- বইয়ের নামঃ আমি অনাহারী
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অজানার ফড়ে
বালক এখানে কিছু খুঁজতে এসো না কাটা ঘুড়ি,
আরক্ত ডালিম, জলছবি, হুইসিল, রাঙা নুড়ি,
অথবা পাখির ডিম কিছুই পারে। ছেড়ে দাও
আশা, দেখছো না দূর নীলিমায় হয়েছে উধাও
বালিকা পরীর মতো তোমার রঙিন ঘুড়ি? হায়,
কেন এলে, কেন ছুটে এলে ভয়ানক অবেলায়?
বালক এখানে কিছু খঁজতে এসো না, এই ভূমি
বড়ো দাগাবাজ, যেন ডাইনোসরের পিঠ। তুমি
অন্তত কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালেই পাবো স্বস্তি।
রাশি রাশি মানবিক ভস্ম আর পরীদের অস্থি
কুড়িয়ে আনন্দ তুমি পাবে কি বালক? চলে যাও,
বরং বানাও শব্দছক, ভেঁপু নিয়ত বাজাও।
তবু কেন ইতস্তত করো মিছেমিছে? শোনো, বলি-
আমার ভিতর বহু ফুটপাত, নানা অলিগলি
জ্যোৎস্নাময় টিলা, চোরা খাদ, কতো বন উপবন।
আমি তো ভিয়েতনামে দুর্বিপাকে করেছি চুম্বন
অনূঢ়াকে আর কম্বোডিয়ায় কী ক্লান্ত চোখ বুজে
গেছে বেলা, কোলে শিশু, ঘুমিয়েছি স্বপ্নের গম্বুজে
এলিয়ে দুশ্চিন্তা-ভারি মাথা, বাংলাদেশে কতদিন
পথে পথে দিশেহারা ঘুরেছি সর্বদা কী মলিন।
কবর খুঁড়েছি বারবার, ঘর-পোড়া জলে-ডোবা
দেখেছি আহত চোখে ভয়ানক নৈসর্গিক শোভা
দলে মিলে, কখনও বা খুব একা। নৈঃসঙ্গের দাঁত
স্বাভাবিকতার ফুল্ল বৃত্ত থেকে করেছে উৎখাত
আমাকেও; হে বালক, তোমাকে কোথাও ভালো মেলা
দেখিয়ে আনবো, কথা দিচ্ছি। চতুর্দোলা, লাঠি খেলা
সেখানে দেখতে পাবে। লোকজন, পুতুল, দোকান-
সব কিছু স্বপ্নে গড়া, সর্বক্ষণ খাড়া রেখো কান,
কেননা স্বপ্নের গান হাওয়ার মতোই ভাসে। বুড়ো
জাদুকর বলে দেবে দ্বীপের খবর, স্মৃতি-গুঁড়ো
ওড়াবে তল্লাট জুড়ে, শীর্ণ আঙুলের স্পর্শে তার
খুলে যাবে নীল পথ, অন্তহীন, আমার মাথার
ভিতর মিনার এক পাখির সোনালি কণ্ঠসুরে
গুঞ্জরিত, দোলে চিত্রশালা সমস্ত মগজ জুড়ে।
হৃদয়-দিগন্তে কত স্বপ্নিল পল্লব ঝরে পড়ে-
স্বপ্নের দালাল আমি বাস্তবিক, অজানার ফড়ে।
আজকাল ভুলে যাই
আজকাল ভুলে যাই, স্রেফ ভুলে যাই কত কিছু।
লজ্জায় করবো মাথা নিচু,
যদি কেউ প্রশ্ন করে, বলুন তো কী আমার নাম? আর
কী-যে হয়-কাল কার সঙ্গে দেখা হলো, বারবার
ভুলে যাই, টেলিফোন নম্বর তো মনেই থাকে না,
আর কত চেনা
মুখ ডুবে থাকে অন্ধকার, এমনকি কবিতার পংক্তি তা-ও
কেমন ধূসর ধ্বনি, চকিতে উধাও।
আমার স্মৃতির উপবন
থেকে নির্বাসন
দেওয়া প্রয়োজন তোমাকেই, কিন্তু তুমি
জুড়ে আছো সর্বক্ষণ আমার মনের আর্ত ভুমি।
আমি অনাহারী
আমাকে তোমরা দেখলে না? আমার বুকের পাশে
জামতলা, সর্ষে ক্ষেত, মেঘের মতন ঘাসে ঘাসে
প্রজাপতি; রাজধানী আমার দু’চোখে অস্ত যায়।
আমার পড়শি নেই, আরশিও চুরমার; এ ভীষণ নিরালায়
পড়ে থাকি। গোলাপজলের মতো স্নিগ্ধ করুণা এখন সাত তাড়াতাড়ি
দেবে কি ছিটিয়ে দূরে থেকে? পিপাসার্ত রইবো আমি অনাহারী!
আমাকে তোমরা দেখলে না, সরল রেখার মতো পড়ে আছি
কবে থেকে একা একবিংশ শতাব্দীর খুব কাছাকাছি।
যতই মুর্দাফরাশ ডাকো,
বাঘের মতন হাঁকো,
সরবো না এক চুলও। শেষতক
জন্তুতে-আমাতে ঠিক কতটা ফারাক, বলবেন গবেষক।
তণ্ডুল করিনি স্পর্শ কতদিন, ছুঁইনি কোমল কোনো নারী;
হাওয়ায় হাওয়ায় রটে দিনরাত, আমি অনাহারী
ওখানে কী আছে আমি যেতে চাই। বারবার
দিয়েছো ফিরিয়ে দ্বারপ্রান্ত থেকে; আর
যাবো না ব্যথিত ফিরে অভিমানে। আমি শস্ত্রপাণি,
দেখছো না? নৈরাশ এবং ভয় করেছি রপ্তানি
নিরুদ্দেশে, অন্ধ
হলেও রাখবো চোখ মেলে ঠিক, দেখে নিও। সব দিক বন্ধ?
শুনবো না মানা, হেঁই দ্বারী-
ঝট্পট্ হটো, ভেতরে না গিয়ে মরবো না আমি অনাহারী।
ইদানীং সুটকেস
ইদানীং কেউ কারো রাখে না খবর বাস্তবিক, অনেকেরই
কাটে বেলা উদ্বেগে সন্ত্রাসে।
নিত্য সেব্য ট্রাঙ্কুলাইজার, সর্বক্ষণ এরা ওরা করে প্রশ্ন
নিজেকেই বারবার-সুটকেস আছে তো প্রস্তুত?
দেশ-দেশান্তরে
ঘোরে দলে দলে কত টুরিস্ট একালে, ভ্রমণেই
খোঁজে মুক্তি নানা পথে, খাটায় যে যার তাঁবু ঈষৎ হেলানো
দক্ষিণে কি বামে।
আমরা ছিলাম পাঁচজন, এক পাত্রের ইয়ার-
একজন যুদ্ধে গেছে কাটা; অন্যজন ঘোরে রাস্তায় রাস্তায়,
ময়লা জমেছে নখে ঢের, কুড়োয় কাগজ ছেঁড়াখোঁড়া, প্রায়
নগ্ন, পোকা-মাকড়ের সঙ্গে
বলে কথা দিনরাত হিজিবিজি, আঁধারের থুতনি নাড়িয়ে দেয়, আর
যে যুবার টান টান চিবুকে খাঁড়ির মতো খাঁজ
ছিলো, সে করেছে আত্মহত্যা এবং রাজহাঁসের
স্বপ্ন দেখতো যে,
সুটকেস হাতে মেতেছে সে সাগরযাত্রায়, হয়তো-বা পৌঁছে
গেছে দূর দেশে, শুধু আমি পড়ে আছি, প্রগাঢ় চুম্বন আঁকি
বিষাদের ঠোঁটে;
প্রতিধ্বনি ডেকে নিয়ে যায় দ্রুত নৈরাশ্যের টানেলে আমাকে।
এমন সময় এক, যখন সবাই ডামাডোলে ভীষণ অস্থির আর
যে যার আপনকার সুটকেস তৈরি রাখে, যেন
সহজেই যাত্রা করা চলে দূরে, অথচ কখনও
আমার নিজের সুটকেস ঠিক গোছানো হয় না।
বিদায় বিদায় ধ্বনি সুটকেসে, ইদানীং সুটকেস দেখে
দেখে বেলা যায়, ভাবি- যদি তার পেটের ভেতর
শার্ট কিংবা ইজেরের মতো থাকা যেত।
নিঃশ্বাসবিহীন।
কী-যে হয়, বারবার মেঝে ফুঁড়ে বহু ক্ষিপ্র হাত
গাছ গাছালির মতো ভীষণ জড়িয়ে ধরে আমার নিজস্ব সুটকেস।