লড়াই
ডাকাত-মার্কা লোকগুলো আমার দু’হাত
বেঁধে ফেলছে, যাতে স্বপ্নের মতো নৌকো ভাসাতে না পারি নদীতে,
যাতে গন্তব্য হ’য়ে ওঠে অপ্রাপনীয়।
ওরা আমার গলা চেপে ধরেছে আজরাইলের ধরনে,
যাতে আমার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত
না হয় কোনও গান কিংবা কবিতার পংক্তিমালা,
যাতে আর নিশ্বাস নিতে না পারি।
ওরা আমাকে ক্রমাগত টেনে হিচঁড়ে পিছনের দিকে
নিয়ে যাচ্ছে গহীন জঙ্গলে,
আমার চুলের মুঠি জোরে
টানছে কেউ কেউ, লাথি মারছে পাঁজরে, মাথায়;
আমি তরুণ বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে
এক ঝটকায় ওদের কব্জা থেকে মুক্ত হ’তে চেস্টাশীল।
১৮।২।৯১
শামসুর রাহমানের সঙ্গে
সে এখন বহুদূরে, একা একা থাকে সারাদিন,
এভাবেই বেলা যায় এবং ঈষৎ ভাঙা গালে
গজায় সফেদ তৃণ, নিয়মিত চুল ঝরে; হায়,
অবসিত দূরন্ত কেশর। বহুদিন
পর তার সঙ্গে দেখা করবার সাধ হ’লো। বাড়িতেই ছিল,
প্রায়-প্রেত, গানে-পাওয়া, খানিক বিব্রত।
‘এখন কেমন আছ,’ শুধারেই, বলে সে হাসার
চেষ্টায় অধিক স্লান, ‘ভাল, বেশ ভাল, তুমি? কণ্ঠস্বরে
নিস্পৃহতা, যেন রুক্ষ সান্ন্যাসী, তবুও
তার খোল থেকে তাকে বের ক’রে আনার ইচ্ছায়
বলি, ‘ভাই চল যাই, কোথাও বেড়িয়ে আসি।‘ ভাবলেশহীন
দাঁড়ানো, প্রস্তাবে উদাসীন।
অনন্তর ব’সে থাকা; চা খাওয়া, অতীত
টেনে আনা লাটাইয়ের সুতোর মতন, লেখা না লেখার
অর্থহীনতায় নিমজ্জিত
কণ্ঠস্বর তার; বলে এক ফাঁকে ‘কবির, প্রতিভা
মুছে যায় হাজার হাজার মূর্খ আর উন্মাদের হট্ররোলে, অট্রহাসি
বেজায় নাকাল করে দরবারী কানাড়াকে আজ।‘
শুনি তার সমাচার আর
ভাবি, যাকে জানি স্বল্পবাক বরাবর,
সে কেন এখন এত বেশি কথা বলে
সূর্যোস্তের দিকে মুখ রেখে? কতিপয়
ক্ষিপ্র যুবা, জিনস্-এর ট্রাউজার, বুক-খোলা শার্ট, গলায় সোনালি চেন,
হোন্ডায় সওয়ার, ভুল স্লোগানের মোহে আত্মাহারা।
ব’সে আছি আমরা দু’জন মুখোমুখি; অন্ধকার
ডানা মেলে। ‘এইসব যুবা
আত্মপরিচয় ছিনতাই ক’রে মশগুল খুব, উপরন্তু
জন্তুর চেয়েও হিংস্র ভ্রাতৃহননের মহড়ায়
দক্ষতার চূড়া স্পর্শ করে, ওরা পিতৃঘ্ন সবাই।‘ তার কথা
পাথরের চাপ, অস্বস্তির কাঁটায় অস্থির হই।
এখনও কবিতা তাকে মাঝে-মাঝে পাঠায় মদির পত্রাবলী,
কে এক নিভৃত ডাক পিয়ন, উড্ডীন,
বিলি করে বেলা অবেলায়; পাড়টা যখন কোনও
আফিমখোরের মতো ঝিমুনিতে বিহ্বল, তখন
নিজের সঙ্গেই তর্ক করে, যেন আমি নেই পাশে। দু’একটি
পাতা উড়ে আসে অন্ধকার ক্রমশ দাঁতাল হয়।
কেমন বদলে যায় চেয়ার বারান্দা, ছবি, বই; যেন দেবোপম ব্লেক
অদূরে আছেন ব’সে রাধাচূড়া গাছটির মগডালে। পেঙ্গুইন পাখি
অকস্মাৎ; শব্দেরা মাছের মতো ঘিরে
ধরে তাকে, ত্র্যাসট্রে কোকিল, ডাকে। এত দূরে থাকে
শহরে এক প্রান্তে, তার কাছে তবুও আসব বার বার।
১০।৩।৯১
শিল্পের হরিণ
ছোটাছুটি, হুটোপুটি, ঘষটানি ঘড় ঘড়, গোঁ গোঁ,
শিল্প-হরিণের গলা ফাঁক। কবি আর চিত্রকর
নিশ্চুপ থাকবে তবু? শকুনের ঝাঁক চোখ ছিঁড়ে
নেয়, পাঁজরের মাংস বেবাক গায়েব। ভয়ঙ্কর
খুবলানি লাগাতার; মোচড়ানো ছায়া প’ড়ে থাকে।
ক’জন হুতুশে লোক ঢাকঢোল ফেলে রেখে ধোঁয়া চেখে
শ্মশান-সুহৃদ, বিস্মৃতির খেয়া সুদূর কোথায়
নিয়ে যায় শিল্পহীনতায় বোধের ওপারে। ভাবি,
খুনীদের জব্দ ক’রে কোন্ ইন্দ্রজাল মৃগছাল
আর কিছু হাড়ে পুণ্যজল ছিটিয়ে ফিরিয়ে দেবে
নান্দদিক স্পন্দন মূলতঃ নইলে দরবেশ হ’য়ে
বিয়াবান বনে ঘোরা সমীচীন। নদী-বিছানায়
বিপুল সূর্যাস্ত নিদ্রাতুর, স্বপ্নে তার মাঝে মাঝে
শিঙ থেকে জলকণা ঝেড়ে ফেলে শিল্পের হরিণ।
১৩।১।৯১
শুদ্ধতার জন্য
আর নয় কটুবাক্য বান্ধব, নিদেন পক্ষে দু’ এক বিঘৎ
পবিত্রতা থাকুক বজায়, স্মিত তিনি
বললেন চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে সিদ্ধার্থের চেনা
মুদ্রা ধার ক’রে, সুহৃদের সুবচন
অর্চনার অন্তর্গত, ধুপ-ধুনো জ্বালি। চেয়ে থাকি
নিষ্পলক, যেন আমি হাতকড়া পরা অপরাধী।
শুধু সুরে দোয়েল করাচ্ছে স্নান নিঝুম বাড়িকে
অবিরত, এরকম জন্মে শুনিনি; মনের ঘাটে
টলটলে জল ছল্কে ওঠে
বার বার। চড়চড়ে দুপুরের বুক চিরে
রিকশা-অলা চলেছে কোথায়,
তার স্নানাহার
স্থগিত এখন ভেজা পিঠে ছন্দিত প্রশ্নের মৃদু
ওঠা, পড়া, বিশুদ্ধতা কতদূর? ‘কাছে ধারে
পুষ্করিনী পেয়ে গেলে গা’ ধুয়ে পবিত্র হব’ ব’লে
সে দ্বিগুণ গতিবেগে চালায় প্যাডেল।
পরীবাগে বাগিচার ঘ্রাণ চুরি ক’রে নিয়ে গেছে
ক’জন মেথর, যারা থর থর কাঁপে
সমার্জনী হাতে পৌরসভার মেজাজ
পারদের মতো চ’ড়ে গেলে। গলা অব্দি আবর্জনা
আমার, উৎকট গন্ধ, ভন্ভনে মাছি; লগবগে
নীতি টুটি চেপে ধরে, উঠে এসে পা পিছলে পড়ি
পরীদের হাম্মামে হঠাৎ, হাবুডুবু খাই, পারি না নিশ্বাস
নিতে, তবু শরীর ভেজে না।
বেজন্মা রাস্কেল ব’লে বিষম চেঁচাই প্রায়শই,
ভাঙাই পাড়ার ঘুম, বন্ধুর সদুপদেশ মাঠে
মৃত; একবার বাগে পেলে হয়, কোনও স্কাউন্ড্বেল
ঝর্ণা তলে এক ফোঁটা পানিও পাবে না
কিছুতেই। লোকে বলে, একরোখা কুলাঙ্গার আমি;
শ্যামলিমা আমার নিকট থেকে দূরে
চলে গেছে ভিতরের ঘরে,
প্রিয়ম্বদা কেউ নেই, যে আমার দায়ভাগ ব’য়ে
পাঠাবে শোধনাগারে আর মিষ্টি মুখ
করাবে পালা পার্বণে। নিরক্ষর চাঁদ
খিস্তি খেউড়ের মেঘে অকৃপণ মাধুর্য ছড়ায়;
আমি তো পতনশীল, কী ক’রে অস্থির হাতে শুদ্ধতার পারাবত ছোঁব?
২৫।৩।৯০