখ চেয়ে গোলাপ কেমন
হেসে তোর দিকে
তাকিয়ে রয়েছে, বন পায়রার ঝাঁকি নম্র এসেছে নেমে
টিনশেডে, চকোলেট রঙের তরুণ পাখি তার
হৃদয় উজাড় করে সুর
ঢেলে স্নান সস্নেহে করাচ্ছে-হ্রদয়কে। এই তো দাঁড়াল বারান্দায়
কলেজ সুন্দরী, তার চুল ওড়ে উদ্দাম হাওয়ায়,
ঘৃণা তুই, তোর তূণ থেকে সব তীর ছুড়ে ফেলে দে মাটিতে।
ঘৃণা, তুই যাকে শক্র ভেবে এতদিন বারবার
চোখ থেকে ঝরালি আগুন,
করেছিস খুন স্বপ্নে তৃতীয় প্রহরে আর দুর্বাসার মতো
কমণ্ডলু ছুড়ে তপোবনে অকস্মাৎ
ভীষণ ভয়ার্ত করে তুলেছিস হরিণ শিশুকে,
প্রকৃত প্রস্তাবে
কখনো সে নয় শক্র তোর, বরং দয়ার কুঁড়ি
ফোটাবার জন্যে সে হয়েছে অন্তরালে
কিছুটা নির্দয়। শোন মিনতি আমার, পুনরায় ভালোবেসে
ঘৃণা তুই মুখ থেকে খুলে ফেল ঘৃণার মুখোশ।
ছায়াসঙ্গীর উদ্দেশে
শাবাস জনাব, আপনার ধৈর্যের মুখে
ফুল চন্দর পড়ুক। সেই কবে থেকে আপনি
আমার পেছনে পেছনে ঘুরছেন।
আমি বাড়ি থেকে না বাড়ালেই
আপনি আমার সঙ্গে জুড়ে যান। সবসময় যে স্পষ্ট
আপনাকে দেখতে পাই, তা নয়।
তবে বুঝতে কষ্ট হয় না,
কেউ একজন আছে আমার পিঠের খুব কাছে,
কখনো কখনো তার নিঃশ্বাস এসে লাগে
আমার ঘাড়ে। ঘুরে দাঁড়ালেই দেখতে পাব তাকে।
আমি ডান দিকে ঘুরলে আপনিও ঘুরে দাঁড়ান ডানে,
যখন আমি বাঁ দিকে এগিয়ে যাই
হনহনিয়ে, তখন আপনিও
চমৎকার কায়দার চলতে শুরু করেন বাঁয়ে।
আর এই তো সেদিন
রৌদ্রের ঝালরময় আরমেনিয়ান গির্জের কাছে আপনি প্রায়
ধরা পড়ে গেলেন আমার চোখে।
আর সেই মুহূর্তে চেহারায় এমন ভঙ্গি ফুটিয়ে
তুললেন, মনে হলো, আপনি আমাকে
এই প্রথমবারের মতো দেখলেন। কী জানেন,
এরকম মুখভঙ্গি শুধু পাকা অভিনেতাই আয়ত্ত করতে পারে।
দেখুন, কখনো কখনো ইচ্ছে
আপনাকে সাফ বলে দিই, ‘আপনার নষ্ট করার মতো
প্রচুর সময় যদি থাকে,
তাহলে যত ইচ্ছে আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করুন
আমি বারণ করব না। ভিড় ঠেলে ঘেমো মানুষের
গন্ধ শুঁকে শুঁকে সকাল-সন্ধ্যা
কিংবা মধ্যরাত অব্দি আমার আশেপাশে
মনের সাধ মিটিয়ে
ঘোরাফেরা করুন, আমার একরত্তি আপত্তি নেই।
এই যে আপনি শিকারি কুকুরের ধরনে
আমার চলার পথ শুঁকে বেড়াচ্ছেন অষ্টপ্রহর,
কী এর উদ্দেশ্য
আমার একেবারে অজানা নয়। বিশ্বাস করুন,
আপনি আমার কাছে যা পেতে চান,
যা আমার কাছে আছে বলে আপনি এবং আপনার
প্রভুরা কল্পনা করেন-
আপনাদের কল্পনাশক্তি কবিদেরও হার মানায়-
সেসব কিছুই পাবেন না।
বরং আমার মুখোমুখি হলে
আপনাকে আমি চটজলদি একমুঠো বেলফুল,
কতিপয় রঙিন বেলুন,
কিংবা টাকার মতো চকচকে কিছু নক্ষত্র দিতে পারি।
ট্রেনের জানালা থেকে
সতেজ সকালবেলা সবুজ আড়ালে
ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন দাঁড়িয়ে ছিল একাকিনী, খুব দ্রুতগামী
ট্রেনের জানালা থেকে দেখলাম। তার
গোড়ালির গন্ধ শুঁকে
একটি গুবরে পোকা ঢুকে পড়ে ঘাসের ভিতরে।
অকস্মাৎ ধবধবে বক উড়ে যায়
দাবার ছকের মতো ক্ষেতের ওপর দিয়ে, আসমানী প্রসাধন চলে
জলের আরশিতে। শূন্য নৌকা
ডাঙায় কুঁড়েমি করে, কী যেন কুড়ায় পথে বিশীর্ণ বালক।
পিত্রালয়ে ফিরোল্টা যাবার আশা পলাশের আভা
ছড়িয়ে তার চোখে, নাকি
প্রবাসী স্বামীর প্রত্যাবর্তনের পথ-চেয়ে-থাকা
ফোটায় অজস্র তারা রক্তকণিকায়,
নাকি ওর হৃদয়ের গহন দুপুরে
মোহন চক্কর দিতে দিতে ডেকে যায় শঙ্খচিল।
হয়তো কেউ তাকে ডেকে নিয়ে গেছে নিকানো উঠোনে,
ধান ভানা বাকি আছে, আছে
ইঁদারার কাছে যাওয়া, বাসী কিছু বাসন-কোসন
মেজে ঘষে ধুয়ে মুছে
সাজিয়ে রাখতে হবে। শিকায় ঝোলানো
খয়েরি বৈয়ম থেকে গুড
এখুনি নামিয়ে দিতে হবে, গাছ-পাকা
পেঁপে কেটে দিতে হবে
অতিথির পাতে, সে এখন মিশে যাবে সংসারের
শত কাজে, যেমন দিঘির সুনসান
পানিতে সহজে ভেসে যায়
মাটির কলস।
ভোরবেলাকার ট্রেন হুইসল্ বাজাতে বাজাতে
ছুটে যাচ্ছে, গাছগাছালির আড়ালবর্তিনী ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন দাঁড়িয়ে আছে আমার ভিতরে।
কী-যে তার নাম,
বিবাহিতা অথবা অনূঢ়া,
নাকি উপস্থিত রজস্বলা নাকি সদ্য গর্ভধারিণী, এসব
কিছুই না জেনে দ্রুত চলেছি একাকী
শহুরে মানুষ। একদিন
সবুজ আড়ালে-থাকা ডুরে-শাড়ি-পরা
যৌবন নিশ্চিত মুছে যাবে,
যেন জলরঙ; আপাতত আমি খুব চুপচাপ
ট্রেনের জানালা থেকে লঙ শটে দেখে নিচ্ছি জলমগ্ন মাঠ,
নিবিড় লাঙল-ঠেলা কৃষকের রোদ্দুরে-পিছলে-পড়া পিঠ,
আনন্দ-বলয় থেকে আসা পাখি, তারে-বসা, শুদ্ধচারী মেঘ
এবং ভাবছি তাকে, বানাচ্ছি প্রতিমা তার স্মৃতির ভিতরে,
নাম ধাম যার
সর্বদা থাকবে ঢাকা বেজায় বেগানা কুয়াশায়।
তার সঙ্গে জানাশোনা
তার সঙ্গে জানাশোনা অনেক আগের। মনে পড়ে
প্রথম দেখেছিলাম তাকে
ছেচল্লিশ মাহুতটুলির ছাদে মেঘান্ধ প্রহরে।
তারপর একদিন হার্নি সাহেবের যত্নের বাগানটাকে
আলো করে হেঁটে গেল রক্তজবা গাছের নিকটে।
আরা একবার আহসান মঞ্জিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে
দেখলাম, তাকাল আমার দিকে খুব অকপটে;
এবং কিছু না বলে মেতে
উঠল সাঁতারে বুড়িগঙ্গা নদীটির বুক জুড়ে। জলকেলি
আমারই উদ্দেশে ভেবে উৎসবের প্রদীপের মতো
জ্বলে উঠে ক্ষিপ্র মুছে ফেলি
নৈরাশ্যের জুলকালি; সে দৃশ্যকে করেছি লেহন অবিরত।
মনে পড়ে, বায়ান্নর বুলেটে জখমি এ-শহরে
সে এলো বিষণ্ন অথচ কী তেজী ভঙ্গিতে, দাঁড়াল
এলোমেলো ঘরে,
আমার শয্যার পাশে মন্থর বাড়াল
পা, রাখল হাত জ্বরে-পুড়ে-যাওয়া আমার কপালে।
দেখলাম তাকে একদিন খারাপ পাড়ার মোড়ে
আশ্বিন-সকালে।
স্বচ্ছ নগ্ন আকাশের নিচে, আবেগের তোড়ে
অন্ধ ভিখারির মুখে পরে দিতে একটি সোনালি
মাছ; বহুকাল পর দেখা গেল তাকে প্রাণভয়ে
উদ্বাস্তু মিছিলে ত্রস্ত, খালি
পায়ে আর উষ্কখুষ্ক চুলে। দেখি সূর্যোদয়ে
কী সূর্যাস্তে বাহু তার বরাভয় আঁকে
শূন্যতায়; পুনরায় তার সঙ্গে হলো দেখা গায়ে
কাঁটা-দেয়া সময়ের বাঁকে।
ছিল সে লাশের ভিড়ে ব’সে খোলা চুলে, বনচ্ছায়ে
পাথুরে ভাস্কর্য যেন। মাথায় তন্ময়
করবীর গুচ্ছ নিয়ে পা দোলায় ধ্বংসস্তূপে ব’সে নিরালায়,
কখনো আমার ঘরে নিঃশব্দে টাঙিয়ে দেয় গাঁদাফুলময়
রবীন্দ্রনাথের পাশে মনস্বী মার্ক্সের ছবি। যায়, দিন যায়।
পড়ছে বাহুর ছায়া দীর্ঘ হয়ে আমার আয়ুতে ক্রমাগত,
কিন্তু দেখি তার স্বপ্ন-ধাঁধানো শরীরে
বয়স আশ্চর্য মঞ্জরিত স্থির বিদ্যুতের মতো,
প্রাত্যহিকতা অলৌকিক বেজে ওঠে চকিত মুদ্রায় তার মীড়ে মীড়ে।
দুখিনী সাঁথিয়া
মধ্য মার্চ নগরবাড়ির ঘাটে কোকোকোলা, সাদা জিপে চড়ে
পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেলাম দুখিনী সাঁথিয়া।
থানার পাশেই ডাকবাংলো,
মন-মরা, কেমন নিষ্প্রভ,-কিন্তু লহমায়
মানবিক আভা বিচ্ছুরণে, হাসি-গল্পে যেন আমি
একটি উজ্জ্বল দ্বীপে ছুটি পেয়ে যাই গোধূলি বেলায়।
কাজলা দিদির মতো সন্ধ্যা আসে আর
চকিতে ঘোমটা টেনে নিত্যকার লোডশেডিং এবং
হ্যাজাক ছাড়াল আলো মঞ্চে, নিমেষে রবীন্দ্রনাথ
নজরুল ইসলাম ব্যাপ্ত মীড়ে মীড়ে
সাঁথিয়ার ব্যাকুল হৃদয়ে। দীপকের কণ্ঠস্বরে
আধুনিক কবি ঠাঁই পান, চকোর কবিতা পড়ে, সুর
মাটি-ঘাস, আল ছুঁয়ে বিলে পৌঁছে যায়। রাত বাড়ে,
ভাটা পড়ে অলৌকিক কলরবে। স্তব্ধতার
মধ্য দিয়ে হেঁটে ফিরে আসি ডাকবাংলোয়। রাত
দেড়টায় শুতে যাই, কিছুতে আসে না ঘুম, চোখ পুড়ে যায়।
জানালার বাইরে আঁধারে কার চোখ জ্বলে? কোত্থেকে অঙ্গার
এলো এত রাতে? ঝোপ থেকে
মানুষখেকোর গন্ধ ভেসে আসে যেন,
আই ইজিচেয়ারে নিশ্চুপ
গা এলিয়ে দিয়েছেন জিম করবেট। সহচর
রাইফেল পাশে স্তব্ধ প্রহর পোহায়।
বিনিদ্র পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দের মতো একটি আওয়াজ
ভেসে আসে, তাকে মনে পড়ে। কাকে? একটি দুপুর
এবং একটি সন্ধ্যা আমার অধীর অঞ্জলিতে
জমা রেখে যে এখন জিম্মি অন্য কোনোখানে, তাকে।
কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙে। কতকাল
শুনিনি কোকিলকণ্ঠ। রোদ এসে শিমুলের রঙে
রাঙিয়ে দিয়েছে ডাকবাংলোকে। বাসি
মুখ ধুই, ফিরে যাব। একটু পরেই
আসবেন ওরা-অধ্যাপক, ছাত্র, সাংবাদিক
কেউ কেউ, সাধারণ মানুষ কজন, সর্বোপরি
কৌতূহলী বালক-বালিকা। ফিরে যাব,
ক্যামেরায় স্নিগ্ধ গাছপালাসহ স্মৃতিময় ছবি, ক্লিক, কবি
এত তাড়া কিসের? বলিনি গাড়ি ঠিক
সময়েই এসে যাবে? কোনো দিন ফের দেখা হবে।
ঈশ্বরদীতে ধরব প্লেন। কিছু উদ্ভিদের স্পর্শ, কিছু
মেঠো ঘ্রাণ কতিপয় মুখ, গল্পে-গানে ঝলমলে,
হৃদয়ের শেকড়ে
থাকবে জড়িয়ে। সাঁথিয়ার প্রতি ওড়াব রুমাল যথারীতি।
আবার শহুরে আড্ডা, টাইপরাইটারের দ্রুত
চটপটে শব্দে মতো অস্থির ব্যস্ততা, অতিকায়
মৌচাকের গুঞ্জরণ, হেনরি মিলার সাক্ষী, এয়ারকুলার
দুঃস্বপ্ন ছড়িয়ে দেবে বহুতল দালানের আনাচে-কানাচে।
কখনোসখনো
হৃদয়ে কোকিল হয়ে ডেকে যাবে দুখিনী সাঁথিয়া।
দ্য গেম ইজ ওভার
অকুণ্ঠ স্বীকার করি, তুমি বেশ তুখোড় খেলুড়ে।
যারা উড়ে এসে জুড়ে
বসে তুমি তাদের কাপ্তান প্রতিনিধি নও; আমি
যে-দলে নিয়ত খেলি, সে দলেরই খুব অগ্রগামী
একজন হয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছ সকল ঋতুতে। কোন লক্ষ্যে
নিবদ্ধ তোমার দীপ্ত চোখ, প্রকৃত আমার পক্ষে না বিপক্ষে
খেলছ, বোঝাই মুশকিল।
অন্ধকারে ঢিল
ছুড়েছি অনেক; ঐন্দ্রজালিকের মতো
সহজে সেসব তুমি করেছ গায়েব ক্রমাগত।
সন্দেহের মেঘ তাই জমেনি কখনো মনে, বরং তোমার ড্রিবলিং, ব্যাক ভলি, ডজ, পুশ দেখে গুলজার
করেছি নরক প্রশংসায়। তুমি হেসে,
কখনো একটু কেশে
পুড়িয়েছ এন্তার সিগ্রেট, আর ধূম্রকুণ্ডলীর
মতো পাকিয়েছ দল ধীর,
স্থির আর কখনো-বা কপট স্তুতির ঘোরে
বস্তুত করেছ নিন্দা আমার নিপুণ ঠারে ঠোরে।
অথচ তোমাকে আমি প্রায়শই জুগিয়েছি বল
বারংবার নিজেকে পেছনে রেখে, চেয়েছি উজ্জ্বল
হোক খেলা যৌথ ভাবে। কিন্তু তুমি একা
চেয়েছ অত্যন্ত ঝলসাতে, এমনকি ভব্যতার সীমারেখা
নিখুঁত দিয়েছ মুছে; শুনেও শুনিনি
উড়ো কথা, বরং তোমার কাছে ঋণী
ভেবেছি সর্বদা নিজেকেই।
এমন ছেড়েছ দান অন্তরালে, হারিয়েছি খেই।
কাকের কর্কশ ধু-ধু ডাকের মতোই খুব পুরানো এ খেলা
দেখে যায় বেলা।
চতুর্দিকে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার;
দ্য গেম ইজ ওভার মাই ফ্রেন্ড, হে সখা আমার।
ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ
তোমার সয়নি তর, ভোরকেই কালসন্ধ্যা ভেবে
সাততাড়াতাড়ি বেপরোয়া
হাঁকালে চাবুক তুমি অস্থির ঘোড়ার পিঠে, গেলে
ছুটে দুর্নিবার
বৈশাখী হাওয়ার বেগে কেড়ে নিতে সোনার মুকুট
সুহৃদের মাথা থেকে। অনেকের ছিল জানা, তোমরা দু’জন
মানে সে রাজন আর তুমি ছিলে দস্তানা এবং
হাতের মতোই লগ্ন সকল সময়।
প্রতীক্ষা শেখোনি তুমি কিংবা শিখলেও
উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোরগ-ঝুঁটির মতো হয়েছে ভীষণ আন্দোলিত
মাঝে-মাঝে। ফলত সফল
কোনো শিকারের পরে মোসাহেব আর
হুঁকোবরদার-পরিবৃত হয়ে ছিলে
যখন, তুমি
সে কোন গুহার পেট চিরে এক ঝাঁক
অদ্ভুত নিরালা পাখি এসে কালো করে
তোমার আকাশ কী-যে বলল
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, আস্তিনের সাপ
ছাড়া অন্য কেউ ঘুণাক্ষরে
বোঝেনি সে-ভাষা।
হঠাৎ শিউরে ওঠো কেন? রুটি টুকরো
করার সময়
রুটির ভেতর থেকে রক্ত ঝরে
বুঝি? নাকি মাছের ঝোলের
বাটি এক লহমায়
হয়ে যায় রক্ত সরোবর? একি, তুমি
নিজের ঘরের চার দেয়ালে খাটের
বাজুতে এবং পারসিক গালিচার
রক্তধারা দেখছ নিয়ত। আর যে ছুরি লুকিয়ে
রাখো তুমি সর্বদা কোমরে,
অষ্টপ্রহর সে যাচ্ছে বকে অবিরত
অসুস্থ প্রলাপ।
অবশ্য এখন তুমি বিভোর নিজের
মুকুটিত শোভা দেখে। দর্পণও তোমার, মনে হয় আজ্ঞাবহ
চাটুকার ইদানীং। যে ছবি দেখতে চাও তুমি
নিমেষে সে ছবি ফোটে জমাট পারদে। অতিশয়
বিজ্ঞ তুমি, উপরন্তু নিখুঁত তোমার চাল। তবে
এ-ও সত্য বলে জেনো, ‘কোথায় মুকুট’ বলে তুমি
অকস্মাৎ আর্তনাদ করে উঠবে একদিন দুঃস্বপ্নের ঘোরে,
দেখবে দু’চোখ মেলে কাঁটাতারে মৃত কালো পাখিটার সঙ্গে
ঝুলে আছে অস্তরাগে রক্তাক্ত গৌরব,
ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ। ক্রমাগত রৌদ্রজলে জং ধরে
শিরস্ত্রাণে আর সেখানেই
দুলিয়ে দর্পিত মাথা হাসে রক্তজবা।
নন্দলাল বসুর সঙ্গে কিছুক্ষণ
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙে অদৃশ্য পাখির গানে,
সে সুর ছড়িয়ে পড়ে ময়ূর রঙের আসমানে।
দূরে নন্দলাল বসুর ছবির মতো
দিগ্বলয় চোখে পড়ে; আমি অভ্যাগত
বত্রিশ বছর আগে যাচ্ছিলাম হেঁটে তাকে নিয়ে
রতন কুঠির পাশ দিয়ে,
অকারণ কত কিছু সযত্নে কুড়িয়ে চলে মন,
অমর্ত্য পাখির মতো গান গায় শান্তিনিকেতন।
খালি পায়ে পথ হাঁটি সকাল ন’টায়, মাটি-ঘাসে
মমতার স্পর্শ পাই, নন্দলাল বসুর নিবাসে
অত্যন্ত স্পন্দিত প্রাণে যাই,
শিল্পীর নিবাস যেন সাধকের ধ্যান, মেলে ঠাঁই
সকলের; জগত সংসার লগ্ন চৌহদ্দিতে। হেসে
তাকালেন, সময়-পেরুনো দৃষ্টি; সাদাসিধে বেশে
আছেন নিমগ্ন ব’সে সুজনি-শোভিত তক্তাপোশে। বসে পড়ি
আমরা ক’জন তাঁকে ঘিরে, দিলেন ভাসিয়ে তিনি শিল্পতরী।
সেই ঘর ভরা
আনন্দের স্বরে, দেখি তাঁর হাতে পোষা পাখির ধরনে ধরা
নিজস্ব প্রিন্টের অ্যালবাম। একটি একটি করে
ছবি মেলে ধরলেন তিনি, দৃষ্টির দুকূল ভরে
আমাদের কেমন সৌন্দর্য এলো-অমরাবতীতে
একটি ছাগল চরে, অজয় নদীতে
পা ডোবায় সাঁওতাল তরুণী; হঠাৎ
অ্যালবাম বন্ধ করে করলেন তিনি ঘরছাড়া দৃষ্টিপাত।
‘আজ এখানেই শেষ, আবার কখনো যদি ফিরে
আসো কোনো দিন অজয় নদীর তীরে,
ছাতিম তলায়, তবে বাকি
ছবি দেখা যাবে ফের একসঙ্গে আরেক সকালে’। দূরে পাখি
ডেকে ওঠে, উৎসব ফুরাল লহমায়,
পান করে পদ্মবন, পলাশ ও শিমুলের মেলা,
গোপাল ক্ষ্যাপার নাচ পথ চলি, গাছের মধ্যেই দেখি শিব, বাড়ে বেলা।
এ কেমন খেলা দেখালেন শিল্পচার্য? কিছু অন্তরালে রেখে,
নান্দনিক উন্মোচনে মেতে কিছু এঁকে
ফোটান ত্রিলোক তিনি; তবুও পায় না সম্পূর্ণতা
শিল্প চরাচরে; নদী, পাখি, তরুলতা,
বারবার ফিরে আসে রঙ রেখায়। আর কত
বছর কী দ্রুত কেটে গেল, নিজের ছবিরই মতো
এই তো আছেন ব’সে নন্দলাল নন্দন সিঁড়ি জুড়ে। চলো যাই,
কাছে ডাকে রোদের ঝালর প’রে ক্ষীণাঙ্গী খোয়াই।
নিরন্তর দোটানায়
নিরন্তর দোটানায় আজ আমি ক্লান্ত, হতাশ্বাস;
এক স্তূপ বেদনার মতো পড়ে আছি এক কোণে,
এবং আমার স্বপ্ন ছেঁড়া পাতা, মনের গহনে
ঘোরে শুধু প্রেতচ্ছায়া নিত্যদিন। সকল বিশ্বাস
ছিন্নমূল; দর্শনে পাই না স্বস্তি, বিজ্ঞানেও আর
নিখাদ উৎসাহ নেই, যখন সভয়ে দেখি, হায়,
জাগর বিজ্ঞানপুষ্ট শক্তির সংহারী মত্ততায়
দ্রৌপদী সভ্যতা দ্যাখে নিরুপায় সর্বনাশ তার।
পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে কোনোকালে,
এইমতো অর্বাচীন গালগল্পে ধরেছে ফাটল,
এ-কথা কবুল করি, অনেক আগেই। দ্বিধাহীন
বলি তবু, আমি বন্দি হয়েও ভ্রান্তির ঊর্ণাজালে
সৃষ্টির বন্দনা করি মাঝে-মধ্যে; কেননা অতল,
রমণীয় দৃষ্টি, ঝরনা স্বর্ণচাঁপা আজও অমলিন।
বহুদিন পর মাকে
সুরমা রঙের মেঘে রোদ্দুরের পাড়, চরাচরে
চকিতে ছড়িয়ে পড়ে সুর,
হৃদয়ের ভোরবেলাকেই ভরে তোলে, পিছুডাক;
আসমানে চিলের পাখার ঝলসানি।
বারান্দার জায়ানামাজের মখমলে প্রজাপতি,
এককোণে তসবি ধ্যানস্থ,
হঠাৎ কী ভেবে তিনি ঘরের ভেতর
গেলেন আমার আম্মা। চৌকাঠে লুটায়
রোদ্দুর, শিশুর হাসি। বহুদিন পর
মাকে দেখলাম তাঁর
আলমারি গোছাতে, একটা ঘ্রাণ, পুরানো দিনের,
সারা ঘরে গুণীর তানের মতো ব্যাকুল ছড়ানো।
আমি অগোচরে;
নানা কাপড়ের ভাঁজে কী যেন তন্ময়
খুঁজছেন; ঘরে ওড়ে প্রজাপতি। ফটোগ্রাফ থেকে
আমার পিতার চক্ষুদ্বয়
চেয়ে থাকে, যেনবা আবৃত্তি করে জন্মদিন। কারুকাজময়
আলমারি থেকে
একটি গোলাপি বানারসী শাড়ি হাতে
নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন কিছুক্ষণ,
তাকিয়ে লাজুক চোখে এদিক ওদিক
জড়ালেন গায়ে।
অকস্মাৎ রঙধনু, তাঁর সমগ্র সত্তায়, যেন
তিনি পুনরায় নববধূ অতীতের
চন্দ্রিল বাসর ঘরে। বৈধব্যের গোধূলিতে একটি গোলাপি
বানারসী শাড়ি হাতে
দাঁড়ানো আমার আম্মা। চোখে
তাঁর বাইফোকাল চশমা,
এবং স্খলিত দাঁত, সময়ের নখের আঁচড়ে
উৎকীর্ণ অস্তিত্বময়, যেন কবিতা লিখতে গিয়ে
কিছু হিজিবিজি এঁকে ফেলেছি খাতায়। আজ এই
সত্তরেও দেখি
যৌবন আনত তাঁর কাছে।
‘এর আগে এমন সুন্দর আমি দেখিনি তোমাকে’,
মনে মনে উচ্চারণ করে অন্তরালে
সৌন্দর্য লুণ্ঠনকারী সরে যাই সে বাসর থেকে।
সুরমা রঙের মেঘে রোদ্দুরের পাড়, কতিপয়
কবুতর রেলিঙ-এ আতিথ্য নেয়, গম
পাবে; মা আমার
দাঁড়ানো দরজা ঘেঁষে, তাঁকে
কী এক উৎসব
ত্যাগ করে গেছে, মনে হয়। আলগোছে
নেবেন কুড়িয়ে তিনি ফিরোজা তসবি
একটু পরেই-
কখন যে মদির গোলাপি বানারসী হয়ে যায়
পশ্চিম আকাশ আর তিনি
আছেন দাঁড়িয়ে
একাকিনী; প্রতীক্ষার কাতর প্রতিমা।
বিউটি বোর্ডিং
আজকাল কোনো কোনো বিকেলে হঠাৎ কী রকম
হয়ে যাই, কী রকম এলোমেলো, যেন
আমার ভেতরে
কালবৈশাখীর মাতলামি, ভুলে যাই ইদানীং
আমার মাথার তিন ভাগ চুলে সাদার পোচড়া
পড়েছে, চোখের আলো বিকেলবেলার
মতোই স্তিমিত। বাসনার স্বপ্ন-ধোওয়া চরে নামে
আচাভুয়া পাখি, মাটি খুঁড়ে বের করে প্রত্ন হরেক রকম।
মনে পড়ে, একদা যেতাম
প্রত্যহ দু’বেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই
বিউটি বোর্ডিং-এ পরস্পর মুখ দেখার আশায়
আমরা ক’জন,
তখন তুমুল সময়কে
দিয়েছি গড়িয়ে স্রেফ চায়ের বাটিতে,
কখনো জ্বলন্ত পুণ্য ঝোপের মতন
মাথা আর জঠররাগ্নি নিয়ে
পড়েছি কবিতা শাপভ্রষ্ট দেবতার স্বরে। কখনও জুটেছে
ফুল চন্দনের ঘ্রাণ, কখনোবা হুল বেশুমার।
কোনো কোনো দিন ডাকে এলে দূর কলকাতা থেকে
বুদ্ধদের বসুর ‘কবিতা’ আমাদের চকচকে
চোখগুলি পড়ত হুমড়ি খেয়ে স্মল পাইকার
নান্দিনিক ভিড়ে আর স্পন্দিত হৃদয়ে দেখতাম কার কার
কবিতা পেয়েছে ঠাঁই কিংবা কার পদ্য
স্বর্গচ্যুত হলো সদ্য-পাওয়া সেই স্বপ্নিল সংখ্যায়।
কাউন্টারে শ্রীযুক্ত প্রহ্লাদ তার একটি খোটো পা
দোলাতেন মৃদু স্বরবৃত্তের মতন, লিখতেন
কালো বেঁটে কলমে লম্বাটে
খাতায় হিসাব আর আমরা কানি বকের ছানার মতো
চায়ের পেয়ালা সামনে রেখে
উঠতাম মেতে
পাউন্ড স্পেংলার টোয়েনবি, মার্বস, উত্তর-রৈবিক
কবিতার দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে প্রত্যাগত
নাবিকের ধরনে এবং আমাদের
কত যে হাসির আলো মিশে গেছে গোধূলির বিনম্র আভায়।
একদিন হঠাৎ সকাল দশটায় শুনি বিউটির গৌর,
যুবক বেয়ারা, যৌন রোগী, ঝুলেছে ফাঁসিতে কাল মধ্যরাতে।
কতকাল যাই না সেখানে আর বিউটি বোর্ডিং-এ।
সেখানে যেতাম যারা আড্ডার সুরায়
চুর হতে, তারা কবে ছিটকে পড়েছে দশর্দিকে,
যেন ভালুকের থাবা
হঠাৎ ফেলেছে ভেঙে তন্ময় মৌচাক। আমি আর
দুরু দুরু বুকে
ঈষৎ কম্পিত হাতে সদ্যলেখা কবিতা কারুকে শোনাই না,
বরং নিজেই শুনি কোনো কোনো তরুণ কবির
আবেগার্ত পদাবলি কখনো-সখনো;
মহিলা কলেজে-পড়া তরুণীর সঙ্গে স্মিত হেসে
কথা বলি, অটোগ্রাফ খাতায় কলের
পুতুলের মতো সই দিই বিয়ে বাড়িতে অথবা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। হয়তো কেউ কেউ
আমার আড়ালে-আবডালে বলে ফিসফিসে স্বরে
‘ভদ্রলোকে তেমন যুবক নেই আর’।
যারা কথা ভেবে ভেবে একদা আমিও নীল প্যাডে
করেছি উজার থরথর
হৃদয় আমার আজ তাকে ভাবি ভাবলেশহীন,
দৈবক্রমে দেখা হলে তার পুত্র-কন্যার মাথায়
আদর ঝরাতে পারি অবলীলাক্রমে
ওদের পিতার কোনো সুহৃদের মতো।
ক্যান্সারের মতো দ্রুত বর্ধমান বয়স আমার।
কতকাল, কত দীর্ঘকাল
বিউটি বোর্ডিং থেকে নির্বাসিত আমি। কোনো দিন
আবার সেখানে ছুটে যেতে পারব কি
আষাঢ়ের বৃষ্টি-আঁচড়ানো অপরাহ্নে কিংবা কোনো
গনগনে ভাদ্রের দুপুরে? যাই যাই
কোনো কোজাগরী পূর্ণিমায়,
করোটির মতো সেই বিউটি বোর্ডিং-এ,
কৈশোরে আঁধারে ভূত দেখার মতন
ভয়ানক ভয় পাব আমি?
বুঝলে হে জগন্নাথ
হুম, বুঝলে হে জগন্নাথ,
আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ থেকে
তোমাকে কিছুই আর করতে হবে না। না, হঠাৎ
খেয়ালের বশে কিছু করিনি, অনেক ভেবেচিন্তে, নকশা এঁকে,
যাকে বলে সর্বসম্মতিক্রমে এই হলো, দেনা
শোধের বালাই নেই, ধার-
তা-ও আর বুঝলে হে জগন্নাথ, করতে হবে না।
এতে যদি কেউ বলে ফেলে তোমার মাথায় বাজ
পড়েছে, তাহলে বড্ড বাড়াবাড়ি হবে। সবই ফাঁকি, ফক্কিকার।
কী বললে? আপন হাতই জগন্নাথ? ছেঁদো কথা, ওসব চলে না
আর আজকাল।
নিজ চোখে দেখছ না এই জমানার হালচাল?
তোমার হাতের কাজ বন্ধ হলো বটে, তবে চোখ
দুটো তো আছেই, তুমি চেনা
সেই উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির মতো শুধু চেয়ে চেয়ে
দেখবে, অন্যেরা সবকিছু করবে সকল ঋতুতে। যার ঝোঁক
রয়েছে যে-দিকে সেদিকেই যাবে দড়িবাঁধা রথ, তুমি মুখ
খুলবে, সে-পথ খোলা রাখিনি, বরং চুপচাপ খেয়ে দেয়ে
যাতে দিন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারো, সুখ
চেখে তৃপ্ত হতে পারো, ব্যবস্থা নিয়েছি, অর্থাৎ যা যা পেতে
তা-ই পাবে অবিকল, এ ব্যাপারে পান থেকে চুন
খসবে না। ভাগ্যিস তোমাকে ঠা ঠা রোদে পুড়ে ক্ষেতে
লাঙল ঠেলতে বলা হয়নি, অথবা উঁচুনিচু পথে টেনে নিতে গুণ।
তাই বলি, অভিমানে মুখ অন্ধকার করে পথের কিনারে
একা বসে থেকো না, নিজের কর্মফল
ভেবে মেনে নাও সব। তোমাকে ভাগাড়ে
আমরা দিয়েছি ছুড়ে, এমন নাহক অভিযোগ
আমাদের পরম শক্রও করবে না। আর ধর্মের কল
বাতাসে নড়ে না ইদানীং; উপরন্তু বাঘের ঘরেই ঘোগ
বাসা বাঁধে, এসবও তামাদি হয়ে গেছে বহুদিন।
এভাবে তাকাচ্ছে কেন? তোমার হাতের স্রেফ দুটো,
বুঝলে হে জগন্নাথ, কব্জি কেটে ঠাঁটো
বানিয়েছি বৈ তো নয়। মিছেমিছি মুখ তুমি করো না মলিন।
বেলা পড়ে আসে
সকালের খবর কাগজে পড়ি কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ অক্ষর
এবং একটা ফটোগ্রাফ দেখি প্রথম পাতায়।
সেই সব অক্ষরের অভ্যন্তর থেকে
এক ঝাঁক প্রজাপতি, মাছরাঙা, পুকুর পারের হাঁস আর
জলপিপি, সোনালি নূপুর,
অনেক পুরানো হলদে পাণ্ডুলিপি উড়ে
এসে বসে ছাদের কার্নিশে। বেদনার বনস্থলী
দৃশ্যত নিউজপ্রিন্টে ফুটে ওঠে চলিত ভাষায়।
তাঁকে চিনতাম, বলা যায়; তাঁর কীর্তিমালা ছিল
পরিচিত আমার নিকট,
সংক্ষিপ্ত জীবনী তাঁর জেনেছি নানান সূত্রে; কবি
ছিলেন, যদিও কাব্যলক্ষ্মী
অনেক আগেই তাঁকে নথের ঝামটা মেরে তাঁর
ভিটে ছেড়ে চলে যান। পরিত্যক্ত কেয়ুরের দিকে
কখনো কখনো তাকাতেন প্রেরণারহিত কবি বড় নীল
কুয়াশা-জড়ানো চোখে পড়ন্ত বেলায়।
মেজাজে চৈত্রের দাহ ছিল তাঁর, কেউ কেউ তাঁকে
দুর্বাসা বানিয়ে ভারি মজা পেত এবং রটাত
কেউ স্বাদ, আড্ডায়, সালুনে নুন কিছু কম হ’লে তিনি নাকি
রাঁধুনিকে করতেন তিরস্কার চার ঘণ্টা, সজারুর মতো
কাঁটা খাড়া করে উঠতেন মেতে যুক্তিতর্কে গল্পে। শোনা যায়,
ঢেঁড়স, গাজর, বীট, ফুলকপি, পালঙ ফলাতে গিয়ে তিনি
গোলাপ, টগর, জুঁই, রজনীগন্ধার প্রতি খুব
অবহেলা করেছেন অনেক ঋতুতে।
প্রাণবন্ত যৌবনের গোলদীঘিটির চতুর্দিকে
ঘুরেছেন তিনি যতবার,
ততবারই একটি পাকুড় গাছ তাঁকে দিয়েছে নির্দেশ
দীঘিতে গোসল সেরে মধ্যাহ্ন ভোজের জন্যে যেতে
রহস্যের নিবাসে যেখানে কেউ থালা
সাজিয়ে রয়েছে ব’সে হাতপাখা নিয়ে;
মাধুর্যের প্রতি নয়, রুক্ষতার পঞ্চ ব্যঞ্জনের
প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেড়েছে নিয়ত।
যতদূর জানি,
শেষ অব্দি বাজত শরীরে তাঁর ঝিঁ ঝিঁ ডাকের মতো এক
শাক্ত ভাব, আশৈশব ভালোবাসতেন
দূর-থেকে-ভেসে-আসা ঘণ্টাধ্বনি, যার
কথা আছে তাঁর এপিটাফে। চরাচরে
একটি সোনালি ঘণ্টা বাজে শব্দহীন, কেবলি রাজতে থাকে
বুকের ভেতর, রেকাবিতে
শিউলি বিষণ্নতায় ম্লান হয় প্রহরে প্রহরে।
না-খোলা একটি চিঠি, আধপড়া কবিতার বই
লেখার টেবিল পড়ে আছে; শেষ লেখা
ডায়েরির নিভৃত পাতায় ফ্যালে দীর্ঘশ্বাস, ঘরে
যেন গজিয়েছে বন অকস্মাৎ, তাঁর
ফটোগ্রাফে প্রজাপতি কী নির্ভার সময় পোহায়। এরপর
কখনো লেখার ফাঁকে চা জুড়াবে বলে
কেউ তাড়া দেবে না; এখন ঘরে হেমন্তের বেলা পড়ে আসে,
বেলা পড়ে আসে বৃদ্ধ কবির নমিত জানাজায়।
ভোরের কাগজ
প্রত্যহ হকার এসে ভোরের কাগজ দিয়ে যায়।
কখনো কখনো
লোকটাকে দেখি একটানা কিছুদিন
সাইকেলে আসে,
আবার এমনও হয়, বহুদিন তার সঙ্গে দেখা
হয় না আমার আর কখনো কাগজ
দিতে দেরি করে যদি আমি হেঁটে গিয়ে কিনে আনি
স্টল থেকে। হকারের প্রতি বিরূপতা
মাঝে-মাঝে মাথা তোলে, কিন্তু ঝরে যায়
মাথার খুশকির মতো পুনরায়; ফলত এখনও
সে আমার দরজায় কড়া নেড়ে ভোরের কাগজ
বিলি করে রোজ।
এ-ও এক ভীষণ নাছোড় নেশা, মদ্যপের মতো
হয়ে যাই প্রত্যহ সকালে,
বিশ্ব পান করে
আখেরে কিছুটা স্বস্তি জোটে, শান্তি যদিও এখনও
গৃহত্যাগী পুত্রের ধরনে ঘোরে বিয়াবানে আর
প্রতিধ্বনিময় কত পর্বতগুহায়।
নিউজপ্রিন্টের বুক থেকে হেডলাইন সমেত
সকল খবর লুপ্ত, দেখি সারা পাতা জুড়ে খুব
জ্বলজ্বলে পতাকার মতো
ফেদেরিকা লোরকার রক্তাক্ত শরীর
সময় পোহায়। জীবনানন্দের হাতে গূঢ় পাণ্ডুলিপি
কিছু শঙ্খচিল হয়ে ঝরায় নীলাভ আচ্ছন্নতা,
কখনো আবার নক্ষত্রেরা চাঁদকে স্যালুট করে
কুচকাওয়াজের ঢঙে, নালন্দার প্রকোষ্ঠে একাকী
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান আছেন ব’সে, চোখে তাঁর স্বপ্ন বুনে যায়
কার হাত, কখনোবা তাজিকস্তানের সুন্দরীর
কংকাল গোলাপ ফুটে থাকে বেশুমার, করোটির চক্ষুহীন
কোটরে ঝরায় গজলের অস্তরাগময় সুর
বিগত-যৌবন বুলবুল।
কখনো নজরে পড়ে নিউজপ্রিন্টের বুকে শামুক কুড়ায়
দেহাতি বালক আর বাদামি গোরুর শিঙে কাঁপে
স্বপ্নঝালরের মতো প্রজাপতি আর
রাত দেড়টায় হুড-ঢাকা রিকশায়
একটি অসুস্থ গোলাপের মতো অনিদ্র গণিকা পাক খায়
শহরের পথে পথে। কখনো আবার চোখে পড়ে
আমার না-লেখা
বেবাক অনিন্দ্য কবিতার পঙ্ক্তিমালা,
কিন্তু পরমুহূর্তেই ভুলে যাই শব্দাবলি, ছন্দ দোলা। তারপর
কী আশ্চর্য, ভোরের কাগজে দেখি, একি
দেবশ্রী লাইনো টাইপের অক্ষরের পরিবর্তে দশদিকে
ছড়ানো ছেটানো তপ্ত সিসের খইয়ের মতো অজস্র বুলেট।
মোমবাতি
কখনো কখনো এরকম হয়, দেরাজ, কুলুঙ্গি
খুঁজে পেতে
একটি ডাগর মোমবাতি
বের করি, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে
পোড়াই সলতে তার, রাখি
লেখার টেবিলে কিংবা মোমবাতিটিকে
যেনবা সোহাগ ভরে হাতে নিয়ে করি
এঘর ও-ঘর, মাঝে মাঝে
বিচ্ছুরিত আলো দেখি একাগ্র দৃষ্টিতে,
যেমন রবীন্দ্রনাথ দেখতেন দিনের প্রথম আলোধারা।
মোমবাতি তপ্ত পানি ফেলে ফোঁটা ফোঁটা,
হাতে পড়লে হাত দ্রুত
সরিয়ে জমাট মোম ঘষে তুলে
ফেলে হাত বুলোই খানিক ছ্যাঁকা-খাওয়ার জায়গাটায়। কখনোবা
টপ-টপ-করে-পড়া জ্বলের আড়ালে
কস্মিনকালেও
না-দেখা তাতার সুন্দরীর অশ্রুপাত লক্ষ্য করে
বড়ই উদাস হই। ঝড়
বইতে থাকে বুকের ভেতর, সেই রোরুদ্যমানা, এলোকেশী
সুন্দরীর কথা ভেবে বড় কষ্ট পাই।
লোডশেডিং-এর ফলে মোমবাতি মহার্ঘ এখন,
তবু কিনি নিয়মিত; অন্ধকারে মোমবাতি জ্বেলে চুপচাপ
বসে থাকা ঘরে,
শিখাটির দিকে অপলক চেয়ে-থাকা
কিছুক্ষণ, অথবা সিঁড়িতে, বারান্দায়, কম্পমান
আলোর সংসর্গে ঘোড়া গথিক উপন্যাসের কোনো
চরিত্রের মতো, ভালো লাগে। ভালো কোনো
মোমবাতি-প্রসূত আলোয়
গহন প্রহরে কবিতাকে ডেকে আনা, কবিতায়
তাকেই আবৃত্তি করা, যাকে ঈষৎ ভুলেছি সময়ের ধোপে।
লোকে তার কথা বলে
লোকে তার কথা বলাবলি করে,
গ্রামে ও শহরে।
শোনা যায়, লোকালয়ে থেকে বহুদূরে নদীতীরে
এবং পাহাড়ে বন-বনান্তরে ঘুরে ঘুরে সে এসেছে ফিরে
আপন নিবাসে। ভেবেছিল নির্জনতা
শান্তি দেবে তাকে, লতা-
গুল্ম, নদী, পাখি, পাহাড়ের চূড়া তার সত্তা থেকে
ফেলবে গ্লানির কালি মুছে, দেবে ঢেকে
খানাখন্দ আহত মনের। মানুষের আচরণ, বলা যায়,
বড় বেশি ক্লান্ত করেছিল তাকে, তাই অসহায়
ব্যক্তির ধরনে
করেছে সে পর্যটন জনহীন মাঠে আর বনে।
আখেরে ভেঙেছে তার ভুল।
এবং সবাই দ্যাখে সে এখন লোকালয়ে ফুল
তোলে, কেনাকাটা করে দোকানে এবং ঝকঝকে
সেলুনের ছাঁটায় চুল, রকে
আড্ডায় শামিল হয়, বলে
নানা কথা বস্তুত সেসব কথা সঙ্গীদের কানের বদলে
মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। কারো কারো হাত
অকস্মাৎ
হয়ে ওঠে অতিশয় ঝোড়ো দাঙ্গাবাজ।
ফলত সে আজ
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, হয় না বিমুখ
তবু মানুষের প্রতি। ভাবে ভুলচুক
এই মর্ত্যবাসীদেরই হয়
আর ব্যান্ডেজের ঘেরাটোপ থেকে তার চক্ষুদ্বয়
স্বপ্নের মতোই জেগে থাকে, জ্বলজ্বলে। মাঝে-মাঝে গল্পচ্ছলে
শহরে ও গ্রামে লোকে তার কথা বলে।
স্বপ্ন অভিভাবকের মতো
স্বপ্ন অভিভাবকের মতো আমার জীবনে তার
নিয়ন্ত্রণ রাখে প্রায় সকল ঋতুতে। হেঁটে যাই
অন্ধকারে, আদিম জলের গান শুনি, স্তব্ধতার
বুক-চেরা, পাথরের নানান গড়ন দেখে চোখ
শিল্পী হয় এবং পাথরে বসে গাঢ় স্পর্শ পাই
আত্মীয়ের, মনে পড়ে দূর কথা, ভুলি শত শোক।
স্বপ্নের ভেতর থেকে উঠে এসে কে আমাকে ডাকে
ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে? সুপ্রাচীন লতাগুল্ম ঢাকা
অবয়ব তার, ধু-ধু মাঠে, পাহাড়ে নদীর বাঁকে
কিংবা কোনো লোকালয়ে কখনো দেখিনি তাকে। মনে
হয়, ছিল বুঝি তার পরনে বিবর্ণ আংরাখা,
হয়তো তার সঙ্গে হয়েছিল দেখা অখ্যাত স্টেশনে।
এমনও তো হয় বসে আছি দপ্তরের কামরায়
বড় একা, স্মৃতিক্লান্ত-হঠাৎ কে একজন এসে
ঢুকে পড়ে এত্তেলাবিহীন আর দু’হাত বাড়ায়
সোজাসুজি আমার দিকেই, কী-যে বলে অনুরাগে
বুঝি না কিছুই, চেয়ে থাকি অপলক, স্বপ্নাবেশে
ভাবি, গনিষ্ঠতা ছিল বুঝি অনেক শতাব্দি আগে।
আমি কি নিদ্রার আকর্ষণে দপ্তরের ভেতরে দপ্তরে
নিভৃতে গিয়েছি চলে? স্বপ্নের গহন পথ বেয়ে
এসেছিল সে কি তবে এ ধূসর ঘরে স্তরে স্তরে
পদচ্ছাপ রেখে, প্রাণে জাগিয়ে অতীত শিহরণ?
প্রত্যহ যা দেখি তাতে কী সুদূর মায়া আসে ছেয়ে
আজও জানি না তো নিদ্রা কাকে বলে, কাকে জাগরণ?