খাকের পুত্তলি
মুর্গীর ডিমের মতো মোতির তালাশে পেরেশান
হইনি কখনো কিংবা লোকশ্রুত কোহে নেদা কাকে
বলা হয়, দানবের জান কোন পরেন্দায় থাকে
লুকানো, এসব প্রশ্ন নিয়ে আজ আর লবেজান
হই না; হৃদয়ে পূর্ণিমায় নামে কোটালের বান।
কোনো কাজে কামেয়াবি প্রার্থনায় খোদার আরশে
নুয়ে-থাকা ফেরেশতার চাইনি মদদ; রসে বশে
থাকার মুরোদ নেই, রমণীর প্রতি নেই টান।
ফেরেশতা তোমরা ভায়া খোদার রোবট বিলকুল;
ক্ষুধা আর তৃষাহীন; নিঃসীম অনন্তে শুধু জপে
যাও নাম; আমার এ বুকে লগ্ন বেদনা-করবী
সকল সময়, যার রঙে সকলেই মশগুল।
স্বেচ্ছায় দোজখে সেই কবে নিজেকে দিয়েছি সঁপে;
খাকের পুত্তালি, তবু পবিত্র আতশে গড়া কবি।
৩০।৪।৯০
গায়ে হলুদ
এই যে হলুদ রঙ বাড়িময় তরুণ তরুণী,
শিশুদের মাতিয়ে রেখেছে, তোমাকেও ক্রমাগত
আমার নিকট থেকে দূরে নিয়ে যাবে, বহুদূরে।
মনে পড়ে, এতটুকু তুমি চোখ বোজা, জননীর
পাশে শুয়েছিলে হাসপাতালের ধবধবে বেডে।
হঠাৎ তোমার কান্না শুনে চম্কে উঠেছিলাম
গোধূলিতে; ক’বছর পরে খুব ভোরবেলা তুমি
মৃত পোষা পাখিটাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় একা
বসেছিলে, চোখে অশ্রুজল সে কথা ভুলিনি এই
বয়সেও; হে আত্মাজা, আজ গায়ে হলুদ তোমার।
কান্নায় উথলে ওঠে অগোচরে সারা বাড়ি হৈ- চৈ
আনন্দের অন্তরালে, আমার নিজের কান্না মেশে
বারান্দা, রেলিং সিঁড়ি, আলমারি, বুক শেল্ফের
সারি সারি বই আর টেবিলের চোখের পানির
সঙ্গে বুক যেন হু হু খাঁচা। হৃদয়ের এত কাছে
ছিলে, কত দূরে চ’লে যাবে। মনে হয়, বহু শ্রুত
লোক কাহিনীর কোনো অধ্যায় উঠছে ভেসে আর
সারা বাংলার গায়ে হলুদ মাখছে একে-একে
সবাই আজকে কনে-দেখা আলোয় গানের সুরে,
আমার অন্তরে বিস্মিল্লাহ্ খান ডুকরে ওঠেন।
১৮।২।৯১
চার অধ্যায়
১
বাল্যকাল এখন বিশ্রাম করে কার করতলে
পক্ষী শাবকের মতো? নাড়ী-ছেঁড়া তাজা কান্না, দোলনা অথবা
ঘুম পাড়ানিয়া গান, স্তন্যপান, টবে গোসলের
স্মৃতি নেই; সহজ পাঠের রাঙা পথ,
গণিতের কাঁকর ছড়ানো পথ, ছড়ার মায়াবী ঘাট, কিছু
টক ফল, বৃষ্টির বিকেলে খোলা মাঠে
ছোটাছুটি, জ্বরোভাব নিয়ে দেখা চিলের চক্কর,
হাজ্জামের চকচকে খুরস্পৃষ্ট শিশ্ন থেকে রক্ত ঝরা হলুদ কাপড়ে-
মনে পড়ে বেলা অবেলায়।
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো গোধূলিতে
আমার বিহবল চোখে অশ্রুজল, জিভে লোনা স্বাদ, কতিপয়
অচেনা জিজ্ঞাসু লোক দাঁড়ানো আমাকে ঘিরে আর
ক্ষুৎপিপাসায় নিত্যসঙ্গী পরম নির্ভরশীল মরমিয়া একটি গর্দভ।
২
আজ নয়, রৌদ্রময় দুপুরপ্রতিম দূর যুবা
বয়সে সুগন্ধি ঘুমে স্বপ্নের নগরে হেঁটে হেঁটে,
সরোবরে ডুব দিয়ে, চুমো খেয়ে পাষাণ পুরীর
কোনও বিলাসিনী কিংবা অরণ্যবাসিনী যুবতীকে
জেগে উঠে দেখি, স্বপ্নচ্যুত শরীর জ্বলছে দাউ
দাউ-এই অগ্নি কোনও দেবদূত নাকি ইবলিস
দিয়েছে ছড়িয়ে শিরা উপশিরা জুড়ে? প্রশ্ন আজও
প্রশ্ন রয়ে গেছে ধু ধু, অপরূপ সাগ্নিক প্রহর
আমাকে প্রতিভাবান বানায় এবং পায়ে পায়ে
কে যেন নিঃশব্দে ঘোরে খাদ্যন্বেষী কুকুরের মতো।
নিয়ত অর্চনা করি রঙিন কুয়াশামোড়া কাকে?
ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি নিভে যায় স্বপ্নাদ্য আগুন।
৩
এখনও কল্পনা করি, সে ভালই আছে; থাক। কেন থাকবে না?
‘না, সে ভাল নেই,’ ব’লে যায়
দুপুরের রোদপোড়া পাখি। পাখি আমার কল্পনা
ডানায় জড়িয়ে নিয়ে মেঘ পাড়ি দেয়
জগৎ সংসার
বিষয়ে নিঃস্পৃহ, উদাসীন। দোতলার ঘর থেকে তার মুখ
ভেসে ভেসে চলে আসে আমার নিবাসে,
বলে ঠোঁট নেড়ে,
‘কেন বৃথা আমাকে তোমার কল্পনার
চোর-কুঠুরিতে বন্দী ক’রে
‘রেখে দিতে চাও? শোনো, আমাকে আমার
হালে ছেড়ে দাও; সন্তদের বুক-ছেঁড়া গান আসমান ফুঁড়ে
জল হ’য়ে ঝরে খরাক্লিষ্ট দীর্ণ মাঠে। তার মুখ
সিনেমার অন্তিম দৃশ্যের মতো শূন্যতায় মেশে।
৪
তুমিতো আসো না, তবু তোমাকেই মন্ত্র জ’পে জ’পে
ডেকে আনি খাতার পাতায়;
আমার ধূসরতায় আমি আছি, তোমাকে সাজাই
নানা রঙে সারা বেলা, বস্তুত পাঠিয়ে দিই সুখের দিঘিতে,
সেখানে সাঁতার কাটো, জল ঝরে চুল,
বাহু, গ্রীবা, স্তনচূড়া থেকে অবিরল,
হঠাৎ কোত্থেকে এসে কেড়ে নাও খাতা, বাক্যময় সে কাগজ
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলো। তোমার চুলের
ঝাপটে বিমূঢ় আমি সুরদাস হই। তবু প্রস্তরিত চোখ
তোমার ভেতরকার অদৃশ্যকে দেখে নিতে চায়।
১০।১০।৯১
চুল টুল ঠিকই থাকে
চুল টুল ঠিকই থাকে, প্রতিদিন ব্লেড চষে গাল
দস্তুর মাফিক আর পোশাকও দুরস্ত বটে, ছেঁড়া
কাগজ অথবা নুড়ি কড়াই না রাস্তা থেকে, ডেরা
বেঁধেছি অনেক আগে, নই আমি বেহুঁশ মাতাল।
এ-কথা কবুল করি, বারংবার আকাশ পাতাল
এক হয় শব্দের তালাশে। যদি বলে, ভুলঘেরা
জীবন আমার, তবে কস্মিকালেও চুলচেরা
তকরারে হব না প্রবৃত্ত, খুশি থাক মেষপাল।
কারো সাতে পাঁচে নেই, তুব ওরা ধিক্কারের থুতু
ছিটোয় আমার মুখে। যেন সব কামেল ফকির
চারপাশে গিজ গিজ করে আর সকলেই নেক-
বান্দা আমি ছাড়া, প্রায়ই ফক্কড়ের কাতুকুত,
ইতরামি সহ্য করি! সেজে থাকি মূক ও বধির;
কলিজা দিইনি ছিঁড়ে, তবু আমি দিওয়ানা আশেক।
২৯।৪।৯০
জন্তু
কেন এই জেঁকে-বসা জন্তুটিকে ঘাড় থেকে পারি না নামাতে
কিছুতেই? আরশোলা, শুঁয়ো পোকা নয়
ঝেড়ে ফেলে দেবো
অথবা ফড়িং নয় মৃদু টোকা দিয়ে
নিমেষে উড়িয়ে দেবো, যেমন কামিজ থেকে ধুলো।
‘এবার সরিয়ে নাও তুষারের আস্তরণ’, যত
বলি তাকে, তত সে ছড়ায় হিম, এমন নাছোড়
পুরানো ত্র্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে পার্কে, চিড়িয়াখানায়
যাওয়ার বাসনা নুড়ি হ’য়ে প’ড়ে থাকে গৃহকোণে, ট্যাপ খুলে
পানি খাওয়া কিংবা চুলে চিরুনি চালানো,
এমন কি কবিতার বই চেখে দেখা
ক্লেশকর মনে হয়। দরজা না ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকি, বাতি জ্বালাবো কি জ্বালাবো না ভাবি বহুক্ষণ,
যেনবা আটকে আছি ঊর্ণাজালে; এদিক ওদিক নড়াচড়া
সাধ্যাতীত। জন্তুটির মুখোমুখি সোফায় ঝিমানো
চিন্তাহীন, বিছানায় শুয়ে-থাকা আমার নিয়তি?
দুঃস্বপ্ন শাসায় মধ্যরাতে একনায়কের মতো,
আমাকে পোড়ায় জ্বরোভাব নিত্যদিন;
সকল যৌবনগাথা শৌচাগারে খাচ্ছে লুটোপুটি।
জন্তুটি বেজায় জবুথবু, তুব তাকে
কমলালেবুর রস, হরলিক্স দেবো না কখনো। ‘যাও তুমি,
এক্ষুণি বেরিয়ে যাও’, বলি উচ্চস্বরে, অথচ সে
নির্বিকার ব’সে ব’সে লোল ঠোঁট চাটে।
১৩।১১।৯০