- বইয়ের নামঃ আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অঙ্গীকার
ফিরে যাবো? কেন ফিরে যাবো বারবার?
জানি সিংহদ্বার
পেরুলেই পেয়ে যাবো আকাঙ্ক্ষিত সব
উপচার, যার জন্যে ভীষণের স্তব
করেছি সকালসন্ধ্যা, পেরিয়েছি ঝড়মত্ত নদী, কতো সিঁড়ি,
রক্তাপ্লুত, বারংবার নেমেছি খনিতে। আজো ফিরি
পথে পথে কেইনের মতো। ফিরে যাবো? প্রহরীর
রক্তচক্ষু দেখে ফিরে যাবো? তুমি তবুও বধির
হ’য়ে থাকবে সর্বক্ষণ? ডাকবে না সেখানে, যেখানে
আমার ব্যাকুল পদচ্ছাপ পড়েছিলো স্বপ্নে, মানে
অলৌকিক অভ্যন্তরে। এই রুদ্ধ সিংহদ্বার থেকে
হতাশায় ভগ্নরথ ফেলে রুক্ষ ক্লান্ত মুখ ঢেকে
গেছেন আমার পিতামহগণ ফিরে। আমার শপথ,
প্রাপ্য ছাড়া আমিতো যাবো না ফিরে, থামাবো না রথ।
অপরাধী
আমি তাকে অকস্মাৎ তারস্বরে গেট আউট গেট আউট ব’লে
তাড়িয়ে দিলাম।
সদর দরজা দিয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি অন্যমনস্কতা
বিড়ি ফুঁকে চ’লে গেলো। দালানের অভ্যন্তরে যেতে চেয়ে পথ
দীর্ঘ পথ বেয়ে
যথারীতি চ’লে যাবে খোলার ছা-পোষা ঘরে সূর্যাস্তের পরে।
আমি কি নির্দয় কোনো জীব? ঠিক তা’না, তাকে জাহান্নামে যেতে ব’লে অনুতাপের বিবরে
ব’সে আছি। অথচ তক্ষুণি তাকে, মানে
সেই অপদার্থ লোকটাকে না তাড়ালে লোকচক্ষুর আড়ালে
আমাকে অরণ্যে
আস্তনা গাড়তে হতো। লোকটা অর্থাৎ
সেই কম্পোজিটার আমাকে বিরক্তির খানাখন্দে
কেবলি দিচ্ছিলো ঠেলে যখন তখন।
একটি নিটোল স্বপ্ন তাকে কম্পোজ করতে দিয়ে দেখি,
স্বপ্নের জায়গায় দিব্যি দুঃস্বপ্ন দিয়েছে বসিয়ে সে,
সুস্থতার জায়গায় অসুখ আর উন্মত্ততা। তার
হাতের অস্থির স্পর্শে সুবিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর
কারাগার হয়ে যায়, শিশুর চিৎকারধন্য মৃদু আলোময়
একটি আঁতুড়ঘর গোরস্থান। পরিপাটি গ্রাম,
মুখর শহর তাকে কম্পোজ করতে দিলেই সে
টাইপে সাজাতো দগ্ধ, বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম আর
আলো চাইলে তড়িঘড়ি ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে নিখুঁত
অন্ধকার শব্দটি বসিয়ে দিতো বারবার। একি
দারুণ অবজ্ঞা তার? না কি বৈপরীত্যবিলাসী সে
ভ্রান্তির কোটরে খোঁজে স্বস্তি অহর্নিশ?
এখন তাড়িয়ে তাকে নিজেই টাইপ কেস নিয়ে
বসে গেছি চমৎকার; দেখবো এবার
কী ক’রে তুমুল ভুল শব্দ যথার্থ শব্দের জায়গা
জুড়ে বসে। কিন্তু আমি স্বপ্ন কম্পোজ করতে গিয়ে, ভারী
অপ্রস্তুত, দেখছি দুঃস্বপ্ন হ’য়ে যাচ্ছে অবিকল
এবং সুস্থতা
ভীষণ অসুখ; আশা নৈরাশ্যের জুতোয় গলিয়ে দিচ্ছে ঠিক
পদযুগ পরিপাটি গ্রাম,
মুখর শহর হয়ে যাচ্ছে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম
এবং টাইপ কেস তন্ন তন্ন ক’রে আলো শব্দটি পাচ্ছিনা খুঁজে আর,
পাচ্ছি না কোথাও-
ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে অত্যন্ত দ্রুত শুধু
ভীষণ হাভাতে এক অন্ধকার বানিয়ে ফেলছি!
অমন তাকাও যদি
অমন তাকাও যদি একবিন্দু অনন্তের মতো চোখ মেলে,
আমি বারবার
তোমার দিকেই ছুটে আসবো প্রত্যহ।
যেখানে তোমার দৃষ্টি নেই,
তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না যেখানে কেনোদিন
সেখানে কী করে থাকি? তোমাকে দেখার জন্যে আমি
যশের মুকুট
ছুঁড়ে দেবো ধূলায় হেলায়, তাকাবো না ফিরে ভুলে
কস্মিনকালেও আর। মেনে নেবো হার, এই খর
মধ্যাহ্নেই হয়ে যাবো স্বেচ্ছায় সূর্যাস্ত; জেনে রাখো,
তোমাকে দেখার জন্যে বেহেস্তী আঙুর আর কয়েক ডজন
হুরীর লালচ আমি সামলাতে পারবো নিশ্চিত।
তোমার নিদ্রার ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাবো বেয়ে ছিপ নৌকো
এবং লাফিয়ে প’ড়ে তোমার স্বপ্নের তটে আবিষ্কারকের
মতো দেবো পুঁতে
আমার নিঃশ্বাসে আন্দোলিত এক পবিত্র নিশান।
কখনো নিদ্রার রাজপথে, কখনো-বা জাগরণে
বাগানে কি পার্কে
সড়কে ট্রাফিক দ্বীপে, বাসে
গোলাপ শ্লোগান হাঁকে একরাশ, উড়ন্ত কপোত
অকস্মাৎ দিগ্বিদিক লুটোয় নিষিদ্ধ
ইস্তাহার হ’য়ে,
পড়ি, ‘নরকেও ভালোবাসা ম্যানিফেস্টো হিরন্ময়।
অমন দাঁড়াও যদি নিরিবিলি পা রেখে চৌকাঠে,
সমর্পণ করতে পারি আমার সমস্ত আয়ুষ্কাল
তোমারই আঁচলে।
যদি পাপ তোমার শরীর হ’য়ে নত নয়, হয় উন্মোচিত,
দ্বিধাহীন তাকে খাবো চুমো গাঢ়, বাঁধবো ব্যাকুল আলিঙ্গনে।
আমি আমার স্বপ্নগুলি
আমি আমার স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
কৃষক যেমন চায় বাঁচাতে ধানের চারা,
পক্ষী যেমন শাবকগুলো দেয় পাহারা,
তেমনি আমি স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
সকল স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?
জমি জিরেত নেইতো কিছু, আমার কাছে
নেই তো কড়ি, শুধু কিছু স্বপ্ন আছে।
সেসব স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?
এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?
দাও বেচে দাও স্বপ্ন তুমি, বলছে ওরা,
‘নইলে পিঠে পড়বে হাজার হিংস্র কোড়া।
এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?
স্বপ্ন দেখায় তেমন কোনো নতুনত্ব নাই।
কিন্তু একলা বুকের ভেতর স্বপ্নগুলি
লালন ক’রে ঘোরা ফেরা নয় মামুলি।
স্বীকার করি, স্বপ্ন দেখায় নতুনত্ব নাই।
স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।
পাথর টাথর, গাছের পাতা, এসব নিয়ে
কে যেন এই স্বপ্নগুলি দেয় বানিয়ে।
স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।
এত স্বপ্ন করবো বলো কী করে বাছাই?
উজান ঠেলে তাদের কেবল বাঁচিয়ে রাখতে চাই!
উম্মত্ততা বয়স্য আমার
প্লাটিনাম চোখ নিয়ে অজস্র শেয়াল রাত্রিভর
আমার বিছানা নোংরা করে স্বপ্নগুলো
দেয়ালে দেয়ালে ঝোলে সার্টিনের পর্দার মতন।
খুব হিংস্রতায়
একটি বিরাট কাঁচি সেসব পর্দার বুকে স্বেচ্ছাচারী হয়।
আফ্রিকার তিনটি মুখোশ অতি দ্রুত
কোরানের আয়াত আবৃত্তি
করতে করতে
আওড়ায় আদালতী বেবাক শপথ।
আমি কি উম্মাদ হয়ে যাচ্ছি?
ঘরে রাশি রাশি টেলিগ্রাম
অচল নোটের মতো নির্লজ্জ ছড়ানো ইতস্তত
এবং সকল বার্তা উদ্ধার-রহিত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে
দেখি মস্ত ছায়ার ধারালো জিভ চাটছে আমাকে
বিশদ ক্ষুধায়।
মেডুসার মুন্ডু চতুর্ধারে নেচে ওঠে বারংবার।
যোগাযোগহীন
টেলিফোন নিয়ে মেতে আছি, কেবলি ডায়াল করি
অসম্ভব ডিজিটের ঘোরে, নিঃশব্দতার ওপর করছি
অলৌকিক বলাৎকার
তবে কি বলবো, হায়, উন্মত্ততা বয়স্য আমার?
এইতো মেঘের বুক ফুঁড়ে
হৃদয়দ্রাবক
তন্বী এক চারা অস্তিত্বের গরিমায় ঝলমলে,
অথচ হঠাৎ
একটি প্রকট হাত, সুবিশাল, দরজা-জানালা ছাদভেদী,
নেমে আসে আমূল উপড়ে নিতে, আমি সাত তাড়াতাড়ি
চারাটাকে মানবিক আড়ালে রাখতে চাই। সেই হাত আমাকে হেলায়
বারবার দিচ্ছে ছুঁড়ে, টেবিলের খাটের তলায়
গিয়েও নিস্তার নেই। সমগ্র সুন্দরবন আসে ঘর ব্যেপে,
চাক চাক আকাশও এখন
আমার নিবাসে, ভাসমান, ডাঁই ডাঁই সংবাদপত্রের নিচে
কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি, একজন কাগজের মূর্তি, পিকাসোর
ছবির মতন কয়েকটি
মুখাবয়বের দীপ্র ব্যাপক চমক হেনে ডাকে,
টেবিলের দিকে ফুরফুরে আঙুল নিবন্ধ তার।
ঘরময় ট্রেন দুর্ঘটনা, লঞ্চ ডুবি, জুয়োর টেবিল; অকস্মাৎ
আমার ডবল এসে আমাকেই পরায় লোহার হাতকড়ি,
চতুষ্পার্শে সুর্যমুখী, নতুন বাছুর, গয়লানী সাঁতরাচ্ছে,
শুধু সাঁতরাচ্ছে……
আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি?
এ রকমই হয়
এ রকমই হয়, দিব্যি হয়ে আসছে অনেককাল থেকে।
যুগে যুগে গ্রাম ও শহর
বাদুড়ের পাখার মতন অন্ধকারে যায় ঢেকে
অকস্মাৎ। জাহাজের সম্পন্ন বহর
সন্ত্রস্ত বন্দর ছেড়ে ছোটে আর্তরবে
মধ্য-সমুদ্রের গাঢ় নীলিমায়, পারে না এড়াতে
ভরাডুবি; এরকমই হয়, বারবার হবে।
দ্বৈপায়ন বণিক বেড়াতে
এসে দূর দেশে মশলার ঘ্রাণে গড়ে রাজ্যপাট।
দ্বিগ্ধিজয়ী বীরের অশ্বের পদাঘাতে চতুর্ধারে
ঘন ঘন ওঠে হাহাকার, নিমেষে উজাড় ত্রস্ত পথঘাট-
মড়কে এমনই হয়, সবাই পালায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বনবাদাড়ে।
অনেক শহর পোড়ে, ভাঙে গ্রাম, গ্রন্থের পাতায়
প্রমত্ত অশ্বের বিষ্ঠা জমে, খোঁড়া তৈমুর অথবা হিটলার
সবাই সোৎসাহে ক্রূর জামার হাতায়
নাচায় কংকাল, নগরের আগুনে তুমুল সেঁকে হাত আর
দেয় ছুঁড়ে অন্ধকূপে কিংবা গ্যাস চেম্বারে তাদের,
যারা কাড়া নাকাড়ার তালে রাজ-রাজড়ার সুরে
ওঠেনা যান্ত্রিক নেচে, বোঝে যারা কুটিলতা নানান ফাঁদের।
চিরকাল খেলা একই, পাল্টায় খেলুড়ে।
একটি কবিতার জন্যে
বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলিঃ
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
বৃক্ষ বলে, আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
জীর্ণ দেয়ালের কানে বলিঃ
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
একজন বৃদ্ধের নিকটে গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক’রে দেবেন কি একটি কবিতা?
স্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠ- যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল?
বলো, কতোকাল?
একটি শিশুকে
যদি চাও, ভরে দিতে পারি এই ভোরের অঞ্জলি
গল্পের অজস্র ফুলে। শোনো বাঘ-ভাল্লুকের নয়,
অথবা পরীরও নয়, চেনা মানুষেই গল্প বলি।
করবো না নামোল্লেখ কিংবা করবো না নয় ছয়
ঘটনাবলিকে সত্যি। একরত্তি মেয়ে তুমি, তাই
বুঝরে না কাহিনীর সন্ধ্যাভাষা। একটি পুরুষ
জীয়ন কাঠির স্পর্শে চেয়েছিলো জাগাতে হৃদয়
মহিলার স্বপ্নাবেশে। বাস্তবের কর্কশ বুরুশ
খানিক রগড়ে দিলো তাকে, বাসনার ছিনতাই
দেখলো স্বচক্ষে, সে মহিলা, মানে, তোমার জননী
স্যুইচ টেপেনি তার ঘরে কিংবা খাবার টেবিল
সাজায়নি কোনোদিন। তার অস্তিত্বের রাঙা ধ্বনি
অন্যত্র পেলব বাজে, তুমি জানো। দিয়েছে সে খিল
একদা-র কপাটে নিপুণ; শোনো, তুমি প্রজাপতি
হ’য়ে ঘোরো, পুতুলের বিয়ে দাও, চালিয়ে কুরুশ
ইচ্ছেমতো তুলো ফুল যৌবনে রুমালে, নেই ক্ষতি
কারুর হৃদয়ে জ্বেলে তারাবাতি, সাজিয়ে নহবৎ
নাড়িও না ভুলে তুমি আরেক জনের ঘরে নথ।
ওডেলিস্ক
সে রাতে তুমিই ছিলে ঘরের মিয়ানো অন্ধকারে
বিছানায় উন্মোচিত। তোমার বিশদ
ডাগর নগ্নতা আমি আকুল আঁজলা ভ’রে পান
ক’রে বারবার
মৃত্যুকে তফাৎ যাও বলবার দীপ্র অহংকার
অর্জন করেছিলাম। নিপোশাক তোমার শরীর
জ্যোৎস্না-কমান ধোয়া মসজিদের মতো
তখন বস্তুত
আমার চোখের নিচে। স্তনপল্লী জ্বলে,
যেমন সন্তের জ্যোতিশ্চক্র অবলীলাক্রমে আর
তৃষ্ণাতুর ওষ্ঠ রেখে নাভির লেগুনে
ভেবেছি তোমার
সুদূর প্রপিতামহী কেউ এমনি সাবলীল নগ্নতায় ভেসে
কারুর চোখের আভা করেছে দাবি।
তোমার শরীর
কোথাও নিরালা পথ, মসৃণ অথবা তরঙ্গিত,
কোথাও বা সুরভিত ঝোপ, আমার ওষ্ঠ-পথিক
ক্রমাগত আঁকে পদচিহ্ন সবখানে। কে জানতো
এমন পুরোনো গাঢ়, প্রায় আর্তনাদের মতোই
ডাক, শিখাময় ডাক মাংসের আড়ালে থাকে, থাকে
লুকোনো এমন বিস্ফোরণ!
সেই নিরঞ্জন রাতে আমার তামাম নিঃসঙ্গতা
ঈষৎ স্পন্দিত
নগ্নতার দিকে হাত দিয়েছিলো বাড়িয়ে এবং
তোমার সপ্রাণ চুললগ্ন বেলফুল
কী কৌশলে আমার বয়স নিয়েছিল চুরি ক’রে।
আমার সকল রোমকূপ পল রবসনী সুরে
সে মুহূর্তে গীতপরায়ণ-আমি তোমার দিকেই ছুটে যাই,
যেমন ওড়ার বাসনায় ছটফতে পাখি আকাশের নীলে,
যেমন লাঙল নগ্ন ফসলাভিলাষী রিক্ত মাঠে।
প্রেমিক সেকেলে শব্দ, তবু আমি তাই ইদানীং।
তুমি নরকের দ্বার, ত্রিলোকে রটায় অনেকেই,
আমি সেই দ্বারে নতজানু, নির্গ্রন্থ পুরুষ এক
স্বর্গের প্রকৃত সংজ্ঞা অভিধা ইত্যাদি
প্রবল ভাসিয়ে দিই আমার স্বকীয় শোণিতের কোলাহলে।
করাঘাত হওয়া চাই
আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই,
করাঘাত হওয়া ভালো। যদি
কোনো বন্ধু-বান্ধব হকার কিংবা গয়লা
আমার আপন দরজায় এসে কড়া নাড়ে কখনো সখনো,
খুব ভালো হয়।
কিন্তু কেউ চুপচাপ এসে চলে গেলে বন্ধ দোরে
রেখে গেলে এক গুচ্ছ ফুল
কিংবা চিরকুট শব্দহীন,
আমি সেই উপহার কখনো গ্রহণ করবোনা।
আমি তো আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে আচমকা
করাঘাত চাই।
নইলে চতুর্দিকে ব্যস্তবাগীশ উইয়ের ঝাঁক ‘প্রভু প্রভু’ শব্দে
গড়বে বল্মীক কতো, আমি
অতিশয় ঢাকা পড়ে যাবো।
বৃক্ষের ছায়ায় ভিন্ন গাছ
পক্ষীর ডানায় অন্য পাখি
তটিনীর গহনে অপর নদী দেখে, মৃত্তিকায়
নক্ষত্রের গুঁড়ো মেখে, গন্ডদেশে ধেনো শিল্পরসের উদাস
চটচটে দাগ নিয়ে খোয়ারিতে ম’জে
বসবাস করতে করতে আজীবনের সঙ্গে তুই তোকারিতে মেতে
অনেক সোনালি সুতো ছিঁড়ে খুঁড়ে
জীবনেরই বিরুদ্ধে বিপ্লবী হয়ে যাই।
তখন আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই।
কৃষ্ণকলি নৈঃসঙ্গ্যের ওষ্ঠ থেকে ওষ্ঠ তুলে
কখনো বলিনা-
লোকালয় আমার ভেতর
প্রবেশ করুক।
আমার নিজের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্যের মতন
রেখেছি যেসব উপদ্রব জমা, তাড়ানো সহজ নয় তাদের কখনো;
ওদের বিশদ তাড়নায় আমি রণক্ষেত্রে পারতাম যেতে
পারতাম মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ফোয়ারা খুলে দিতে,
পারতাম মেরু অভিযানে হতে স্কটের দোসর, পারতাম
সইতে ক্রূর তুষার-কামড়।
কিন্তু শুধু সারাবেলা মগজে ভ্রমর নিয়ে পুরোনো চৌকাঠে
চন্দন বুলোই, ফুলপাতা হয়,
কখনো কারুর
অলৌকিক মুঠোয় নিমেষে চলে যাই বার-বার।
সেই মুঠো থেকে
কখনো সখনো আমি নিষ্কৃতি প্রার্থনা করি ব’লে
আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই।
কিংবদন্তী
ধারে কাছেই একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে,
সেখানে রোজ নিরিবিলি চাইতো যেতে।
কিন্তু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
ফটকে নেই দৈত্যপানা মুখের মানুষ,
কুকুর টুকুর নেইকো কিছুই;
সকালবেলা কিংবা কোনো রক্তজবা-কমান গোধূলিতে
কিংবা ঝোড়ো হাওয়ার রাতে সেই বাড়িতে
তবু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
সেই বাড়িতে থাকে যারা, নয়তো তারা শত্রু আমার।
তীক্ষ্ম ছুরি, কিংবা ধরো বিষের পাত্র
আমার জন্যে রাখে না কেউ।
কিন্তু তবু এই আমিটার সত্যিমিথ্যে
সেখানে হায় হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
সেখানে এক নিরুপমা বসত করে
চারদেয়ালের অন্তরালে।
সুরের মিহি নকশা দিয়ে সাজায় প্রহর মনের মতো,
শূন্যে ফোটায় রক্তগোলাপ হৃদয় যেন।
গাছের পাতায় আদর রাখে ইতস্তত।
শেখায় কথা কেমন সুরে দাঁড়ের সবুজ পাখিটাকে।
নিরুপমার ভোরের মতো হাসির ছটায়
দেয়ালগুল এক পলকে
উৎসবেরই নামান্তর।
কখনো ফের সেই বাড়িটা রাত্রিমাখা
উদাসী এক মেঘ হ’য়ে যায়
যখন সে তার কান্নাপাওয়া শরীরটাকে
দেয় লুটিয়ে শূন্য খাটে।
সিংদরজায় অদৃশ্য দুই পশু আছে,
তাদের মুখে লুপ্ত চাবি।
কোন্ খাবারে তৃপ্ত কেবা, নেই কো জানা;
তাইতো দুয়ার বন্ধ থাকে
এবং আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
কী পরীক্ষা নেবে?
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
হাতে জপমালা নেই, তবু
আমি তো তোমার নাম মন্ত্রের মতন
করি উচ্চারণ সর্বক্ষণ। যেখানে তোমার ছায়া
স্বপ্নিল বিলাসে
অপূর্ব লুটিয়ে পড়ে, সেখানে আমার ওষ্ঠ রেখে
অনেক আলোকবর্ষ যাপন করতে পারি, তোমারই উদ্দেশে
সাঁতার না জেনেও নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
গহন নদীতে নেমে যেতে পারি।
তোমার সন্ধানে ক্রোশ ক্রোশ দাউ দাউ পথ হেঁটে
অগ্নিশুদ্ধ হতে পারি, পারি
বুকের শোণিতে ফুল ফোটাতে পাষাণে।
যখন পাথরে হাত রাখি,
পাথর থাকে না আর অরূপ পাথর,
হয়ে যায় প্রতিমা তোমার।
যখন বৃক্ষের দিকে দৃষ্টি মেলে দিই,
বৃক্ষ হয় তোমার শরীর।
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায় এক বুক উপদ্রব নিয়ে থাকি,
ব্যাকুলতা বারবার সিঁদ কেটে ঢোকে,
হৃদয়ের ঘরগেরস্থালি, বনস্থলী
লুট হয়ে যায়
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায়, আমি তাই তুমি ছাড়া কারুর জন্যেই
পারি না অপেক্ষা করতে আর।
ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার ওষ্ঠজাম, তুমি না থাকলে
আমার সকল চুমো যাবে বনবাসে,
তোমার অমন হাত স্পর্শ ক’রে ছুঁয়েছি স্বর্গের
মল্লিকাকে, তুমি চ’লে গেলে
আমার ছোঁয়ার মতো অন্য কোনো হাত থাকবে না আর।
এর পরও অনুরাগ নিক্তিতে মাপতে চাও, চাও
আমার পরীক্ষা নিতে নানা অছিলায়?
আর কি ভোগ চাও? এক একে নির্দ্বিধায়
সবি তো দিয়েছি।
হৃদয়ের আসবাবপত্তর সবি তো
স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে চাই, তবু কেন যাবতীয়
সম্পদ আমার
ক্রোক করবে বলে নিত্য আমাকে শাসাও?
আমি তো তোমাকে সুখ দিতে চয়ে কেবলি নিজের
অসুখ বাড়াই।
মাটি ছুঁয়ে বলছি এখন,
এই বৃক্ষমূলে আমি শীর্ণ হই, অন্ন আনি নিজে,
কান্নায় ধোওয়াই পদযুগ।
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
আমার সম্মুখে তুলে ধরো বিষপাত্র,
নিষ্পলক দ্বিধাহীন নিমেষে উজাড় করে দেবো।
কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ
সকল সময় নয়, কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ
তোমাকে হাওয়ার পাই, পাই সিগারেটের ধোঁয়ায়।
কখনো দরজা খুলে দাঁড়ালেই স্মিত অন্ধকারে,
কখনো বা সুরভিত বারান্দায় মৃদু চন্দ্রলোকে,
গোলাপের অন্তঃপুরে, কখনো সড়কে, মৃত্যু আর
জীবনের গুঞ্জরণময় হাসপাতালের বেডে
সহসা তোমাকে দেখি। গাছগাছালির অন্তরালে
মেঘের উড্ডীন দ্বীপে, এমন কি গোষ্পদেও তুমি।
তুমি এলে আমার চৌদিকে অবলীলাক্রমে দৃশ্য
কেবলি পাল্টাতে থাকে, তুমি এলে হাজার হাজার
নক্ষত্রের তোড়া আমার সম্মুখে দীপ্র উপস্থিত,
সুনীল সমুদ্র ওঠে দুলে, দিগন্তের পাড় চিরে
উদ্ভাসিত জাহাজের গর্বিত মাস্তুল; নীল জলে
কুহকের কেশপাশ, জাগে প্রতিধ্বনিময় দ্বীপ।
তুমি এলে একরাশ ভেলভেটপ্রতিম গোলাপ
মোহন আলাপে মাতে বেহালার সাথে, মাথাভরা
অজস্র উকুন নিয়ে রুক্ষ্ম, একাকিনী ভিখারিনী
খিস্তি খেউড়ের মধ্যে অকস্মাৎ পুঁটলি দুলিয়ে
গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান এবং ভাগাড়ে কতো
পোকাকীর্ণ পশুর নিথর চোখে ভাগবত লীলা!
তুমি এলে কংকালের দশটি আঙুল ঘুণধরা,
হিহি অন্ধকারে নেচে ওঠে অর্গানের রীডে রীডে।
কতদিন তোমার জন্যেই ধুই সিঁড়ি অনুরাগে,
সযত্নে সাজাই ফুল করোটিতে, পোড়াই লোবান,
জ্বলে বাতি পিলসুজে কিন্তু তুমি আসো না তখন।
যখন প্রস্তুতি নেই, আয়োজন-রহিত যখন
আমি, এলোমেলো, বিভ্রান্তির চক্রে ঘূর্ণমান রুক্ষ,
তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ো কী প্রবল আমার ওপর।
চুমোয় চুমোয় রক্তে বাজাও দীপক, দৃষ্টি মেলে
তোমার উদ্ভিন্ন দিকে ভাবি শুধু, তুমি কি এমনই?
তোমার সুগন্ধে আমি এতো বার হই সমাচ্ছন্ন,
তোমারই ভেলায় ভাসি, তবু আজো তোমাকে বুঝি না।
খুলোনা এ মুখ
তোমাকে দেখলে ভয় পাই খুব, বুকের ভেতর
অশ্বক্ষুরের প্রখর শব্দ, জাগে কলরব
প্রাকারে প্রকারে। ক্রূদ্ধ মশাল, কাঁপে থরথর
ঘুমধরা হাড়, চোখে ভাসমান বেকসুর শব।
তোমার অমন ভবিষ্যময় চোখে তাকালেই
পারমাণবিক ভস্ম আমাকে করে দ্রুত গ্রাস
হাতড়ে হাতড়ে কোনো সূত্রের পাই না যে খেই,
পায়ের তলায় মাটি অস্থির, বর্বিত ত্রাস।
দোহাই তোমার এক্ষুণি ফের খুলোনা এ মুখ।
ফস ক’রে তুমি কী যে ব’লে দেবে, দেয়ালের দিকে
তর্জনী তুলে স্তোত্র পাঠের উদাত্ত সুখ
চোখে নেবে কিছু হয়তো আনবে কাল-রাত্রিকে।
তোমার ভীষণ ভাবী কথনের নেই কোনো দাম
মাঠে কি পার্কে, কলোনীতে, মেসে, গলির গুহায়।
আত্মাকে ঢেকে খবর-কাগজে যারা অবিরাম
প্রমত্ত তারা দেয়ালে কিছুই দেখে না তো, হায়।
অন্যে বুঝুক না বুঝুক আমি জানি ঐ ঠোঁট
নড়লেই কালবৈশাখী দেবে দিগন্তে হানা,
প্রলয়ের সেনা গোপনে বাঁধবে নির্দয় জোট
হত্যার সাথে, ঝাপটাবে খুব নিয়তির ডানা।
তুমি বলেছিলে, জননী তোমার কুক্কুরী-রূপ
পাবে একদিন, জনক সর্বনাশের বলয়ে
ঘুরপাক খেয়ে হবেন ভীষণ একা, নিশ্চুপ;
নগরে ধ্বনিত হবে শোকগীতি লম্বিত লয়ে।
দেবতা তোমার জিহ্বায় কেমন অভিশাপ ঘিরে
দিয়েছেন, তার ছায়ায় প্রতিটি গহন উক্তি
ধ্বংস রটায় আধা-মনস্ক মানুষের ভিড়ে
খুলবে না মুখ-এলো করি এই চরম চুক্তি।
গন্ডার গন্ডার
বাঁচতে পারবে? কী করে বাঁচবে? চৌদিকে ক্রূর
কী একটা যেন তোমার গন্ধ বেড়াচ্ছে শুঁকে;
বুঝি ছায়াটাও কালো ইস্পাতী নখর-ফলায়
ফেলবে উপড়ে। বাইরে সদাই কতো সুচতুর
ফাঁদ পাতা থাকে, কন্টকময়; সুখে কি অসুখে
নির্বান্ধব, বেখাপ্পা তুমি চলায় বলায়।
কাদায় নুড়িতে এবং খোয়ায় নিজের রক্ত
দেখেও তোমার শিরায় গলিতে তুহিন প্রবাহ
বয় না, শুধুই লোহার অনেক হিজিবিজি শিক
চোখে এঁটে দেয় খাঁচার নকশা। আর অলক্ত
ভ্রান্তিবশতঃ মগজের ঝোপে হানে দাবদাহ।
জটিল ধোঁয়াটে স্বপ্নগুহায় ঘোরে বৃশ্চিক।
আত্মগোপন করতে কি চাও পাতার লুকোনো
সবুজ দুর্গে? বৃক্ষ মাচায় পাবে আশ্রয়?
সঙ্গ নেবে কি পাতালনিবাসী কাঁকড়া কোনো?
নিসর্গপ্রীতি আর বিপদের বিবাদ চুকোনো
সহজ তো নয়। বস্তুত তুমি খুঁজছো অভয়
তীব্র সত্তা-সঙ্কটে এই বিজনে এখানে।
বাদামের খোলে ঢুকেও তোমার নেই নিস্তার।
অলিগলি আর সদর রাস্তা, বাস ডিপো আর
জাহাজঘাটের মাটি ফুঁড়ে ঐ আসছে কেবল
আসছে উড়িয়ে ধুলোবালি ক’রে ত্রাস বিস্তার।
চৌদিক থেকে আসছে নিয়ত রাগী গন্ডার
হাজার হাজার; রৌদ্রে খড়্গ করে ঝলমল।
বৃথাই লুকোনো, বরং পাতার দুর্গপ্রাকার
গাছের কোটর কিংবা শুকনো বাদামের খোল
থেকে দ্বিধাহীন বেরিয়ে আসাই শ্রেয় অবশ্য।
গন্ডার শুধু গন্ডারে আজ সব একাকার,
খণ্ডিত তুমি নিরুপায় শোনো ধ্বংসের রোল;
তোমার বিলয়ে ফলবে অন্য কারুর শস্য।
গৌণ শিল্প
আমার ব্যর্থতা, কালো, সাংকেতিক ব্যর্থতা কখনো
লতাপাতা কিংবা পাখপাখালির আড়ালে লুকিয়ে
থাকে, কখনো-বা
ওষ্ঠের কিনারে তিক্ত স্বাদ রেখে যায়।
আমার নৈবেন্য নেয় বারবার ব্যর্থতার হা হা এভেনিউ।
শব্দ কতিপয়,
অসফল, দিশেহারা, বুঝি পিতৃমাতৃহীন পথের সন্তান,
এলেবেলে খেলে মৃত অন্ধকারে, ঘুমায় কবরে।
লতাগুল্মময় কবরের পাশে নতজানু কম্পমান, ডাকি
বারবার ঝোড়ো হৃদয়ের তীব্র আর্তি নিয়ে, ওরা
নিঃস্পন্দ নিঃসাড় যেন মেঘের আড়ালে বিকলাঙ্গ চন্দ্রকণা
অথবা এমন লখিন্দর যার গলিত শরীরে
পারবে না চল্কে দিতে প্রাণধারা বেহুলা কখনো।
ওদেরতা চমৎকার সেজেগুজে, শার্টের কলার
উল্টিয়ে শোভন আর টুপিতে পালক গুঁজে পথে
বেরুনোর কথা ছিলো,
কথা ছিলো, ওরা যাবে ড্রইংরুমের সুশীতল পরিবেশে,
বসবে সোফায়, লাল গালিচায়, দেবে জুড়ে নিভৃত আলাপ,
কথা ছিলো, ওরা যাবে ভেজা-ভেজা অন্ধকারময় গ্রন্থাগারে,
মেলাবে আপন হাত তত্ত্বপরায়ণ, তথ্যঠাসা অধ্যাপকদের সঙ্গে,
তরুণ তরুণীদের ভিড়ে করবে রগড় পার্কে করিডরে
আলো আঁধারিতে
কাফেটারিয়ায়,
কথা ছিলো, ওড়াবে অজস্র টিয়ে বাণিজ্যিক এলাকার লাল
পেট্রোল পাম্পের কিছু সম্ভ্রান্ত ওপরে,
মধ্যবিত্ত ছাদে, চিলেকোঠায় গলির মোড়ে আর
খবরের কাগজের হুজুগে পাড়ায়,
অথচ এখন ওরা লতাপাতা কিংবা পাখির ডানার
অথবা ঠোঁটের ছায়াচ্ছন্নাতায় গভীর লুকোনো
এবং তাদের সঙ্গে আমার শ্যামল শৈশবের কিছু বেলা
যৌবনের অলৌকিক রথ,
দীপ্র, ভগ্ন, স্মৃতি আচ্ছাদিত, শ্যাওলায় কারুময়,
আমার আশার কীর্তনিয়া
করেছে প্রস্থান গৌণ শিল্পের আড়ালে।
চতুর্দপদী
পায়রার পালকের রোদ তোমার হাতেরও রোদ,
দেয়ালের শ্যামলিমা তোমার মুখেরও শ্যামলিমা।
যখন দোয়েল শ্যামা ডাকে, অস্তিত্বের চতুঃসীমা
তোমার সঙ্গীতময় হয় অনুরূপ; অনুরোধ
করে চন্দ্রমল্লিকার কোমলতা তোমার নিকট
বিশদ থাকার জন্যে, অথচ সত্তায় হু হু চিতা
সর্বদা বেড়াচ্ছো ব’য়ে হে বিষাদময়ী, হে বনিতা
নৈঃসঙ্গ্যের। ধোঁয়াক্লিষ্ট হৃদয়ের কাটেনা সঙ্কট।
চাইনা তোমাকে বন্দী করুক অসিত হাহাকার।
আমিতো নির্লিপ্তিপ্রিয় নই; নিশ্চিত আমিও চাই
ঝরুক আমার বৃষ্টি তোমার চিতার রূপানলে,
তোমার সত্তায় হোক ব্যাপ্ত বকুলের শিষ্টাচার।
দু’হাতে কুড়িয়ে স্বেদমুকুলিত প্রহরের ছাই
বলবো না, প্রেম মুঞ্জরিত কেবল দাহঘ্ন জলে!
চেয়ার অস্বস্তিকর
চেয়ার অস্বস্তিকর, উঠে দাঁড়ালেও স্নায়ুতন্ত্রী
হয়না ঝংকৃত নিরাপদ মৃদু তালে, ফুলগুলি
ব্যর্থ আজ। উদ্বেগের খচখচে কাঁটা ক্রমাগত
বিঁধছে আমার মনে; ক্ষণে ক্ষণে হাওয়ায় হাওয়ায়
কেমন পাশব গন্ধ ভাসে, আমার দু’কাঁধে কিছু
বিসদৃশ ঘটে যাবে যেন! পাখনা গজাবে নাকি
অকস্মাৎ? আমি, শামসুর রাহমান, অবশেষে
কাফকার গ্রেগর শামসা হয়ে যাবো? আমি বড়ো
বেশি ছোটো হয়ে যাচ্ছি, মনে হয়; কীট পতঙ্গের
মতোই আমি কি তবে দেয়ালে বসবো? মৃত্তিকায়
খাবো লুটোপুটি কিংবা নোংরা শুঁড়ে নিয়ে নিরুদ্বেগ
নর্দমার ধারে উড়ে যাবো আবর্জনা ভালোবেসে?
ভাগ্যিস এসেছো তুমি এ মুহূর্তে, তোমার দৃষ্টির
স্পর্শে আজ আমার মনুষ্যরূপ রয়ে গেলো শেষে।
জীবশ্ম
ঘরের জন্যেই ঘুরি, সারাদিনমান ঘুরি, অথচ কোথাও
চার দেয়ালের কিংবা জ্যোৎস্না-ছাওয়া, রৌদ্রের গুঞ্জনময় কোনো
ছাদের নিশ্চিন্তি নেই। থিয়েটার গিয়ে দেখি, হায়,
এ কেমন বেয়াড়া উদ্ভট স্থান? মঞ্চ নেই, অভিনেতা নেই,
নেই দর্শকের ভিড়। একজন বিড়বিড় বিষম অস্পষ্ট
কী একটা পড়ছেন, খুব দ্রুত ওল্টাচ্ছেন পাতা, হয়তো বা নাট্যকার,
কিন্তু পান্ডুলিপি তাঁর বর্ণমালাহীন। কী-যে হয়,
আমি বাগানের কাছে যেতে চেয়ে নিষ্পাদপ মরুন গভীরে
চলে যাই। নক্ষত্রপ্রতিম পত্রপূর্ণ
গাছ দেখবো না কোনখানে, এ কেমন বেখাপ্পা বসতি?
ওখানে কে পড়ে আছে, অধো মুখ, দোমড়ানো টিনের মতন?
কাটা সেপাইয়ের ভাগ্যের ভূগোল কাঁটাতার-দীর্ণ,
নির্দয় কর্দমময়। তার কাছে ফুল হাতে যাই,
ফুল ধুলো হ’য়ে যায়। তবে কি আমিও
ধস্-আতংকিত
খনি-শ্রমিকের মতো ভূ-গর্ভস্থ কয়লার দেয়ালে
ভীষণ আটকা পড়ে গেছি উদ্ধারের অতীত? তবে কি
আঙুল রক্তাক্ত ক’রে লুপ্ত হবো খনিজ আড়ালে?
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে-জমিনও আজ
যথেষ্ট অনড় নয়, খুঁটিগুলো কেবলি এলিয়ে পড়ে। দৃঢ়
ভূমি কোথাও কি নেই? যেদিকে তাকাই,
সাগর শুকিয়ে যায়, ঝরনা রূপান্তরিত পাষাণে,
মায়ের সিন্দুক প্রতিধ্বনিময় গুহা, অশরীরী
তান্ডবে দুঃস্বপ্নাকীর্ণ। তাকালে গাছের দিকে, পাতা
পোড়া মাটি হয়ে ঝরে, শেকড় সাপের মতো ফণা তুলে আসে।
এমন কি তোমাকেও দেখি না মিটিয়ে তৃষ্ণা, পাছে
তোমার গহন ঐ নয়ন পল্লব ভস্মীভূত হয়, তুমি
নিমেষে জীবাশ্ম হয়ে যাও।
তক্ষক
আমার ঘরে ডাকে, রাত্রিদিন ডাকে
ভয়াল সুরে এক চতুর তক্ষক।
স্বস্তি নেই মনে, ঘুরছি এলোমেলো,
অথচ সে-ই নাকি আমার রক্ষক!
নানান ছলে তার সঙ্গে অবিরাম
খুঁজছি বস্তুত সুযোগ সন্ধির।
ভীষণ তার ডাকে নিয়ন্ত্রিত আমি,
বাস্তবিক এ জীবন বন্দীর।
অন্ধকার যেন জ্যান্ত অতিশয়,
চতুর্ধারে আলো এখন কী দুস্থ।
ধ্বস্ত চোখ মুখ, চৈতন্যে আঁধি;
ঘুরছি নরলোকে একাকী, অসুস্থ।
রক্তে জমে শুধু তুষারকণা, প্রাণে
শংকা সর্বদা গুপ্ত হত্যার
দিগ্বলয়ে ঘোর মত্ত বৈশাখী,
কাঁপছে থরোথরো ভিত্তি সত্তার।
দুঃস্বপ্নে চেনা শহর লুণ্ঠিত;
অগ্নি ক্রমাগত করছে বনগ্রাস।
রণচন্ডী মাটি দেয় না নির্ভর,
নিখিল প্রাণীকুলে ব্যাপক সন্ত্রাস।
এড়াতে পারিনা যে ঘরের শক্রুকে;
আড়াল থেকে দ্যাখে চতুর তক্ষক।
দেয়ালে ঠুকি মাথা, কখনো ঢাকি মুখ,
তবে কি সে-ই হবে আমার ভক্ষক?
তবে মননেও
আড়ালেই থাকি, ত্রস্ত সর্বদাই; ব্যস্ত ভিড় ঠেলে
কবুই ভরসা ক’রে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া আজো
হলো না আমার। পাদপ্রদীপের আলো কোনোদিন
পড়বে না মুখে জানি। তা ব’লে ভাগ্যের কথা তুলে
বারোমাস কাউকে দিই না দোষ। হাটে মাঠে নয়,
মৃদু আলো-আঁধারিতে গৃহকোণে একা একা কাটে
প্রায়শ আমার বেলা। খেয়ালের বশে বাস্তবের
সঙ্গে খেলি কানামাছি-লেখার টেবিলে অকস্মাৎ
দেখে ফেলি ডোরাকাটা উদ্দাম জেব্রার দল কিংবা
গন্ডারের একরোখা দৌড়, কখনো লেগুন নম্র
ওঠে জেগে আদিম জলের মায়া নিয়ে। স্নানার্থিনী
কটি থেকে দেয় ছেড়ে প্রাচীন বাকল, প্রেমবিদ্ধ
বংশীবাদকের সুরে পাথর, মরাল আসে ছুটে,
সিংহ আর মেষ থাকে শুয়ে পাশাপাশি, কখনো বা
জিরাফ বাড়ায় গলা বইয়ের পাহাড় ফুঁড়ে, দেখি
বারংবার টেবিলের ইন্দ্রজালঃ ট্রয়ের প্রাচীর
শালের ঘর্মাক্ত আলোয় বড়ো বেশি নিঃস্ব, যেন
প্রেতপুরী; এক কোণে বাংলার মাটিলে ঘর
প্রস্ফুটিত, অন্যদিকে পদ্যাক্রান্ত নিশি-পাওয়া কাফে।
বইয়ের পাতায় খুঁজি মুক্তির সড়ক বদ্ধ ঘরে
প্রত্যহ, তত্ত্বের ঢক্কা নিনাদে কখনো কানে মনে
লাগে তালা; অহর্নিশ মননের রৌদ্রজলে বাঁচা
সার্থক মেনেছি, তবু জানি সারাক্ষণ দর্শনের
গোলক ধাঁধায় ঘুরে তথ্যের খড়-বিচালি ঘেঁটে
ক্লান্ত লাগে, বুদ্ধির সম্রাট ভয়ানক মুখোশের
আড়ালে প্রচ্ছন্ন থেকে হানেন সন্ত্রাস। বাস্তবিক
মননে থাকলে মেতে সর্বদা অথবা শিল্পে ম’জে
রইলে অগোচরে মনে জটিল অরণ্য জেগে ওঠে,
জীবন-বিরোধী শ্বাপদের খুরে মগজের কোষ
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। তাই বদ্ধ ঘর ছেড়ে দূরে
মাঝে-মধ্যে যাওয়া ভালো, ভালো সূর্যাস্তের স্তবময়
টিলায়, নদীর শান্ত বাঁকে যাওয়া। তবে মননেও
খেলবে উদার হাওয়া, শিল্প হবে দীপ্র, মানবিক।
তিনি সূর্যাস্তের লোক
তিনি সূর্যাস্তেরই লোক; অবশ্য অজস্র সূর্যোদয়
সত্তায় রেখেছে জমা অন্তর্লীন আভা, ছড়িয়েছে
প্রাণবীজ পলে পলে তন্তুতে তন্তুতে আন্তরালে,
তবু অস্তরাগ
ডাক দেয় তাঁকে বারবার। এত যে কুহক আছে
সেই বর্ণময় নিরুচ্চার ডাকে, তিনি
জানেন নি আগে।
বেশভূষা জীর্ণ আভিজাত্যের সুদূর ঘ্রাণে ভরপুর, চোখে
দেয়ালে দেয়ালে খোজে চিত্রমালা পূর্বপুরুষের। কখন যে
চোখের দিগন্তে মেঘ জমে ম্লান রক্তজবার মতন, প্রাণে
সুরেলা ধ্বনির প্রেত নেচে ওঠে, দর্পণে দর্পণে
প্রতিবিম্ব নানা দোলাচলে ভাসমান অপসৃত।
কখনো-বা ফ্রয়েডীয় লোকে
নিজের অস্তিত্ব কী উদ্ভভট
ঘেরাটোপে ছায়াচ্ছন্ন দেখে চমকে ওঠেন খুব, বারবার
পালা ক’রে দ্বৈত সত্তা যায় হেঁকে কর্কশ প্রান্তরে,
কখনো নদীর বাঁকে কখনো অরণ্যে, কখনো বা
বালিয়াড়ি ঘেঁষে, চোরাবালিতে কখনো।
রুমালে চাপেন নাক যখন তখন। পচা গন্ধে
টেঁকা দায় ভেবে নক্শাময় আলমারি খুলে তিনি
আতরের উজাড় শিশিটা নেড়ে চেড়ে হয়ে যান
দীর্ঘশ্বাস, দুর্গন্ধের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন ক্রমশ,
অথচ নাছোড় গন্ধ করছে বিব্রত তাঁকে রাত্রিদিন।
বুঝি এই স্বস্তি তাড়ানিয়া
গন্ধ তাঁর অস্তিত্বেরই। তবে কি নিজেরই শব ব’য়ে
বেড়াচ্ছেন ভাবলেশহীন? ধ্বংস্তূপ
অথবা পাখির
দগ্ধ বাসা চোখে পড়লেই স্বগৃহের কথা মনে পড়ে তাঁর।
এখনতো চোখ নেই গ্রন্থের পাতায় কিংবা জরুরি দলিলে,
আপাতত নিসর্গের মিতালিতে নিস্পৃহ, কী এক
নিষ্করুণ শোভাযাত্রা দৃষ্টির সম্মুখে। দেখছেন অতিদ্রুত
গজাচ্ছে বিষাক্ত প্রাণীভুক গাছ বসতবাটির
চতুর্ধারে, আর পরগাছা ক্রমশ উঠছে বেড়ে
নিজেরই শরীরে তাঁর, কংকালের বুকে কাক জুড়েছে পাঁচালি।
বারান্দায় পায়রার ঝাঁক
বাজপাখি হয়ে তেড়ে আসে, নিরীহ পুতুলগুলো
হয়ে যায় ঘাতকের মতো অবিকল, দেখছেন
তিনি; শয্যাতল থেকে কতিপয় মৃত নীল হাত
শূন্য পেয়ালার দিকে কেবলি পৌঁছুতে চায়, পদহারা
জুতোগুলো নৃত্যপর চতুর্দিকে, কড়িকাঠে অসংখ্য যুবতী
দমবন্ধু ক্রূর অবেলায়
উদ্বন্ধনে ভয়ানক নিষ্প্রভ এবং আশেপাশে
পুরোনো সিঁড়ির ধাপে বারান্দায় ছাদে দন্তহীন
বৃদ্ধেরা ক্রন্দনরত, উন্মত্ত শিকারী কুকুরের
পাল ক্রমাগত
খুঁড়ছে ঘরের মেঝে, তিনি দেখছেন। চোখে তাঁর
উৎসবমুখর নৌবহর ডুবে যাচ্ছে এবং বুকের মধ্যে
ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, জঠরে ক্রোধান্ধ বাঘ, রুক্ষ
মরুভূমি প্রসারিত ঘরে।
আতংক বিলাস নয় তাঁর, বাস্তবিক
ভীতির পেরেকে কন্টকিত সত্তা, কবন্ধের দল
স্মৃতির ওপরে কুচকাওয়াজ করছে অবিরাম।
তিনি তো দর্পণ স্বকালের।
শোনেন অবাক হয়ে কতো
নতুন শব্দের ঝাঁক, নব্য গায়েনের নীলাম্বর-ছোঁয়া স্বর
কেমন অস্বস্তিকর অথচ বাঁচার মীড়ে মীড়ে
ঝংকৃত পথের ধারে। কেউউ ‘সূর্যাদয় চাই’ বলে
চৌরাস্তায় আকর্ষণ করে ভিড় আর
বিষাদের প্রতিমূর্তি তিনি
জনশূন্যতায় বন্ধ আপন প্রকোষ্ঠে
নিজেকে মেশান শুধু দূরগামী মেঘে, তিনি সূর্যাস্তেরই লোক।
তুমিই গন্তব্য
সকালে গলির মোড়ে, দ্বিপ্রহরে রেস্তোঁরায়, অপরাহ্নে পার্কে,
সন্ধেবেলা বাস-স্টপে, মধ্যরাতে ইস্টিশানে কিংবা
গিজগিজে বাণিজ্যিক এলাকায়, দরজির দোকানে, ঘ্রাণময়
সেলুনে বকুলবনে, যেখানেই যখন ডাকোনা কেন তুমি,
তোমার কাছেই যেতে হয়।
কী শীত কী গ্রীষ্ম
সকল ঋতুতে
তোমার কাছেই যেতে হয়। নিমেষেই কী বিপ্লব
বিস্ফোরিত অস্তিত্বের নিঝুম পাড়ায়। অকস্মাৎ
অন্তরাল থেকে নীল পতাকা উড়িয়ে দাও আর
রক্তচক্ষু ট্রাফিক বাতির মতো পিতার নিষেধ,
মাতার কাতর অনুনয়,
হৈ হুল্লোড়ময় রাস্তার কিনারে ফেলে রেখে
তড়িঘড়ি পা বাড়াই তোমারই উদ্দেশে। বার-বার
ঝঞ্ছাহত চৈতন্যের দায়ভাগ নিয়ে
তোমার কাছেই যেতে হয়।
কোনো কোনো রাতে কাক না জাগার আগেই কী ছলে
আমাকে জাগিয়ে দাও। শোচনীয় পিপাসায় গলা
কাঠ হ’য়ে যায়, তুমি জলের বদলে স্পঞ্জ থেকে
বিন্দু বিন্দু সির্কা নিংড়ে দাও। কখন যে হেলাভরে
আমাকে দেয়াল ঠুকে খুন করো কর্কশ পেরেকে,
চৈত্য থেকে টেনে এনে আবার বাঁচাও-বোঝা দায়।
নিজের রক্তের নক্শা দেয়ালে মেঝেতে দেখে দেখে
কতো যে নিষ্ফল বেলা কাটে, পাই না তোমার সাড়া
বহুদিন। যেন তুমি নেই
ত্রিলোকে, ছিলে না কোনোদিন।
পুনরায় অকস্মাৎ বেজে ওঠে রক্তের ভেতর
সোনাটার মতো
তোমার গোপন টেলিগ্রাম।
আলুথালু গৃহিণী নদীকে
প্রবল আনেন ডেকে চোখে,
আমার পায়ের তটে আছড়ে পড়েন বার-বার,
মেয়েটা কেবলই টানে পাঞ্জাবির খুট আর আমি
যেন শক কিংবা হুন, দু’পায়ে মাড়িয়ে
আঁচল, পুতুল ছুটে যাই ভূতগ্রস্ততায়
যা’ কিছু সম্মুখে পাই
লন্ডভন্ড ক’রে সব ছুটে যাই। জানি,
তুমিই গন্তব্য চিরদিন।
কোন্ ইন্দ্রজাল ধরো অক্ষি তারকায়?
হাতের মুদ্রায়?
বাসি স্বপ্নে মশগুল তাজা যুবা, বিবেচক প্রৌঢ়,
এমনকি শ্লেষ্মা-কবলিত বেতো বৃদ্ধ,
যাঁর ভূরুসুদ্ধ কী রকম শাদা হয়ে গেছে, তারা
তোমার পেছনে ছোটে দিগ্ধিদিক, তবে
কেন আমি মিছেমিছি দাঁড়াবো সংকীর্ণ কাঠগড়ায়?
খেলাচ্ছলে ফেলে যাও আমার দুয়ারে
কী উজ্জ্বল রাঙা চিরকুট, বুঝি তোমারই ঠিকানা।
এবং আড়াল থেকে দ্যাখো খুঁজে পাই কিনা, দ্যাখো
অপার কৌতুকে
আমার সকল কিছু পাতালে ভাসিয়ে।
আমি তো কুড়িয়ে সেই লিপি সংসার শ্মশান ক’রে ছুটি।
বুকের ভেতর কম্পমান বেয়াল্লিশ বছরের ভীতু হাড়,
যদি বনবাদাড় পেরিয়ে, সারা রাত খাদ ঘেঁষে
হাঁটার পড়েও,
টপ্কে অজস্র কাঁটাতার
বৈদ্যুতিক বেড়া
আখেরে সেখানে গিয়ে তোমাকে না পাই,
যদি পৌঁছে যাই, হায়, ভুল ঠিকানায়!
নাটক
নাটক চলছে সগৌরবে আর দর্শকে দর্শকারণ্য, তিল
ধারণের ঠাঁই নেই কোনোখানে। কুশীলবদের অবয়ব
দৈত্যমার্কা নয়, যমদূত নয় ওরা, বাস্তবিক
মাটির মানুষই বলা চলে। দৃশ্যে আছে কিবা নেই,
বোঝা দায়। উইংস-এর আড়ালে নিপুণ
নেপথ্য-কথক অনর্গল আওড়ায় বাক্য বাক্যাংশ এবং
সেই মতো নানা কুশীলব কী যে বিড়বিড় করে প্রতি অঙ্কে।
দৃশ্য আছে ঠিকঠাক, অথচ তেমন নাটকীয়তাই নেই।
আমিও দর্শক এই নাটকের। জড়োসড়ো, বোকা ভঙ্গিমায়
আছি এক কোণে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি মেলে। কখবো না
চোখ বুজে থাকি, শুনি, বলে কেউ-নাটকটা মজাদার বুঝোছা বান্ধব?
প্রতি পদে ত্র্যাকশন দেখছো না? বিষম রোমাঞ্চকর লাগে।
নাটকের বিষয় বাস্তবধর্মী চমৎকার, মানে হত্যা।
রূপক প্রতীক নেই, ব্যাপারটা খোলামেলা খুবই।
এ নাটকে আগাগোড়া প্রতিটি দৃশ্যেই মনোহর
নানান খেলার সাজে হত্যা করে পায়চারি। কখনো সে করে
নান্দীপাঠ, কখনো বা ভূমিকা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়
নৈপুণ্যে বাড়ায় হাত, পিয়ানো বাজায়, মোমগন্ধী সুরে গায়
গান, ছড়ি নেড়ে নেড়ে স্বগত ভাষণে ওঠে মেতে,
মাথায় টুপিটা খুলে নিয়ে করে বাউ। হত্যা যেন
ফুরফুরে চড়ুইভাতি চৌরাস্তায় কিংবা বন-বাদাড়ে, টিলায়।
কখন যে গুলি কার খুলি চকিতে উড়িয়ে দেবে,
শীতল মাথায় কে বা খুন করতে করতে হেসে হবে খুন ,
পড়বে লুটিয়ে কৌচে অথবা ভায়ের
বন্ধুর গরম ঝটিতি রুমালে মুছে নিয়ে
গুনগুনিয়ে ফিরবে নিষিদ্ধ আস্তানায় ট্রালা লালা-
সঠিক যাবে না বলা। এ নাটকে হত্যা মানে চৈত্রে কি আশ্বিনে
বিকেলে পুকুর পাড়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরা অথবা ফুলের
পাপড়ি কিংবা গাছের সবুজ পাতা ছেঁড়া,
দাঁতে ঘাস কাটা।
এ নাটকে কুশীলব যখন তখন ছোঁড়ে পিস্তল, বন্দুক,
যেমন বালক সুখে বাগিয়ে সাধের টয় গান
যথেচ্ছ ট্রিগার টেপে। রুমাল চাপে না কেউ চোখে,
হেসে যাচ্ছে গড়াগড়ি; দর্শকেরা দেয় তালি কী উল্লাসে!
আমিও কি তাদের সামিল হবো? নিজের অজ্ঞাতে
তুমুল বাহবা দেবো পাত্র-পাত্রীদের? নাকি দ্রুত
সিট ছেড়ে চলে যাবো? লতার আড়ালে যাবো অলক্ষ্যে সবার
অথবা খুঁড়বো গর্ত, তুলবো মিনার? কিংবা নাট্যকার সমীপে ব্যাকুল
হাঁটু গেড়ে করজোড়ে করবো নিবেদন-নাটকের
বিষয়টা আগাগোড়া পাল্টে দিন হে দ্রষ্টা, হে স্রষ্টা দয়াময়!
নিরুপমার কাছে প্রস্তাব
বকুলতলায় যাবে? তুমি বড়ো সন্দেহপ্রবণ,
সেখানে, বিশ্বাস করো, সাপখোপ নেই, মাস্তানের
আড্ডা নেই। বিপদের আবর্তে তোমাকে কোনোদিন
ডোবাতে পারি না। পাখি আসে সেখানে এবং
কয়েকটি প্রজাপতি হয়তো-বা। কবিতার বই
ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পাশাপাশি পড়বো দু’জন।
সেকেলে টেকেলে যা-ই ভাবো, প্রাণ খুলে যত দুয়ো
দাও আধুনিকা, তবু তোমাকেই বকুলতলায়
নিয়ে যাবো; করো না বারণ। যদি পাখি না-ও ডাকে,
না-ও থাকে এক শিখা ঘাস সেই বকুলতলায়,
তবু নিয়ে যাবো। না, ওভাবে ফিরিয়ে নিও না মুখ,
ভেবো না আমার নেই কালজ্ঞান। বস্তুত আমিও
অনেক উত্তাল দীপ্র মিছিলে শামিল হ’য়ে যাই,
যখন ভিয়েতনামে পড়ে বোমা, আমায় হৃদয়
হয় দগ্ধ গ্রাম মেঘে মেঘে খুনখারাবির চিহ্ন
খুঁজে পাই; উপরন্তু বসন্তের পিঠে ছুরি মেরে
হত্যাকারী সেজে বসে আছি। কেন এ প্রহরে
তোমাকে হঠাৎ দূরে বকুলতলায় যেতে বলি?
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
আমার ভেতর এক দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া পরিব্যাপ্ত,
ভয়াল নখরময় প্রাণীকুল অন্তর্গত তন্তু
ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় সর্বক্ষণ এবং জীবাশ্মগুলো
জ্যান্ত হয়ে ওঠে ভয়াবহভাবে হঠাৎ কখনো।
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
বকুলতলায় ব্যাপ্ত আমার উধাও শৈশবের
উন্মুখর দিনগুলি, সেই রাঙা পবিত্রতা তোমার সত্তায়
মেখে দিতে চাই। তবু, হে মহিলা, তুমি কি যাবে না?
নো এক্সিট
আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। কাঁধে
ক্রূশকাঠ থাকতেই হবে কিংবা কাঁটার মুকুট
মাথায় পরতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা না।
এসব মহান
অলংকার আমার দরকার নেই। বাস্তবিক আমি
এক হাত নীল ট্রাউজারের পকেটে রেখে অন্য হাত নেড়ে নেড়ে
সিঁড়ি বেয়ে ‘আচ্ছা চলি, তাহলে বিদায়’ ব’লে একটি উচ্ছিষ্ট
রাত্রি ফেলে রেখে
নির্জন পেছনে
অত্যন্ত নিভৃত নিচে, শিরদাঁড়াময়
নক্ষত্রটোলার পত্রপত্রালির ঈষৎ দুলুনি নিয়ে
খুব নিচে চলে যেতে চাই।
অবশ্য সহজ নয় এভাবে চকিতে চলে যাওয়া। ত্র্যাশট্রেতে
টুকরো টুকরো মৃত সিগারেট, শূন্য গ্লাশগুলো
বৈধব্যে নিস্তব্ধ আর টেবিলে বেজায় উল্টোপাল্টা পান্ডুলিপি
-প্রস্থানের আগে
এই সব খুঁটিনাটি বেকুব অত্যন্ত আর্তস্বরে কিছু ডাক দেয়।
তখন আমার বুকে তিন লক্ষ টিয়ে
তুমুল ঝাঁপিয়ে পড়ে, কয়েক হাজার নাঙা বিকট সন্যাসী
চিমটে বাজাতে থাকে চতুর্ধারে, পাঁচশো কামিনী
দুলুনিপ্রবণ স্তন বের করে ধেই ধেই নাচ শুরু করে।
আর আমি চোখ-কান বন্ধ ক’রে সাত তাড়াতাড়ি
বিদায় বিদায় ব’লে ক্ষিপ্র দৌড়বাজের মতন
ছুটে যাই, ছুটে যাই দূরে অবিরত। ইচ্ছে হলেও প্রবল
কাউকে দিই না অভিশাপ; এতদিনে জেনে গেছি
আমার কর্কশ অভিশাপে
কোনো নারী গাছ কিংবা প্রতিধ্বনি হবে না কখনো,
অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় ফেলবে না হারিয়ে নৌকোয় কোনো শকুন্তলা,
এমন কি খসবে না একটিও পালক বিবাগী মরালের।
সার্কাস ফুরিয়ে গেলে এক্রোব্যাট অথবা ক্লাউন
সবাই বিষণ্ন হয় অগোচরে হয়তো বা। কেউ ছেড়ে চুল,
অন্ধকার তাঁবুর ভেতর কেউ খায় হাবুডুবু
দুঃস্বপ্নের ক্ষুধার্ত কাদায়,
কেউ বা একটি লাল বলের পেছনে
ছুটতে ছুটতে কৈশোরের সমকামী প্রহরে প্রবেশ করে,
বমিতে ভাসায় মাটি কেউ, কেউ উত্তপ্ত প্রলাপে!
হে আমার বন্ধুগণ, দোহাই আপনাদের, দেরি সইছে না;
দিন বলে দিন,
তা’হলে আমি কি এই সার্কাসের কেউ? আপনারা
যে যাই বলুন, এই গা ছুঁয়ে বলছি মাঝে-মধ্যে,
না, ঠিক হলো না, প্রায়শই বলা চলে,
নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। স্বজনের লাশ
কবরে নামিয়ে চটপট
ঢোক ঢোক গিলতে পারি মদ খুব ধোঁয়াটে আড্ডায়,
প্রিয়তম বন্ধু
আত্মহত্যা করেছে শুনেও নিদারুণ
মানসিক নিপট খরায়
অবৈধ সংগম ক’রে ঘামে নেয়ে উঠতে পারি সহজ অভ্যাসে।
আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। অথচ হঠাৎ
একজন তারস্বরে বলে ওঠে, ‘নো এক্সিট, শোনো
তোমার গন্তব্য নেই কোনো’। না থাকুক, তবু যাবো,
দিব্যি হাত নেড়ে নেড়ে চলে যাবো, কেউ
বাধা দিতে এলে
বিষম শাসিয়ে দেবো, লেট মি এলোন, স’রে দাঁড়াও সবাই……
লক্ষ্মী কি অলক্ষ্মী আমি চাই না কিছুই, চাই শুধু যেতে চাই।
পেয়ে যাই
কখনো কিছু না কিছু পেয়ে যাই, বন্ধু উপহার
পাঠান হঠাৎ কিংবা প্রবাসী ভায়ের চিঠি আসে
সুদূর শহুরে ঘ্রাণ নিয়ে, কখনো দেয়ালে এসে
বসে সুদর্শনা পোকা, যেন তার কপালের টিপ।
কখনো বা পেয়ে যাই অন্ধকারে আমার ঠোঁটের
তীরে তার দীপ্ত তন্বী অধর তরণী। অন্য ঘর
থেকে ভেসে-আসা চঞ্চল চুড়ির কাচরেলা শব্দে
বুকে জেগে ওঠে লক্ষ অশ্বারোহী; ক্ষুরধ্বনি পাই।
কোনো কোনোদিন খুব শান্ত হরিদ্রাভ অপরাহ্নে
সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে কখনো মা এমন তাকান
নিবিড় আমার দিকে, সমস্ত শৈশব দুলে ওঠে-
চকিতে আবার পাই তাঁকে কাছে সতেজ তরুণী।
কখনো গলির খঞ্জ কিংবা বন্ধ নীলাভ দরজা
আমার মগজে কবিতার কিছু পঙ্ক্তি গুঁজে দেয়।
পোস্টার
পথে বেরুলেই পড়ে চোখে। সকাল দুপুর কিংবা
বিকেলের খরচা-হ’য়ে-যাওয়া রোদে অত্যন্ত গোচরে
আসে ওরা, যেমন দোকানপাট, রাস্তার কুকুর,
রঙিন সাইনবোর্ড, কৃষ্ণচূড়া, গম্বুজের পায়রা অথবা
ট্রফিক পুলিশ। বুকজোড়া দাবিদাওয়ার নানা
উল্কি নিয়ে ওরা স্পষ্ট উপস্থিত দেয়ালে দেয়ালে,
প্রগলভ্ পোস্টার, বারো মাস তেরো পার্বণের সাজ
এই শহরের; রৌদ্রে জলে চেয়ে থাকে অপলক।
এবং চলতি পথে বেকার যুবক বাসযাত্রী কেউ কেউ,
ক্লান্ত কবি, মেজো সেজো কর্মচারী নানা দপ্তরের,
সিমেমাগামিনী তন্বী, ফেরিঅলা, দুস্থ বুড়োসুড়ো
লোক, ভিড়ভাট্রা অপছন্দ যার- সবাই পাঠক
দারুণ মুখর সব পোস্টোরের। অলজ্যান্ত কিছু
অক্ষর নক্ষত্র হ’য়ে ভাসে তাদের নিজস্ব নীলিমায়।
আমারও বিষম ইচ্ছে, সমস্ত শহরে দেবো সেঁটে
একটি পোস্টার গরীয়ান, শুধু করবো সে লৌকিক
ভাষার কিছুটা হেরফের- আমার একান্ত দাবি,
চাই, তাকে চাই, শুধু তাকে উৎসবে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র-
বিপ্লবে তাকেই চাই সর্বদাই। আমার পোস্টার
মেলবে সুস্নিগ্ধ চোখ, হ’য়ে যাবে নবীন মাথুর।
প্যারাবল
নাড়েন সবল হাত ছুটে আসে নফরের দল
তড়িঘড়ি চতুঃসীমা থেকে। তাঁর প্রবল নির্দেশে
সমুদ্রে জাহাজ ভাসে, অবিরাম চাকা ঘোরে কল-
কারখানায়, তৈরি হয় সেতু দিকে দিকে; দেশে দেশে
নিমেষে জমান পাড়ি রাষ্ট্রদুতগণ, কারাগারে
জমে ভিড়, সৈন্য বাড়ে রাতারাতি, কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে অস্ত্রাগার, এমন কি আগাড়ে ভাগাড়ে
শকুনের বসে ভোজ। কিন্তু ছোট কোমল ডানায়।
ভর ক’রে পাখি আসে ডালে তাঁর নির্দেশ ছাড়াই-
বিখ্যাত কোকিল। ডাকে অন্তরালে, নির্ভীক স্বাধীন।
হঠাৎ বলেন তিনি, ‘পাখিটাকে কী ক’রে তাড়াই?
থামা তোর গান, নইলে দেবো শাস্তি ওরে অর্বাচীন।
তবু সুর আসে ভেসে। কোকিল নয়কো কারো দাস,
কখনো পারে না তাকে স্তব্ধ করতে কোনো সর্বনাশ।
প্রচ্ছন্ন একজন
ভরাট দুপুর আর নিশুতি রাত্তির নিয়ে বুকে
প্রত্যহ সে করে চলাফেরা
আশেপাশে, কথোপকথনে মাতে পথ ঘাটে যদি
ইচ্ছে হয় শুধায় কুশল পাত্রমিত্রদের। কখনো সখনো
তাকে যায় দেখা রেললাইনে, কখনো ডোবার ধারে
কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা, কী যেন অধীর দেখে নিস্তরঙ্গ
জরৎ সবুজ জলে, আঙুলে বসন্ত নিয়ে কখনো চালায়
ব’সে মাপে অন্ধকার, জ্যোৎস্না, কখনো-বা
ল্যাস্পপোস্টে ব’সে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে
আকাশের দিকে, যেন নেবে করতলে
চমৎকার আসমানী পণ্য-
চাঁদের ভগ্নাংশ, নক্ষত্রের ফুলকি অথবা নীলিমা
যা’ পড়ে পড়ুক।
ঘরে এসে ঢুকলেই দ্যাখে চার দেয়ালের একটাও
নেই কাছেধারে, ছাদ মেঘ হয়ে ভাসে, ‘ঘর তবুতো ঘর”
ব’লে সে গভীর নিদ্রা যায় নগ্ন উদার মেঝেতে।
স্বপ্নের চাতালে।
লাল বল অতিশয় চপল এবং
সবুজ পুষ্পতি ট্রেন বাজায় বিদায়ী বাঁশি, ট্রাফিক পুলিশ
চিনির পুতুল হয়ে দিকদর্শী অত্যন্ত নিপুণ।
সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, যখন ভারিক্কী এক
কাকাতুয়া আপিসের বড় কর্মকর্তার ধরনে।
কার্যকারণের
হদিশ খুঁজতে গিয়ে বেজায় গলদঘর্ম হন।
নিদ্রাল শিয়রে ব’সে পাখি বলে এ কেমন টেঁটিয়া মানুষ,
কেমন দুনিয়াছাড়া ঘুমোচ্ছে নিটোল কী-যে, যেন
চতুর্ধারে নেই কোনো বালা মুসিবৎ।
সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, ভীষণ স্তম্ভিত পোকা ও মাকড়।
প্রতিযোগী
আমার যুগল পা রক্তে ভাসে।
যেখানে নিজস্ব পদচ্ছাপ
আঁকার সাধ ছিলো আশৈশব,
সেখানে পৌছুনো সহজ নয়।
ছিলো না সম্বল তেমন কিছু
খানিক ছিলো শুধু অহংকার।
গড়তে চাইনি তো অকূল নদী,
দিগ্বলয় কিংবা পাহাড়ও নয়।
গড়ার সাধ ছিলো অন্তরালে
একটি চৌকাঠ স্বর্ণময়।
তোমাকে প্রতিযোগী ভেবেই আমি
হয়েছি পথচারী অচিন পথে।
তাই কি তুমি সেই রুক্ষ পথে
রক্তপায়ী কাঁটা বিছিয়ে দিলে?
প্রবাসী
তুইও যাচ্ছিস চ’লে ক্রমশ যাচ্ছিস চ’লে কেমন জগতে।
তোর জগতের কোনো সুস্পষ্ট ভূগোল কোনোমতে
ত্রঁকে দিতে পারলেও হয়তো বা হতো বোঝাপড়া বড়ো জোর
নিজের মনের সঙ্গে। কাফকা অনধিগম্য তোর,
ভূতলবাসীর আর্ত অস্তিত্বের উপাখ্যান ওরে
তোর তো জানার কথা নয়, তবু কেন কোন সে বিপাকে, ঘোরে
ক্রমশ যাচ্ছিস চ’লে অমন জগতে? কোন মন্ত্র
করেছে দখল তোকে, কার ষড়যন্ত্র
করছে বিচ্ছিন্ন তোকে মার্বেল, পাখির বাসা আর
জনক জননী থেকে? কেবলি আড়ালে ডাকে’ কোন অন্ধকার?
ফুটফুটে শার্ট আর হাফপ্যান্ট প’রে, আড়াআড়ি
ঝুলিয়ে সুনীল ব্যাগ, মায়ের আদর খেয়ে খুব তাড়াতাড়ি
যখন যেতিস রোজ মর্নিং ইশকুলে, কী-যে ভালো
লাগতো তখন। সারাক্ষণ তোর পথ চেয়ে আলো
থাকুক কল্যাণ হয়ে, বলতাম মনে মনে। হায়,
চুকেছে ক্লাশের পাট আজ, বইপত্র ধুলিম্লান, অসহায়
রঙিন মার্বেলগুলো কোথায় যে আছে প’ড়ে। কখনো হাসিস
অকস্মাৎ অকারণ কাঁদিস কখনো- এ কেমন খেলা তোর?
পাখি শিস
দিলেও সম্প্রতি তুই হোসনে খুশিতে তরঙ্গিত। ঘরের যে কোনো কোণ
বেছে নিয়ে থাকিস নিঃসঙ্গ ব’সে; ক্রীড়াপরায়ণ ভাই বোন
ডেকেও পায় না কাছে তোকে-এই অলক্ষুণে দৃশ্য
দেখে দেখে বড়ো কন্টকিত আমি, ভয়ানক নিঃস্ব।
এখন নিঃসঙ্গ আমি, পরিপার্শ্ব কর্কশ বিমুখ, উপরন্তু
অত্যন্ত বিরল বন্ধু। বুঝি তাই হৃদয়ের তন্তু
কেমন বেসুরো বাজে। হে বালক, হে পুত্র আমার, তুইও শেষে
নিলি ঠাঁই গোধূলি জগতে? এ কেমন ভিন দেশে
অকালে জমালি পাড়ি? রাত্রিদিন আমাদের সঙ্গে বসবাস
ক’রেও প্রবাসী সারাক্ষণ। নীলাকাশে শুকনো ঘাস
কিংবা শুধু ঝাঁক ঝাঁক পোকা ও মাকড়
দেখিস কি চতুষ্পার্শ্বে? না কি ভয়ংকর হিচককী কাকে ঘর
বারবার অতিশয় ভ’রে যেতে দেখে অবিরত
দু’হাতে ফেলিস ঢেকে মুখ মন্ত্রচালিতের মতো।
প্রার্থনা
ফুলকে সুন্দর বলা হয়, পাখিকেও, নক্ষত্রের
নদীর রূপের খ্যাতি আছে যার পর্বতমালার
সৌন্দর্য কীর্তিত বিশ্বময়। তুমি বস্তুজগতের
অন্তর্গত, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশিনী, কিন্তু
তোমার এবং তার সুষমায় পার্থক্য অনেক।
তোমাকে সুন্দরী বলা চলে, অন্তত আমি তো
তাই বলি; চোখ মুখ, চুল গ্রীবা অথবা চিবুক
-সবকিছু যেন সমন্বিত ইন্দ্রজাল বাস্তবিক।
অথচ যখন তুমি বয়সের ভারে হবে নত,
পরিত্যক্ত ভাঙা হাটে, হবে লুপ্ত ইন্দ্রজাল, হায়,
মসৃণ পেলব ত্বকে অদৃশ্য লাঙল যাবে রেখে
শুকনো গাঢ় রেখাবলী। অতএব, হে নিরুপমা, আজ
জানাই প্রার্থনা, লোভাতুর কাফ্রি-মৃত্যু অন্ধকারে
এক্ষুণি তোমাকে নিয়ে যাক লুটে প্রেমিকের সাজে।
প্রায়শ্চিত্ত
প্রত্যহ কিছু না কিছু দৃশ্য আমি চুরি ক’রে নিই।
ভিন্ন চরিত্রের রৌদ্র, আলাদা জ্যোৎস্নার
বিনম্র কম্পন, অগোচর রাস্তা এবং গ্রন্থের
অত্যন্ত রহস্যময় লিপি চুরি করে নিই; সিঁড়ির আড়ালে
ছায়াচ্ছন্ন মোহন মিথুন মূর্তি, লোপামুদ্রা ভীষণ বিব্রত
শাড়ির আঁচল নিয়ে; একজন বৃদ্ধ, বর্তমানচ্যুত কাছিমের মতো
মুখে বর্ষিয়সী মহিলার অবয়বে
বসন্তের চেলি দেখে কেমন বিহ্বল। বালকের
হাতে গাছ তুলে দেয় ফুল, পুর্ণিমার অন্তঃপুরে
কেউ সিদ কেটে
অভাবিত রূপালি প্লাবনে ভাসে, স্বদেশী ম্যাডোনা
সন্তানের সৎকারের জন্যে পাতে শোকশীর্ণ হাত-
কখনো এসব দৃশ্য, কখনো বা অন্য ধরনের
দৃশ্যাবলি প্রত্যহ কিছু না কিছু চরি ক’রে নিই।
কোত্থেকে হঠাৎ প্রজাপতি, শ্যামা এসে
সহমর্মিতায় দুলে বলেঃ
‘এমন তস্কর তুমি আলো-আঁধারিতে,
তবে কি পাড়ায় বলো নিন্দে রটবে না?’
কখনো মৌচাকে
যদি পড়ে ঢিল, আমি রবীন্দ্রনাথের
আপদের মতো করবো ব্যাখ্যা কৃতকর্মের এবং
দোরে দোরে কবিতার ফুল চন্দন দিয়ে, যতদিন বাঁচি,
প্রায়শ্চিত্ত করবো বারংবার।
ফিরে যাও
ফিরে যাও আমার দুয়ার থেকে তোমরা এখন
ফিরে যাও; কিছুতেই তোমাদের দেবো না মাড়াতে
আমার চৌকাঠ! তোমরাতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিয়েছো পাড়ি কতো না সমুদ্র
অথবা বীরভূমে ধু ধু হয়েছো তৃষ্ণার জল তাঁর
প্রহরে প্রহরে আর নজরুল জ্যৈষ্ঠের দুরন্ত
মেঘের মতন বাবরি দুলিয়ে মোহন বলাৎকার
করেছেন তোমাদের ওপর প্রত্যহ। কবেকার।
জীবনানন্দের জন্যে চকিতে করেছো উন্মোচন
করুণ শঙ্খের মতো স্তন এবং সুধীন্দ্র দত্ত
নিখিল নাস্তির মৌনে ডুবে তোমাদের নাভিমূলে
যৌনাঙ্গের অগভীর কেশে রেখেছেন মুখ ভুলতে
মনস্তাপ। তোমরাতো সাজিয়েছো বিষ্ণুদে’র ঘর
রাত্রিদিন, দিয়েছো সন্ধ্যায় তুলে শ্বেত বাহু মুখ।
এখনো তো বুদ্ধদেব বসুর শয্যায় তোমাদের
ব্রার টুক্রো সিঁদুরের রঙ প’ড়ে থাকে ইতস্তত।
ফিরে যাও, আমার দুয়ার থেকে ধিক্কার কুড়িয়ে
ফিরে যাও। তোমাদের চোখে তুলে রাখবার ইচ্ছে
মৃত টিকটিকি হ’য়ে আছে, বুকে নেবো না উৎফুল্ল।
বলে দিচ্ছি, ছলাকলা ব্যর্থ হবে; বিসমিল্লাহ খান
যতই বাজান তাঁর পুষ্পিত সানাই, তোমাদের
হাত ধ’রে আনবো না বাসরে কখনো। তোমরাতো
উচ্ছিষ্ট উর্বশী; ফিরে যাও, ফিরে যাও, যদি পারো
নতুন পাতার মতো সজীব শিহর নিয়ে এসো।
বদলে ফেলি
আমি যে এই আমির খোলস ছেড়ে ছুঁড়ে যখন তখন
বেরিয়ে আসি,
রৌদ্রেপোড়া জ্যোৎস্না মোড়া এই সমাচার তোমার চেয়ে
ভালো ক’রে কেউ জানে না।
ফুটফুটে খুব সকালবেলা কিংবা ধরো পিতামাতার
বুক-কাঁপানো ঘুম-তাড়ানো ডাগর কোনো মেয়ের মতো
মধ্যরাতে
এই যে আমি ঘরে বাইরে কেমন যেন হ’য়ে উঠি,
তোমার চেয়ে বেশি বলো
কেই বা জানে?
আমাকে এক ভীষণ দানো তাড়িয়ে বেড়ায় অষ্টপ্রহর,
তীব্র খাঁ খাঁ খিদের চোটে আমার মাংস
অস্থি মজ্জা চেটে চুটে হরহামেশা সাবাড় করে।
লকলকানো চুল্লিতে দেয় হেলায় ছুঁড়ে,
অথবা সে অগ্নিমান্দ্যে ভুগলে তখন খামখেয়ালি খেলায় মাতে।
তপস্বী এক বেড়াল সেজে ঘুরে বেড়ায় আশে পাশে
আমার ঘরে।
রাত্রিবেলা অনেক দামী রত্ন স্বরূপ দু’চোখ জ্বেলে
আঁধার লেপা চুপ উঠোনে কিংবা কৃপণ বারান্দাটায়
আলস্যময় কোমল পশুর গন্ধ বিলায়
এবং আমি ইঁদুর যেন।
আবার কখন রুক্ষ মরু চতুর্ধারে জ্বলতে থাকে,
বুকের ভেতর শুশুনিয়া, হাতড়ে বেড়াই জলের ঝালর;
মুখের তটে ঝরে শুধুই তপ্ত বালি; কখনো-বা পায়ের নিচে
বেজে ওঠে বেগানা হাড়।
এই যে এমন দৃশ্যাবলি উদ্ভাসিত যখন তখন,
তুমি ছাড়া কেউ দেখে না।
হঠাৎ দেখি, মুখোশ-পরা আবছা মানুষ দু-রঙা ঐ
ঘুঁটিগুলো সামনে রেখে বললো এসে,
‘তোমার সঙ্গে খেলবো পাশা।
জনবিহীন জাহাজ-ডেকে দ্যুতক্রীড়ায় মত্ত দু’জন
ডাকিনীদের নিশাস হয়ে বাতাস ফোঁসে চতুর্দিকে,
মাঝে মধ্যে চোখে-মুখে ঝাপ্টা লাগে লোনা পানির।
প্রতিযোগীর শীর্ণ হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ চমকে উঠি,
যেন আমি ইলেকট্রিকের শক পেয়েছি অন্ধকারে।
প্রতিযোগী কিতাব নিসাড়, নীল-শলাকা আঙুলগুলো
দারুণ শীতে মৃত কোনো সাপের মতো ঠাণ্ড এতো-
শিউরে উঠি।
মুখোশধারীর চক্ষু তো নেই, শুধুই ধু ধু যুগ্ম কোটর।
ভীষণ দানো দুরন্ত সেই পেলব বেড়াল এবং কালো
মুখোশ-পরা আবছা মানুষ আসলে সব
তুমিই জানি।
ভূমন্ডলে তোমার চেয়ে চমকপ্রদ চতুর কোনো বহুরূপী
কে-ই বা আছে?
আপন কিছু স্বপ্ন তোমায় বাট্রা দিয়ে খাট্রা মেজাজ
শরীফ করি।
তোমার জন্যে টুকরো টুকরো সত্তাটাকে নিংড়ে নিয়ে
রূপান্তরের গভীরে যাই কখনো বা কেবল চলি।
জানিনা হায়, সামনে কী-যে আছে পাতা-
ফুল্ল কোনো মোহন রাস্তা কিংবা বেজায় অন্ধ গলি।
তোমার জন্যে সকাল সন্ধ্যা নিজেকে খুব বদলে ফেলি,
অন্তরালে বদলে ফেলি।
তোমার জন্যে চড়ুই হয়ে চঞ্চু ঘষি শ্বেত পাথরে,
কখনো ফের স্বর্ণচাঁপায় এক নিমিষে হই বিলীন।
কখনো বা পিঁপড়ে হ’য়ে দুর্গ বানাই ব্যস্তবাগীশ
ছুটে বেড়াই দেয়াল পাড়ায়।
তোমার জন্যে হই শহুরে শীর্ণ কুকুর, দীর্ণ বুকে গাড্ডা থেকে
পান করি জল;
তোমার জন্যে হই আসামী ফাঁসির এবং নোংরা সেলে
ব’সে ব’সে নিষিদ্ধ ঐ বহর্জীবন নিয়ে কেমন জ্বরের ঘোরে
উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখি, ক্বচিৎ কোনো শব্দ শুনি।
তোমার জন্যে যখন তখন নিজেকে খুব বদলে ফেলি, আমূল আমি
বদলে ফেলি।
বিচার
সে জানে বিচার হবে তার। কেন? সে-কথা অজ্ঞাত
জানে না কী তার অপরাধ। এ কেমন্ কাঠগড়া,
সাক্ষী সাবুদও বা কী রকম? বিচারক অনাগত, শুধু
চৌদিকে বোলেল্লা হল্লা। কেউ কেউ চোখের ঠোকর
মারে তাকে, কেউ কেউ ইতর ভাষায় কী-যে বলে,
মলিন ছাতার বাট কিংবা ছড়ি দিয়ে মাঝে-মধ্যে
কেউ বা খোঁচায়। ধন্দে করুণ সে, অসহায় আজ
ভুলেছে নিজের নামধাম। অকস্মাৎ ফিসফাস,
হয়তো বা এসেছেন তিনি, মানে বিচারক। সে-ও
চালায় নিস্পৃহ দৃষ্টি, তার রুক্ষ চুল, চার দিন
না-কামানো দাড়ি, শিরদাঁড়া বেয়ে মুহূর্ত গড়ায়।
না, ধর্মাবতার আসেন নি। পুনরায় হট্রগোলা,
অট্রহাসি, একজন তাকে ক্ষিপ্র চিমটি কেটে দূরে
সরে যায়, অন্যজন নিপুণ ধাক্কায়
হঠাৎ মাটিতে ফেলে ছোঁড়ে লাথি, যেন সে টিনের
কৌটো; কেউ কর্কশ মধ্যাহ্নে তার মুখের নিকট
টলটলে জলভরা গ্লাশ নিয়ে পর মুহূর্তেই
ঝটিতি সরিয়ে নেয় হাত।
তৃষ্ণা বাড়ে আরো, দ্যাখে, মৎস কন্যা সমস্ত শরীরে
অভ্রের মতন জলকণা নিয়ে অদূরে দাঁড়ানো
এ অশ্লীল ভিড়ের মধ্যেই।
দ্যাখে কযেকটি হাড়, হয়তোবা নাবিকের, নেচে
নেচে আসে, দ্যাখে মৃত ভস্ম ঝেড়ে ফিনিক্স আবার
জেগে ওঠে। বিচারক অনাগত। অধৈর্য, অশান্ত
দর্শকেরা মেতে ওঠে অলৌকিক দাঁড়িপাল্লা হাতে,
দেয় রায়-তাকে শত কুটি করে রক্ত গোধূলিতে
নদীতে ভাসাতে হবে। তার শরীরের টুকরোগুলো,
দেখলো সবাই, দ্রুত হয়ে গেলো এক শো গোলাপ।
‘এমন মামলা ঘটে, এতে কিছু নতুনত্ব নেই;
ব’লে তারা গোলাপের পাপড়ি
কুটি কুটি ছিড়ে ফের ওড়ালো অনেক ধূলো-ধোঁয়া।
বিচ্ছেদ
রোল কল করলেই সাড়া দেবে, এমন তো নয়।
কিন্তু আছে, একমুঠো রাঙা কোমলতা।
লিখবে না, শিখবে না কিছু, নয় ছয়
ইত্যাদি কিছুই নয়, ঐতো মাঝে-মধ্যে মাথা নাড়ে
ঈশ্বর জপালে কোন শ্লোক। ওখানে থাকারই কথা
তার যতক্ষণ থাকা যায়। কখন কে কাড়ে,
ভয়, এই ভয়।
রেখো না ফ্লাওয়ার ভাসে, হায়
প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্নতা হেতু ফুল
কী বিপুল
শূন্যতায় অবেলায় অতিশয় জীর্ণ হ’য়ে যায়।
ব্যক্তিগত রাজা
ব্যক্তিগত রাজার কাছে হাঁটু গেড়ে
যাচঞা করি একটি কিছু
ইতল বিতল।
দৃষ্টিতে তাঁর চন্দ্র ধরে, সূর্য ধরে;
জ্বলছে হাতে রক্তজবা
চমৎকার।
শস্য ক্ষেতে তাঁর পতাকা নিত্য ওড়ে,
ফুলের তিনি খুব উদাসীন
অধীশ্বর।
সকাল যখন সকাল থেকে
যাচ্ছে স’রে অনেক দূরে
কিংবা কাছে,
রাত্রি আবার রাত্রি থেকে,
আমার করুণ অঞ্জলিতে
অন্ধকারে উঠবে ফুটে পদ্ম কোনো?
বুকের ভেতর মাছরাঙা আর
দীপ্ত আঁশের মৎস্য নিয়ে
ঐতো আমার সন্ত রাজা
ফুটপাতে নীল একলা হাঁটেন।
পার্কে ব’সে বেলুন ছাড়েন,
কিংবা বাসের পাদানিতে
ঝুলে ঝুলে যান যে কোথায়!
কখনো ফের জনসভায়
অনেক মুখের একটি মুখে
যান মিশে যান,-
আবার কখন চিমটে বাজান বৃক্ষতলায়।
ব্যক্তিগত রাজা যিনি তিনি বেবাক পোশাক খুলে
ঐ চলেছেন ভেসে ভেসে
জ্যোৎস্নাস্রোতে, রৌদ্রমায়ায়।
আমি কি তাঁর অমন গহন ছায়া তুলে
আমার চোখে পাগল হবো?
ঘোর দুপুরে দিলেন ছুঁড়ে কাঁটার মুকুট
নগ্ন হাতে আমার মাথাআ লক্ষ্য ক’রে।
ব্যক্তিগত রাজা আমার অগাধ রোদে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
সত্তাজোড়া অসুখ নিয়ে
একলা হাঁটেন।
বৈতরণী অন্ধকারে বনবাদাড়ে
পায়ের রক্তে যন্ত্রণারই পুষ্প এঁকে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
ধূসর কোনো ইস্টিশানে,
মেঘে মেঘে একলা হাঁটেন।
মন্তাজ
এই তো হরিণ ছোটে, রত্নরাজি ওড়ায় সুতীক্ষ্ম খুরে, ফুলের মেঘের
নরম সংকেত জেগে ওঠে; মুঞ্জরিত গুপ্ত ক্ষেত। আবেগের
গলায় পা রেখে দেখেছিতো, তবু জলজ্যান্ত স্বর
সোনালি ঘন্টার মতো বাজে চতুর্দিকে আর ঘর
বাড়ি উল্টোপাল্টা ছুটে যেতে চায় আকাশের সুনীল মহলে।
আপিশ ফটক ছেড়ে পথে নামি, ঠিক সন্ধে হ’লে,
কখনো বা আরো পরে বাড়ি ফিরি, বাসের টিকিটে
আলতামিরার চিত্র, শিং উঁচানো রৈখিক বাইসন, খিটখিটে
বুড়োটা ভীষণ উক্তিময়, হঠাৎ চোয়ালে তার গাছের বাকল পরা
রমণী ঝিকিয়ে ওঠে, নিসঙ্গ আমার কাঁধে। কড়া
নাড়লেই দরজাটা যাবে খুলে যথারীতি, জামা-
জুতো ছেড়ে লম্বা হবো কিছুক্ষণ। ঘনিষ্ঠ পা’জামা
চোখের পলকে শূন্যে তাঁবু হয়, ওড়ে; কী প্রাচীন হ্ণদে ঝুঁকে
মজি ছায়াবিলাসে, সহসা কারা যেন লাঠি ঠোকে
কঠিন মাটিতে, আসে তেড়ে দুর্বার চাদ্দিক থেকে।
আমি তো নিবিয়ে আলো শুয়ে পড়ি চাদরে গা ঢেকে।
চোখ বুজলেই দেখি পিতৃপুরুষের কবরস্থানের খুব
ডাগর ডোগর ঘাস, সবুজ ছাগল; ডাবা হুঁকো ক্ষিপ্র ডুব
দিয়ে সরোবরে মানস হংসের মতো প্লুত শোভা
রচনার পরে নাচতে নাচতে দোতারার কুয়াশায়
আমার বাড়িটা একি প্রকাশ্যেই মহিলার মুখ হ’য়ে যায়।
মাইফেলে
সে রাতে ছিলেন তিনি মাইফেলে। আশি বছরের
ম্লান খড়কুটো তাঁর সমগ্র সত্তায়।কী উদাস
চক্ষুদ্বয়, শিরাপুঞ্জে বয় মাঘ, শুধু দীর্ঘশ্বাস
ঘিরে রয় তাঁকে; দেখছেন ঘরে ঝাড় লণ্ঠনের
শোভা নেই; মনে পড়ে, বাইজীর ব্যস্ত নূপুরের
মতো বেজেছিলো কত প্রহর এবং বারোমাস
ছিলো বেনো সুরের নক্শায়! অন্য নিবিড় আকাশ
চকিতে উঠতো জেগে আড়ালে ধামার, খেয়ালের।
ঈষৎ নোয়োনো মাথা তুলে প্রতিপক্ষ শূন্যতার
মূক পটে আঁকলেন উদারার গান্ধার মধুর-
তখন বাইরে অমাবস্যা, ঘরে অঝোর পূর্ণিমা।
দেখি না পাঞ্জবি কিংবা কালো মখমলের টুপি তাঁর,
এমন কি চোখ-মুখ। এখন তো নিজে তিনি সুর,
শুধু সুর, অজর তরুণ এক, লুপ্ত সব সীমা।
মাতামহীর মধ্যাহ্ন
ত্র্যালবামের এই চেনা জানা
সংসারে আজ নেই যে তিনি।
কেমন ধূসর, কতো ধূসর ক্রমান্বয়ে
হলেন তিনি, বলতে পারো মনো-মুকুর?
গলির কোলে আটচালাটা
অষ্টপ্রহর আদর খেতো
রৌদ্র ছায়ার। কখনো বা উঠতো কেঁপে
বদমেজাজী হাওয়ার ভীষণ ধমক খেয়ে!
আটচালাটা তাঁরই ছোঁয়ায়
হয়েছিলো আয়ুষ্মতী।
সেই কবেকার খেজুর পাতার ঝিলিমিলি
ঝালর রচে আজো এমন দূর দশকে।
একলা দুপুর উদাস হতো
আমার মাতামহীর বুকে।
রৌদ্র যখন পারদ হ’য়ে টলটলাতো,
বলতেন তিনি, ‘দুপুর তুমি কার বলো তো?’
শীতল পাটির স্নিগ্ধতাকে
নিতেন শুষে দেহের ভেতর।
হঠাৎ কখন বুক জুড়ে তাঁর উঠতো কেঁপে
প্রাচীন কোনো পথের রেখা, জানতো না কেউ।
এক নিমেষে শীতলপাটি
বদলে হতো কাঁটার ভুবন।
কখনো ফের তাঁর আয়ত চোখের নিবাস
যেতো ভেসে কংকাবতীর চোখের আলোয়।
যাদব চক্রবর্তী মশাই
হিশেব টিশেব শেখান নিকো,
তবুও তার কাঠের বাক্সে মুদ্রাগুলো
হিশেব মতো উঠতো নেচে পরীর মতো।
কিন্তু যখন বেহিশেবী
নাছোড় দুপুর আলু থালু
করতো তাঁকে, তখন স্মৃতির পরগণাতে
উড়তো শুধু পাগলা ঘোড়ার ক্ষুরের ধূলি।
যায়না দেখা কোথাও তাঁকে
সকাল সন্ধ্যা দ্বিপ্রহরে,
মাঝে-মধ্যে বিষাদ সিন্ধু ছাপিয়ে উঠে
উদ্ভাসিত মাতামহীর মুখের রেখা।
মুকুট
কোত্থেকে এলেন তিনি? কন্টকিত দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া
থেকে না কি? যেন এ শহরে প্রবেশের ছাড়পত্র
পান নি এখনো কিংবা পেলেও জরুরি সে দলিল
হাতছাড়া হয়ে গেছে। খুঁজছেন শ্যামা ও মুনিয়া,
খুঁজছেন খরগোশ ফের কি সব দু’চার ছত্র
আওড়ান, বোঝা দায়। কখনো-বা ইতস্তত ঢিল
দেন ছুঁড়ে, গায়ে তাঁর শতচ্ছিন্ন অদ্ভুত পিরান,
পদযুগ নগ্ন ধূলিম্লান। পিরানের ভাঁজে ভাঁজে,
দ্যাখে পুরবাসী, ঝলসিত কী যে নক্ষত্রের মতো
সর্বক্ষণ। গাত্রাবাস আমোদিত অনেক বিরান
প্রান্তর এবং জলাভূমির প্রাচীন গন্ধে। বাজে
শরীর বীণার মতো; মুকুট শোভিত সমুন্নত
মাথা তাঁর। ব্যবসায়ী, ফড়ে, হা-ঘরে, চাকুরে
লোলুপ তাকিয়ে থাকে; উদাসীন তিনি যান দূরে।
লেনদেন
হঠাৎ তিনি আমার স্মৃতির বনস্থলি রোমাঞ্চিত
করলে আমি প্রবেশ করি ছেলেবেলার শ্যামল মুঠোয়।
চোখের কোণে হারিয়ে-যাওয়া সুদূর চোখের, শীর্ণ হাতের,
তাঁর সে গায়ের হলদে কোটের ইতস্তত ঝলক লাগে।
হলদে কোটে কেমন যেন চুরুট চুরুট গন্ধ ছিলো,
চোখের কোণে সে কোন্ ঝিলের ইস্পাতী এক ঝিলিক ছিলো।
টাঙ্গি হাতে ভালুক টালুক খুব মেরেছেন হেলায় ফেলায়-
তাঁর বিষয়ে আরো বহু এমনিতরো গল্প ছিলো।
হলদে কোটের সিংহপুরুষ সুদূর আমার ছেলেবেলায়
দিয়েছিলেন হাতে তুলে একটি পুতুল, মনে পড়ে।
মনে পড়ে, পুতুলটাকে কোথায় যেন, কখন যেন
হারিয়ে ফেলে সেই ছেলেটা দুঃখ খুবই পেয়েছিলো।
তেমন পুতুল আর দেখিনি ভূভারতে, দোকান-পাটে
তন্ন তন্ন করেও আমি পাইনি খুঁজে দেশ-বিদেশে।
তেমন পুতুল ঝরে শুধু অলৌকিকের মুঠো থেকে?
স্মৃতির সুতোয় লটকে থাকে নীল্চে নীল্চে দুর্বলতা।
সেই যে তিনি পুতুল দিয়ে সাত সকালে নিলেন বিদায়
আর দেখিনি তাঁকে আমি এই শহরে, অন্য কোথাও।
তখন থেকে খুঁজছি তবু দেননি তিনি আমায় দেখা,
জ্বলছে মনে ভিন্ন কালের হলদে কোটের উদাস আভা।
যদি তাঁকে একটা কিছু দিতে পারার একটুখানি
সুখের সময় পেতাম তবে ধন্য হতাম রুক্ষ বেলায়।
তাঁরই জন্যে দুঃখ-সুখের পদ্য বিছাই দোরে দোরে,
হঠাৎ যদি বিবাগী সিএ বর্ষীয়ানের চোখে পড়ে!
শান্তি পাই
যখন তুমি অনেক দূরে থেকে
এখানে এই গলির মোড়ে আসো,
উঠোনে দাও পায়ের ছাপ ত্রঁকে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি দেহের বাঁকে বাঁকে
স্মৃতির ভেলা ভাসাও, তোলো পাল,
মুক্ত করো যমজ পায়রাকে
শান্তি পাই।
যখন তুমি আমার পিপাসায়
নিমেষে হও আঁজলাভরা জল,
দৃষ্টিজাল ছড়াও কী আশায়,
শান্তি পাই।
যখন তুমি ঠোঁটের বন্দরে
বিছিয়ে দাও গালিচা রক্তিম,
প্রভাত জ্বালো চোখের কন্দরে,
শান্তি পাই।
ঝঞ্ঝাহত উজাড় এ বাগানে
আন্দোলিত তুমিই শেষ ফুল!
জাগাও তুমি সবুজ পাতা প্রাণে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি দুপুরে ঘুমে আসো,
তোমার বুকে অতিথি প্রজাপতি;
থম্কে থাকে ভয়ে সর্বনাশও,
শান্তি পাই।
যখন তুমি জলের গান হয়ে
আমার দেহে আমার মজ্জায়
কী উজ্জ্বল জোয়ারে যাও ব’য়ে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি আমার ঠোঁটে রাখো
একটি লাল গোলাপ, আত্মায়
ঝরাও পাতা আবেগভরে ডাকো,
শান্তি পাই।
যখন তুমি হাওয়ায় দাও মেলে
তিমির-ছেঁড়া আমার এ পতাকা,
কিংবা আসো বিরূপ জল ঠেলে,
শান্তি পাই।
সে-রাতে আমার ঘরে
সে-রাতে আমার ঘরে এক ঝাঁক উৎফুল্ল জোনাকি
বললো এসে-একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অন্তর্হিত জোনাকির পরে একটি বাদুড় খুব
আনন্দে ঘনিষ্ঠ হয়ে কড়িকাঠে জানালো সস্নেহে-
একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে। অনন্তর
একজন মহিলার মুখ জানালায় ফুটে ওঠে,
নীলিমানিমগ্ন সুর তার ভাসে, যেন সমুদ্রের
ফেনাময়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
সেই স্বর ডুবে গেলে কতিপয় প্রাচীন কংকাল
কবরের মাটি ফুঁড়ে, ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে এসে
বললো গাঢ়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অথচ শব্দের দূত ওড়ায়নি তখনো নিশান,
তখনো অদৃশ্য ওরা প্রেতলোকে, জীবাশ্মের মতো
স্তব্ধ, আমি প’ড়ে থাকি এক কোণে, ব্যর্থ অসহায়।
হে প্রিয় কল্পনালতা
কখনো কখনো ওরা আসে না, আবার কখনো বা
যুদ্ধ-ফেরতা সৈনিকের মতো এসে পড়ে, রচে শোভা
শূন্যতায়; মগজের পুকুরে সাঁতারপ্রিয় হৃদয়ের তন্ত্রী
কী রুদ্র ঝংকারে ছিঁড়ে সুবিস্তৃত রৌদ্রের ভেতরে যায়, যন্ত্রী
হ’য়ে ঘোরে, শাড়ির পাড়ের মতো রাঙা পথে, পতিত বাগানে।
বাউল বাউল ব’লে রসালো জ্যোৎস্নায় খুব মেতে ওঠে গানে।
ওরা অলৌকিক ম্যানিফেস্টোর ডানায় ভর ক’রে
দ্রুত বিলি হ’য়ে যায় শহরের আনাচে কানাচে। গুঞ্জরিত ঘরে ঘরে
এবং স্থানীয় আঁদ্রে ব্রেতো করলে কৃপা বেহদ গাঁওয়ার সব
লজিকের বুকে-পিঠে রূপালি চাবুক হেনে আনকোরা রব
তুলে খিল ভরপুর জ্যোৎস্নায় বেবাক স্বপ্নাহত হয়।
দুস্থ চন্ডীমন্ডপের বুলির আড়ালে কতিপয়
শব্দ জাগে বলীয়ান নব্যতায়, কবিসংঘ পেয়ে যায় বিরল ভুবন,
স্বপ্নাদ্য বলাই যায়। রঙিন কুপন
হাতে নিয়ে টপলেস পরীরা আঁধারে পরিচারিকার মতো
ব্যস্ততায় সঞ্চারিণী; মেঝে ফুঁড়ে ভৌতিক আলোয় উঠে আসে
অবিরত
অপরূপ শব আর শুয়োরের মুণ্ডু। পিরিচে যুল স্তন, যাত্রী
সবুজের দিকে ক্রমাগত। বইয়ের কবরে কে ঘুমায়? রাত্রি
চোলিতে নক্ষত্র গেঁথে চন্দ্রমাকে আনে বুদোয়ারে
নিরিবিলি প্লুত দৃষ্টি হেনে; অতিশয় মৌন হাড়ে
জ্যোৎস্না বোনে অন্তহীন কিংবদন্তী। এই তো প্রফুল্ল জোনাকিরা
গুল্মলতায় খেলে লুকোচুরি-বনময় কী আদিম ক্রীড়া।
হে প্রিয় কল্পনালতা এসো তুমি উন্মাদিনী ওফেলিয়া সেজে
আমার এলসিমোরে, হে দয়িতা, পাখাবতী, শবাকীর্ণ ষ্টেজে।