- বইয়ের নামঃ আমরা ক’জন সঙ্গী
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অধিষ্ঠান
সেদিন যাবার আগে বলে গিয়েছিলে,
‘তাড়াও দুঃখের মেঘ, এই যে যেখানে
বসে আছি, থাকতাম দুপুরে বিকেলে,
সেখানে গেলাম রেখে আমার নিজস্ব প্রতিনিধি-
একটি নির্জন ছায়া, তাকে
নিয়ে দিব্যি কেটে যাবে তোমার সময়’।
কিছুই না বলে
আমিও নিলাম মেনে তোমার বিধান। সেই থেকে
ছায়াটিকে পরাই প্রত্যহ
অর্চনার মালা। কত খরা, কত বর্ষা আসে যায়,
ছায়াটি যায় না মুছে এতটুকু, বরং ক্রমশ
গাঢ় হয়।
বহুকাল পর তুমি এসে
বসতে চাইলে সেই প্রতিষ্ঠিত পুরোনো জায়গায়।
ছায়ায় দীক্ষিত আমি তোমাকে বরণ করে সেখানে বসাতে
যাবার আগেই ছায়া তর্জনী উঁচিয়ে বলে তোমাকে কঠোর
আদেশের স্বরে, ‘ফিরে যাও তুমি সুদূর পশ্চিমে’।
অন্তত এটুকু থাক
অন্তত এটুকু থাক, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে
হাসিমুখে ঈষৎ তাকানো ফিরে, একটি কি দুটি
কথা কিংবা অত্যন্ত বাঙ্ময় নীরবতা সহকারে
বিদায় সাজানো; এলে চলে যেতে হয়, তবু যেন
প্রস্থানের আগে শূন্য ঘরে আনন্দ টাঙিয়ে হেসে
অসামান্য নীলপদ্ম ফুটিয়ে হৃদয়ে দিগন্তের
দিকে হেঁটে চলে যেতে পারি, অন্তত এটুকু থাক।
অন্তত এটুকু থাক, দেখা হলে হাতের ঝাঁকুনি,
আলিঙ্গন, প্রিয়তমা রমণীর ঠোঁটে চুমু এঁকে
প্রহরকে বন্দি করা, কবিতার পঙ্ক্তির মতোই
শুয়ে থাকা বেড়ালের পশমে ডুবিয়ে হাত একা
কথা বলি কিছুক্ষণ, নাগরিক কাঠবিড়ালির
চঞ্চলতা, ঝোপঝাড়ে জোনাকির নির্ভার উৎসব;
রাত্রি হলে যে শাড়ি ব্লাউজ খুলে মোহগ্রস্ততায়
নেবে তাপ স্বামীর অধীর নগ্নতার, তাকে ভাবা;
অন্তত এটুকু থাক আপাতত প্রাণের খরায়।
আদিম স্মৃতির মতো
এখন নিশুত রাত, ঝিঁঝি ডাকে; দোর এঁটে একা অন্ধকারে
বসে আছি, কে জপায় মন্ত্র চুপিসারে
বারে বারে? ক্রিসমাস গাছের মতোই অগোচরে
কী যেন একটা দ্রুত বেড়ে ওঠে আমার ভেতরে
এবং চৌদিক থই থই
পবিত্র অনলে; কে আমাকে ডাকে দূরে? থাকবোই
যথারীতি অনড় অটল,
এ-কথা যাবে না বলা। আমি তো স্ববশে নেই; জল,
পাথরের বুক চিরে আসে
কী উদ্দাম, কে রুখবে তোড়? মোহন বিরোধাভাসে
মজে আমি ভিজিয়ে শরীর
দেখি লোকচক্ষুর আড়ালে জাগে পুণ্য প্রতিমা নিবিড়
নক্ষত্রের নীড়ে; তবে
আমি কি গড়েছি তাকে অন্তর্লীন অচিন বৈভবে?
নাকি অন্য কেউ,
আমার ভেতরে যার বসবাস, জাগিয়েছে ঢেউ
চড়াময় মরা গাঙে পূর্ণিমার বিশুদ্ধ প্রভাবে?
সাঁতার কাটছি বলে মনে হয়; প্রকৃত প্রস্তাবে
একটি স্রোতের চোরা টানে উদ্দাম চলেছি ভেসে
নিরুদ্দেশে।
অন্তর্গত দেবতা না ছলনাপ্রবণ শয়তান
বীণার ঝংকারে তোলে তান
যখন যেমন খুশি? যার কণ্ঠস্বর
আমাকে নিজের মধ্য থেকে টেনে আনে, ঢের বেশি শক্তিধর
সে আমার চেয়ে; যুগ-যুগান্তের শত কণ্ঠ জাগে
তার কণ্ঠস্বরে, যা ছড়িয়ে পড়ে নদীস্রোতে, ফুলের পরাগে,
পাহাড় চূড়ায়, রূপ তার ক্রমাগত
আবছায়া থেকে সমুত্থিত আদিম স্মৃতির মতো।
আমরা কি যেতে পারি
আরিচার ঘাটে পৌঁছেতেই
পাক্না ফলের মতো সূর্য পড়ে গেল
নদীর পানিতে।
মাছের আঁশটে গন্ধ ভেসে আসে, দূরে
নৌকা চলে যায়। বিশ্রামের
ছায়াটুকু পোহাচ্ছে টয়োটা নিরিবিলি।
নড়েচড়ে বসে
ফ্লাস্ক থেকে তুমি ঢাললে চা,
মুখের ভেতরে
পেস্ট্রির সুঘ্রাণ গলে যায়।
বয়সিনী ভিখিরিনী জানালার ফ্রেমে, ওর শীর্ণ খড়ি-ওঠা
প্রসারিত হাতে তুমি তুলে দিলে স্ন্যাক্স হে সুজাত।
আবার শহরমুখী, সন্ধ্যার ঘোমটা-পরা আসমান, আর
বৃক্ষময় পিচপথে ধাবমান যান,
একটি একাকী লোক, হয়তো হাট-ফেরা
ডোবে কুয়াশায়।
তোমার সোনালি বাহু মাছের ধরনে ঝলসিত
বারবার; ঈষৎ রঙিন ঠোঁটে, চুলে,
কর্ণমূলে, গ্রীবার ঢালুতে ক্যাসেটের
সংগীত ছড়ায় রঙধনু
এবং আমার হাত ডাকে
তোমার হাতের উষ্ণতাকে মতিচ্ছন্ন মানুষের
মতো কী ব্যাকুল।
আমার ভেতরকার স্বেচ্ছাচারী পাঁজর, পাঞ্জাবি
ফুঁড়ে লুটোপুটি খায় আমারই সত্তায়।
তোমার পাঁচটি আঙুলের স্রোত বেয়ে
একজন নারী, বড় একা, তারার আগুনে গড়া,
আমার ভেতরে
গোপনে প্রবেশ করে অন্তরাল ছিঁড়োখুঁড়ে, স্পিডোমিটারের
কাঁটা ঊর্ধ্বগতি;
রাত বাড়ে, আমার মুঠোর মৃদু চাপে
তোমার আঙুল হয়ে যায় কণিকার কণ্ঠস্বর।
ফিরে এসে টিপি
সফেদ কলিংবেল, ঘরে ঢুকে শুই বিছানায়।
তখনও তোমার ঘ্রাণ, রাত্রির গহন
জঠরের নিবিড় নরম,
দূরগামী নৌকা,
হাট-ফেরা লোক, ঝোপঝাড়,
তোমার বিচ্ছিন্ন চলে-যাওয়া,
নির্জন পথের হাহাকার
জেগে থাকে সত্তাময়। কী যেন আমার মধ্যে জ্বলে আর নেভে
জোনাকিপ্রতিম
বারংবার; ইচ্ছে হয়, আবার সেখানেই যাই এই মুহূর্তেই।
আমরা কি যেতে পারি একই স্থানে পুনরায় একই মন নিয়ে?
আমার ক’জন সঙ্গী
আমার নিজস্ব কিছু সঙ্গী আছে যারা কস্মিনকালেও ভুলে
টেপে না কলিংবেল, দরজা খোলার
অপেক্ষায় থাকে না কখনো, নিজেদের
খেয়ালখুশিতে আসে যায়
বিনা এত্তেলায়, এই সব সঙ্গীর অদ্ভুত আচরণে আমি,
বলা যায়, উঠেছি অভ্যস্ত হয়ে রীতিমতো কয়েক বছরে।
একজন, অমাবস্যা রাত্রির রঙের
মতো শাল মুড়ি দিয়ে দাঁড়ায় আমার পাশে হাতে
নিয়ে গ্লাস, বলে ‘দাও তিনটি চুমুক’। হতাশার
ঘ্রাণময় পানীয় আমার
কণ্ঠনালি বেয়ে নামে, আমি তার দিকে বিস্মিত তাকিয়ে থাকি
থমথমে স্তব্ধতায় নিরুপায়, গৌরববিহীন।
অন্যজন এসেই বাধিয়ে দ্যায় খুব
হুলস্থুল; টেবিলে চায়ের কাপ, পেলিক্যান কালির দোয়াত
যায় গড়াগড়ি
আহত যোদ্ধার মতো, জানালার কাচ
গুঁড়ো হয়, পর্দা ফালা ফালা, পলস্তারা খসে পড়ে
দেয়ালের, রেডিও হঠাৎ
উন্মাদের মতো কোলাহল করে ভয়ানক বোবা
বনে যায়, লণ্ড সবকিছু, যেমন দাংগায়
হিংসার তাণ্ডবে
তছনছ বাগান, বসতবাড়ি, দেখি শুধু দেখি।
আরও একজন আছে, যার যাতায়াত এই ফ্ল্যাটবাড়িটায়
বেড়ে গ্যাছে ইদানীং। আমার শোবার ঘরে ঢুকে
রাগে গর গর করে সারাক্ষণ ডালকুত্তার ধরনে, দ্রুত
টুঁটি চেপে ধরবার নিখুঁত কৌশল,
তার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, যেন
জানা আছে, আমার রক্তের স্বাদ পেলে শান্ত হবে। ভয়ে ভয়ে
থাকি, পাছে আমাকে সে ন্যাকড়ার ফালির মতন
করে ফেলে। তার প্রতি আনুগত্য জানাতে ভুলি না।
কায়ক্লেশে হেঁটে আসে অপর একটি লোক, যেন
বহুদূর থেকে
তার আসা; বলা-কওয়া নেই সটান সে ধুলো পায়ে
লম্বা হয় আমার শয্যায়, চোখ বুজে
আকাশ-পাতাল ভাবে, বিষাদের কামড়ের সুতীব্র চিৎকার
সারা মুখে। সে আমাকে তার
কাছে ডেকে নিয়ে
পাশে শুতে বলে, লীন হতে চায় আমার ভেতরে।
বাকি একজন, চটপটে, সর্বদাই হাসির ঝিলিক চোখে,
জ্যোৎস্নাময় কলাপাতা বিছায় আমার
সমুখে সযত্নে
শিল্পের আঙ্গিকে, যেন পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে খুব
নিরিবিলি করাবে ভোজন
এবং আমার চার দেয়ালে নিমেষে
নিপুণ টাঙিয়ে দেয় কেমন আলাদা সূর্যোদয়,
আমার চলার পথে পাতে স্বপ্নখচিত উদার
রঙিন গালিচা।
আমার সঙ্গিরা যার
যখন যেমন খুশি আসে আর যায়, যায় আর
আসে, আমি শুধু
অভ্যর্থনাকারীর ধরনে বসে থাকি গৃহকোণে বড় একা।