আজ থাক
একজন কবি, সময়ের দাঁত-নখ
খুব গাঢ় আঁচড় কেটেছে তার অস্তিত্বের ভূমন্ডলে; কবি
হৃদয়ের নিভৃত গোলাপ
দিয়েছিল অনুরাগে সেই তরুণীকে গোধূলিতে,
চাঞ্চল্য অপর নাম যার। কবিতার
ঝোপঝাড়ে বসবাস তার।
একদিন কবি তরুণীকে বলে আবেগকম্পিত
কণ্ঠস্বরে, ‘ছোঁব কি তোমাকে?’
‘আজ থাক ব’লে সে বসলো স’রে দূরে।
অন্যদিন কবি প্রশ্ন করে যুবতীকে, ‘চুমো খাব?’
‘আজ থাক,’ ব’লে সে তাকায়
আকাশের চিলটির দিকে।
অনন্তর একদিন মৃত্যু যখন কবির ঠোঁটে ঝুঁকে
দিচ্ছিল চুম্বন, সেই তন্বীকে দোয়েল
জানালার কাছে
এসে বললো, ‘যাবে না দেখতে সেই ক্ষয়িষ্ণু কবিকে?’
‘আজ থাক’, ব’লে সে তরুণী
অভ্যাসবশত আর শেল্ফ থেকে টেনে নেয় কবিতার বই।
২৯।২।৯১
আদাব আরজ
এতবার বলেছি ব্যাকুলতা উজাড় ক’রে
বিশ্বাসই করতে চাওনি
আমার কথার মৌমাছিগুলোকে
তড়িঘড়ি তাড়িয়ে দিয়েছো আগুন দেখিয়ে
বলেছিলাম সময় আমাকে
দুমড়ে মুচড়ে আলোর গতিতে ছুটছে
আমার উপর অনস্তিত্বের গাঢ় ছায়া
টুকরো টুকরো স্বপ্ন এখন জাল গোটানো
নিরুত্তর তুমি ঘরকে অধিকতর
আলোকিত করলে হাসির আবীর ছড়িয়ে
যেন আজরাইল আমার জান কবজ ক’রে কখনো তার
কালো ডানা মেলে উড়ে যাবে না সফেদ অনন্তে
এই ক’দিন ধরে না-দেখা
আমার সত্তায় লাগাচ্ছে বিষাদের পোচ
কতকাল তোমাকে দেখবো না ভাবলেই
আমাকে ছেঁকে ধরে হাজার হাজার কাঁকড়া
রোজ কবিতা লিখেও নিস্তার নেই নাস্তির হাত থেকে
এই জন্যেই প্রত্যহ তোমাকে দেখার বাসনা
শত শত কদম ফুল
একটু স্পর্শ করার স্বপ্ন অনুপস্থিতির নিদান
ভ্রমবশত স্থগিত রেখেছো বাসনার উম্মীল ন
তোমার গোড়ালিতে চুমু খাচ্ছে অলৌকিক
জানতেও পারো না তোমার মুঠোর চাপে
ভালোবাসা দোয়েলের মতো ধুঁকে ধুঁকে মরছে দ্যাখো না তুমি
আমার না-থাকা তোমার হৃদয়ে
ধরিয়ে দেবে আগুন
কৃকলাস সংস্কারের শেকল ছিঁড়ে ছুটে আসবে তুমি
তখন অনুপস্থিতির কণ্ঠে নিঃশব্দ আদাব আরজ
৫।৫।৯০
আড়ালে
বাজিয়ে কলিংবেল দেখি তুমি তোমারই ধরনে
দাঁড়ালে দরজা খুলে। বৃষ্টিধোয়া বিকেলের তাজা
রোদ্দুরের মতো হাসি আমাকে জানায় অনাবিল
অভ্যর্থনা। বুঝিনি কিছুই, নিষ্পলক চেয়ে থাকি;
একটু আগেই বুঝি লোভাতুর চারটি দেয়াল
নিয়েছে বেবাক শুষে আর্ত হৃদয়ের অশ্রুজল।
১৮।৬।৯১
এই পংক্তিমালা
আমার কবিতা আজ নক্ষত্রের কাছে
নীরবে প্রার্থনা করে উজ্জ্বলতা আর
নদীর নিকট চায় ঊর্মিল সঙ্গীত।
আমার কবতা
তোমার চোখের কাছে ধার চায় কিছু গভীরতা,
তোমার স্তনের মতো রঙিন উত্তাপ অভিলাষী
আমার কবিতা। দোয়েলের
বুকের স্নিগ্ধতা, জনহীন দীর্ঘ কোনও
পথের ইঙ্গিত হ’তে চায়
এই পংক্তিমালা।
যতবার করি পাঠ তোমার দু’চোখ, ওষ্ঠ দীপ্র স্তনচূড়া,
ততবার মনে হয় তুমি, চোখ যার ভাবনায় মজ্জমান,
মরমিয়া কবিতার বই।
৫।১১।৯১
একটি কবিতা লিখত গিয়ে
একটি কি দু’টি শব্দ মেদুর বিকেলে সাদা চুলে
আঙুল বুলিয়ে দেয়, গুঞ্জরণ তোলে;
বহুদিন পর খাতা খুলে
বসে যাই নিরিবিলি, হট্ররোলে
মেতে আছে রাস্তা, থাক। পরুর খাটাল থেকে আসে
প্রসূতি গাভীর ডাক মাঝে-মাঝে কয়েকটি কাক
গোধূলি আমার আগে নিস্তব্ধ আকাশে
স্বরের আঁচড় কেটে দিতে চায়। ঐতো উন্মুক্ত বইয়ের তাক
আমাকে অভয় বাণী শোনায় নিঃশব্দে কল্যাণের; খোলা খাতার পাতায়
কলম চালাই দ্রুত, একটি কবিতা লিখে ফেলে
আগুনের আঁচ থেকে শান্ত শুভ্রতায়
বিলীন হবার আকঙ্খায়। তাল কাটে, বলপেন ঠেলে ঠেলে
ক্লান্ত হই, তবু কিছুতেই
বাকবিভূতির ছটা কাগজের বুকে নৃত্যপর
নয়, সুন্দরের কংকালেরও দেখা নেই;
যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো পড়ে থাকে কিছু বেখাপ্পা অক্ষর।
ঘর্মাক্ত চেয়ার ছেড়ে শীর্ণ বারান্দায় যাই, ঘরে
পায়চারি করি, চোখ রাখি আসমানে, অস্থিরতা
সত্তায় ফোটায় আলপিন, আমি ব্যর্থতার চরে
ব্যথিত প্রেতের মতো একা-একা ঘুরি, বিষলতা
ভীষণ জড়িয়ে ধরে, পথ চলা দায়
ব্যেপে-আসা কুয়াশায়, ঠোঁটে এ কেমন অহিফেন?
খাতায় এ কার ছায়া কাঁপে? ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায়,
সস্নেহে রবীন্দ্রনাথ আমার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
২৯।৪।৯১
একটি মানুষ কেন
একটি মানুষ কেন একা ব’সে আছে বারান্দায়
গালে হাত দিয়ে ভরসন্ধ্যেবেলা? বুঝি হাত বোমা
ফাটলেও নড়ে চড়ে উঠবে না কিংবা
ভড়কে দেবে না লাফ। উজাড় চায়ের কাপ, একট কি দুটি
নোনতা বিস্কুট
পিরিচে বিশ্রামরত। খুট খুট শব্দ ইঁদুরের? তার
চুলে মৃদু হাওয়ার আঙুল, সালোয়ার কামিজের
ঢেউ তুলে একজন তরণী রাস্তায় হেঁটে যায়।
এইমাত্র তরুণ কবিরা উঠে গেল তর্ক সেরে,
গূঢ় কবিত্বের কষ্টি পাথরে তুমুল ঘ’ষে পদ্যকারদের,
তৃতীয় প্রবাহ নিয়ে কিছু কথা হলো,
লাতিন আমেরিকার জাদু বাস্তবতা ছায়া ফেলে মাঝে-মাঝে
হয়তো ফের সাকুরার বারে
কিংবা দিশি মদের দোকানে যাবে ধুয়ে-মুছে নিতে
ঈর্ষা, ক্রোধ বাদ বিসম্বাদ; ওরা মাথা পেতে নেবে
অলৌকিক ঝর্ণাজল, মণিমুক্তো কত।
একটি মানুষ ব’সে আছে চুপচাপ, দপ ক’রে জ্বলে ওঠে
গোল চাঁদ চৈত্রের আকাশে। সে পেতেছে
যত ফাঁদ ছন্দ ও মিলের,
সব কিছু টপকিয়ে চলে গেছে কবিতার প্রকৃত সারস
কতবার। মগজের পথেরধনু, জোনাকিরা আসবে না
আজ রাতে, এখন পায়ের কাছে খবরের কাগজ লুটোয়।
জ্যোৎস্নার ভেতর থেকে কণ্ঠস্বর জেগে
ফিস ফিস কত কিছু ব’লে যায় তার কানে কানে শোনে কি না,
বোঝা দায়, শীর্ণ বাগানের পাতা ঝরে
মাথার উপর, অভ্যন্তরভাগে অনিবার্য গুউঞ্জরণ নেই।
৩।৪।৯১