তার আসতে-থাকা
প্রত্যুষে নীড়াশ্রয়ী পাখির ডানায়
শস্যদানার মতো ঘুম ভানার উপর দিয়ে
আলোর উন্মীলনের মধ্য দিয়ে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
নিঃশব্দতার বেড়ি ছুঁড়ে ফেলে
ট্রাফিকের কর্কশতায়্য পা ডুবিয়ে
ভর দুপুরে পথচারীর এক বুক তৃষ্ণায় ঢেউ তুলে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
পাতার মর্মর ধ্বনিকে সঙ্গী ক’রে
অপরাহ্নের আয়েশী রোদের মসলিনে পা ফেলে
কোকিলের গান-চিহ্নিত পথে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
এক নাগাড়ে আপন সৌন্দর্য বলয়ে ঘুরে ঘুরে
সন্ধ্যার সীমানায় নিজেকে ঝংকৃত ক’রে
জোনাকির মালা গলায়
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা
নিঃসঙ্গতার পিঠে সওয়ার হয়ে
কত ছায়ার ফিসফিসানি গায়ে মেখে
আমার নিদ্রাহীনতাকে মন্থিত শিহরিত করে
সেই কবে থেকে তার আসতে-থাকা।
২৩।১০।৯০
দুই বুড়ো
একজন জেদী বুড়ো অন্য এক বুড়োকে বিছানা
থেকে টেনে তুলে
বলে, ‘চল যাই, এই বিকেলের রঙ
মগজের অভ্যন্তরভাগে
ভ’রে নিয়ে আসি, চল যেখানে যুবক যুবতীরা
গল্প ক’রে, তর্ক ক’রে ভালবেসে সময় কাটিয়ে
দেয়, আজ সেখানেই যাই। তবু তাকে আলসেমি,
অবসাদ ধ’রে রাখে ঘরে।
‘শোনো বন্ধু,’ চটপটে বুড়ো অন্য বুড়োটিকে
বলে অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বরে, ‘বসো গিয়ে
লেখার টেবিলে
এখনই, নচেৎ কবিতার ছুটিষ্কাল কাটবে না
কস্মিকালেও, দেখছ না
বাঁধানো খাতার সাদা পাতাগুলি খরা
পীড়িত চোখের মতো তাকিয়ে রয়েছে
প্রতীক্ষায়, না হয় লিখেই ফেলো চিঠি দয়িতার কাছে।
‘কে দয়িত? কে আমাকে তার যৌবনের
সরোবরে ডুব দিতে দেবে
অবেলায়? কে আছে এমন এ শহরে
বৃদ্ধের চুম্বন আর আলিঙ্গনে পাবে সুখ, আমার ভেতরে
জাগিয়ে তুলবে যুবককে?’ অবসাদগ্রস্ত বুড়ো
নিশ্চুপ ঝিমোয় নিশ্চেতন অন্ধকারে, ডোবে মৃত্যু ভাবনায়। জেদী বুড়ো
প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে সুহৃদকে নিজেই বৃদ্ধের
ভেতরে প্রবেশ করে। পাতা ফুঁড়ে আদিম কোকিল স্বতঃষ্ফুর্ত ডেকে ওঠে।
দুপুরে ব’সে
দুপুরে আছেন ব’সে শিমূলের ডালে একজন
পাখি আলেমের মতো। মনে হয়, এখনই ওয়াজ
করবেন শুরু স্মিত কণ্ঠস্বরে। তার সে আওয়াজ
বুঝিবা গচ্ছিত কল্যাণের জন্য; চকিতে বিজন
পথ স্নাত সুরে আর দুপুরের জরির বসন
ঝলমলে, কম্পমান। দশদিক কী মোহন সাজ
পরে, পান্থ কবি চমৎকৃত নৈসর্গিক কারুকাজ
দেখে; শূন্যতায় কবিতার বীজ করেন রোপণ।
একদিন মৌতের গুহায় তাকে চ’লে যেতে হবে
অনিচ্ছায়; প্রতিধ্বনি, মেঘের নেকাবে-ঢাকা চাঁদ,
বান্ধবীর মেধাবিনী চক্ষুদ্বয়, হ্লদের আহ্লাদ
ক্রমশ বাজতে-থাকা টেলিফোন, বারান্দার টবে
প্রষ্ফুটিত গোলাপ-কিছুই পারবে না আটকাতে,
অসিত ডানায় ঢেকে মৌত পৌঁছে দেবে আখেরাতে।
৩০।৪।৯০
দ্রাক্ষাবন
বেশতো এখন ঘরে গেরস্থালি নিয়ে আছ, আছ
ভিতর মহলে নিয়ে গুপ্তধন, দ্রাক্ষাবন। বেলা
যায় নানা তুচ্ছতায়, মাঝে-মাঝে পেকে ওঠে কোনো
নিটোল আঙুর, রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে খুব
নিরালায়; খিটিমিটি, বিসম্বাদ, আপদ বিপদ
তোমাকে সরিয়ে রাখে দ্রাক্ষাবন থেকে। এভাবেই
দ্বৈরথের মুখোমুখি। পোকা গুচ্ছ গুচ্ছ ফল কুরে
কুরে খায়, বুঝি তাই বিষাদের ছায়ায় ঘুমাও।
জাগরণে পৃথিবীকে তোমার নিকট কী রকম
মনে হয়? মৃত্যু নয়, জীবনেরই আকর্ষণে সব
বাধার পাথর কেটে হেঁটে যাও দ্রাক্ষাবনে একা।
বেশিদিন দেখব না তোমাকে এবং জানব না
আমার মৃত্যুর পরে কী হবে তোমার; আঙুরের
ফলন সবার বন্দনীয় হবে কিনা, জানব না।
১৬।২।৯১
ধ্বংসের কিনারে ব’সে
(১)
সূর্য, দেবতার মুকুটের মতো সূর্য, তুমি কেন
আজও তুল্লে মাথা, হায়, অন্ধকারে, হে মঙ্গলময়?
তুমি কি পাওনি লজ্জা এতটুকু এই দৃশ্যাবলি
দেখে, কেন চোখ অন্ধ হলো না তোমার? উপকূলে
প’ড়ে-থাকা রমণীর মৃত স্তনে তোমার সোনালি
চুম্বন দিয়েছ এঁকে কামুকের মতো দ্বিধাহীন;
দুধের বাচ্চার বুকে পারলে না জাগাতে স্পন্দন
জীবনের; কেন তুমি ফুঁসে-ওঠা বঙ্গোপসাগর থেকে সব
জল শুয়ে নাওনি সে রাতে সীমাহীন তীব্রতায়?
কোনও কথা না ব’লেই রক্তরঙ পাথর খন্ডের
ধরনে আবার ডুবে গেলে ভয়ঙ্কর হন্তারক
সমুদ্রের গর্ভ জলে। এ কেমন আত্মসমর্পন?
তাহ’লে কী ক’রে ব’লো আমার হৃদয়ে উঠবে জেগে
সূর্যস্তোর ধ্বংসের কিনারে ব’সে বিচূর্ণ বেলায়?
(২)
এই দেখ কে যেন জটায় বেঁধে সমুদ্রকে আজ
জলঢোঁড়া বানিয়ে রেখেছে, অগণিত চোখ মুখ
থেকে মুছে গেছে লোনা পানির হুষ্কার। জলরাশি
পারেনি ছিনিয়ে নিতে সপ্তর্ষিমন্ডল, জেলেদের
ডিঙি নাচে ঢেউয়ের চূড়ায় পুনরায়, বালকেরা
এক্কা দোক্কা খেলে আর সূর্যাস্তের কণা চতুর্দিকে
ছড়িয়ে দিগন্ত থেকে হাঁস নামে গৃহীর উঠোনে,
ন্যাংটো শিশু দাওয়া ছেড়ে ধাওয়া করে হাঁসের পংক্তিকে;
শিস দিতে দিতে গোধূলিতে হেঁটে যায় একা একা
উপকূলে স্বাস্থ্যবান, সাহসী যুবক, অন্তরালে
জাদু-বাস্তবতা-টানে দয়িতার খোঁপায় পরায়
হৃদয় রঙের ফুল। কৃষকের বুকে ধানচারা
গান হ’য়ে ধায় সমুদ্রের দিকে, জননী কিশোরী
মেয়েটিকে ডেকে বলে, ‘আয়, তোর চুল বেঁধে দিই।
১২।৫।৯১
না স্বর্গ না নরক
দীর্ঘকাল নরকবাসের পর যাব কি আবার দলে দলে
অন্য নরকের দ্বারে? নাকি
স্বর্গীয় বাতাস ছুঁয়ে যাবে? আশঙ্কার
ছুরি বিদ্ধ বুকে সারাক্ষণ। বার বার
স্বপ্নের কপোত সমুদয় পিশাচের পদতলে
ধূলি হয়ে গেছে। ছুঁড়ে-দেওয়া তেজাবের
দহনে ঝল্সে যাওয়া মুখ নিয়ে ফের
হেঁটে যাব চিরন্তন সবুজের দিকে।
অন্তত না স্বর্গ নরকে পেলে ঠাঁই শুদ্ধ হব
নদীতে সাঁতার কেটে খানিক সময়।
২৬।৩।৯১