ফিরে তাকাব না
শপথ নিলাম, কিছুতেই ফিরে তাকাব না আর।
পেরিয়ে এসেছি বহু দীর্ঘ পথ, পায়ে বহু ক্ষত,
দগদগে, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই
শুকোবে এ ক্ষত, মুছে যাবে এই মুখের আঁধার।
তুমি এসো, অতিশয় শীতল কুয়াশা ফুঁড়ে দ্রুত
তুমি এসো; ভয় নেই, কিছুতেই ফিরে তাকাব না।
আমি কি অচেনা কেউ? এখনও কি চিনতে পারোনি?
আমার হাতে কি তুমি দেখতে পাওনি কোনো বাঁশি?
এখনও তুলতে পারি কত সুর সামান্য বাঁশিতে,
সেই সুর শুনে পাখি এখনও সান্নিধ্যে আসে, নুড়ি
গড়াতে গড়াতে চলে আসে কাছে, পশুরা হিংস্রতা
ভুলে যায় নিমেষেই এবং বাঁশির সুরে সব
নরখাদককে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি, প্রত্যেকটি
প্রহরীর দৃষ্টিপথে মায়াপুরী তৈরি করে আমি
এখানে এসেছি মেয়ে, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
কিন্তু তুমি দূরে সরে যাচ্ছ কেন? কেন ছায়া হয়ে
মিশে যাচ্ছ অধিক গভীরতর ছায়ার ভেতর?
ধাবমান হোন্ডায় আজরাইল, তুমি তার ব্যাক
সিটে ভাবলেশহীন, যেন অতিশয় সাদা এক
মুখোশ রয়েছে সেঁটে মুখে, বুকে হিম স্রোত বয়।
তবে কি তোমাকে দেখে ফেলেছি হঠাৎ পুনরায়
সর্বনাশ লোভে? ফিরে এসো, আর ফিরে তাকাব না।
ফুলচোর
অন্যের বাগান থেকে যে-বালক সাততাড়াতাড়ি
ছিঁড়ে নেয় কিছু ফুল, নই যদিও লুণ্ঠনকারী,
তারই মতো চুরি করে ফেলি
বেলাবেলি
তোমাকে অন্তত
দু’চার ঘণ্টার জন্যে। ঠিক প্রথামতো
চৌর্যবৃত্তি আখ্যা দিয়ে একে
আমাকে পরাতে কেউ পারবে না হাতকড়া। বেঁকে
বসলে পাড়ার পাঁচজন, যদি বসে
সত্যি সত্যি তাদের স্ববশে
আনব স্মৃতির সরোবরে চকিতে নামিয়ে আর
জানিয়ে সালাম পাঁচবার।
ফুটে আছ দূরে তুমি, এই দুটি হাত
পৌঁছে না সেখানে কোনোমতে, হায়, এমনই বরাত-
তবু রাত্রি এলে
আমার নিবাসে কারা মোমবাতি জ্বেলে
জুড়ে দেয় ঘূর্ণি নাচ এবং আমাকে ফুলচোর
খেতাবে ভূষিত করে। তিনটি নাছোড়
নারী চন্দনের টিপ আমার কপালে
এঁকে শুধু বিবাহ বিবাহ বলে উড়ে গিয়ে উঁচু মগডালে
বসে দোলে অর্চনার মুদ্রাঙ্কিত সত্তায়, পাখিরা
জেগে উঠে সোলেমান বাদশার আংটির হীরার মতো হীরা
কেবলি ঝরাতে থাকে চোখ
থেকে, যেমনটি ঘটে রূপ-কাহিনীতে, যত অসম্ভবই হোক।
অন্ধকার ঘরে একা বসে ভাবি-
আমার সকল চাবি
স্বেচ্ছায় আন্ধারে ফেলে দিয়ে বন্দি হয়ে আছি স্মৃতির নিবাসে
কতকাল, যে শব্দই আসে
কানে, মনে হয় তার পদধ্বনি। নিজেকেই ফুলচোর মেনে
এ কেমন বেড়ি ক্রমাগত যাচ্ছি টেনে?
রাত্রির তৃতীয় যামে শুনে অচিন পাখির শিস
হঠাৎ চমকে ওঠে সশস্ত্র পুলিশ।
বৃক্ষ বৃত্তান্ত
এখানে একটি গাছ, শোনা যায়, বহুকাল থেকে
দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠায় সন্ন্যাসীর মতো। লোকে বলে,
একদা এক গাছে ছিল ফলের বিস্ময়
ঋতুতে ঋতুতে, আজ আর
তার কোনো ডালকে হাসিয়ে থরে থরে দূরে থাক,
ধরে না একটি ফলও। পথচারী যারা,
তারা কিছুক্ষণ
দাঁড়ায় গাছের নিচে ছায়ায় ভিজিয়ে
নিতে বড় রোদপোড়া শরীর তাদের। কিন্তু নাকে
আসে না ফলের ঘ্রাণ। তাই
বিশ্রাম ফুরালে ওরা চলে যায় নাক সিঁটকিয়ে,
কেউ কেউ প্রস্থানের আগে
কৃতজ্ঞতাবশত তাকায়
গাছটির দিকে স্নেহশীল চোখে একবার, বলে
মনে মনে, ‘থাকুক সে এমন অক্ষয়
শতেক বছর আরও’।
পাড়ার উঠতি যুবকেরা।
ক্রমে গাছটির নিষ্ফলতা নিয়ে বড়
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। একদিন ওরা ঢাকঢোল
বাজিয়ে গাছের নিচে পঞ্চায়েত ডেকে-
মাঝে মধ্যে দুলে ওঠে ছায়ার চামর অগোচরে-
শাণিত কুড়ুলে
বহু বছরের ঝড়জল সরে যাওয়া
গাছের শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার সম্মিলিত
জোরালো প্রস্তাব করে পাঠ। একজন নিরক্ষর, বুড়োসুড়ো
লোক প্রস্তাবের প্রতি উদাসীন, যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গাছের
শেকড়বাকড় তুল্য নিবু নিবু চোখে
দেখেন গাছের
সমগ্র অস্তিত্ব থেকে চুইয়ে চুইয়ে
সবার অলক্ষ্যে ঝরে ক্রমাগত মূক অশ্রুজল।
বেদেনীর জন্যে
তন্বী বেদেনী বউটি তোমার হারাল কোথায়?
কোথায় উজাড় করলে তোমার ভরা ঝাঁপি?
ফোলা ঠোঁট দেখে উদ্বেগ গ্রীবা বাড়ায় কেবলি,
শত শত ঘোড়া খুর ঠোকে মনে, ভয়ে কাঁপি।
হৃদয়ে আমার গোধূলি বেলায় জ্বেলেছে দেয়ালি
তোমার অমন চোখের দু’ফোটা কালো আলো।
তন্বী বেদেনী এ শহরে তুমি কেন এসেছিলে?
তোমার সংগে দেখা না হলেই ছিল ভালো।
মনে পড়ে আজ তোমার শরীর থেকে উঠে আসা
নদীর এবং গাছগাছালির বুনো ঘ্রাণ;
অঙ্গ তোমার কালো বিদ্যুৎ, প্রতিটি ঝলকে
চমকে উঠছে খুব সহর্য এই প্রাণ।
তোমার বুকের বাটিতে কটির মালায় এবং
নাভির কোটরে বসন্ত রাগ কী নিবিড়।
খোঁপার কৃষ্ণ মধুকোষ থেকে ঝরে মধু, তুমি
সে-মধু মিশিয়ে ছুড়েছ আমার দিকে তীর।
তোমার পাছাটা, কুমোরের গড়া পুরুষ্ট ঘড়া,
ভাসে জ্যোৎস্নায়, যখন এ-পথে যাও হেঁটে।
আকাশের নীড় ছেড়ে জ্বলজ্বলে অজস্র তারা
চুমো খেয়ে যায় তোমার উদোম তলপেটে।
আমার দৃষ্টি তোমার আতশী সত্তার তটে
শামুকের মতো চলে অবিরাম ঢিমে তালে।
নির্যৌবন আমি বড় একা, ভরা যৌবন
তোমার বেদেনী, যেনবা লেগেছে হাওয়া পালে।
নীল আয়নায় বিকীর্ণ শোভা, ভেসে ওঠে মুখ
তোমার আমার। ইঙ্গিতে ডেকে নিয়ে গেলে
গোলাপ বাগানে; চুম্বনে ছিল পাখিদের গান,
হৃদয়ের তাপ সেখানে এসেছি কিছু ফেলে।
চকচকে, চুল, ঠোঁটে ছিল স্বাদু পানের সোহাগ,
কথায় কথায় দুলছিলে, তুমি গোধূলিতে,
যেন তরঙ্গে চিকন নৌকা। আমার সমুখে
ধরেছিলে মেলে রঙিন রুমাল ঘ্রাণ নিতে।
সে রুমালে ছিল অদ্ভুত এক নকশা কেমন;
মনে হয় বুঝি, অথচ যায় না কিছু বোঝা।
হাজার সূর্য ডুবে যাবে শুধু অর্থ খুঁজতে,
খুঁজেছি অনেক এবং চলছে আজও খোঁজা।
রুমালের রঙে মিশেছিল রঙ কিছুটা যেনবা
গোলাপের মতো আর জহরের মতো কালো;
তোমার মদির আশ্লেষে আছে মৃত্যুর ফণা,
তোমার সঙ্গে দেখা না হলেই ছিল ভালো।