- বইয়ের নামঃ ধ্বংসের কিনারে বসে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনুশোচনার গান
চৈত্রের আতশি রোদে দিনভর হেঁটে হেঁটে সর্বস্ব খুইয়ে
কায়ক্লেশে পৌঁছে যাই ভুতুড়ে বাড়িতে। ভয়ে চুল
খাড়া, যেন কাটা ধান গাছের তিরিক্ষি গোড়া; ভুল
ক’রে এসে গেছি, তাই মাথাটা নুইয়ে
ব’সে থাকি আরশোলা ইঁদুর এবং চামচিকে, বাদুড়ের
আস্তানায়। এভাবেই ঢের
ভুল ক’রে গেছি, যাচ্ছি ক্রমাগত; এখন কোথায়
যাব এই ঘুরঘুট্রি অন্ধকারে? হায়, এখানেও থাকা দায়।
প্রায় জেতা খেলা
সামান্য ভুলের জন্যে হেরে গেছি ভর সন্ধ্যেবেলা
আনাড়ির ধরনে বস্তুত। বার বার।
শক্রদের করেছি নিবিড় আলিঙ্গন
মিত্র বিবেচনা ক’রে; বিভ্রমের দোলাচলে মৈত্রীর বন্ধন
বেবাক ফেলেছি ছিঁড়ে। নষ্ট যারা, তুখোড় নচ্ছার,
তাদের গলায় মালা দিয়েছি পরিয়ে ঘুরে ফিরে
ঢাক-ঢোল, পেটানোর মাঝে,
হেলাভরে ঈগলের চূড়া ছেড়ে ভীষণ কলহপ্রিয় বায়সের নীড়ে
খুঁজেছি আশ্রয়, এরকম শত কাজে
ভ্রান্তির পেরেক বিদ্ধ। যদি মগ্ন হই সংশোধনে,
তবে কি ধীমান সজ্জনেরা আমাকে দেবেন দীক্ষা নতুন বোধনে?
কুকুর, বেড়াল কিংবা হাঁস, মুরগি, কবুতর- কিছুই পুষি না;
আমার আরাধ্য সেই কবে থেকে ত্র্যাপোলের বাণী।
টেবিল ল্যাম্পের নিচে কত রাত সাজিয়েছি অনেক হরফ
নিদ্রাহীন, ভোরবেলা দেখি ভুল শব্দ ভেংচি কাটে;
কবিতার গায়ে শুধু বিকৃত, বেঢপ সাজ; হাত-পা বরফ
হ’য়ে যায়। যে তন্বীকে অক্ষরবৃত্তের ছাঁচে এনে শূন্য খাটে
সযত্বে বসাই, সে নিমেষে উগ্রচন্ডী স্তনের রাক্ষসী হয়;
বড় রকমের ভুল হ’য়ে গেছে কোথাও নিশ্চয়।
দেখ, দেখ, এ বয়েসে দেচ্ছি এ কেমন লাফ;
আগুনে, অথই জলে যেখানেই পড়ি, সাফ সাফ
ব’লে দিই, অনুশোচনার
কোন গান ইনিয়ে-বিনিয়ে আমি গাইবো না আর।
১৮।৩।৯১
অলৌকিক সেতু
কষ্ট হোক, এবার নিশ্চিত ফিরে যাব কোলাহল
ছেড়ে ছুড়ে নিজের গহনে। অতি তুচ্ছ, অস্পষ্টতা-
জড়ানো কারণে কাদা মেখে দেবে কেউ
আমার সত্তায়, ঠোঁট বেঁকিয়ে কেউবা দর্পভরে
যাবে চ’লে পার্টি কিংবা সমিতির ডাকে, তবু আমি
এখন সেখানে যাব, স্বচ্ছন্দে নিশ্বাস নেব, যেখানে শব্দেরা
বিভিন্ন রঙের মাছ, অবচেতনায়
সঞ্চরণশীল আর স্বপ্নের কিনারে
অত্যন্ত রহস্যময় জেলে জাল ফেলে ক্রমাগত
অবয়বহীন, কুয়োতলায় তরুণী
নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি
গেরস্তের ঘরে দেয় ঝংকৃত আগুন।
অগ্নিশিখা থেকে ধার নিয়ে উদ্দীপনা
গ’ড়ে নেব মর্ত্য আর অমর্ত্যের অলৌকিক সেতু।
১৩।১।৯১
অসমাপ্ত কবিতা
খরায় শব্দের চাষবাস বেজায় উচ্ছন্নে গেছে;
সুন্দরের পা কাটা এবং চোখে হলুদ পিচুটি,
তা ব’লে এভাবে দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে সারাক্ষণ
ব’সে থাকবার কী-যে মানে হয়! অসুখ তাড়াও,
আঙুলের ডগা দিয়ে জাগাও আবার ভালবাসা;
ভুল নাম শুনে তুমি জনপদে চুপচাপ থেকো।
ক’পোয়ালা কফি খেলে, স্পর্শ পেলে ক’জন রূপসী
রমণীর একটি কবিতা লেখা যায় নিরিবিলি?
ট্রাউজারে স্কচ কতবার চলকে পড়লে শব্দবোধ
রুপবান হতে পারে? নিশিন্দা পাতায় প্রতীকের
প্রজাপতি উড়ে এসে বসে কি কখনো? বাগানের
ছায়ায় দাঁড়ায় এক আহত হরিণ ভ্রমবশে।
একটি কবিতা অসমাপ্ত রয়ে গেছে বহুদিন
থেকে, এরকম হয়, হতে থাকে মাঝে-মাঝে কিছু
জরুরি শব্দের অকস্মাৎ গা ঢাকা দেয়ার হেতু;
একটি কবিতা অসমাপ্ত রয়ে গেছে দীর্ঘকাল।
জীবনযাপন অবসাদ মুখ্য হয়ে ওঠে, বাড়ে
রক্তচাপ, বিপন্নতা কী আয়েশে পাশে শুয়ে থাকে।
কখনও হবে না লেখা আর এই বিশেষ কবিতা
ভেবে মনোকষ্ট হয়-যেন কোনো বাড়ি নিরালায়
একটি দেয়াল নিয়ে বোবা, সেই কবে ক্ষয়ে গেছে
ইটের গাঁথুনি, বুনো ঘাস অবিরল খল খল
করে ভিটেমাটিতে এবং চামচিকা, ইঁদুরের
চাঞ্চল্য বাড়তে থাকে ক্রমাগত প্রহরে প্রহরে।
নিভৃতে বিষণ্ন থাকি, থাকি পদ্যের সংস্রব থেকে
দূরে, পরবাসে, তবু একটি দোয়েল টুপ করে
ফেলে যায় উপমা, কোত্থেকে ঝরা পাতা রূপটান
দেয় কোনো ছন্দের, কনকচাঁপা খুঁজে আনে মিল।
শব্দগুলি একে একে অপচয়ী পুত্রের মতন
ফিরে আসে, পুনরায় রুগ্ণ, ক্ষয়া কবিতা পূর্ণিমা।
দর্শনের খুঁট ধ’রে উদাসীন ঘোরঘুরি করি-
আমি কি নিজের কাছ থেকে ধু ধু দূরে সরে যাচ্ছি?
নিদ্রাহীন রাত্রিগুলি শুষে নেয় কত অশ্রুজল,
অমরত্ব মারবে বিপথে এনে, মুখে এক ফোঁটা
পানি দিতে থাকবে না কেউ ধারে কাছে; এ জীবনে
অসমাপ্ত কবিতার মতো দীর্ঘশ্বাস হয়ে যাবে।
৫।৫।৯১
আঙ্গিক
সহসা কৌতুকপ্রিয় আসমানে বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ,
দেবদূতদের নিরর্থক হাসি, মাংসাশী হাওয়ার হা-পিত্যেশ।
সেই কবে নির্গমন শ্রাবণ দুপুরে, ভেজা মাথা,
সপসপে জামা, রক্তশূন্য সেবালোভী
রোগীর মতন দশ আঙুল; যাইনি
তেমর কারুর কাছে তুর্কী তোয়ালের
চাঞ্চল্যে শুকিয়ে দেবে মাথা। উপন্যাস পাঠাশেষে সে ঘুমায়,
স্বপ্নরিক্ত খাট, ভবঘুরে প্রজাপতি মুগ্ধাবেশে চাটে তাকে।
নিরুত্তাপ কলহে অথবা নগ্ন ঘুমে কেটে গেছে
বেখবর কতকাল। কবিতার নতুন আঙ্গিক
অধরা; সরস পাতাকাঙ্খী জিরাফের
গলা আর জেব্রার দুরন্ত দৌড়ে, আফ্রিকার কালো
স্তনে, ক্রেমলিন-তারকায়
নতুন আঙ্গিক খুঁজে সান্নিপাতে লবেজান আমি।
ব্যর্থতা নিছক উট উপবিষ্ট বালির উপর ব্যথাতুর।
তবুও তো ইচ্ছে হয়, সফেদ কাগজে
শুভেচ্ছা শব্দটি লিখে শক্র মিত্র সকলের বুক-
পকেট ভরিয়ে দিই, হাত রাখি সব ফুটোময়
এতিম খানার ছাদে, নিঝুম প্রহরে একা ফনিমনসার
বনে বিদ্ধ হ’য়ে হু হু বুকের শোণিতে কিছু কুসুম ফোটাই।
ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি হারাই অরণ্যে পথরেখা।
অকস্মাৎ দারুণ খরায় এক ঘড়া টলটলে জল নিয়ে
কবিতার নতুন আঙ্গিক।
১৪।৯।৯১