সিতমের ঘরে
কতকাল হলো গত, তবু আজো হৃদয় বেতাব
সর্বক্ষণ; কী যেন তালাশ করি, একা-একা ঘুরি,
মধ্যে-মধ্যে বিড় বিড়, আসমানে সুতোহীন ঘুড়ি
ওড়াই মস্তির ঝোঁকে। জেগে জেগে বেশুমার খাব
দেখা, বলো, এ কেমন বিমারী আমার? কত গাব
মেখে জাল তৈরি খাটা খাটুনিতে, মাছ বুড়বুড়ি
কাটে, কিন্তু নিরাপদ; কখনো করিনি কিছু চুরি
তবু বাটে মনচোরা অপবাদরটে বেহাসাব।
পরীগ্রস্ত, একা-একা সাত সওয়ালের জবাবের
উদ্দেশে সফররত, কত বনবাদাড়ে, নগরে
ঘুরি, ফিরি; প্রশ্ন ভুলে খুঁজি তাকে, যাকে কোনোদিন
দেখিনি, শুনিনি কণ্ঠস্বর। অদৃশ্য রূপের জের
স্বপ্নের পরেও থাকে, বসে না কিছুতে মন ঘরে;
কী ক’রে যে কাটে দিব জলহীন জলাশয়ে মীন।
২৯।৪।৯০
সুধাংশু যাবে না
লুণ্ঠিত মন্দির আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো-
‘আখেরে তুমি চলে যাবে?’ বেলাশেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।
স্বর বলে, ‘লুটেরা তোমাকে জব্দ ক’রে
ফেরে আশে পাশে,
তোমার জীবনে নিত্যদিন লেপ্টে থাকে
পশুর চেহারাসহ ঘাতকের ছায়া,
আতংকের বাদুড়-পাখার নিচে কাটাচ্ছো প্রহর,
তবু তুমি যেও না সুধাংশু।‘
আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারী, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজো সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।
১১।১১।৯০
সেদিন তোমাকে
যখন প্রথম দেখি অপরাহ্নে পুরানো বাড়িতে
তোমার পরনে ছিল প্রিন্টের কামিজ সালোয়ার।
ক্রমশ সন্ধ্যায় ঠোঁট শহরকে ছুঁলো, কে ফাঁকে
দুলিয়ে ডাগর বেণী পড়লে তুমি নিজের কবিতা।
তোমার শরীরে কৈশোরের কুমারীর ঘ্রাণ খেলা
করছিল, ঠোঁট থেকে ঝরে গেল অজস্র রঙিন
প্রজাপতি, ভাল লেগেছিল অনাবিল আচরণ;
কবিতার কিছু ছেলেমানুষি, হাতের নড়া, কথা।
আবার যখন দেখি আরেক বিকেলে, গায়ে শাড়ি,
বিবাহের আভা ছিল তোমার সত্ত্বায়, বুক ভরা
দুধের ঝাঁঝালো গন্ধ, চোখে কিছু বিষাদের দাগ;
বিষাদের আলাদা সৌন্দর্য আছে, তন্ময়তা আনে;
হাতে ভানুসিংহ ঠাকুরের ক্যাসেট, হৃদয় ধু ধু;
সেদিন তোমাকে মেয়ে বড় বেশি ভালবাসলাম।
৪।৪।৯১
হঠাৎ কখন
ভোরবেলা চা খেয়েছি পর পর তিন পেয়ালা। এক ফাঁকে
দুটো টোস্ট আর একটা
কুসুমহীন ডিম খাওয়া গেল তৃপ্তি সহকারে।
খবরের কাগজের হেডলাইনে
চোখ বুলানো কিছুক্ষণ; বারান্দায় দাঁড়ানো;
গাছপালা, টুকরো টুকরো মেঘ, নির্বাচনী পোস্টার,
কয়েকটি পাখি, শাকশজি বহনকারী ঠেলাগাড়ি আর
উস্কো খুস্কো রিক্শাযাত্রীকে দেখা;
কবিতার খসড়া নিয়ে বসা,
তার কথা ভাবা, টেলিফোনে আলাপ।
একটা চামচিকের বিরক্তিকর ওড়াউড়ি,
হঠাৎ কখন গোধূলি আমার উপর ঝুঁকে পড়ল, খেয়াল করিনি।
১৮।২।৯১
হয়তো
ইতিমধ্যে গৃহপরিচারিকা চায়ের সরঞ্জাম
নিয়ে গ্যাছে, দিনের ফার্নেস খানিকটা কমজোর,
এক্ষুণি বেরুবে তুমি সেজে-গুজে ঘরবাড়িদোর
ছেড়ে আর অকস্মাৎ তোমার কনিষ্ঠ পুত্র, নাম
উহ্য থাক, লাল পরী আর শাহজাদা গুলফাম
থেকে ছুটি নিয়ে এসে করবে জিগ্যেশ, ‘সেই কবি,
আসতেন যিনি মাঝে-মাঝে, এ বাড়িতে যার ছবি
দেয়ালে টানানো নেই, কী হয়েছে তেনার আঞ্জাম?’
চমকে তাকাবে তুমি ওর দিকে কিছুক্ষণ, যেন
জিন করে ভর, নিস্তব্ধতা তোমাকে করবে গ্রাস।
ঘোর থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে কথার বিনুনি
করবে রচনা, ‘কার কথা তুই, অবাক, এখনো
রেখেছিস মনে? কে সে? আচ্ছা, সে লোকটা? মৃত্যু-ত্রাস
ছিলো তার, ম’রে গ্যাছে’ ব’লে চুলে চালাবে চিরুনি।
২।৫।৯০