- বইয়ের নামঃ আমার কোন তাড়া নেই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আজকাল খুব বেলা করে
আজকাল খুব বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার
অথচ এমন একদিন ছিল
যখন আমি অন্ধকার থাকতেই জেগে উঠতাম
শুনতে পেতাম অনেক দূর থেকে কোনো পাখির গান
অনেকক্ষণ ধরে বালিশে মুখ গুঁজে
পাখির চাউনি স্বপ্নে দেখা ঘোড়ার চমকিলা পিঠ আর
একটি মেয়ের সোমত্থ বুকের কথা ভাবতাম
দমকা হাওয়ায় উলটে যাওয়া নীল পদার আড়ালে
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে একটি কি দুটি তারা চোখে পড়ত
আজকাল বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে আমার
ঘুম ভাঙার পরও
বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না
দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না
এক সময় খুব সিগারেট খেতাম প্যাকেটের পর প্যাকেট
এখন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি
কিসসু আমার ভাল লাগে না
সকালবেলা মানে ন’টা-দশটার পর থেকেই
আমার মন খারাপ থাকে
আস্ত সকালবেলাটাকেই চুসকি মনে হয় বিছানার
চটকানো চাদরটার দিকে তাকাই
গিজগিজে দাড়িতে হাত বুলোই বাকরখানির ঘ্রাণ
ভেসে আসে কোত্থেকে রেডিওতে গান বাজে হাসন রাজার
একটা মেষপালক আর একটা গয়লানী জবর
জোড় খায় ঝোঁপেঝাড়ে কবে যেন কোন তৈলচিত্রে
দেখেছিলাম মনে পড়ে
চাটা বিস্বাদ লাগছে দাঁত দিয়ে রুটি ছিঁড়ি
খেতে হবে বলেই খাওয়া অনেক আগে
একজন বুড়োসুড়ো খুব ফর্সা মানুষ যার নাক ছিল
ঈগলের চঞ্চুর মতো
চায়ের বাটির দেয়ালে লেগে থাকা চায়ের
ভেজা পাতার দিকে চোখ রেখে আমাকে
বলেছিলেন তোমার জীবন যাবে বুঝেছ হে ছোকরা
কালি ছিটোতে ছিটোতে
তা কালি নেহাৎ কম ছিটোইনি রবীন্দ্রনাথের মুখ
কাজী নজরুল ইসলামের মুখ
জীবনানন্দের মুখ বুদ্ধদেব বসুর মুখ
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ
কমলকুমার মজুমদারের মুখ একরাশ ফুল হয়ে ভাসে
আমার চেতনা প্রবাহে
ইদানীং সকালবেলা থেকেই মন খারাপ থাকে আমার
দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না
মাথায় চিরুনি চালাতে ভাল লাগে না
সেলুনে যেতে ভাল লাগে না
অফিসে যেতে ভাল লাগে না
পরস্ত্রীর সঙ্গে দিল্লাগি ভাল লাগে না
টাইপরাইটারের আওয়াজ শুনতে ভাল লাগে না
পিকাসোর জীবনী পড়তে ভাল লাগে না
বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে ভাল লাগে না
স্ত্রীকে চুমু খেতে ভাল লাগে না
সাদা কাগজ দেখতে ভাল লাগে না
খবরের কাগজের হেডলাইনে
চোখ বুলোতে ভাল লাগে না
মায় কালি ছিটোতে ভাল লাগে না
এখন আমি সিগারেট খাই না
আবার ধরব কিনা ভাবছি
আমার রক্তের ভেতরে গোধূলি একটা স্তোত্র তৈরি করছে
আমার মগজের ভেতরে
এক ঝাঁক পাখি খড়কুটো জড়ো করছে দিনরাত
আমার বুকের ভেতরে ক্রমাগত
একটা রুপোলি গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে
এবং জীবন
কুষ্ঠরোগীর ফোলা ঠোঁট নিয়ে চুমো খাছে আমাকে
মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে
ফাঁসিতে লটকে দিই কিংবা নিজেই এই মাথাটা
পেতে দিই চলন্ত ট্রেনের চাকার নিচে
কিংবা সূর্যাস্তের রঙের মতো অনেকগুলো ট্যাচলেট খেয়ে
অসম্ভব লম্বা একটা ঘুম দিই
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে যায় একজন বলেছিলেন
তোমার জীবন যাবে কালি ছিটোতে ছিটোতে
দেখি কালি আমাকে শেষ পর্যন্ত
কতটা ডোবাতে পারে কতটা।
আমার অসুখ
হ্যালো হ্যালো জাভেদ, তুমি
শুনতে পাচ্ছ?
এখানে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
অনেক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, শুধু হ্যালো হ্যালো
বলাই সার, ওপার থেকে
কোনো সাড়াশব্দ নেই। টেলিফোনের ভেতর
একটা ভূতুড়ে আওয়াজ ছাড়া
অন্য কোনো ধ্বনি আমার কানে
বাজছে না আজ।
অথচ একজন মানুষের কণ্ঠস্বর
শোনার জন্যে আমি কী রকম তৃষ্ণার্তা হয়ে উঠেছি
তুমি তা বুঝতে পারবে না জাভেদ।
ক’দিন ধরে আমি এই আমার একলা ঘরে
বিছানাবন্দি হয়ে আছি। আমার টিপয়ে এখন
সূর্যাস্তের রঙের মতো
ত্র্যান্টিবায়টিক ক্যাপসুল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স,
থার্মেমিটার আর একটা পিরিচে
কয়েকটা বিস্কুট। বুঝতেই পারছ জাভেদ
এই ঘর থেকে বের হবার সামর্থ্য আমার নেই।
আজ কদিন ধরে আমি কোথাও
যেতে পারছি না। মাঝে মাঝে দেয়ালের টিকটিকির শব্দ
পাখিটাখির গান কিংবা কোনো উঠাইগিরা
কুকুরের ডাক শুনতে পাই। কিন্তু জাভেদ
এখন আমি সবচেয়ে বেশি শুনতে চাই
একজন মানুষের প্রকৃত কণ্ঠস্বর।
আমি সেই থেকে একটানা হ্যালো হ্যালো করে
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু তুমি
এখনো নিরুত্তর। কতদিন আমি তোমার ভরাট গলার
ওঠানামা শুনি না।
হাসপাতালের বেড়ে নয়, আমি আমার
নিজের ঘরেই বিছানায় নিঃসঙ্গ শুয়ে আছি।
আমার শিয়রে অনিদ্রোয় হ্রদে ভেসে বেড়ানো
কোনো নার্স নেই গলায় মালার মতো স্টোথিসকোপ দুলিয়ে
ডাক্তার আমার পালসবিট গুনছে না।
শরীরে নিদ্রার রজনীগন্ধা ফোটে না, জাভেদ। কারো
কণ্ঠস্বর, হোক সেই স্বর চেনা কি অচেনা, মধুর
অথবা কর্কশ, শুনতে পেলেই
আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠব।
জাভেদ, অসুখ তো একলা পথে ভ্রমণেই মতো। এখন
আমি ভ্রমণ করছি এক বিশাল
মরুভূমিতে, যেখানে মরীচিকা আছে
মরূদ্যান নেই, সাপে ওগরানো বিষ আছে, নেই
এক ফোঁটা দ্রাক্ষারস। আমি এই মরুভূমির
বালিয়াড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ছি
বারংবার, রাশি রাশি বালুকণায় ভরে গিয়েছে
আমার মুখ, আমার কণ্ঠনালী। এখন আমি
প্রাণপণে চাই প্রত্যাবর্তন।
আমি চেয়ে আছি অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে,
যেমন তীর্থযাত্রী আপন নিবাসে
ফিরে আসার তাগিদে তাকায় তার ফেরার পথে।
জাভেদ, বারবার দিনদুপুরে
রাতবিরেতে বেজে ওঠে আমার টেলিফোন। আর
রিসিভার তুললেই অনেক্ষণ ধরে
একটা যান্ত্রিক ভূতুড়ে আওয়াজ হতে থাকে,
কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না।
আমার আঙুল কামড়ে ধরে
ব্যাপারটা কিছুতেই আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না
খুলে বলাই ভাল
ইদানীং আমি আমার একটা আঙুল নিয়ে
খুব মুশকিলে পড়েছি
হতো যদি অনামিকা কড়ে কিংবা বুড়ো আঙুল
তাহলে তেমন ক্ষতি ছিল না
আসলে আমি আমার তর্জনী সম্পর্কে
ভীষণ উদ্বিগ্ন কেননা
একটা সিগারেট ধরাতে কিংবা কলম ধরতে পর্যন্ত
আমার ভারি কষ্ট হচ্ছে আজকাল
ভাল কথা নিজের বিষয়ে
একটা জরুরি তথ্য জানাতে ভুলে গিয়েছি
আমি এই শহরেরই একজন কবি
বইয়ের দোকানে আমার কিছু কাব্যগ্রন্থ কিনতে পাওয়া যায়
সমালোচকদের জহুরী নজর আছে
আমার ওপর
বলা যেতে পারে কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব কিছু
ধারণাও আছে আমার
আমি চাই আমার প্রতিটি পংক্তিতে
তরুণ পাখির ডানার ঝলসানি আর স্পন্দন
তন্বী স্তনের নিটোল সুষমা
বুদ্ধিমান যুবকের দিলখোলা হাসি এবং
বয়েসী দুঃখী মুখের কুঞ্চন
এবং
আমার ম্যানিফেস্টোর প্রথম লাইন হল
কাব্যগ্রন্থ কস্মিন কালেও প্রচার পুস্তিকা হবে না
ধুত্তোরি আসল কথা থেকেই দূরে সরে এসেছি
য বলছিলাম
ইদানীং আমি আমার একটা আঙুল নিয়ে
খুব মুশকিলে পড়েছি
একদিন আমি খুব রাত করে একা একা
হাঁটছিলাম রাস্তায়
রাস্তা তখন সান্নাটা আর মরা জ্যোৎস্না নিঃশব্দ
সোনাটার মত ছড়িয়ে ছিল চারদিকে
হঠাৎ বলাকওয়া নেই কোত্থেকে এক ঝাপ উঁচানো
গাউন পরা কসবীর মত পরী দাঁড়াল আমার মুখোমুখি
এবং আমি ওকে রাস্তা দেখানোর সঙ্গে যাঃ শালা
জদ্যত আমার তর্জনীটাকে
সে কামড়ে ধরল
অনম খাপ্চু চেহারার আড়ালে এই ধাষ্টামি
আমি ভাবতেই পারিনি
চিৎকার করে উঠলাম আত্ময় জ্বালাধরান
যন্ত্রণায়
অথচ আমার গলা থেকে এক ফুট্কি আওয়াজও
বেরুল না আর ঐ পরী না ফরী
ওর ডানায় ভর করে ট্রাফিক আইল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে
উড়তে উড়তে জয়নুলের পাইন্যার না হয়ে গেল
আরেকদিন একটা ডালকুত্তা
আমার এই জখমি আঙুলটাকে কামড়ে ধরল
মানে তর্জনীটাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে
ওর দাঁতের বেজায় সুখ করে নিল
অন্য একদিন ধোপদুরস্ত এক চাপ্টাবাজ
কামড়ে ধরল আমার আঙুল
দুনিয়াসুদ্ধ সবারই এক নাছোড় আক্রোশ
আমার এই আঙুলের ওপর
লোকে খামকা আমাকে ছিটেল বলে না
যখনই কোথোও আমি কোনরকম ধাষ্টামি বহুরূপী গব্বাবাজি
দেখতে পাই তখনই উদ্যত হয় আমার তর্জনী
আর যে পায় সে-ই যখন তখন আমার আঙুল কামড়ে ধরে
আমার একজন প্রতিবেশী
আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোকটিকে বাতিগ্রস্ত বলা
ঠিক হবে না, যদিও তিনি
কিছুট উটকো ধরনের মানুষ আর হর-হামেশা
বলেন মাথা-খারাপ করা কিছু কথা।
বরাবরই দেখে আসছি,
আমার প্রতিবেশীর চুল প্রায় সকল সময়
উস্কো খুসকো, অনবরত ঝাড়েন সিগারেটের ছাই,
আর কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে
মটকাতে থাকেন আঙুল। হঠাৎ কোনো কারণে আড্ডায়
তার মেজাজ সাপের ফণার মতো লাফিয়ে উঠলে,
আমি কোনো দ্বিরুক্তি না করে
সারা ময়দান তার হাতেই ছেড়ে দিই। ভদ্রলোক
ভীষণ আসক্ত নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতি। তাই বলতে যতটা
ভালোবাসেন, শুনতে ততটা নয়।
অনেকে তাঁকে পছন্দ করে না, কেউ করে বেজার
সন্দেহ। কারো কাছে তিনি সিআইএ-র
এজেন্ট, কেউ তাকে কেজিবি-র দালাল বলে
শনাক্ত করতে আগ্রহী। এ সন্দেহ সন্দেহ খেলা চলে
তাঁর আড়ালে। তিনি টের পান কিনা জানি না। তবে প্রায়শই
‘কী জানেন, সোনার রেকাবিতে আরশোলা
নির্দ্বিধায় হেগে দিতে পারে’ বলে আমার প্রতিবেশী
সিগারেটে তন্ময় সুখটান দেন। এই বাক্যটি তিনি,
বলা যায়, ধুয়ো হিসেবে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
কোনো কোনোদিন আড্ডায় মাঝখানে
তিনি বেমক্কা বলে বসেন, ‘এ পাড়ায় একটি বাড়িরও
দেয়াল নেই, প্রকৃত কফিন আছে
প্রতিটি উঠোনে।‘ কারুর ভুরু কুঁচকে ওঠে কেউ হাসে
ফিচেল হাসি কেউবা
চেয়ারের হাতলে তবলা বাজাতে শুরু করে, দৃষ্টি
চালান করে জানালার বাইরে।
এ ধরনের কথা যে তিনি আসর মাৎ করার জন্যে বলেন,
তা নয়। এইতো সেদিন অফিসের দিকে
রওয়ানা হয়েছি, আমাদের ব্যাকাট্যারা গলির মোড়ে
দেখা হয়ে গেলো আমার সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে,
কাছে ধারে কেউ নেই; কুশল জিগ্যেস না করেই
তিনি বললেন, ‘বুঝলেন রাহমান সাহেব, এ শহরের
প্রতিটি যুবতীর শরীরে মাছে আঁশের মতো
কিছু একটা গজাতে শুরু করেছে, আমি
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।‘ তিনি যে মাছের বদলে হিসহিসে
সাপ শব্দটি ব্যবহার করেননি,
সে জন্যে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম।
পরদিন তিনি বললেন,
‘আমার টেবিলটা কাল সারারাত কেঁদেছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর মাঝে মাঝে গান গেয়েছে
মাথা-বিগড়ে-যাওয়া ওফেলিয়ার মতো।‘
বলা নেই, কওয়া নেই, এক বিকেলে
সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে
‘চঞ্চল টাকা আঁচলে বেঁধেনা’ ব্যাংকের এই বিজ্ঞাপনটি
তিনি এভাবে আওড়ালেন, যেন
কোনো ধ্রুববাক্য উচ্চারণ করছেন।
তাঁর আরো কিছু বেধড়ক উক্তি-
সেদিন দেখলাম চৌরাস্তায় একজন স্যুটপরা মাকুন্দ
গবাগব গিলছে সংস্কৃতির শালপাতা।
আমাদের এই শহর যদি পুরোদস্তুর একটা বার্থ ডে কেক
হয়ে যায়, তাহলে
নিশ্চয় ডগমগে চৈত পরব শুরু হয়ে যাবে চারদিকে।
আচ্ছা বলুনতো আপনারা কি কেউ
শহীদ মিনারের ওপর এক ঝাঁক ধাতব শকুনকে ওড়াউড়ি
করতে দেখেন না সবসময়?
আমার উঠোনে ক্লিওপেট্রার কালের জাহাজ
নোঙর ফ্যালে; কুরোসাওয়ার সাত সামুরাই
চকচকে তলোয়ারের চমৎকার খেলা দেখার মধ্যরাতে;
প্রমেথিউসের টাইটানিক পায়ে গজিয়ে উঠেছে মস্ত গোদ।
আমরা ক’জন মেতেছিলাম ইতিহাসের
গতিপ্রকৃতি নিয়ে। আলোচনা যখন উত্তজনার
চূড়ায় থরো থরো, তখন আমার প্রতিবেশী প্রায় কবিতা
আবৃত্তির ধরনে বললেন,
‘ইতিহাস আঠার মতো আটকে আছে ঝকঝকে
কেতাদুরস্ত কূটনীতিকদের চটপটে পাছায় আর আ’মরি
নিতম্ব উঁচিয়ে-রাখা বিশ্বসুন্দরীদের
প্রতিযোগিতা-লোলুপ চুচিতে।
সত্যি বলতে কি, মানব স্বভাবের কোন্ এলাকায়
আমার প্রতিবেশী অবস্থান,
এ ব্যাপারে আজ অব্দি আমি মনস্থিত করতে পারিনি।
আমার কোনো তাড়া নেই
জাভেদ, তোমাকে আমি ডাকছি এই সাতসকালে,
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে,
তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
জাভেদ তুমি টইটম্বুর বাসে
বাদুড়ের ধরনে ঝুলে যাচ্ছ।
কী দরকার ছিল এত কষ্ট করার,
পরের বাসে গেলেই তো পারতে!
তোমার কি এতই তাড়া ছিল?
আর ক’টি মিনিট
অপেক্ষা করতে পারলে না।
জাভেদ তুমি কোথায় চলেছ সবুর বিহনে?
জাভেদ, আমি তোমাকে মনে করে
অন্য কাউকে ডাক দিইনিতো? ইদানীং
এ এক দারণ মুশকিল, বুঝেছ জাভেদ,
চট্জলদি একজনের সঙ্গে
আরেকজনের তেমন তফাৎ
খুঁজে পাওয়া যায় না, যেমন ঝানু নিকেরির ঝাঁকায়
একটি মাছকে খুব আলাদা ভাবা যায় না।
আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি জাভেদ,
ঐ চোখ, ঐ কপাল আর ঢেউখেলানো চুল-
কী করে ভুল হবে আমার?
তুমি আমাকে, এই উনিশশো তেরাশির আমাকে
চিনতে পারনি হয়ত।
আমি কি খুব বেশি বদলে গিয়েছি?
নইলে কেন তুমি একটু
থমকে দাঁড়ালে না, করলে না অপেক্ষা? নাকি
চিনতে পেরেও
পড়ি মরি করে বাদুড়ের ধরনে
ঝুলে পড়েছ বাসের হাতলে। জিম্নাসটিকে
এত ভাল তুমি, আমার জানা ছিল না।
যাদের খুব তাড়া থাকে, তারা আশেপাশে
ভাল করে তাকায় না; উপরন্তু
চেনা মানুষকে ওরা অচেনা বানাতে পারে
চোখের পলকে।
জাভেদ, নিমেষের জন্যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে,
মনে হল। তারপর কী যে হল, পাকা অভিনেতার মতো
তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে। আমিও সাহস করে
ছুটে যাইনি তোমার দিকে,
পাছে বিব্রত হতে হয় আমাকে।
জাভেদ, আমি তোমার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
অপেক্ষা করে থাকব।
তোমাকে দেখে আমি কারো পা মাড়িয়ে,
কাউকে গুঁতিয়ে অমন ঠেলেঠুলে
চলন্ত বাসে উঠে পড়ব না অথবা
চিনতে পেরেও বেমালুম না চেনার ভান করব না।
আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করার পারব।
আমি অপেক্ষা করতে পারি
একটি গোলাপ কুঁড়ির উন্মীলন দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
পক্ষীশাবকের প্রথম ওড়া দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
শিশুর কচি মুখের প্রথম বুলি শোনার জন্যে;
কোনো মুমূর্ষুর চোখের তারার নিভে- যাওয়া দেখার জন্যে,
কবিতার হারানো পংক্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে
আমি অপেক্ষা করতে পারি।
আমার নিঃসঙ্গ চঞ্চু
জাভেদ এখন তুমি ভীষণ একাকী
আবেদনপত্রের মতন ঝুলে আছো মেঘের কেশর ধরে
জাভেদ তোমার গলা ফুঁড়ে
বেলফুল ঝরে রাশি রাশি
বুকে
বিশাল চোখের মতো ঘড়ি
জাভেদ কখনো তুমি সর্ষক্ষেতে একজন অশ্বারোহী হয়ে
সবুজ লাগাম হাতে ছুটছো কেবল
ঘোড়ার জ্বলন্ত চোখ রণধ্বস্ত শহরের নিরালা জানালা
পা দগ্ধ মিনার আর গ্রীবা
খয়েরি গীটার
তুমি সেই গীটার আঁকড়ে ধরে অতল পাতালে
যাচ্ছো স্বপ্নবৎ মাছের সন্ধানে নাকি
তার খোঁজে যে একদা কোনো মধ্যরাতে
জলকন্যা হতে চেয়েছিল
জাভেদ নিঃসঙ্গ বন্ধু হে আমার তুমি
ফিরে আসো মুঠো মুঠো হীরে জহরত
মাথায় নীলচে জলচর পাখি আর
শিশ্নে লতাগুল্ম নিয়ে তুমি ফিরে আসো
জলকুমারীর মাছরাঙা স্মৃতি তোমাকে নিয়ত ঠোকরায়
তোমার জামার নাম বিষাদ জাভেদ
ট্রাউজার বিচ্ছিন্নতা গেঞ্জি বিবমিষা
তোমার জুতার ফিতা কখনো কখনো ম্রিয়মাণ
লাউয়ের ডগার মতো ঝুলে থাকে
আকাশে একটি পাখি যেন
উড্ডীন পেরেক
তুমি সে পাখির তীক্ষ্ণ চঞ্চুর উদ্দেশে
অক্ষর ছিটিয়ে খুব নিরাসক্ত চেয়ে থাকো আর
পাখিটির বুকের ভেতর থেকে সজীব পাতার
মতো হাত চকিতে বেরিয়ে আসে তুমি সেই হাত
হাতে নিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের
নিঃসঙ্গ চূড়ায়
ঈগলের মতো বসে আছো।
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা
১
লিখি আর না-ই লিখি, প্রতিদিন কবিতার খাতা
খুলে বসি পুনারায়, তাকে
টেবিলে সযত্নে রাখি মঠবাসী সন্ন্যাসীর মতো
ব্যবহারে। কবিতার খাতা, মনে হয়,
দূর অতীতের তাম্রলিপি,
কখনো প্রবাল-দ্বীপ। কবিতার খাতাটির স্মৃতি
নিয়ে একা একা পথ হাটি সারাদিনমান, বেলাশেষে
পৌছে যাই
সে-দেশে, যেখানে আজ হরিণ হরিণ নয় আর,
যেখানে পাখিরা নয় পাখি। তবু আমি
হরিণের বর্ণিল ভঙ্গিমা,
পাখির গানের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসি, নিয়ে আসি
কবন্ধের হাত থেকে ময়ূর-ময়ূরী।
যাবতীয় অনিন্দ্য গোলাপ, বিদ্যুল্লতাময় মেঘ,
বৃষ্টিভেজা মুখ আর মায়াবৃক্ষসহ
সেসব অর্পণ করি পুণ্যার্থীর মতো
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতাটির বুকে।
২
সুদূর বৃটিশ যুগে পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রবরবা মুসলিম লীগের আমলে কত কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বায়ান্নোর রক্তাপ্লুত ভাষা-আন্দোলন থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
ভাসানীর সন্তোষের কুটিরের আর তাঁর পদযাত্রা থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রাজবন্দিদের নির্যাতিত জ্বলজ্বলে চোখ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
শেখ মুজিবের স্বাধীনতা-ঝলসিত উদ্যত তর্জনী থেকে,
বজ্রমুষ্টি থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
সতত ভূতলবাসী তরুণ সিরাজ সিকদার আর তাঁর
সহযাত্রীদের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মুক্তিযোদ্ধা, হুইল চেয়ার আর ক্রাচ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
জীবনানন্দীয় পাতা থেকে আস্তে সুস্থে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
কমল মজুমদার পাঠ করে চণ্ডালের হাঁড়ি, শ্মশানের
তন্বী সতী, তার বানভেজা স্তন আর
গোলাপ সুন্দরী আর শ্যাম নৌকার নিকট থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
পথিকের মধ্যহ্নভোজন আর ভগ্ন পান্থ নিবাসে কাছ
থেকে কিছু
পিছুটান শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
এবং বৈচিত্র্যময় উপজাতীয় সংস্কৃতি থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বাথরুমে-রাখা বালতির পানি আর কৈশোরের
নদীটির কাছ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মেয়েদের হস্টেল এবং মাতৃসদনের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
স্বপ্নপ্রসূ কম্যুনিস্টো থেকে,
পরাবাস্তবের সূর্যমুখী থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।
রৌদ্রদগ্ধ শস্যক্ষেতে কৃষকের অবস্থান থেকে,
বিবাহ বাসন আর কবরের বাতি থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।
একশ চার ডিগ্রী জ্বর
কে যেন আমাকে মাছে মত তেল ছাড়াই
ভাজছে ভাজছে ভাজছে হঠাৎ
কামারের হাপরের নিচে জ্বলজ্বলে পেটা লোহার কথা
মনে পড়ল আমার
এখন আমি বলা যেতে পারে টগবগে
আগ্নেয়গিরির তাপে ভয়াবহভাবে
ঝলসানো আদিম গুহামানবের মত
আমার ভেতর সেদ্ধ হচ্ছে কিছু বনমুরগী আর রাজহাঁস
আমি আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে
প্রবেশ করেছি এক তন্দুরে
অঙ্গারগুলো তুতেন খামেনের মণিরত্ন হয়ে
নাচছে আমার চতুর্দিকে
বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে এক সুন্দরী
দাঁড়াল আমার সামনে
তার চুল লাল
চোখ লাল
স্তন লাল
লাল তার ঊরু আর নিতম্ব অগ্নিশিখা তার বগলের চুল
সেই লালচুল সুন্দরী আমার দুচোখে হৃদ্যতাবশত
সামনে ছুঁড়তে থাকে ত্রন্তার জ্বলন্ত রক্তজবা
দেখতে পেলাম সুন্দরীর শুধু একটিমাত্র স্তন এবং
তার সঙ্গী স্তনটি যে জায়গায় থাকার কথা সেখানে
জমাট হয়ে আছে বৃদ্ধার ফোকলা হাসি
অসহ্য উত্তাপের মধ্য থেকে
আমি বিকশিত হচ্ছি আগুন রঙের ফুলের মত
আমার মাথাটা এখন রবারের বেলুন
চিল বালিহাঁস আর ঈগলকে নিচে রেখে দিব্যি
উঠে যাচ্ছে ক্রমাগত উপরে উঠে যাচ্ছে
বেলুনের সুতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড়
এক ঝটকায় ঝরে গেছে আমার বয়স
যেমন খসে পড়ে পুরোনো দালানের চুনবালি
এখন আমি শিশু
বালিশের ফোকরে আটকানো আমার মাথা
ক’দিন ক’রাত্রি ধরে ক্রমাগত কখনো
এপাশ ওপাশ করছি ঝড়ে-পড়া নৌকোর মত
কখনো কতরাচ্ছি একজন রাগী ফেরেশতা
আমাকে ঘন ঘন চাবকাচ্ছে আগুনের চাবুক দিয়ে
ব্যাপক দাবানলে আমার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ছে আমার
অন্তর্গত এক পড়শী
আমার সঙ্গে পুড়ছে প্যারাডিসো হ্যামলেট গীতাজ্ঞলি
ডাস ক্যাপিটাল বনলতা সেন পদ্মনদীর মাঝি
ইয়েটস-এর পত্রাবলি গোলাপসুন্দরী আর
আবদুল করিম খাঁর যমুনাকে তীর
আমার মাথার ভেতরে আলতা বাদুড় চালতা বাদুড়
অসংখ্য বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি ঢোসকা মাতালের
পদধ্বনি মস্তানের বিলা আওয়াজ
আমি শুনতে পাচ্ছি সুন্দরবনের চিতাবাঘের অট্রহাসি
প্রসব যন্ত্রণাবিদ্ধ এক নারীর গোলাপী হাসি
আমি শুনতে পাচ্ছি
সেপিয়া রঙের বিবর্ণ ফটোগ্রাফগুলো থেকে বেরিয়ে এসে
আমার চেনা আত্মীয়স্বজন তারস্বরে
আমাকে ডাকতে শুরু করেছে আমি শুনতে পাচ্ছি
আমার আগেকার দিনগুলোর এক দয়িতা আমাকে চটকাচ্ছে
আর আমার গৃহিণীর নির্ঘুম অসহায় হাতে
জ্বরের চার্ট বাতিল শাসনতন্ত্রের মত কম্পমান।
কবিতার প্রতি ঢ্যাম্না
এখন নখরাবাজি ছাড়। লচ্ খাওয়া হয়ে গেছে
অনেক আগেই; সেই কবে থেকে জোমে আছি আর
তোমার জন্যেই আজ আমি এমন উঠাইগিরা।
তোমার অশোক ফুল ফোটা পড়েছে আমার চোখে
বহুবার, বহুবার দেখেছি ঝুল্পি, ছাতি। জিভ
ভ্যাঙচানো; বুলিয়েছি হাত ঝাপে। জোড়-খাওয়া তা-ও
হয়েছে অনেকবার হে চামর খেপ্লু আমার।
আমিতো কপাল ফেরে ভিড়েছি তোমার মারকাটারি
অন্দরখানায়। আচমকা থেমে পড়ি, ফের গোড়া
থেকে করি শুরু আর এক পা এক পা চলি; তুমি
কাছে না থাকলে বলো কী করে হাওয়ায় গেরো বাঁধি?
কেন তুমি মাঝে-মধ্যে খামোকা বাতেলা দিতে চাও?
আন্সান্ কথা রাখ চনমনে মেয়ে যদি তুমি
আমার এ খোমা-বিলা দেখে সবকিছু গুবলিট
করে দিতে যাও, তবে কেন নিয়েছো আমার ছল্লা
ঘন-ঘন কান্কি মেরে? চুস্কি তুমি, সাতঘাটে ঘুরে
ফিরে বেড়ানোই কাজ; স্থিতু হয়ে বসতে পারো না
কোথাও সামান্যক্ষণ। এখন হঠাৎ ঠাণ্ডা পানি
হবে তুমি, তা হবে না। কেননা হেকোরবাজ নই
আমি আজো, যদিও ঢ্যাম্না বলা যায় ইদানীং।
কী জন্যে এই মধ্যরাতে
কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর অন্ধকারে
মধ্যরাতে জেগে থাকা?
কি জন্যে আজ আকণ্ঠ এক তৃষ্ণা কেবল
বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখা?
মাঝে-মধ্যে বাইরে তাকাই, দূর আকাশে
যায় না দেখা জাগর তারা;
গাছগাছালি নিথর নিঝুম বন্য ঘ্রাণে
পাচ্ছি গতকালের সাড়া।
রাতদুপুরে পড়ছে মনে শীত দুপুরের
একলা শঙ্খচিলের ওড়া,
পড়ছে মনে অনেক আগের সাগর পারের স্বেদ ঝরানো
তেজি তরুণ সফেদ ঘোড়া।
অন্ধকারে মাঠের ভেতর আমরা দু’জন
ছিলাম প্রেমে পুলকিত-
প্রবেশ করে উষ্ণ মাংসে হীরের ছুরি, মদির চাপে
নীল ফোয়ারা উচ্ছুসিত।
রাত্রি আমার চোখে মুখে নিশাস্ ফ্যালে
রমণরত প্রাণীর মতো;
স্মৃতির ঝাঁঝে হঠাৎ আমি হয়ে পড়ি
কেমন যেন অসংযত।
কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর মধ্যরাতে
আজকে আমি নিদ্রাহারা?
অস্থিরতা পোকার মতো ঘুরছে মনে,
সত্তাজোড়া কিসের তাড়া?
চমকপ্রদ কত কিছুই ঘটে আমার চিত্তপুরে,
নেইকো কোনো লেখাজোখা।
রহস্যময় শব্দবলি জ্বলে নেভে
যেন নিশুত জোনাক পোকা।
আমি কি এই মধ্যরাতে শ্মশানচারী
পদ্য লেখার আকর্ষণে?
ভবিষ্যতের কোন্ দেয়ালি মরীচিকা
দুলিয়ে দিলো দগ্ধ মনে?
কৃষ্ণচূড়া গাছের মতো জ্বলছি একা
চৈতন্যের চৌরাহাতে,
নাম-না জানা তীব্র দহন সইছি কিসের
আবছা মোহন প্রত্যাশাতে?
জাভেদ তোমার কথা
জাভেদ, তোমার কথা বেশ কিছুদিন
ধরে আমি ভাবছি প্রত্যহ। কবে কোন্ সালে কোন্ সে শ্রীহীন
পাড়ায় জন্মেছো তুমি, কী যে নাম
সে বিদ্যালয়ের, ছিমছাম
সেনার কদমছাঁট চুলের মতন ঘাসময় অনুপম
উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যার পড়েছিল তোমার প্রথম
পদচ্ছাপ, কবে বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে
কতিপয় পুস্তকের জ্ঞানগাম্যি চেখে
নিয়েছিলে সডিগ্রী বিদায়, তারপর
জুটিয়ে মাঝারি চাক্রি বে-থা করে বেঁধেছিলে ঘর-
যথারীতি পুত্র কন্যা এনে
বছর বছর, চোখ-বাঁধা বলদের মতো নিত্য ঘানি টেনে
অকালে পাকালে চুল,-এই সব কথা ইতস্তত;
বুঝেছো প্রায়শ ভাবি আজকাল। কত
ঝড়-ঝাপটা, কত যে জাহাজডুবি দেখছো জাভেদ
সচক্ষে, অথচ কোনো নিষ্কুল নির্বেদ
কখনো তোমাকে খুব ভুগিয়েছে বলে
জানা নেই; এড়িয়ে গিয়েছো ঠিক নিঁভাজ কৌশলে।
অনেক ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে
তুমি কি মাঝরিদের চেয়ে
কিছু উঁচূ হতে চেয়েছিল বাড়িয়ে নিজস্ব গলা
নিত্য জিয়াফের মতো? ঊর্ধ্বারোহণের ছলাকলা
অনেকেরই আয়ত্তে সম্প্রতি। ধিক, ধিক
জাভেদ তোমাকে ধিক, তুমি বাস্তবিক
সর্বদা মাঝারি রয়ে গেলে। সেই আপিশের সিঁড়ি
বেয়ে ওঠা ক্রমাগত সপ্তাহে ছ’দিন, আর ভীষণ বিচ্ছিরি
গলিতে প্রত্যহ ফিরে আসা,
সুপ্রাচীন কংকালের মতো অস্থায়ী, ক্ষয়িষ্ণ বাসা
নিয়ে পরিণামহীন ভাবনা এবং দূর স্মৃতি
অপ্রেমের খাটস্থিত কাঁথা মুড়ি দিয়ে যথারীতি
ঘুমানো, আবার জেগে ওঠা ভোর, ছড়া
কাটা সন্তানের সঙ্গে আর জবর খবর পড়া
চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, আবার আপিশ,
ঘড়ির শাসন, কালি ছিটানো খাতায় আর কিছু ফিস্ ফিস্,
নিত্যদিন নিষ্প্রভ মাইম
দেখিয়ে জাভেদ তুমি নাছোড় লোলুপ ঊর্ণাজালে
বিপন্ন আটকে পড়ে এই মতো জীবন কাটাল।
যুগপৎ গবেষণা আর তদন্তের ঘোরে
বারংবার বিশ্লেষণ করে
দেখেছি আসলে
তোমার বৈশিষ্ট্য নেই কোনো, তুমি সাধারণ মাঝারির দলে
রয়ে গেলে আজীবন। কোনো স্বপ্ন, কোনো অভিলাষ
আনেনি খ্যাতির ছটা তোমার আঁধারে। দীর্ঘশ্বাস
হয়ে আছো শুধু
অত্যন্ত নেপথ্যে আর মরুর মতন অতি ধু-ধু
জীবনে চলেছো রয়ে চায়ের কাপের স্পষ্ট ফাটলের মতো
কিছু দাগ; জাভেদ যমজ ভাই আমার, সতত
তুমি কোন্ ত্রাসে
পুরাণ পুতুল হলে নড়বড়ে বিপন্ন নিবাসে
জীবনকে ব্যাধি ভেবে নিজেকেই রূঢ় উপহাস
করছো নিয়ত আর দেখছো কেমন
নিস্পৃহ বিবশ ছন্দে লক্ষ লক্ষ জাভেদের পঙক্তিতে আরো একজন
জাভেদ চলেছে মাথা নিচু করে, যেন প্রেতচ্ছায়া,
গন্তব্যের প্রতি উদাসীন, সম্মুখে বিস্তীর্ণ ইন্দ্রধনু মায়া।
তসলিম রশিদের জীবনযাপন
এড়িয়ে পিতার দৃষ্টি যৌবনপ্রত্যুষ দরজায় খিল দিয়ে
কবিতা লিখেছি আমি আর মনে প্রাণে
কবিতাকে করেছি গ্রহণ
পৃথিবীর সর্বোত্তম বস্তু বলে, অথচ জনক
কস্মিনকালে ও জানাননি সমর্থন
আমার এ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের প্রতি। ভরা সূর্যাস্তের দিকে
মুখ রেখে তিনি
উঁচিয়ে বয়স্ক ছড়ি তাঁর
দিয়েছেন তাড়িয়ে বেবাক অলৌকিক
হরিণ এবং পরী ভাড়াটে বাড়ির
সংকীর্ণ চৌহদ্দি থেকে, আমি
অসহায় বন্ধ ঘরে মেরেছি সকালসন্ধ্যা কপালে চাপড়া।
জননীকে বোঝাতে চেয়েছি কবিতাই প্রকৃত আবেহায়াত
অস্তিত্বের ব্যাপক খরায়
মা আমার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে গ্রীষ্মের দুপুরে
নিরিবিলি ঢেলেছেন মাটির সুরাই থেকে পানি,
যেমন শৈশবে তিনি আমাকে সাদরে
ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখে গৃহকোণে শাণিত বটিতে
কাঁটতেন রান্নাঘরে রুপোলি ইলিশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে দয়িতার কানে কানে, মনে পড়ে,
গোধূলি বেলায়
রমনা লেকের ধারে কবিতার পঙ্ক্তিমালা আউড়ে বলেছি-
কবিতা তোমারই মতো অনিবার্য স্বপ্নভূমি আমার জীবনে।
অর্থনীতিকানা তুমি ব’লে সে যুবতী
জ্বলজ্বলে কূটনীতিকের
ঘনিষ্ঠ জীবনলগ্ন হয়ে দিলো পাড়ি মার্কিন মুলুকে।
কারুর পিতাই নয় বস্তুত অমর। তাই পেনসনভোগী
জনক গেলেন পৌছে একদিন মায়াবী স্টেশনে
বিপন্ন সংসার ফেলে হাভাতে আঁধারে;
আমার কলেজ-পলাতক সহোদর রাত জেগে টকটকে
লাল কত আশার অক্ষরে
দিলখোলা অজস্র পোস্টার লেখে চোখের আড়ালে,
মাঝে মাঝে জেল খাটে এবং বিবাহযোগ্য বোন
প্রত্যহ শাপান্ত করে উদ্ভিন্ন উজ্জাত যৌবনকে।
আমি নিজে যেন তেন প্রকারেণ চাকরির খোঁজে
দিনে
অফিসে অফিসে ঘুরি আনকোরা গোয়েন্দার মতো,
রাতে
পরাবাস্তবের পিঠে তুমুল সওয়ার হয়ে ক্ষিপ্র
বলপেনে
ক্ষণজীবী বসন্তের এবং ফেরারি কোকিলের
জন্যে হা-পিত্যেশ করে ছিমছাম আঠারো মাত্রার
সুঠাম অক্ষরবৃত্তে কত তন্দ্রালু কবিতা লিখি
ঢুল ঢুল চোখে।
সন্ধ্যা নামে, নিরক্ষর সন্ধ্যা নামে শহরের বেল্লিক বস্তিতে।
আমার ভূতলবাসী অস্থির অনুজ আসে খুব
সন্তর্পণে
মায়ের হাতের রান্না চেখে নিতে মাঝে-সাঝে ফের
চকিতে গা-ঢাকা দ্যায় কে জানে কোথায়।
আমার ধৈর্যের বাঁধে ফাটায় সে বোমা বেধড়ক,
গালমন্দ দিই ওকে, বিশেষত যখন অফিসি মহাপ্রভু
আমাকে শুনিয়ে দেন বাছা বাছা স্ল্যাং। ইতোমধ্যে
একটি নিখাদ চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি দৈববলে। বোনটিকে
ফাঁকি দিয়ে মহল্লার মাশাল্লা যুবক
সটকে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। সহোদরা যৌবনের জতুগৃহে
পোড়ে দিনরাত।
আমার জননী তাকে সর্ব্দা রাখেন চোখে চোখে,
পাছে সে গলায় দ্যায় দড়ি কিংবা ঝাঁপ
লাখেরাজ জন্মান্ধ কুয়ায়।
কোনো কোনো মধ্যরাতে সঙ্গমান্তে গৃহিণী বলেন
চুপিসারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সারাটা জীবন যাবে
ভাড়াটে বাড়িতে,
আজো তো হলো ছাই নিজের বসতবাড়ি কোনো।
আমি বিদূষক সেজে হাসন রাজার মতো গেয়ে উঠি-
কী ঘর বানামু আমি শূন্যের মাঝার।
যদিও বাসাড়ে আমি জন্মবধি এই দুনিয়ায়,
রোজানা বানাচ্ছি দ্যাখো গায়েবি মহল।
আমার অনুজ জপে প্রত্যহ মাও সে-তুঙ আর
পড়ে কৃশকায় চারুবাবুর কেতাব,
যা নিশ্চিত পাইপগানের চেয়ে বেশি অগ্নিউদগীরণকারী।
আমার অনুজ সুকান্তের সংক্রামক প্রেরণায়
নিজেকেই ঠাউরেছে মহান লেনিন।
দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়িয়ে যায়, তবু
কোথাও পাই না খুজে অনুজকে আর।
কখনো সখনো আমি কবিসম্মেলনে যাই, নামজাদা সব
কবিদের সঙ্গে মফস্বলী মঞ্চে সদ্য-লেখা পদ্য পাঠ করি।
খদ্দরের পুরোনো পাঞ্জাবি
উড়ন্ত ঘোড়ার ডানা; বিবর্ণ স্যাণ্ডেল
হোলি গ্রেল; কিছুক্ষণ শব্দের নিজস্ব ইন্দ্রজালে
পিঠচাপড়ানি পেয়ে, দিশি মাল টেনে
ভুলে থাকি বাস্তবের কচ্ছপ-কামড়
তোতাপাখি বিবেক ছোলার লোভে সকল সময়
নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে থাকে।
আমার বাঁদিকে বসে চোখের পিচুঁটি মোছে আর
হাই তোলে বারো বছরের স্বাধীনতা।
ইদানীং প্রায়শই পড়ি অনুজের বিস্ফোরক
পুরোনো ডায়েরি,
দাঁড়া-বার-করা হিংস্র পোকার মতন
ভাবনা মগযে ঘোরে। হতচ্ছাড়া জীবনকে কিছুতে পারি না
নিয়ে যেতে অন্য কোনো বাঁকে
শুধু পালটে দিই, ক্রমাগত দিতে থাকি
আমার নিজের কবিতার কিছু শব্দ রাগে, চরম ঘেন্নায়।
তোমার সকল খেলা
না, এখন আর চুপচাপ বসে থাকা
যায় না, একটা কিছু করতেই হয়। ঐতো সূর্যটা গা-ঢাকা
দেবো দেবো করছে কখন থেকে, সন্ধ্যা হয়ে এলো
বলে চতুর্দিকে এলোমেলো
কত কিছু ঘটছে নিয়ত। আর বেশি দেরি হলে পাততাড়ি
নিশ্চত গোটাতে হবে। তাই বেলা থাকতেই যতক্ষণ পারি
রাখবো দর্শক ধরে। খালি
আসরে জমে না খেলা, মাঝে মাঝে যদি করতালি
ঝংকৃত না করে মঞ্চ, তবে
নিজেকে উজাড় করে এই খেলা দেখিয়ে কী হবে?
তোমার সকল খেলা, বলে লোকে, হয়েছে পুরোনো। বলো আর
কতদিন বারংবার
একই ভেলকি লাগাবে উৎসুক চোখে? মানে,
এখন সবাই জানে
তোমার আস্তিন থেকে ক’টা কবুতর অকস্মাৎ
আসবে বেরিয়ে আর কালো টপ হ্যাটে তুমি হাত
রাখলেই মঞ্চে হবে উদ্ভাসিত সহজে খরগোশ,
এবং কবুল করি এ আমারই দোষ।
একই খেলা দেখতে দেখতে সত্যি কেউ
মনের ভেতরে আর সম্প্রতি পায় না খুঁজে আনন্দের ঢেউ।
খেলায় যখনই
ম্লান মনোটানি
ব্যেপে আসে, তখনই দর্শক সীট ছেড়ে
দাঁড়ায়, হারায় ধৈর্য, সিটি দ্যায়, কখনো ভীষণ যায় তেড়ে
বেকুল স্টেজের দিকে, কখনো বা পচা ডিম,
টোমাটোর গোলা ছোটে। ঐন্দ্রজালিকের হাত-পা হয়ে যায় হিম।
যখন পুরোনো খেলা কোনো অর্থ করে না বহন
কারো কাছে হে বন্ধু তখন কৌশল পাল্টিয়ে ফ্যালো, নিমেষে খাটাও
তাঁবু শূন্যে এবং পাঠাও
পা দুটো সুনীল আসমানে। নয়তো তুড়ি
মেরে দিব্যি নিজেই নিজের বুকে ছুরি
আমূল বিঁধিয়ে আনো রক্ত রঙের বদলে।
তাহলে বলবে লোকে, দ্যাখো কী কৌশলে
ঐ চটপটে
লোকটা লাগায় ধন্দ প্রত্যেকের চোখে, মজাদার খেলা বটে।
পারিবারিক ত্র্যালবাম
এক মধ্যরাতে আমার পারিবারিক ত্র্যালবামের
গান শুনে জেগে উঠলাম
পুরোনো দিনের গানে নীলাম্বরী শাড়ির মন-কেমন-করা
ঝলসানি মেশকে আম্বরের ঘ্রাণ
হেমন্তের উদোম বিকেলে নববধূর চাউনি
আলবোলার ধোঁয়াটে গুড় গুড় ধ্বনি
আগদুয়ারে আতিথেয়তা খিড়কি পুকুরের
লাজনম্র সজলতা চিলেকোঠার নির্জনতা
সে গান নিয়ে যায় আমাকে ছায়াতুর এক পথে
হলদে পাতার ওপর বিছানো ডোরাকাটা
শতরজ্ঞির প্রতি টিফিন ক্যারিয়ার আর ফলমূলের প্রতি
কয়কটি কমলালেবু গড়াতে গড়াতে আসে
ডুবে যায় কবরখানার দবিজ ঘাসে
সে গান নিয়ে যায় আমাকে দূর
সমুদ্রতীরে ভেজা বালিতে পদচ্ছাপ দেখায়
দেখায় মুখচ্ছবির পেছনে সূর্যাস্ত
আমার পারিবারিক ত্র্যালবাম জলকন্যার মতো গান গায়
ঘুমায় তারা আর গুল্মময় স্বপ্নের ভেতরে কখনোবা
থমকে দাঁড়ায় প্রবাল সিঁড়ির ধাপে
সুদূর গ্রামের পোড়াবাড়িকে জানায় অভিবাদন
আমার কল্পনার গা চটে আস্তে সুস্থে
আমার অস্তিত্ব স্বপ্নের পাখির মতো
উড়ে যেতে চায় তার কাগুজ ঠোঁটে চূমো খেয়ে
বুকে জড়িয়ে ধরে।
শাদা কথায় বললে দাঁড়ায়
আমার পারিবারিক ত্র্যালবাম এক ঐন্দ্রজালিক যে
দেখাচ্ছে তার মোহসঞ্চারী বিরতিহীন খেলা
কাঠের পিঁড়িতে বসে বটিতে সবুজ কুমড়ো
কাটছেন আমার মা গ্রীনবোটে আব্বা বাবা আমার
তাঁর গায়ে ওভারকোট দূর আকাশে হংসমিথুন
আর আবছা রূপোলি মটরশুঁটির মতো
একটি কি দুটি তারা প্রধান মাঝি হাল ধরেছে উজানে
বার্থ ডে কেকে ছুরি চালাচ্ছে আমার সাত বছরের কন্যা
আমার নেই-যে পুত্র তার কপালে ব্যাণ্ডেজ ঠোঁটে হাসি
বর্ষার পানিতে সয়লাব উঠোনে সাঁতার কাটছে
যুগল হাঁস একটি গ্যাছে নেউলের পেটে
কয়কটা শাদা লাল কালো মুরগি চরে উঠোনে
এখন ওরা গরহাজির
আমার একজন সুদর্শন তরুণ স্বজন চেয়ে থাকে নিষ্পলক যে
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি
আমি পারিবারিক ত্র্যালবামটির সঙ্গে ক্রমাগত
এমন আচরণ করি যেন সে যক্ষের ধন
কখনো তার ভেতরে বিধবার ধবধবে শাড়ির
মতো দুপুর কখনো অগাধ জ্যোৎস্না বিস্তার
কখনো তার ভেতর থেকে ভেসে আসে আকর্ণ হাসি
কখনো ডুকরে ওঠে কান্না
সেখানে কখনো ঈদের পোশাকের ঝলমলে উচ্ছ্বাস
কখনোবা কবরের বাতির ব্যথিত কম্পন।
প্রলয়ান্তে
কংক্রীট বনে ঘেমো জনস্রোতে বলো
তোমাকে কোথায় কোন্ ঠিকানায় খুঁজি?
কবন্ধ এই শহরে সন্ধ্যা হলো,
এদিকে ফুরায় বয়সের ক্ষীণ পুঁজি।
সেই কবে থেকে চলেছে অন্বেষণ।
ক্লান্তি আমার শরীরে সখ্য গড়ে,
তোমার গহন ঊর্মিল যৌবন
আনে আশ্বন এখনো বন্ধ ঘরে।
মনে পড়ে যায় শরীরে তোমার নাচে
খর বর্ষার তন্বী পাহাড়ি নদী।
তোমারই চুলের নিভৃত ছায়ার কাছে
চাই আমি চাই আশ্রয় নিরবধি।
দেয়ালের লেখা আমিও করেছি পাঠ-
জুটবে ভাগ্যে উপেক্ষা অবশেষ।
সাক্ষী এ নদী, সোনা-ওগরানো মাঠ,
খুঁজেছি স্বর্গ তোমাকেই ভালবেসে।
নশ্বরতার প্রতাপ জেনেও আমি
করি সঞ্চয় স্বপ্নফলানো স্মৃতি,
তোমারই ছায়ার আজো আমি অনুগামী,
যদিও হারানো জানি জাগতিক রীতি।
ভেবেছি ক্রমশ বিস্মরণের লেকে
তুমি ডুবে গেলে হবে না কিছুই ক্ষতি,
কিন্তু তোমার স্মৃতির পীড়ন থেকে
আমৃত্যু নেই আমার অব্যাহতি।
বিরোধী কালের জতুগৃহে করে বাস
সত্তা আমার ভস্মে গিয়েছে ঢেকে;
মেলে না কোথাও এক কণা আশ্বাস,
রজ্জুও নেই সর্পের ব্যতিরেকে।
ধ্বংস বাজায় চৌদিকে তার ঢাক,
কোথায় নিলালো তোমার পায়ের রেখা?
বিপাকে লুপ্ত আমার ব্যাকুল ডাক,
প্রলয়ান্তে ও পাবো কি তোমার দেখা?
ফাটলসর্বস্ব এক দালান
আমার চাদ্দিকে হায়েনার
হাসির মতন
অজস্র ফাটল আজ আমাকে ভীষণ
শাসন করছে, মনে হয়। মনে হয় কথাটা খামোকা বেশি
বলা হল; কবিতায় এ রকম বাড়তি কথার
ঠাঁই নেই, থাকা অনুচিত। বরং বললেই হতো
প্রকৃতই আমি ভয়ানক ফাটলসর্বস্ব এক
দালানের পুরোনো বাসিন্দা আশৈশব।
আমার নিকট থেকে একে একে অনেকেই ক্রমাগত দূরে
সরে যাচ্ছ সম্প্রতি, যেমন
ঝড়-বাদলের গন্ধ পেয়ে হুঁশিয়ার
পিঁপড়েরা গা-ঢাকা দেয় সাত তাড়াতাড়ি
বলা নেই, কওয়া নেই, এই যে হঠাৎ
সটকে পড়ল যারা, ধ্যেৎ,
সুহৃদ অথবা
আত্মীয়স্বজনদের বিষয়ে সটকে পড়া এই ক্রিয়াপদ
ব্যবহার করা আদপেই সমীচীন নয়। তাঁরা
বেহদ্দ গর্হিত কাজ করেছে, একথা
কস্মিনকালেও আমি বলব না। কেউ
ফাটলসর্বস্ব দালানের পতনের রূঢ় শব্দ
শোনার আশায়
শেষ অব্দি অপেক্ষা করে না।
অথচ সেদিনও
এক সঙ্গে গুলজার করেছি নরক,
পুরোনো সড়ক বেয়ে হেঁটে
গিয়েছি সকালে
অথবা বিকেলবেলা। সন্ধ্যায় খেলেছি দাবা, একই
টেবিলে খেয়েছি আর কখনো সখনো
দিয়েছি চুমুক গ্লাসে মস্তির ঝালরে ঝলসিত,
প্রত্যহ নিবিট হ্যাণ্ডশেক আর দু’বার দু’ঈদে
অন্তত করেছি কোলাকুলি খুব গোলাপী আহলাদে।
অজস্র ফাটলময় দেয়ালে খিলানে চেয়ে থাকি
নিষ্পলক যখন তখন,
যেন করি পাঠ অতিশয় মনোযোগে
আমার নিজস্ব ভাগ্যলিপি। মাঝে মাঝে
মধ্যেরাতে ঘুরি দালানের
আনাচে কানাচে, তারপর ভয় নিয়ে শুতে যাই,
ভয় নিয়ে জেগে উঠি প্রত্যহ আবার।
লোকটা উটকো বড় আজব ছিটেল,
বলে কেউ; কেউ বা বানায়
গল্প কিছু লতাপতাসমেত বস্তুত-
এই দালানের নিচে নাকি
আছে সুপ্রাচীন গুপ্তধন, আমি যক্ষের মতন সর্বক্ষণ
রেখেছি নজর তাতে। নইলে এইমতো
বিপদ মাথায় নিয়ে কেউ কি এখানে করে বাস?
সুদূর নীলিমা থেকে ঢ্যাঙা পোস্টম্যান অকস্মাৎ
নেমে আসে এবং আমার
হাতে গুঁজে দেয়
সুনীল নোটিশ এক, ভাষা যার অবোধ্য নিছক আর সেই
পোস্টম্যানটিকে কিছু জিজ্ঞেস করার
আগেই সে তার ব্যাগ দোলাতে দোলাতে মেঘদলে
ভাসমান, শাগালের ছবিতে যেমন।
ব্যাপারটা তবে দেখবার মতো। তাই,
নিজের সঙ্গেই আমি বোঝাপড়া করি বহুদিন
এবং নিজের অজান্তেই বারংবার
চমকে তাকাই, কাছে ধারে
সামান্য শব্দ হলেই, ভাবি এই বুঝি
হুড়মুড় করে সব দেয়াল খিলান ঘুণেধরা কড়িকাঠ
পড়ল মাথায়। সত্যিই তো
এই যে এখনো আমি অনেকের নিন্দামন্দ সয়ে
দিনরাত্রি এই ভয়তরাসের মধ্যে আছি, এর
রহস্য কোথায়? কেন আমি এই ফাটলের
সম্মেহন ছেড়ে অন্য কোথোও যাই না? কেন? প্রশ্ন
আপাতত একটাই। উত্তর আমার
জানা নেই; কেননা আমি তো এক নয়,
আমার ভেতরে আছে বহু বহুজন। তাদের কেউই
উত্তর খোঁজার জন্যে আমার মতই গা করে না।
বনে জঙ্গলে
এই তো আমার নাতি হাঁটি হাঁটি পা পা করে পার
করে দিলো তিনটি বছর। এখনো অক্ষরজ্ঞান তার
হয়নি সঠিক। অবশ্য সে মাঝে-মাঝে আওড়ায়
অ-আ-ক-খম এ-বি সি-ডি, মাতে ছেলেভোলানো ছড়ায়
মায়ের, খালার সঙ্গে। নানা রঙের বই নিয়ে
কখনো সখানো বসে, পড়ে আস্তে ইনিয়-বিনিয়ে,
যেন সে পড় য়া মস্ত। কখনো আমার খুব পুরু
লেন্সের চশমা পরে আর তাকায় টোলের গুরু
মশায়ের ঢঙে। তবে তার বড় বেশি পক্ষপাত
রঙিন ছবির প্রতি। গালিভার, সিন্দাবাদ, সাত
সমুদ্দর তেরো নদী, সিংহ এবং রাক্ষুসে বাঘ,
গণ্ডার, তালুক, বুনো হাতি, উটের পায়ের দাগ
বালিতে দেখতে ভালোবাসে। যখন টিভিতে বন
জঙ্গলের ছবি দ্যাখে, তখন সে খুশিতে কেমন
ডগমগে হয়ে ওঠে। হঠাৎ বায়না ধরে জঙ্গলে যাবার
ঝুলিয়ে বন্দক কাঁধে, যেন আজই করবে সাবাড়
হিংস্র পশুদের, ঘোরে যারা জঙ্গলের আনাচে কানাচে।
কী করে বোঝাই তাকে বস্তুত সে জঙ্গলেই আছে?
বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো
জো, তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমারই মতো
একজন কালো মানুষ গলার সবচেয়ে
উঁচু পর্দায় গাইছি সেতুবন্ধের গান, যে-গানে
তোমার দিলখোলা সুরও লাগছে।
জো, যখন ওরা তোমার চমড়ায় জ্বালা-ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো করে হেসে ওঠে,
তখন কালসিটে পড়ে সভ্যতার পিঠে।
যখন ওরা বুটজুতোমোড়া পায়ে লাথি মারে তোমাকে,
তখন ধূলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
জো, যখন ওরা তোমাকে
হাত-পা বেঁধে নির্জন রাস্তায় গার্বেজ ক্যানের পাশে
ফেলে রাখে, তখন ক্ষ্যাপাটে অন্ধকারে
ভবিষ্যত কাতরাতে থাকে
গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার জন্যে।
যদিও আমি তোমাকে কখনো দেখিনি জো,
তবু বাইবেলের কালো অক্ষরের মতো তোমার দু’ফোটা চোখ
তোমার বেদনার্ত মুখ বারংবার
ভেসে ওঠে আমার হৃদয়ে, তোমার বেদনা
এশিয়া, আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকায় ব্যাপ্ত, জো।
আমি একজন ফাঁসির আসামিকে জানতাম,
যিনি মধ্যরাতে আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
আমি এক সুদর্শন যুবাকে জানতাম,
যে দয়িতার মান রাখার জন্যে জান কবুল করেছিলো
আমাদের একাত্তরের মুক্তযুদ্ধে,
আমি একজন যাবজ্জীবন কারাবন্দি তেজি
নেতাকে জানতাম, দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে
যিনি কোনো কোনো রাতে তার শিশুকন্যাকে একটু
স্পর্শ করার জন্যে, ওর মাথার ঘ্রাণ নেয়ার জন্যে উদ্বেল আর
ব্যাকুল হয়ে আঁকড়ে ধরতেন
কারাগারের শিক।
আমি এমন এক তরুণের কথা জানতাম,
যে তার কবিতায় আলালের ঘরের দুলাল, মেনিমুখো! শব্দাবলি ঝেড়ে ফেলে
অপেক্ষা করতো সেদিনের জন্যে,
যেদিন তার কবিতা হবে মৌলানা ভাসানী
এবং শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতো।
যখন তাদের কথা মনে পড়ে,
তখন তোমার কথা নতুন করে ভাবি, জো।
জো, যখন তোমার পাঁচ বছরের ছেলের
বুক থেকে রাস্তায় ওরা ঝরায় টকটকে লাল রক্ত,
যেমন পিরিচে ঢেলে দ্যায় কফি,
জো, যখন তোমার পোয়াতি বউ হায়নাদের
দৃষ্টি থেকে পালানোর জন্যে দৌড় তে দৌড় তে
মাঝপথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
জো, যখন তোমার সাহোদরকে ওরা
লটাকিয়ে দ্যায় ফাঁসিতে,
তখন কাঁচা দুধের ফেনার মতো ভোরের শাদা আলোয়
বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো আর্তনাদ করতে করতে
হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
মধ্যজীবনের বৃত্তান্ত
একন আমার মধ্যজীবন যীশুর মতন
ক্রুশকাঠে ক্রুর পেরেকময়;
তবুও হৃদয়ে প্রহরে প্রহরে মেঘবিস্তার,
এবং মোহন চন্দ্রোদয়।
গ্রীষ্মে কি শীত দিন কাতরায় অফিস-গুহায়,
সন্ধ্যাবন্দি দাবার ছকে।
গেরস্থালির খোয়ারিতে মজে সোহাগ বিলোই
রাতে গৃহিণীর ঘুমেল ত্বকে।
হঠাৎ কখন কৃপণ কলের পানি থেমে যায়,
কাকস্নান সারি নিত্য আমি।
ক্যালেণ্ডারের সুন্দরিগণ লিবিডো জাগান,
হযে যাই ক্রমে মর্ষকামী।
রেশনের কৃশ লাইনে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল
ভাবি, আওড়াই লোর্কা, শেলি।
চকিতে চেতনা প্রবাহে ধরায় গনগনে জ্বালা
কবেকার নববধূর চেলী।
কখনো ছুটির দুপুর কাটাই ভাতঘুমে আর
থ্রিলারে, সস্তা উপন্যাসে,
এবং বিকেলে চীনে বাদামের খোসা জমে ওঠে
খেলার মাঠের ধ্বস্ত ঘাসে।
মোরগের মতো গলাটা ফাটিয়ে দিইনি শ্লোগান,
যাইনি যুদ্ধে একাত্তরে।
অবশ্য শত রাজা উজিরের শব উড়ে যায়
চায়ের কাপের তুমুল ঝড়ে।
মুখে বিপ্লবী বুলি লেগে থাকে আঠার মতন;
সমাজতন্ত্রে ঈমান আনি;
অথচ যখন জনকল্লোলে কাঁপে রাজপথ,
নিদ্রার মোহে চাদর টানি।
নিউজপ্রিন্টে মারি ও মড়ক, গুপ্ত লড়াই,
কে কোথায় কবে চড়ছে শূলে—
রাখি না খবর; আপাতত আমি কাতরাই শুধু
পুরোনো আমার দন্তশূলে।
ডাস ক্যাপিটাল জপি নিশিদিন, লেনিনের বাণী
করি মুখস্থ, তবুও হায়
আঁধি ও ব্যাধিতে দিশেহারা মনে ধর্মগ্রন্থ
কেমন অলীক ছায়া বিছায়।
ভোরের আজান কি মায়া ছাড়ায় ফাঁকা রাস্তায়,
ঘুমন্ত ঘরে, বিবশ কানে।
আধখোলা চোখে দেখি বৃক্ষের আইবুড়ো ডাল
কাঁদে কোকিলের গায়েবি টানে।
আমি বটে এক জাতস্বপ্নিক স্বপ্নের ঘোরে
মায়াজাল বুনি বন্ধ ঘরে।
আজো আরব্য রজনী আমার মগজের কোষে
রঙিন কুয়াশা সৃষ্টি করে।
স্বদেশী মাটিতে ইদানীং আর টেকে না তো মন,
বাক্স প্যাঁটরা তৈরী থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য স্বর্গরাজ্য, তাই ভিটেমাটি
বেচে ছুটে যাই ভিসার ডাকে।
মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি দেয়াল ঘড়িটা
পাখা নেড়ে যায় দূরের নীলে;
আমার ভেতর থেকে কার হাত বেরিয়ে চকিতে
ছিপ ফ্যালে ফিকে সবুজ ঝিলে।
বাথরুমটার বালতির জলে, দেখি দৈবাৎ
ঝলমল করে কাস্পয়ান;
এবং চলেছে দূর শতকের ফিনিশীয় শাদা
পালতোলা এক সাগরযান।
রঙ বেরঙের অজস্র পাখি ঠোঁটে নিয়ে ওড়ে
একটি কফিন পুষ্পঢাকা।
শূন্যতাময় দহলিজে নাচে রাজনর্তকী
দূর অতীতের ভস্মাখা।
সন্ধ্যার মতো অন্ধ দুপুরে আমার উঠোনে
রোমক সেনারা খেলছে পাশা।
ওপরে পেরেকবিদ্ধ শরীর ক্রুশকাঠে গাঁথা,
শিয়রে আমার সাপের বাসা।
রুটিন
তাঁকে চেনে না এমন কেউ নেই এ শহরে
তিনি থাকেন
সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় হাঁটেন মোজাইক করা মেঝেতে
বসেন ময়ূর সিঙ্ঘাসনসুলভ পদিমোড়া চেয়ারে
খ্যাতি তাঁর পায়ের কাছে কুকুরের মত
কুঁই কুঁই শব্দে লেজ নাচায়
হলফ করে বলতে পারি আমাদের আগামী
বংশধররা বাধ্যতামূলকভাবে পড়বে তাঁর সচিত্র জীবনী
স্কুল কলেজে সমাজ রাষ্ট্র জগৎসংসার বিষয়ক তাঁর হ্যাণ্ডবুক
সুকান্ত লাইনো টাইপে
প্রকাশিত হবে বছরের পর বছর
আর এওতো অবধারিত যে তাঁর জন্মবার্ষিকী এবং
মৃত্যুবার্ষিকীতে আপামর জনসাধারণ
ভোগ করবেন সরকারি ছুটি
আমাদের এই পঙ্গু দেশ যাতে তিন লাফে এলাহি
পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে
সেজন্যে রাত জেগে তিনি দেখেন বন্যায় ভেসে যাওয়া
ছাগলের পেটের মত ঢোসকা নিবন্ধ
ফজরে দশ মিনিট নামাজ পড়ার পর তিনি
পনেরো মিনিট তেলাওয়াত করেন কোরান পাক
খুরপি আর ঝারি হাতে
আধঘণ্টা বাগান করেন
দুর্লভ জাতের গোলাপ ফোটানোই তার লক্ষ্য
এক ঘন্টা কাটে তাঁর
ব্রেকফাস্টা করে খবরের কাগজ পড়ে
আর ডেটারজেন্ট সুবাসিত সাফসুতরো বাথরুমে
তিনি দশটা পাঁচটা অফিস করেন নিয়মিত
ক্লাবের টেনিসকোর্টে কাটান ঘণ্টা দেড়েক
ছেলেমেয়েদের আদর করেন পনেরো মিনিট
ঘড়ি ধরে ঘরের বউকে সোহাগ করেন ত্রিশ মিনিট
পরের বউকে নব্বই মিনিট
মাশাল্লা মজবুত তাঁর গাঁথুনি
ইস্পাতি গড়ন অথচ
মাখনের মত নরম তাঁর মন
প্রত্যহ তিনি পরিবগুর্বোদের জন্যে দুঃখ করেন
পাক্বা তিন মিনিট।
লেয়ার্টেস
এই ছিল তবে আমার ভাগ্যে মধ্যদুপুরে
বিনা মেঘে এই বিপুল বজ্রপাত?
পিতা হত আর পিতৃশোকেই ভগ্নী আমার
উন্মাদিনী সে হয়েছে আকস্মৎ।
কত ঝঞ্ঝায় কত যে প্লাবনে কেটেছে আমার
মাতৃস্নেহের ছায়াহীন শৈশব।
বিকৃত শত মুখোশের ঢঙে নাচে অবিরত
অধিবাস্তব নাট্যের কুশীলব।
নাছোড় অশেষ দাবানল জ্বলে শিরায় শিরায়,
হৃদয়ের শত ফুল্কি দুচোখে ওড়ে।
তীক্ষ্ণ অসির সূচিমুখ আমি করছি পরখ,
শক্র কোথায় কোন্ প্রান্তরে ঘোরে?
আমার নিরাহ বয়েসী পিতার লাশ ওরা খুব
তাড়াহুড়ো করে মাটিতে রেখেছে ঢেকে।
রক্তের ঋণ শোধার জন্যে মনে হয় তিনি
আর্ত কণ্ঠে আমাকেই যান ডেকে।
আজীবন শুধু রাজসেবা করে জনক আমার
বার্ধক্যেই হলেন অসির বলি।
জঘন্য এই হত্যা আমাকে দেয় ধিক্কায়,
আমি নিজস্ব ধোঁয়াটে নরকে জ্বলি।
ভগ্নী আমার কালের বৃন্তে স্বর্গ কুসুম,
মেলেছিল তার প্রতিটি পাপড়ি সুখে।
রাজার কুমার কী জানি কেমন বাজালো বেহাগ,
দুঃখ-ফলানো ঢেউ ওঠে তার বুকে।
চৈতি রাতের স্বপ্নে মগ্ন যুবরাজ তাকে
শোনালো ব্যাকুল মদির গুজ্ঞরণ।
সোনালী নদীর মত সেই স্বর শুনে হয়ে গেল
একটি মেলডি তরুণীর তনুমন।
দর্শনঘেঁষা বাক্যবিলালসী বুদ্ধিজীবী সে,
দিশাহারা যেন মননের সংকটে।
ভগ্নী শোনেনি বারণা আমার, রাখেনি মিনতি-
পড়ল জড়িয়ে ঊর্ণার ক্রুর জটে।
কোন্ ইঙ্গিতে অপাপবিদ্ধ তরুণীর প্রতি
কুমার করেছে নিষ্ঠুর আচরণ?
নিশ্বাসে তার পুষ্পপোড়ানো গ্রীষ্মের দাহ,
ভাষায় প্রাকৃত বৃশ্চিক-দংশন।
সারল্য তার পায়নিকো ক্ষমা, মগজের কোষে
অপ্রকৃতি গায় বড় এলোমেলো গান।
তন্বী শরীরে জলচুম্বন, নিখাদ পূররী,
ভুঁইচাপা আর জলবিছুটির ঘ্রাণ!
রাজার বাগানে সাপ তোলে তার চক্কর-আঁকা
ফুটন্ত মাথা; ঘাতক, গুপ্তচর
আশপাশে ঘোরে, করে কানাঘুষো। মারি ও মড়কে
কংকাল হয় কত লোক লস্কর।
দশকে দশকে বাটপাড় আর ঘোড়ল দালাল,
লুটেরার পাল আসে পালটিয়ে রূপ।
ইতরজনের বহ্বারম্ভ সাধু সজ্জন
ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে আজ বড় নিশ্চুপ।
কানকখা শুনে মিত্রকা আমি শক্র ভেবেছি,
সত্তা আমার হীন দ্বৈরথে মাতে।
যে-জাল নিজেই বিছিয়েছি ষড়যন্ত্রে ব্যাপক,
অসহায় আমি আটকা পড়েছি তাতে।
জোর যার তার মুলুক সত্য, দুর্ভোগ বাড়ে
গণমানুষের, খরাকবলিত দেশ।
ঘুচাবো দীনতা, এমন সাধ্য নেই একতিল,
আমি নগণ্য ব্যর্থ লেয়ার্টেস।
রাজার কুমার হয়তো পারতো দুর্গ প্রাকারে
জ্বালাতে সূর্য অমাবস্যার রাতে,
কিন্তু এখানে কেবলি শবের ছড়াছড়ি আর
বীর যুবরাজ নিহত আমারই হাতে।
শ্লোগান
হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই
অশুভের সাথে আপোসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই।
এখনো জীবনে মোহন মহান স্বপ্ন চাই
দয়িতাকে ভালোবাসার মতোন লগ্ন চাই।
কবিতায় আমি তারার মতোন শব্দ চাই,
শান্তি এবং কল্যাণময় অব্দ চাই।
মল্লিকা আর শেফালির সাথে চুক্তি চাই,
সর্বপ্রকার কারাগার থেকে মুক্তি চাই।
মুক্তি চাই,
মুক্তি চাই।
হে আমার বাল্যবন্ধুগণ
শোনো তোমরা হে আমার বাল্যবন্ধুগণ-
শোনো আফজাল, তাহের, ফরহাদ, সূর্যকিশোর।
আজ পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
ভাবছি তোমাদের কথা।
আফজাল, আমি জানতাম
সেলুলয়েডে একটা নির্মল কাহিনী রচনার সাধ ছিলো তোমার।
তাহের, তুমি একটা বিরাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে।
ফরহাদ, গ্রাম-থেকে-আনা তোমার গোলাপী রঙের টিনের
স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো
যাবতীয় চিরকুট, সবুজ শাল আর একটা রাজহাঁস।
সূর্যকিশোর,
প্রতিদিন সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাওয়াতেই ছিলো তোমার আনন্দ।
আফজাল, তোমার সেই সেলুলয়েডী সাধ, যদ্দূর জানি,
পূর্ণ হয়নি। এইতো সেদিন আমরা কতিপয় শোকার্ত মানুষ
গোলাপজল আর লোবানের ঘ্রাণময় হাতে
তোমাকে শুইয়ে দিলাম মাটির নিচে, যেখানে
কাঁকড়াবিছে আর পোকামাকড়ের ঘনিষ্ঠ গেরস্থালি।
প্রতিবাদহীন তুমি ছিলে অসম্ভব নিশ্চুপ, অথবা শার্টের কলারে
কিং জ্যাকেটের আস্তিনে একটা পিঁপড়ে
অথবা, কাঁচপোকা আনাগোনা করলে তুমি
মাথাখারাপ-করা অস্বস্তিতে ভুগতে, টোকা মেরে উড়িয়ে দিতে
তৎক্ষণাৎ। মনে পড়ে, আফজাল তোমার সঙ্গে দেখেছিলাম
জীবনের প্রথম জোনাকি আর তোমার স্মৃতি এখন জোনাকি।
তাহের তুমি সেতু তৈরির স্বপ্ন খারিজ করে
বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে একদিন পাড়ি জমালে সুদূর বিদেশে।
তুমি আজ ফেঁসে গিয়েছো ভিনদেশী এক শহরে, ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরের ঝলমলে করিডোরে, ব্যাংক ত্র্যাকাউন্টের ঝকমকিতে,
চকচকে এস্কেলেটারে।
ফরহাদ, তোমার সেই ‘এলাহি ভরসা’ খচিত
গোলাপী রঙের টিনের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে-পড়া রাজহাঁস
গ্রামীণ তেজারতির অন্ধকার গুদামে দম আটকে
মারা গ্যাছে। তুমি চটজলদি
তাকে দাফন করেছো জামতলায় হল্দে পাতার নিচে।
সূর্যকিশোর; সেই যে তুমি হাঙ্গামায় বেচারামের
দেউড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেলে
সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে, তারপর তোমার কোনো খোঁজখবর
আমি পাইনি। তুমি কি পশ্চমবঙ্গের রাইটার্স বিল্ডিং এ
কলম পিষছো? নিত্যদিন মিশছো চৌরঙ্গীর ভিড়ে ? নাকি
ডেলি প্যাসেজ্ঞারি করছো মফস্বলী ট্রেনে?
সূর্যকিশোর, তুমি কি আজ খুচরো যন্ত্রাংশের কারবারি?
তুমি কি ধিকিয়ে-ধিকিয়ে-চলা খবর কাগজের
সংবাদ-শিকারি? তুমি কি ফাটকা বাজারে ঘোরো নিত্যদিন?
সূর্যকিশোর, হে বন্ধু আমার, তুমি এখনো
সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যেতে ভালোবাসো প্রত্যহ?
ইতিহাসের চেল্লাচিল্লি আর রাজনীতির হৈ-হল্লায়
তুমি বেঁচে আছো কিনা, আমি তা জানি না সূর্যকিশোর।
শোনো তোমরা শোনো, হে আমার বাল্যবন্ধুগণ,
পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
আমি ভাবছি তোমাদের
এবং ভাবছি আমার নিজের কথা।
একদা সুকান্তের মতো গালে হাত দিয়ে
পুরোদস্তুর কবির কায়দায়
একটা ফটো তুলেছিলাম,
উই-খাওয়া সেই ফটো আজ
কোথায় হারিয়ে গ্যাছে। তোমাদের অলক্ষ্যে
কী রহস্যময় সখ্যে
অক্ষরের পরী ভর করেছিলো আমার ওপর। এখনো
গায়ে-কাটা-দেওয়া প্রহরে প্রহরে
আমার নিভৃত ঘরে, পথে-বিপথে তার
অনির্দিষ্ট আনাগোনা।
শোনো তোমরা শোনো, হে বাল্যবন্ধুরা আমার, শোনো
আমার ঘরে নিমেষে বস্তুময়তার উপরিতলে পিছলে
অনেক রঙিন মাছ এসে যায়, সাঁতার কাটে, এসে যায়
জলাভূমির ধারে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের
হাড়গোড়ের সারে মজ্ঞরিত লক্ষ লক্ষ টাটকা গোলাপ।