এসেছে বেগানা চিল
এসেছে বেগানা চিল পুনর্বার আমার আকাশে
ছিঁড়ে নিতে নীল মাংস নখরের ক্ষ্যাপাটে আঘাতে।
কতকাল পর এল, কাটল চক্কর কতবার-
রাখিনি হিসাব তার। ঘরে ব’সে ভাবি বাল্মীকির
উত্তরাধিকার আর অবেলায় পথ্য নিয়ে যাই
শয্যাগতা রমনীর কাছে। শল্য চিকিৎসক তার
ব্যর্থতা পারেনি ঢেকে নিতে রবারের দস্তানায়।
ফেরিঅলা ডেকে ডেকে ফিরে যায়; আপাতত সাড়া
নেই এই বাসগৃহে। পদ্য লেখা শেষ হ’লে ছুঁই স্নেহভরে
শব্দরাজি, আজকাল আমার পদ্যের রূপটান
করে না কম্পন সৃষ্টি কোনও খানে; শব্দ মরা মাছি?
বেগানা চিলের ডাক মাঝে-মাঝে ব্যর্থতার বোধ
নিভৃতে জাগিয়ে তোলে। লাজুক যুবার মতো এই
পান্ডুলিপি নিজেকে আড়ালে রেখে ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
৫।১১।৯১
কণ্ঠস্বর
হঠাৎ কখনও
কারও কণ্ঠস্বর বীতংসের
ছলনা এড়িয়ে
বয়সের পরপারে
মেদুর সময়হীনতায়
ছুঁয়ে যায় অশান্ত হৃদয়,
যেন মাছরাঙা-বুকে স্বপ্ন-গোধূলিতে
বিলের নগ্নতা।
কণ্ঠস্বর রাধা নীপবনে;
দ্বিধায় পা ফেলে স্তব্ধতায়,
কখনও বা ভিজে যায় গহন শ্রাবণে, নীল শাড়ি
নিঙাড়ি নিঙাড়ি
লাজনম্র চোখে চায় এদিক ওদিক।
হৃদয় মুরলীধর, ফোটে সহস্র কদম ফুল
স্বরের ছোঁয়ায়;
কী এক নিবিড় ঘ্রাণে সময়ের পাপড়ি ঝরে যায়।
৩০।৭।৯১
কথা ছিলো
কথা ছিলো, আমার আনন্দ-গানে ভরিয়ে তুলবো
অলিগলি, জনপথ, অবাধ প্রান্তর,
আমার ভরাট গলা ছোঁবে দিগন্তকে; কথা ছিলো,
পায়রা উড়িয়ে দেবো ভোরবেলা মেঘের কিনারে।
কথা ছিলো, উৎসবের উদ্দেশে কবিতা নিরুদ্বেগ
লিখে মুছে ফেলবো সকল দুঃখ শোক।
কণ্ঠে আনন্দের সুর তোলার সময় বেলাশেষে
বেজে ওঠে ব্যর্থতার করুণ রাগিণী, হাত জুড়ে
কবুতর নয়, কিছু নুড়ি দৃশ্যমান। মনে পড়ে, সেই কবে
কল্যাণের জন্যে এসো বলে শূন্যতায় খেলিয়েছি
কণ্ঠস্বর, অথচ চৌদিকে অকল্যাণ
পেঁচার নিখুঁত সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠার অন্ধকার জপে।
আমার ভেতর থেকে যাবতীয় আমোদ, উল্লাস
কারা যেন অতি দ্রুত ছিনতাই ক’রে নিয়ে যায়।
কথা ছিলো, প্রত্যেককে দেখাবো অনিন্দ্য সূর্যোদয়
মুক্ত মনে, অথচ এখন, এ মুহূর্তে, সূর্যাস্তের ছোপলাগা
কবরের দিকে অসহায় চেয়ে থাকি। অবেলার
কোকিল ছড়িয়ে দেবে সুরের নির্মল কিছু রেনু
কবরের ঘাসে, সেই প্রত্যাশা ফেরারী; বন্দীদশা
এলো বুঝি পুনরায়! নিধন লিপ্সায় মত্ত গুপ্ত ঘাতকেরা
ঘোরে খোলা পথে,
পথিক রবীন্দ্রনাথ কন্ঠে নিয়ে শান্তির ললিত বাণী বিষন্ন, বিব্রত।
২১।১।৯১
কবিতার জ্বর
মলিন কবির মুখ, কবিতার পেলব গা’ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
রক্তিম কপালে তার পানি-পটি দেওয়া প্রয়োজন,
মাথাটা ধুইয়ে দিলে ভাল হয়, অদূরে কোথাও
প্যাঁচা ডেকে ওঠে বার বার। চোখ বোজা আর
দপ দপ করছে কপালের রগ, নড়ে ওঠে ঠোঁট,
রোগা প্রজাপতি; দাও কমলালেবুর রস ওকে
একটু একটু ক’রে। কবি পায়চারি করে ঘরে,
বারান্দায়, কখনও গলির মোড় থেকে ঘুরে আসে।
কবিতার জ্বর বাড়ে ক্রমাগত, লাবণ্য শরীর
থেকে ঝ’রে গেছে, তার বিছানায় যেন বা কংকাল
গচ্ছিত রেখেছে কেউ। রাত্রির তৃতীয় যামে ঘুম
পায় ক্লান্ত কবির, অথচ জেগে থাকে, যদি তার
ডাক আসে অকস্মাৎ। কী এক নিগূঢ় শুশ্রুষায়
কবিতার জ্বর সেরে যায়, শয্যা নেয় রুগ্ন কবি।
৮।৪।৯১
করোটির অন্তর্গত
করোটির অন্তর্গত তমসায় অকস্মাৎ চাঁদ ওষ্ঠ থেকে
ঝরায় ক ফোঁটা বিষ, অন্সরার নিবিড় কাঁচুলি
ছুঁড়ে ফেলে শহরের বস্তির তরুণী।
নোংরা বিছানায় বিকলাঙ্গ একজন বেকারত্ব
পোহায়, হাঁড়িতে ফুটবে না পানি, তণ্ডুলের ঘ্রাণে
উঠবে না জেগে কেউ; নক্ষত্র ফুটবে।
অন্সরা পারে না দিতে খাদ্য টাদ্য, পিপাসার পানি,
ভাঙা ঘরে জ্যোৎস্নার জোয়ার
আনার সামর্থ্য রাখে, সপ্তর্ষিমণ্ডল
হাতের চেটোয় নিয়ে কবিকে স্তম্ভিত
ক’রে দিতে পারে, মেঘ থেকে এনে দিতে পারে কিছু
পারিজাত; যুপকাঠে জল্লাদের মাথা, জনতার কোলাহল।
কবির অমর্ত্য কণ্ঠ বেয়ে নামে বিষ,
তবু তিনি ছন্দমিল বিষয়ে প্রখর
কৌতূহলী, বাড়ি তার ভাসমান বজরা, ঘুমঘোরে
আস্তে সুস্থের কাটেন স্বপ্নাদ্য পাউরুটি;
রুটির ভেতরে মণিমুক্তো, কাব্যকণা, কবি নিজে
হাবুডুবু অলৌকিক স্যুপের বাটিতে।
২৫।৩।৯১
কাঠগড়ায়
শেষতক কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো আমাকে
যদিও বুঝতে পারিনি মাথামুণ্ডু
কী আমার অপরাধ এবং কার কাছে
কাঠগড়ায় চারদিকে ঢেউয়ের ঝাপ্টা
নিরক্ষর চাঁদ সুরুজ আমার কৌসুলি
নক্ষত্র আর জোনাকি সাক্ষীসাবুদ
লতাগুল্ম সকল সুকণ্ঠ পাখি জানায় প্রতিবাদ
তবু টানাহ্যাঁচড়া অদৃশ্য হ্যাণ্ডকাফ
কোন মামলা দায়ের করেনি সে
আমার প্রতি বৃশ্চিক-বিরূপতা গরহাজির
বরং ওর চোখের তারায়
বুকের উদ্যানে আমার ভালোবাসার নীড়
তার গায়ে পড়া শুভার্থীরা অভিযুক্ত করেছে
আমি নাকি ওর সম্ভ্রম হানির কারণ
অথচ মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না কী ক’রে
আঁচড় কাটলাম তার সম্ভ্রমের মসলিনে
কোন উটকো লোকজন কিংবা পাড়াপড়শীকে
জড়ো করা সম্ভব হয়নি আমার বিপক্ষে
রাগী বরাগবৎ ওরা আমার কবিতাকেই
দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে
আমার বেলেহাজ পংক্তিমালা নাকি
তার ইজ্জতে ধাব্বা লাগিয়েছে
হতচকিত আমি চিৎকার ক’রে বলতে চাই
প্রমাণ কোথায় কিন্তু কণ্ঠ আমার নুড়িঠাসা
একচোখো খুচুটে লোকগুলো বলে
তোমার হাতের ছাপ হৃদয়ের নক্ষত্রছাপ
সহজলভ্য অক্ষরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের ফাঁকফোকরে
শাস্তি-শজারু অপেক্ষমাণ
আসমানের দিকে নজর রেখে
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আমার উচ্চারণ
বয়সের দাঁতখিঁচুনি আমাকে নিরস্ত করেনি
বানিয়ে চলেছি শব্দের রামধনু
বসন্তোৎসব যেখানে ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত
পাখির নীড় যেখানে হামেশা ভস্মীভূত
বন্দনা এবং বদনামি যেখানে সমার্থ
অনিবার্য সেখানে কবির নির্বাসন
৫।৫।৯০