কার্যকারণ
‘দেখ, দেখ লোকটা কেমন কায়ক্লেশে
হেঁটে যাচ্ছে, রাস্তা পার হচ্ছে আস্তে সুস্থে রুক্ষ বেশে,
ভয়ানক নড়বড়ে, জোরে, হাওয়া বইলেই প’ড়ে খাবি খাবে
ধুলোয় নির্ঘাৎ’, কতিপয় তরুণ তরুণী অতিশয় মজা পাবে
আমার উদ্দেশে এই সব কথা ব’লে। সাদা চুল,
অবিন্যস্ত, নুয়ে পড়া অস্তিত্বের ক্লান্তির গাঢ় ছাপ, কী ব্যাকুল
বাঁচবার সাধ আজও; আমার নিজের লেখা কয়েকটি বই
থেকে যাবে কিছুকাল, মরণের পরে শুধু শূন্যতা অথই।
আমার মৃত্যুর পরে কোনওদিন তুমি র্যাপক
থেকে খুব আলগোছে নেবে তুলে
আমার পুরানো কোনও বই, অনেকেই যাবে ভুলে।
কোনও, পংক্তি, চিত্রকল্প অথবা উপমা
চকিতে তোমার হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে, প্রিয়তমা,
তোমার স্মৃতিকে দেবে ভিজিয়ে ক্ষণিক বৃষ্টিধারা; বুঝি তাই
বার্ধক্যের কালো বারান্দায় উবু হ’য়ে চুপিসাড়ে লিখে যাই
আজও কিছু পংক্তি, ফাটে সময়ের বিচিত্র বুদ্বুদ্
ক্রমাগত; অতৃপ্তির কারাগারে নিদ্রাহীন নিই ঘুমের ওষুধ।
২২।৪।৯১
কাল এবং আগামীকাল
আমার ক্ষণকালীন দাঁড়ানো সিঁড়ির ধাপে
তুমি উপরে কপাট ছুঁয়ে চৌকাঠে পা রেখে
কোথায় স্পন্দমান মুহূর্তগুলো
শূন্যতা ভূতুড়ে কুকুরের মতো চাটে আমাকে
মনে পড়লো তোমার চোখ পথ চলতে
পানির ঝাপটা লাগা দু’টুরো কাচ
শানবাঁধানো ফুটপাতে নয়
হেঁটে যাচ্ছি জলাশয়ের উপর পা ফেলে
ফ্ল্যাটে প্রত্যাবর্তন বিমর্ষ মনে
চার দেয়াল রক্তবমি করে বার বার
বুকশেলফের বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস
জানালার পান্ডুর গাল বেয়ে টপটপ অশ্রুপাত
জ্যান্ত কবর দিচ্ছি আবেগকে অলক্ষ্যে
অথচ ছটফটে মনে
কী-যে ঘটে তোমাকে ঘিরে আবেগ জিন্দা আবার
বানাতে শুরু করি তোমার জন্য জ্যোৎস্নার তোরণ
এই মুহূর্তে কেউ কি জানে
তোমাকে ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছি না
একবার শুধু একবার এসে দেখে যাও তোমাকে
কীভাবে বেঁধেছি আলিঙ্গনে বুঁদ হ’য়ে তোমার ঘ্রাণে
নিজের সঙ্গে নিজের ফেরেব্বাজি
একে বলা যাবে না
এসো দেখে যাও আমার রক্তের জোয়ারে
তোমার চিৎ সাঁতার ডুবসাঁতার
অসম্ভব তোমার ঠোঁট থেকে
আমার ওষ্ঠ বিচ্ছিন্ন করা
কে আছে এমন তোমার ছায়াকে আমার সত্তা থেকে
নেবে ছিনিয়ে
আবার দ্যাখো আমার উদ্বাস্তু হাত পায় না খুঁজে
তোমার কোমরের বাঁক উরুর মালভূমি
আমার আঙুল তোমার ঝল্সে-ওঠা শরীরে সন্ধ্যভাষায়
রোজনামচা লিখতে উন্মুখ
ঈদের চাঁদের মতো তোমার ভুরু
সেই সেতু যেখানে আমার আত্মার নিত্যদিনের
আসা-যাওয়া তোমার হাসি গতকাল
এবং আগামীকালের মধ্যে ঝরন্ত তারা।
৪।৫।৯০
কালবেলার সংলাপ
সুজাতা। কতকাল অন্ধকার আমাদের শাসাবে, গৌতম?
বলো, আর কতকাল? কেবলি হোঁচট খাই, ভয়
পাই প্রতি পদক্ষেপে; দূরন্ত বইলে হাওয়া, ভাবি-
এই বুঝি এলো তেড়ে মাস্তানের দল, পথ খুঁজি,
চৌকাঠে কপাল ঠেকে, পায়ে কালো পাথরের ভার।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত যেন আমি, পারি না কোথাও ছুটে
যেতে, এই অন্ধকার এত বিষ লুকিয়ে রেখেছে
নিজের থলিতে, আগে কখনো জানিনি। ভয় যাপি
সর্বক্ষণ; হবে কি সন্ত্রম লুট? হবে কি বিলীন
হলমায়্য সিঁথির সিঁদুরচিহ্ন? গৌতম, আমায়
বলে দাও। ওই শোন, ‘গৃহস্থের ঘোর অমঙ্গল’
শব্দ ছুঁড়ে উড়ে যায় ছন্নছাড়া পেঁচা।
গৌতম।
বিচলিত
হয়ো না সুজাতা অন্ধকার অধিপতি নয়, কিছু
আলো আমাদের অস্তিত্বের দিকে ঝুঁকে আছে আজো
গাঢ় চুম্বনের মতো; আছে সম্প্রীতির চন্দ্রাতপ।
সুজাতা। না, গৌতম, আশঙ্কার ভূতপ্রেত কী ভীষণ নাচে;
বাঘ-ভালুকের ভয় নেই, বিষাক্ত সাপের চেয়ে
ঢের বেশি বিষধর মানুষ এখন। আমাদের
বসতবাড়িকে ওরা বানিয়েছে চিতা; স্বপ্নগুলো
ভস্ম হয়ে ধূলায় মিশেছে। অসহায় মানবতা
কাঁটার মুকুট প’রে নুয়ে থাকে ক্রুশ কাঁধে নিয়ে;
অনেক হৃদয় আজ লাঞ্ছিত গোলাপ দিগ্ধিদিক।
গৌতম। থাক থাক সুজাতা, আগুনে ঘর পুড়ে গ্যাছে, যাক;
আত্মাকে পুড়িয়ে খাক করে দেবে এমন আগুন
নেই কোনো উন্মত্ত মশালে। বর্বরের হুঙ্কারের
মধ্যে জেগে থাকে কিছু মানুষের দীপ্ত বাণী, থাকে
তাদের গভীর চালচিত্র, যারা কখনো ধর্মের
অন্তরালে অধর্মের বাঘনখ সযত্বে পোষে না,
যারা ধ্যানে ও মননে মনুষ্যত্বকেই করে ধ্রুবতারা
চিরকাল। সুজাতা তোমার দুটি রাঙা পদতলে
চুমু খায় পুণ্য দুর্বাদল, তোমার আঁচল
ধরে রাখে চারাগাছ, মুখ ছোঁয় জবা। পুনরায়
নতুন আকাঙ্খা নিয়ে এসো ঘর বাঁধি দুজনায়।
ঘাতক শানাক তার ছুরি, মাথা নত করবো না,
শেখাবে বাঁচার মন্ত্র চিরদনকার পূর্বপুরুষের মৃত্তিকায়।
সুজাতা।। এসো হাতে হাত রাখি পূর্বপুরুষের মৃত্তিকায়,
ভাঙাচোরা স্বপ্নসমূহকে ভালোবেসে জড়ো করি।
২১।১১।৯০
কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত
প্রকাশপ্রবণ ষড়ঋতুতে এবং ঘোরলাগা
আত্মাদর্শী; ‘হায় নিস্তব্ধতা, হায় নিস্তব্ধতা’ ধ্বনি
দিয়ে চক্রবাল ছুঁই। দূরবর্তী গোচারণ ভূমি, নদীতীরে,
ত্রস্ত পক্ষীযূথ, পথরেখা ক্রমশ ভৌতিক; যদি
এক হাঁড়ি নিথর দধির মতো চাঁদ হাতে এসে
ডাগর আহ্লাদ হতো, করজোড়ে দাঁড়াতাম আকাশের নিচে।
বস্তুত আমার কোনো পূর্বজন্ম নেই, তুব কেন
স্মৃতি এরকম জাতিস্বর? তেজী জ্যোৎস্নাবিচলিত
দীঘির প্রাচীনতায় পূর্বপুরুষের ছায়াবৎ প্রতিকৃতি
দেখে গরীয়ান; খুঁজি কার পাণ্ডুর অধরে শ্লোক
বিচ্ছুরিত, কার হাতে অচিন প্রকাশক্ষম এক
খাগের কলম শোভা? হায়, দীঘির রহস্য গূঢ় ঘনীভূত।
বিসদৃশ ধারাবাহিকতা মরীচিকা; হয়তো বা
জরাবৃত, অন্ধকার বাসগৃহে আগরবাতির
মোহাচ্ছন্ন ধোঁয়া, বিসর্পিল। বুঝি কারো পলকরহিত নগ্ন
চাহনিতে শিখা, তারার স্পন্দন, না-বুঝেই তাকে
অলোকসামান্য আপনার জন ভাবি আলিঙ্গনে।
চমকিত অতীতের ধূসরিত তবু মনোহারিত্ব অসীম
আপাতশোভন ডালা খুলে দ্যাখে এ বদনসীব-
জমেনি সঞ্চয় কিছু; নির্বোধের মুখ ব্যাদানের
মতো শূন্যতার উপহাসে কী-যে কম্পমান ক্ষয়িত শরীর।
হৃদয়ের তন্তুজালে মুণ্ডুহীদের তড়পানি;
‘সাড়া দও মেধা, শিল্প’ ব’লে নিঃশব্দ চেঁচাই;
গলার ভেতরে ধুলো, ছাই ওড়ে, রুদ্ধ ফিনিক্সের জাগরণ।
ঘাসঢাকা সিঁড়িতে নিবিষ্ট বসে ডায়েরিতে ঝুঁকে
পড়ন্ত বেলায় কিছু পংক্তি রচনার ধ্যানে থাকি,
শরীর হাওয়ার চাপে হৈমন্তিক স্বপ্নের ধনুক, ছিলা শত
টুকরো, তালু ফুঁড়ে বিষপায়ী কাঁটাতার, অকস্মাৎ
ছন্নছাড়া ঝড়, কালীদহে তোলপাড়, অবসাদ।
খসে যায়, অস্থির আঙুল থেকে কলম কেবলি খসে যায়।
এই আমি বানিয়েছি এসব অক্ষর? তবে কেন
এমন অচেনা লাগে? পংক্তির ভেতরে অন্য পংক্তি
সোহাগকাঙাল মদ্যপের মতো ঢুকে পড়ে। আমার স্বাক্ষরে
অন্য কারো স্বাক্ষরের অদ্ভুত আদল; দৌড়ে যাই,
জংলী লতাগুল্মে পা আটকে পড়ে থাকি, ন্যাবাধরা;
কেমন বেঘোরে নিমজ্জিত অবচেতনের মেঘময়তায়।
২৯।১০।৯০