যুবক যুবতী
পুরানো বাড়ির দোতলার ছোট ঘরে ওরা দু’জন শয্যায়
তুমুল মৈথুনে লিপ্ত যুবক-যুবতী। মুছে যায়
বারান্দা, পাশের ঘর, গোলাপের টব, গ্রন্থরাজি,
সপ্তর্ষিমন্ডল; নিদ্রামগ্ন গুরুজন,
শিশুরা স্বপ্নের কোলে রূপকথা শোনে।
জ্যোৎস্নায় বিভ্রান্ত কাক অকস্মাৎ ডেকে ওঠে, নারী
বাথরুমে যাবে, কাঁদবে কি? বিছানায় পড়ে থাকে
বিস্রস্ত চুলের ক্লিপ, যুবক বালিশে খোঁজে তার
ঘ্রাণ; বিচ্ছেদের কথা ভেবে হৃদয়ে প্রবল ঝরে
কী আর্ত শিশির, রাত্রি গাঢ় হয় আরও, উন্মাদের অট্রহাসি।
অনেক বছর পরে প্রৌঢ়তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যুবক
সুদূরের সেই যুবতীর
মৃত্যুর খবর শুনে এমনকি স্তন্তিত হবে না, উদাসীন
চলে যাবে ভালেরির কবিতার দিকে।
১।৪।৯১
যে পাখিকে আব্বা
সে এসে বসলো খোলা বারান্দায়
তাঁর সৌন্দর্য সকল বর্ণনার মাপজোককে
নাকাল করে
দৃশ্যমান আশ্চর্যের চৌহদ্দিতে কবিতাসদৃশ
নিখুঁত পক্ষী অস্তিত্বে আব্বার সেই কবেকার
লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলির ঝাপটার অস্পষ্ট দাগ
আমাকে উপহাসের খোরাক বানায়
কী ক’রে সম্ভব এত যুগ পরেও কী করে সম্ভব এই উপস্থিতি
খটকার কুয়াশায় আচ্ছন্ন আমি
একটি পুরানো কাহিনীকে নতুন ক’রে ঢেলে সাজাই
হঠাৎ মনে পড়ে আমাদের পরিবারের ওষ্ঠে
উড়ে বেড়ায় এক কুসংস্কারের কালো প্রজাপতি
মরহুম আব্বা তাঁর তল্লাটের নামজাদা পক্ষী শিকারী
শিকারে গিয়ে হরিয়াল বেলে হাঁস চখা আর
শোরখাবের রক্তাক্ত ভার হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরেননি
এমন কোনও দিনের কথা জানা নেই
পার্থ দৃষ্টির অধিকারী তিনি একবারই শুধু ফিরে এসেছিলেন
শূন্য হাতে গোধূলিতে যেদিন সবচেয়ে আশ্চর্য পাখিটি
তাঁর অনুপম দক্ষতাকে বিদ্রুপ ক’রে মেঘে উধাও
যদিও ছররার ধমকে বিচলিত
এখন আম্মা কখনও সখনও কণ্ঠে রূপকথার সুর এনে বলেন
আমাদের পরিবারে যত অঘটন ঘটে
সবকিছুর সঙ্গে জড়িত আব্বার দোনলা বন্দুকের
ফসকানো টিপ ঈষৎ আহত পাখির বেদনার ছায়া
পাখিটির মুখের কাছে
তুলে ধরি শস্যের দানা রুটির টুকরো
কিন্তু চঞ্চু উন্মোচিত হয়নি পানির পেয়ালাও স্পর্শ রহিত
আমার শুশ্রুষা প্রত্যাখ্যানে শস্যের খোসার মতো অসার
এসেছি তোমার হাতে গুলীবিদ্ধ হ’তে
পাখিটি বলে ভাবলেশহীন মানুষের কণ্ঠস্বরে
আমার শিরায় পিতৃরক্তের তোলপাড়
অথচ পক্ষীবধের তালিম আব্বার কাছহ থেকেও নিইনি
যে পাখিকে আব্বা শিকার করতে পারেননি
সে আবছা ক্রোধ এবং অভিমানের ছায়া থেকে
স’রে দাঁড়িয়ে আনন্দের স্বর্গীয় বিন্দু
এবং আমার কবিতায় চিরন্তনতার উদ্ভাসন
২৪।৫।৯১
যে-ঘরে আমার বসবাস
যে ঘরে আমার বসবাস, তার সঙ্গে সূর্যালোক
বেজায় কার্পণ্য করে। ফলত মনের ঘাটে বিষাদের ছায়া
প্রত্যহ বিস্তৃত হয়, যেন কেউ মৃত্যুর খবর
শোনাবার ব্যাকুলতা নিয়ে ব’সে থাকে সারাক্ষণ
আমার শয্যায় ঠিক মর্মর মূর্তির মতো; তাকে
হেলায় হটিয়ে দেবো, শিখিনি এমন মন্ত্র আজও।
কখনও কখনও সুন্দরীর রূপ ধরে, অধরের তাপ দেয়
আমার তৃষিত ঠোঁটে, বুকে
টেনে নেয় মোহন ভঙ্গিতে, অকস্মাৎ
বিস্মিত নিজেকে দেখি এক পিশাচীর আলিঙ্গনে
বিমূঢ় কয়েদী আর মুখের ভেতর
সীসার, দস্তার গন্ধ, মেরুদন্ড হিম হ’য়ে আসে।
মধ্যরাতে দুঃস্বপ্নের শ্বাসরোধকারী চাপ থেকে খুব ঘেমো
অশক্ত শরীরে জেগে উঠি। পাশে নেই
জীবন সঙ্গিনী; সে এখন
হাসপাতালের বেডে। সফেদ হাঁসের মতো নিঝুম সেবিকা
হয়তো বড়ি দিয়ে তাকে ঘুম
পাড়িয়ে নিজস্ব ডেস্কে ব’সে দেখছেন হাতঘড়ি।
এখন যে নেই পাশে তার
অভাব কামড়ে ধরে নিয়ত আমাকে উন্মাদিনী
বেড়ালের মতো; মনে পড়ে ফুলশয্যা কবেকার, থরথর
বিবাহিত ঠোঁটে
প্রথম চুম্বন আর মিলনের উন্মথিত রাত;
অনেক বছর আগে রতিতৃপ্ত তার মুখে ভোরবেলাকার প্রসন্নতা
মনে পড়ে, প্রায় তিন যুগ আগে
প্রথমবারের মতো তার উদরের ষ্ফীতি, বিবমিষা, বমি;
অনন্তর একদিন ম্যাডোনার ধরনে নতুন
খাটে বসে থাকা পরিজনদের মাঝে,
সন্তানের দিকে স্মিত তাকানো এবং অন্তরালে
স্তন্যদান, কত দ্রুত কালো ঘোড়সওয়ার সর্বদা ধাবমান।
এইতো সেদিন গেল আরোগ্য নিবাসে, মনে হয়
কতিপয় শতকের হাওয়া ছুঁয়ে যায়,
আমার বুকের মধ্যে হৈমন্তিক ঝরা পাতাদের হাহাকার।
সে কবে আবার পার্শ্ববতী ধু ধু শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলবে
পরিচিত ঘ্রাণে আর আলোছুট ঘরে এসে বাদ বিসম্বাদে
আমাকে নাজাত দেবে পিশাচীর বাহুপাশ থেকে?
১৭।৩।৯১
লাল স্কার্ফ
ভোরবেলা কেউ জেগে ওঠার অনেক আগেই
বিজয়-উদ্যানের মাথায় পরিয়ে দেবো
একটা লাল স্কার্ফ
যা দেখে পথচারীরা পারবে না
ফিরিয়ে নিতে চোখ
থামতে ওদের হবেই বেশ কিছুক্ষণের জন্য
সেই লাল স্কার্ফ এমন একটি কবিতা
যার আটপৌরে হরফগুলোকে ছাপিয়ে
গভীর উপলব্ধির উন্মীলন
কিংবা যা’ সঙ্গীত সাধকের সুরাতীত সুর
আমার যৌবন এবং প্রৌঢ়ত্বের
বিভৃততম অনুভূতির নীলিমাকে স্পর্শ করা উচ্চারণ
অনেক বিঘাজেড়া বাদুড়-ছায়ার নিচে
হাওয়ায় দুলতে থাকবে
রক্তজবার মতো তাক লাগানো স্কার্ফ
পূর্বপুরুষদের হাসি উঠবে ঝলমলিয়ে
স্কার্ফটি বানিয়েছি বসন্ত আর
চিরন্তনতার রেশমি বসন কিঞ্চিৎ কাটছাট ক’রে
লাল স্কার্ফ কখনো
রক্তের ছোপ-লাগা হার কখনো রামধনু
অনেক মৃত্যুর নিস্তব্ধতার দুর্মর স্বপ্নতরঙ্গ
সেসব মৃত্যুর মধ্যে প্রত্যক্ষ করি নিজের মৌত
বুকের ভেতর বরফের বোবা চিৎকার আর
অনেকের নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় আমার বেঁচে থাকা
৭।৫।৯০