ছিল না
ছিল না, এখনও নেই। শত খোঁজাখুঁজি
করলেও কোনো দিকে পাবে না হদিশ।
থমকানো মেঘের ধরনে বসে আছে। ফিসফিস
কী যেন বলছে হাওয়া কানে
তার, পাবে কোথায় এখন?
মনের ভেতরে নদী বয়ে চলে অজানার টানে;
স্রোতে খড়কুটো, তীরে কী আদিম বন।
চায় কায়মনোবাক্যে, শূন্যতার মরু
সয় না তৃষ্ণার্ত চোখে, কাকে
চায় জানা নেই তার, কে অজ্ঞাতনামা সাঁওতালি পুরুষ ডমরু
বাজায় হৃদয়ে সারাক্ষণ, সেই ধ্বনি
পারবে কি ফোটাতে শ্বেত-পাথরের মূর্তি এই পাঁকে
অথবা সাজাতে লীলকান্তমণি
দরজার মাথার অক্লেশে? এরকম
না-ই হলো, ক্ষতি নেই। বরং সে চায়
নিমেষে কনকচাঁপা এবং শরম-
ছাওয়া চোখে মানবী উঠুক ফুটে খাতার পাতায়।
ডালিমতলায়
হিসেব রাখে না কেউ আর। আজকাল
দেশ থেকে দেশান্তরে দিচ্ছে অনেকে উড়াল।
কারো ছুটি কাটে ইউরোপের শৈলাবাসে,
কারো মন্টিকার্লোতে রুলেটে ভাগ্য হাসে
অকস্মাৎ। কেউ ফ্রাঙ্কফুর্ট, কেউ কেউ
সুনীল ভূমধ্য সাগরের শান্ত ঢেউ
গুনে গুনে কাটায় সময় নীলচক্ষু সঙ্গিনীর মভরঙ
বিকিনির ঘ্রাণ শুঁকে, কারো পুঁজি বাড়ে হংকং
আর সিঙ্গাপুরে, কেউ কুয়েতি বিমানে
চলে যায় পেট্রো ডলারের ক্ষিপ্র টানে;
কারো কারো চলায়-বলায়
কিসের মিশোল লাগে। আমি আস্তে হেঁটে যাই ডালিমতলায়।
তিনি বোধ করলেন
দেখতে দেখতে খুব সকলবেলার সূর্যটাকে
পাকা স্ট্রাইকারের ধরনে
গড়িয়ে গড়িয়ে কেউ অতি দ্রুত পশ্চিম আকাশে
নিয়ে গেল। ঘরে
থই থই ছায়া, সারি সারি অক্ষরের অবয়ব
চোখে পড়লেও ঠিক কাউকেই আর
তেমন আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না, অথচ বেলা
গেল, পাখি তার
ক্লান্ত ডানাদ্বয় পাতাময় ডালে গুটিয়ে ফেলার
সঙ্গে সঙ্গে। খাতা বন্ধ করে তিনি চোখ বুজলেন।
জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন কিছু ক্রীড়াপরায়ণ
ছেলে মাঠ ছেড়ে
ঘরমুখো, পথপ্রান্তে যুবক-যুবতী হেঁটে যায় কবিতার
যুগল পঙ্ক্তির মতো। তাদের উদ্দেশে
আশীর্বাদ ঝরে তাঁর ঠোঁট থেকে, যদিও জানেন
তিনি এসবের আদপেই কোনো মানে
নেই শেষ অব্দি, কত দৃশ্য ফোটে পটে, মুছে যায় অগোচরে,
কার আর মনে থাকে ছায়ার আঁচড়?
উড়ে-যাওয়া বেলুনের পেছনে পেছনে
ধাওয়া করে বালকেরা। কিয়দ্দূরে র্যােফায়েল রমণীর মতো
কেউ ঘন দীঘল সোনালি
চুল আঁচড়ায়, জানালার ধারে কেউবা দাঁড়ায়,
ফেরি-অলা শাকসব্জি বয়, বারান্দায়
দু’জনের মধ্যে এলেবেলে কথা হয়-
এই সব ক্ষণিক বুদ্বুদ ভেবে তিনি একটি পুরনো চিঠি
ডায়েরির ভেতরে গচ্ছিত রাখলেন।
যুদ্ধের বাতিল কার্তুজের মতো চিন্তা নিয়ে তিনি
কী করবেন ভেবে দিশেহারা।
বেলা তো যাবেই; এই খুব একা-একা থাকা তাঁর
মাঝে-মাঝে ভারি হয়ে ওঠে
সিসের মতন; ঘরে বাতি জ্বালবেন নাকি অন্ধকার ঘরে
থাকবেন বসে চুপচাপ
কোনো পূর্বপুরুষের তৈলচিত্রের মতন, এই দ্বিধা
তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখল কিছুক্ষণ
ঘরের মেঝেতে, অকস্মাৎ তিনি বোধ করলেন
পাতি বুর্জোয়ার বিবমিষা।
তুমি আছ
ভেবেছিলাম ঠিক তুমি আছ তুমি তো আছই
এ শহরে যেমন পুণ্য আলো থাকে
গির্জায় পূর্ণ মহিমায়
তুমি তো চলেই যাবে
তুমি তো চলেই যাবে শেষতক, আজ নয়তো কাল।
আমার সকাল
পরবে সন্ধ্যার সাজ, যেদিন হাওয়ায় তুমি উড়িয়ে আঁচল
খুব ছলছল
চোখে একা দাঁড়িয়ে পথের ধারে নেবে, হায়, চকিতে বিদায়।
বিষণ্ন দ্বিধায়
একাকী থাকব পড়ে ফ্ল্যাটে এবং ক্ষণে ক্ষণে
প্রাণের গহনে
উঠবে ব্যাকুল ডেকে অন্তরালে বিচ্ছিন্ন কোকিল,
বেদনায় নীল।
তোমার যাবার পরে অকস্মাৎ হবে
মনে, কী বৈভবে
ছিলাম নিমগ্ন কী সৌন্দর্যে এতদিন, আগে কেন ওরে মন
হয়নি স্মরণ?
দেবে না, তোমরা দেবে না
দেবে না তোমরা দেবে না।
ক্ষুধা মেটানোর জন্য
দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন
দেবে না, তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না তোমরা দেবে না
মাথা গুঁজবার ছাপড়া
নগ্নতা-ঢাকা কাপড়া
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না, তোমরা দেবে না।
দুস্থ শিশুর পাত্রে
গুঁড়ো দুধ দিন রাত্রে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না, তোমরা দেবে না।
ক্ষুধার্ত যারা কাঁদবে,
শিকলে তাদের বাঁধবে,
দেবে না কাঁদতে দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না, তোমরা দেবে না।
পারি না এ-কথা ভুলতে,
আমাদের মুখ খুলতে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না, তোমরা দেবে না।
চলে শুধু ষড়যন্ত্র,
ভাঙা হাটে গণতন্ত্র
দেবে না, তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
দেবে না, তোমরা দেবে না।
স্বপ্নের দ্বীপে হাঁটতে,
সোনালি শস্য কাটতে
দেবে না তোমরা দেবে না।
দেবে না, দেবে না, দেবে না।
নায়কের প্রতীক্ষায়
বারবার ঘোষকের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘সুধীবৃন্দ,
একটি নাটক হবে মুক্তাঙ্গনে, একটু অপেক্ষা
করুন নিঃশব্দে ধৈর্য ধরে; দয়া করে
কোনো বিশৃঙ্খলা
সৃষ্টি করবেন না; কোনো ভাংচুর যেন
না হয় এখানে। আমাদের নায়কের
সুলুক সন্ধান
এখনও মেলেনি, ফলে নাটকের কাজ
শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। আরও কিছুক্ষণ দর্শকণ্ডলী
আমরা আপনাদের একান্ত সহযোগিতা চাই।
সাজঘরে ধড়াচূড়ো সবই আছে ঠিকঠাক, চোগা
চাপকান, গলার মুক্তোর মালা, টুপি কিংবা তাজ
অথবা সাফারি স্যুট, বুট
কিছুরই কমতি নেই; রয়েছে গচ্ছিত, শুধু আজ নায়কের দেখা নেই,
এ তল্লাটে কোথাও নায়ক নেই কোনো।
যারা মুখ্য পাত্রপাত্রী নয়,
তারা যার যে রকম ইচ্ছে মাঝে-মাঝে
নাটকের কিঞ্চিৎ মহড়া দিচ্ছে আর নিজ নিজ গরিমার
রোদ পোহানোর
ফাঁকে ফাঁকে দর্শকের চোখের সম্মুখে
ফেলছে ধোঁয়ার জাল। এরকম শান্ত, আলাভোলা
দর্শক কখনো
কোথাও দ্যাখেনি কেউ। নায়ক বেপাত্তা
জেনেও তাদের মধ্যে কেউ
টুঁ শব্দটি করছে না। বেড়ালের ডাক নেই, তীক্ষ্ণ সিটি নেই;
পচা ডিম অথবা টোমাটো
শূন্যমঞ্চে ছুড়ছে না কেউ। মনে হয় থমথমে গোরস্থান।
এরকম ভাবলেশহীন যারা, তারা
হয় মৃত,
নয়তো কলের পুত্তালিকা সব, হঠাৎ যাদের
ফুরিয়ে গিয়েছে দম। হ্যাজাক জ্বালানো
হয়েছে সে কবে,
নায়কের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে না এখনও।
সময় ঠোকর দিচ্ছে ক্রমাগত যেরকম গাছে
দ্যায় কাঠঠোকরা; অধিকারী
দিশি মদে চুর, প্রম্পটার নেপথ্যে ঝিমোয় আর
নোংরা ড্রেন, ঝোপঝাড়, ডোবা থেকে-আসা ঝাঁক ঝাঁক
মশা ভণে নাট্যকথা অমৃত সমান
এ ভবের হাটে। দিন যায়, রাত কাটে, দর্শকেরা
সেই কবে থেকে অসহায়
প্রতীক্ষায় আছে,
প্রতীক্ষায় আছে,
প্রতীক্ষায় আছে
কখন নায়ক এসে গৌরবের বেশে
স্তব্ধতাকে কাচের মতন
টুকরো টুকরো করে
অকস্মাৎ মুক্তাঙ্গনে ঝোড়ো বেগে প্রবেশ করেন।