বোধ
ফ্ল্যাট বাড়িটার তেতলার জানালায়
চুড়ি পরা হাত, দীর্ঘ খোলা চুলে চিরুনি-আদর, দাঁত
মাজতে মাজতে তরতাজা যুবক বেরিয়ে আসে
গলির ভেতর থেকে, টগবগে তেলের কড়াইয়ে
ভাজা হচ্ছে ডালপুরি, মগে গরম চা,
বুড়োসুড়ো একজন, গায়ে
শাল, লাঠি হাতে
একলা হাঁটেন পথ এক ঝাঁক সাদা-কালো
কবুতর গম খায়
আলোময় মাটিরঙ ছাদে, জানালার
পর্দা চমকায়
হাওয়ায় ছোঁওয়ায়, কিছু বাসন-কোসন
হচ্ছে ধোওয়া; কলতলা গুঞ্জরণময়,
পুরনো দেয়াল থেকে ঝুলে-পড়া নৌকা, নির্বাচনী পোস্টার, বাতিল,
নৌকো হচ্ছে বালকের হাতে, পোস্টম্যান
দূর থেকে-আসা চৌকো খাম, ম্যাগাজিন দিয়ে যায়; দীর্ঘকাল পরে
ফিরছে হাসপাতাল থেকে ঘরে রোগী,
বেনারসী শাড়ির মতন
রোদ বস্তিটার ছাদে-
ঘর দোরে প্রজাপতি,কে মেয়েলি কণ্ঠে ‘মতি মতি’
বলে ডেকে ওঠে,
অগাধ বিস্ময়ে দেখি, পাখি ওড়ে
ছড়িয়ে আমার মনে জ্যোতির্ময় বোধ।
মরণোত্তর
লোকটাকে দেখতে সুন্দর বলা যাবে
কিনা, এ বিষয়ে
মতভেদ থাকা
বিচিত্র কিছুই না। তবে সকলেই
সমস্বরে এ-কথা বলবে, তার কথা বলবার
ধরনে একটা কিছু আছে, যা সহজে
টেনে আনে ভিড়, ওর কথা
শোনে লোকে কান পেতে ঝাল মুড়ি, ছোলা ভাজা আর
চীনে বাদামের মজা চিবোতে চিবোতে। আজনবি
বহুদূর থেকে
এসেছে এখানে রহস্যের ঘ্রাণ নিয়ে। ছিল তার
পোশাক-আশাকে কিছু দূরত্বের ছাপ।
তাকিয়ে ভিড়ের দিকে পাখির ধরনে
যখন সে আকাশের দিকে
তর্জনী উঁচিয়ে বলল, এই দারুণ খরায় আমি
চোখের পলকে
নামিয়ে আনতে পারি শ্রাবণের ফুলঝুরি; এই
ভয়ানক পুষ্পহীনতায়
এক্ষুণি ফুটবে ফুল হরেক রকম,
যদি আমি ফোটাই আমার হাতে একটি বিশেষ
মুদ্রা, ভাইসব,
তখন অনেকে তার উচ্চারণে ধ্রুবতারার ঝলক দেখে
শিহরিত হলো, কেউ কেউ খুব জোরে
হেসে উঠে অবিশ্বাসী প্রকরণে হলো মনোযোগী।
চতুর্দিকে থমথমে নীরবতা। লোকটা হাতের
যাবতীয় মুদ্রা কী সহজে ফোটাল, অথচ তার
সকল উদ্যম ফলহীন
গাছের মতোই সে বিশাল জনসভায় থমকে
থাকে; দুয়ো ছুটে আসে তার
দিকে দশদিক থেকে, পাথর ও নুড়ি
ভীষণ ছুড়তে থাকে অনেকেই। রক্তাক্ত শরীরে
নিষ্প্রাণ সে পড়ে থাকে ভয়ানক ভেঙে-যাওয়া পুতুলের মতো।
যখন প্রান্তর
জনহীনতায় ফের রহস্যজনক হয়ে ওঠে,
তখন হঠাৎ নাচে খই বৃষ্টির এবং রঙ-
বেরঙের ফুল ফুটে ওঠে বন্ধ্যা মাটিকে হাসিয়ে।
রোমকূপ কেঁদে ওঠে
হৃদয়ে আমার তুমিই গড়েছ
নয়া আঙ্গিকে
স্বপ্নের টেরাকোটা;
তৃষ্ণাকাতর জীর্ণ শাখায়
প্রহরে প্রহরে
ঝরে অমৃতের ফোঁটা।
আমার সময় খুব বেশি নেই,
এই পর্যায়ে
সব কিছুতেই তাড়া।
বাকি পথ আমি কীরকম ভাবে
পাড়ি দেব বলো
সুজাতা তোমাকে ছাড়া?
মহাজাগতিক তন্তুজালের
রহস্য কত
এখনও রয়েছে ঢাকা।
তারও চেয়ে বেশি রহস্যময়
তোমার গহন
সুনিবিড় চেয়ে-থাকা।
তুমি যাকে ভালোবাসতে একদা
তার ছায়া কেন
আমাদের মাঝে পড়ে?
সেই ছায়াটির মৃদু কম্পনে
আমার নতুন
স্বপ্নেও ঘুণ ধরে।
এই অবেলায় হৃদয়ে আমার
পড়েছে তোমার
ফুল্ল পদচ্ছাপ।
তোমার হাতের স্পর্শে এবং
উষ্ণ চুমোয়
ভুলেছি মনস্তাপ।
নিসর্গে আমি তোমাকেই দেখি,
তোমাতে প্রকৃতি
পেয়ে যায় অবয়ব।
তোমার শরীরে আজো জ্বলে ওঠে
যখন তখন
বর্ণিল উৎসব।
পেয়েছি তোমাকে, ভাবি কৃপণের
সঞ্চয়ী টানে,
পাখি হয়ে নাচে মন।
কিন্তু তবুও না পাওয়ার ধু-ধু
আঁধিঝড় কেন
প্রাণে তুলে আলোড়ন?
শারদ দুপুরে, হেমন্ত-রাতে
আমার প্রতিটি
রোমকূপ কেঁদে ওঠে।
অন্ধ কাঙাল পথে চেয়ে থাকি;
ব্যর্থ ওষ্ঠে
বিষাক্ত ফুল ফোটে।
সকাল থেকে সন্ধ্যা
সকাল থেকে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা থেকে সকাল একজন লোক
কী-যে করে, সবাই
ভারি তাজ্জব। বোঝা যায়, ওর ঝোঁক
কেবলি পালিয়ে বেড়ানোয়;
কিছু একটা খোঁজা ওর চোখ দুটোয়
মানচিত্র দিয়েছে এঁকে। ‘এই ভাই
কেন তোমরা এমন স্বভাব’ এ-কথা কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতে
গিয়েও থম। কলতলায় পানি ভরতে
তাসা আইবুড়ো মেয়ে,
যার গা বেয়ে
যৌবন ঝরছে ব্যর্থতায়, চা-খানার ছেঁড়া হাফ-প্যান্ট-পরা
ছেলেটা, মনিহারি দোকানদার
আর ছেলেভোলানো ছড়া
কেটে বেড়ানো বুড়ো, যার
হাওয়া-ওড়া চুলে
মেহেদির ছোপ,
‘এই দুনিয়া পায়রার খোপ
বৈ তো নয়’ শব্দগুলো যে ফকিরের কণ্ঠে বাজে,
তারা প্রত্যেকেই লোকটার গতিবিধিকে প্রশ্নাধীন করে তুলে
ফের মন দ্যায় নিজ নিজ কাজে।
লোকটা কখনো ফুটপাতে, কখনও টানেলে,
কখনোবা ময়দান ছেড়ে নক্ষত্র-ছাওয়া পথে খুব একা
চুপিসারে পা ফেলে
এগোয়, যাতে কারো সঙ্গেই দেখা
না হয়, কখনো ভোঁ দৌড়ে গলির ভেতর
উধাও বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়। অষ্টপ্রহর সবার চোখে ধুলো
দিয়ে খোঁজে ঘরের ভেতর ঘর।
পাড়ার রঙ-বেরঙের লোকগুলো
জানে লোকটা কারো কোনো ক্ষতি
করবে না কিছুতেই। হাতে কখনো লাঠি
নেয় না তুলে, দা কুড়োল নদারৎ,
গলায় খেলিয়ে স্বর্ণচাঁপা জাগানো গৎ
পথ হাঁটে, নাড়ে না তুখোড় ভঙ্গিতে কোনো কলকাঠি;
তবে বোঝা দায় তার মতিগতি।
লোকটার মুখের আদলে
কেউ কেউ বলে, রহস্যের তুলি বুলিয়ে দিয়েছে অচিন
রঙ, আসলে
সে লোকচক্ষু থেকে সারাদিন,
সারা রাত কষ্টেসৃষ্টে আগলে রাখে
ধুকপুক বুকে নিজস্ব কিছু স্বপ্ন, যেমন বিপদে কান-খাড়া পাখি
তার শাবকগুলোকে ঢাকে
পাখায়। আমি, সত্যি বলতে কী, নিগেটিভ ছবির মতো
লোকটার পাশেই থাকি,
আমার হাতের চেটোয় তার বুকের রক্ত ঝরে অবিরত।