পুরানো শহর
পুরানো শহরে আমি বস্তুত যাই না বহুদিন।
মনে পড়ে, একদা ছিলাম প্রাচীনতা ভালোবেসে
সেখানে; অজস্র বর্ষা ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেছে কত
অসমাপ্ত কবিতার মতো কথা ও কাহিনী, চিল
কেটেছে চক্কর আসমানে, রুগ্ন বালকের চোখে
বিচিত্র আল্পনা এঁকে; আজও ছন্নছাড়া গলি ঘুঁজি
স্বপ্নের ভেতর খুঁজি। দ্বিপ্রহরে অথবা বিকেলে,
রাত্তিরে আমার ডাক নাম ধ’রে ডাকে লুপ্ত মাঠ।
পুরানো গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে শৈশব অভিমানে
মুখ ভার করে থাকে; চৈত্র সংক্রান্তির কাটা ঘুড়ি
ভেসে ভেসে যায়, তবু ছোটে না পেছনে। বাতি-অলা
দেয় হাতছানি, চলে যায় গায়ে বিষন্নতা মেখে;
তোবড়ানো গালের বয়েসী শিল্পী ধুকছে যক্ষ্মায়,
মধ্যরাতে আর্ত কণ্ঠ ডেকে যায় কৈশোর, যৌবন।
৮।৪।৯১
প্রত্যাখ্যাত
এখন এখানে কেউ চেনে না আমাকে। দূর প্রান্তে প’ড়ে আছি
পালকের গৌরববিহীন ঈগলের মতো একা; যে সেতারে
প্রত্যহ উঠত বেজে রঙধনু, রৌদ্র-জ্যোৎস্না, স্বপ্ন সমুদয়,
তাকে স্পন্দনের দ্যুতি নেই। ভূলুণ্ঠিত,
আরশোলা নিত্যদিন। মাঝে-মধ্যে আমার ক্ষণিক
দৃষ্টিপাত, নিদ্রাতুর; চোখ
ফেটে পানি; বুকজোড়া হু হু দীর্ঘশ্বাস।
একদা মাথায় হাত রেখেছেন অনিন্দ্য ফেরেশ্তাগণ স্নেহে,
আজ তারা কোথায় উধাও? কী আমার
অপরাধ? কেন রুক্ষ আক্রোশে তিমিরে ছুঁড়ে ফেলে
আমার পরীক্ষা নিতে দিলেন গা’ ঢাকা
মেঘ-বাগিচায়? হায়, তবে কি নিষ্ঠুর,
আফলা জমিনে
ফসলের যৌবন আনার ব্রত এখন আমার? জলধারা
নেই, বুঝি তাই দিনরাত্রি এই শোণিত সিঞ্চন।
বর্বরের হুঙ্কারে, দাপটে ওষ্ঠাগত প্রাণ, প্রিয়
সুহৃদেরা বহুদূরে। বাচাল বৃদ্ধের
তিরস্কার জোটে নিয়মিত; স্বেচ্ছাচারী তরুণেরা
দেবে অর্ঘ অকাতরে, করি না প্রত্যাশা। আত্মলোপী
ঈগলের আচরণে নিভৃত চূড়ায়
আমৃত্যু থাকতে হবে নৈঃসঙ্গ্যের হিমেল ঝাপটে;
বেলাশেষে এই দন্ড সহজে নিয়েছি মেনে; রূঢ়
প্রত্যাখ্যানে অচঞ্চল, বিনম্র বিবাগী।
১২।১।৯১
বউ
বয়স ক্রমশ বাড়ে, বাড়তে থাকে মেঘে মেঘে, নানা
ঘাটে পদচ্ছাপ রেখে এই আনাগোনা। মুছে যাবে,
তবু দেখে নিই বার বার, সহজে কাটে না মায়া।
যেতে হবে, সকলেই যায়; তাড়াহুড়ো ক’রে যেতে
মন নয় রাজি, গোছাবার কত কিছু আছে বাকি।
প্রেমিকার কাছে যাই কখনও সখনও, নিরুপায়
দেখি তার নিরুত্তাপ অবহেলা। খেলাচ্ছলে বলে
মাঝে মাঝে-ইদানীং পদ্য টদ্য লিখি কি না, যেন
কোনও শ্রমনিষ্ঠ জেলে জালে তার মাছ টেনে তুললো,
না কি হা-পিত্যের ক’রে কাটে তার বেল। ধূলিম্লান
শরীর ক্লান্তির চাপ স’য়ে যায়, মন বড় জেদী,
তাকে ‘বউ’ ডাকে অন্তর্গত সবুজের টানে।
৫।১১।৯১
বাংলা শব্দতত্ত্ব
ভোরবেলা আমার প্রসন্নতার সঙ্গী
রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’, কিছুক্ষনের মধ্যেই
বই ঘরময় পাখির কণ্ঠস্বর,
ঘরের চতুঃসীমায় সুরের সোনালি পাড়
আর সুরের ভাঁজে ভাঁজে
বাংলা শব্দের রহস্য তন্বীর মতো
দেয় গড়াগড়ি। আমার সত্তায় হঠাৎ
মার্কোপোলের জাগরণ।
একেকটি বাংলা শব্দ আমাকে কী এক সম্মোহনে
কখনো অকূল সমুদ্রে,
কখনো দুর্গম অরণ্যে, কখনো মরুভূমি,
কখনো-বা মেরু প্রদেশের তুষার ঝড়ে আহ্বান করে আবার সেই আহ্বান
বিশাল জলচর প্রাণীর পিঠের মতো
পদ্মার চরে অথবা বিবাদরহিত মাছের গন্ধ লেপ্টে-থাকা
জেলেপাড়ায়, ঢাকার ঘিঞ্জি বস্তিতে
মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধ নোঙর-করা জাহাজের মতো কলোনীতে
আমার আমন্ত্রণের রেশমি নিশান।
যখন অভিভুত আওড়াই আনন্দ, আমার দৃষ্টিকে
আপ্লুত ক’রে উদ্ভাসিত
এক মধ্যবিত্ত ঘর, যেখানে ভর দুপুরে
আয়নার সামনে আঁচড়াও তুমি দীর্ঘ চুল,
গান গাও গুনগুনিয়ে;
সেই মুহুর্তে ইলিশের চকচকে মিছিল
ডাগর নদীতে কম্পমান ঝালর,
প্রজাপতির পিছনে
ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি।
যখন আমার নিঃশ্বাস সুন্দরের
ধ্বনির ধারক, মনে পড়ে
বারান্দায় তোমার দাঁড়ানো, হাতের রুলিতে
বিকেলের স্তব্ধ অসীমতা এবং
স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর মুখোশ-খশানো মিছিলে
অগনিত মুখ, শাড়ির আঁচল আর মুষ্টিবদ্ধ হাত।
যখন বিশালতা আমার ওষ্ঠে দপ দপ করে,
বাংলাদেশ সন্তান-হারা প্রসূতির মতো বুক খুলে
দেখায় আমাকে, আমি দু’চোখ ঢেকে ফেলি
আবহমানকালের অসংখ্য কাটা মুন্ডুসমেত রক্তপ্রবাহ দেখে।
চোখ খুলে দেখি, রবীন্দ্রনাথ
আমার হাত থেকে তুলে নিচ্ছেন ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’
এবং তাঁর সৌম্য হাতে একরাশ ফুল;
পুস্পগুচ্ছ শান্তিনিকেতনের না শহীদ মিনারের
ঠাহর করতে পারিনি।
শব্দের কাঙাল আমি, অন্ধের মতো আমার পথ হাতড়ানো।
২৫।১১।৯০
ব্যাজস্তুতি
একবার যে শোনে প্রকৃত গান, ভেসে যায় সুরে
সুরে দূর থেকে দূরে, তার জন্যে নয় স্বাভাবিক
জীবন যাপন আর কোথাও বেসুরো কিছু শোনা
দুঃসহ যন্ত্রণাময়, ভীষণ বেখাপ্পা লাগে সব।
সে কবে ছেড়েছি ঘর সুরের অমিত আকর্ষণে,
বর্ষণে অথবা খরতাপে, শীতে ও বসন্তে ঘুরে
ঘুরে বেলা গেছে, আনন্দে বিষাদে পৌঁছে গেছি ঠিক
প্রায় অস্ত গোধূলিতে, তবু কেন ব্যাকুলতা যাপি?
শুধু শোনা নয়, সুর সৃজনের দায় নিয়ে স্তব
করেছি অদৃশ্য আর অশ্রুতের; রহস্যের ঝাঁপি
খুলে লহমায় সর্পমণি দেখে নিয়ে তপোবনে
হেঁটে গেছি একা-একা, মরুধূলি মেখেছি আত্মায়।
এই পথে পড়ে চামেলীর ট্রাকপিষ্ট শব
কেমন বে-আব্রু, হায়। তবু রাধাচূড়া হাসে, মাপি
সঙ্গোপনে তার আহলাদের বহর এবং মনে
বেদনা লুকিয়ে নিরপেক্ষ চাঁদ মেঘে ডুবে যায়।
আমাকে খোঁজে না কেউ আর। লোকটার অন্তঃপুরে
কী কী ঘটে, সে কি অর্ধাহারে থাকে, না কি দিগ্ধিদিক
জ্ঞানশূন্য? পথ্য পায় ঠিকঠাক? সে কি আনাগোনা
করে চির দুঃখীরূপে? এ বিষয়ে সবাই নীরব।
জলকন্যাদের স্বপ্ন দেখি উপদ্রুত এলাকায়;
আমি কি ত্রাণের দ্রব্য চেয়ে নেব ভিক্ষুকের বেশে
দাতা দেবদূতদের কাছে? বিকৃতমস্তিষ্ক সাঁঝ
নামে আর জেগে ওঠে শবাহারী দুঃস্বপ্নের বন।
সর্বস্ব উড়িয়ে দিয়ে প্রখর হাওয়ায় অবেলায়
আকাশ, প্রান্তর, নদী আমাতেই করেছি ধারণ
অগোচরে, অথচ শাকান্ন সংগ্রহের আলোড়ন
গৌণ কাজে লিপ্ত রাখে, দুর্ভাবনা নিত্যসঙ্গী আজ।
আমি কি নিভন্ত খুব? নইলে কেন অতিশয় ক্লেশে
ধোঁয়াচ্ছে জীবন? এখনও তো সাধ হয় অকারণ
গান হ’য়ে জ্বলে উঠে। গলায় সুরের কারুকাজ
লুপ্ত বহুদিন; অপমানে দগ্ধ চলে যাব শেষে?
১২।৬।৯১