জবাবদিহি
শীতসন্ধ্যায় একা-একা হেঁটে যাচ্ছিলাম ফুটপাতে
সুপার মার্কেটের ধার ঘেঁষে। কোথাও
জনমানুষের সাড়া নেই; দোকানপাট, পেট্রোল পাম্প,
ঘরবাড়ি, লেক, গাছপালা
সবকিছু ভারী নিদ্রাতুর। একস্মাৎ কী-যে একটা
ছুঁয়ে গেল আমাকে।
চমকে দেখি, কেউ কোথাও নেই, বাতাসও নয়
সঞ্চরণশীল; আমার ভেতর
এক কম্পন, গুনীর আঙুলে সেতারের তার।
কিছু কথা আমাকে স্পর্শ করার বাসনায় কম্পমান।
শহদীদের কি স্পষ্ট কোনও কণ্ঠস্বর আছে?
কোন্ ভাষায় কথা বলে ওরা?
যে ভাষায় ভাসমান মেঘের টুকরো শহুরে পথে
দাঁড়ানো বিরল গাছের পাতা, ডাগর
নদীর বাঁক অথবা কুয়াশা কথা বলে,
সেই ভাষাই কি ভর করে শহীদদের কণ্ঠহীন কণ্ঠে?
কী ওরা বলতে চায়? কান পেতে থাকি,
হাঁটার ছন্দ হোঁচট খায়। নক্ষত্রের গুলজার আড্ডায়
চোখ রাখি, ফিস্ফিসানি
গর্জন হ’য়ে ফেটে পড়ে ফুটপাতে, ভড়কে
থমকে দাঁড়াই। শহীদদের জোরালো কোরাস
শুনতে পাই, “পথচারী, জবাব দাও। আমাদের যারা
হত্যা করেছে দিনদুপুরে,
তাদের বিচার কেন ঘুমিয়ে আছে লাশকাটা ঘরে?
আমাদের স্বপ্ন যারা ঝাঁঝরা করে দিয়েছে বুলেটে,
আমাদের আপনজনের চোখ আজো ভাসছে শোকাশ্রুতে
যাদের তাণ্ডবে,
তারা কেন থাকবে বিভোর সুখনিদ্রায়?
জবাব দাও পথচারী, জবাব দাও।
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
মৃত্যু-খচিত নক্শা তৈরি করেছে,
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের, যারা
আমাদের ঘরে ভ’রে দিয়েছে অন্তহীন মাতম।
আমরা শাস্তি দাবি করছি তাদের,
যারা মনুষ্যত্বের গা’ থেকে তুলে নিয়েছে চামড়া।
জবাব দাও, কেন শাস্তি হবে না সেই অপরাধীদের?’
নিরুত্তর আমার দাঁড়িয়ে থাকা শীতসন্ধ্যায়
একঠায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবি,
শহীদদের একরোখা কোরাস আমাকে চাবকাবে
কতকাল? অসহায় কবিকে কেন করতে হবে জবাবদিহি?
শহীদদের কণ্ঠস্বর সহজে আমাকে
ছেড়ে যায় না, লেপ্টে থাকে প্রতিটি নিশ্বাসে,
আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেসব সড়কে,
যেখানে ব’য়ে গেছে প্রতিবাদী রক্তধারা।
জেগে গেছি, হত্যাকারীরা শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত
শহীদদের কণ্ঠস্বর পথচারীকে শান্তি দেবে না।
২৬।১।৯১
জাহাজডুবির পর
অকস্মাৎ বজপাত; বুকে লগ্ন তক্তা, ভাসমান;
ধুধু আসমান, ক্লান্ত দেহমন, কোথায়্য সৈকত?
ঢেউগুলি সর্পফণা; নিজ নাম অর্থহীন, কেউ
ডাকলেও পারবো না দিতে সাড়া। এখনও যে কোনো
হাঙর নেয়নি কেটে পা আমার, করেনি সাবাড়
অন্য কোনো জলচর প্রাণী, এ এক বিস্ময় ঝলমলে।
জালের সুতোর মতো কিছু স্মৃতি ঝুলে আছে, হাড়ে
তিন মাথা-অলা কুকুরের দন্তশলাকার ক্রমে
ভীষণ প্রবিষ্ট; মনে হয়, এক্ষুণি দু’হাত তক্তা
থেকে খ’সে যাবে আর পাতালের কবর হবে সেই
করুণ নাবিকদের মতো। রকমারি অছিলায়
নিজেকে জাগিয়ে রাখি, বার বার খুঁজি তীরভূমি।
জীবনের চেয়ে বেশি মৃত্যুর দিকেই যাচ্ছি ভেসে
একা, দ্রুত; আমার ব্যাকুল ডাক বুদ্বুদের মতো।
সঙ্গীদের আর্তনাদ মনে পড়লেই নিঃসঙ্গতা
অধিক দাঁতাল হ’য়ে ওঠে; হীনবল দুটো হাত
মর্চে-পড়া তরবারি, চোখে-মুখে লবণাক্ত ঝাপ্টা,
মাঝে-মাঝে ফেলে-আসা শহরের আলোর তামাশা।
গোধূলিবেলায় যদি প্রায়-মৃত ভেসে উঠি তীরে,
আবার বানাতে হবে জলযান বন থেকে কাঠ
কেটে এনে; কায়ক্লেশ সইবো সব স্মিত মুখে আর
খাটাবো স্পর্ধিত পাল পুনরায়। অভিযানে মেতে
তরঙ্গে সওয়ার হ’য়ে বাজাবো নিজস্ব দিলরুবা;
জীবন রেখেছি জমা সুরের গভীর মর্মমূলে।
২০।৯।৯০
জিন
আমাকে ধরেছে জিন, মনে হয়, ঘন সন্ধেবেলা,
যখন ছিলাম শুয়ে অন্ধকার ঘরে। কলিজার
ভেতরে চিৎকার শুনি, যেন কোনো লাউডস্পীকার
মাতমের প্রতিধ্বনি। জ্যোৎস্না নাড়াচাড়া প্রিয় খেলা
ঝুলে-থাকা বারান্দায়; নেচে বলি, ‘আমি কার চেলা?’
আসলে কারোরই নই, অবহেলে বিষাক্ত কাঁটার
উপর কখনো হাঁটি, কখনো-বা জলন্ত অঙ্গার
হাতের তালুতে নিয়ে কাছে পিঠে ছুঁড়ে মারি ঢেলা।
কোথায় শক্তির উৎস আমার, জানি না। জাদুগর
ব’লে নেই পরিচিতি, উন্টাপান্টা ক’রে কত কিছু
হো-হো হাসি, আমি অন্য কারো দৃষ্টি আর কণ্ঠস্বর
পেয়ে যাই রাতারাতি। দর্পণ নাদান, মুখ নীচু;
কপোতের ঘাড় ভেঙে ব’সে থাকি একা, গমগীন,
হঠাৎ উল্লাসে মত্ত আমার ভেতরকার জিন।
২৯।৪।৯০
তা হ’লে নির্ঘাত বজ্রপাত
আমাকে কি ছেড়ে যাবে সে হঠাৎ এই গোধূলিতে?
তা হ’লে নির্ঘাৎ বজ্রপাত,
পুড়ে হব ছাই; ভয়ে-ভয়ে থাকি দিনরাত। নিদ্রাহীন
কত যে প্রহর কাটে; চোখে চোখে রাখি
তাকে, রক্ত শুষে তৃপ্ত থাকে। তবু তার ছলনার
অন্ত নেই, আমার নিকট স্পষ্ট দাবি করে সন্তের জীবন।
মাঝে মাঝে কী এক খেয়ালে চলে যায়, মিশে যায়
হাওয়া, দেয়ালে মাথা ঠুকি
বার বার; আহার রোচে না মুখে, ঝুঁকি নিয়ে যাই
উত্তপ্ত তামাটে পথে, জলাভূমি আর
খাদের কিনারে খুঁজি তাকে, খুঁজি সাপের ফণায়;
এভাবেই পরমায়ু-পুঁজি দ্রুত শেষ হতে থাকে।
‘দাঁড়াও, আমাকে বর্জ্য ভেবে কুম্ভীপাকে
ফেলে যাও কেন, আমাকে কি করেছে দখল কুষ্ঠ’,
বলতে পারি না তাকে অভিমানে। কী এক ভাটার
টানে চলে যায়, যেন তার
ঘুঙুরবিহীন পদযুগ কোনোদিন নেচে নেচে
এই বোবা দেয়ালকে করেনি সঙ্গীত।
এরকম অন্তর্ধান তার কতবার,
রাখিনি হিসের; উদ্বেগের কাঁটা বুকে নিয়ে শুধু
মুহূর্তে, মিনিট, ঘন্টা চিবিয়ে খেয়েছি,
এবং নিদ্রার রেণু চোখ থেকে সরিয়ে প্রচ্ছন্ন দরজায়
আমার দু’চোখ শত চোখ হ’য়ে গাঁথা,
যদি তার ছায়া এসে বলে, ‘ওঠো।‘
৪।৪।৯১