কে দেবে জবাব?
কথা দিয়েছিলে বাঁধতে পারব স্বপ্ন-মুখর
শান্তির ঘর, আমার বাগান সাজানো থাকবে
জুঁই চামেলীতে এবং গোলাপে। পাখি দোল খাবে
ভোর সূর্যের আবির জড়ানো ডালে আর গানে
ভরবে প্রহর। আমার শিশুর দোলনায় ঝুঁকে
দাঁড়াবে না কোনো কবন্ধ প্রেত, প্রেম-নিমগ্ন
যুগলের চুমো খাওয়ার প্রহরে পড়বে না ছায়া
হাড়-হাভাতের, কথা দিয়েছিল স্বাধীনতা তুমি
কথা দিয়েছিলে মেহেদি-রাঙানো রমণীয় হাত
উষ্ণ রক্তে কোনো দিন আর উঠবে না ভিজে,
কোনো যুবা আর গুলির আঘাতে, রাজপথে পড়ে
আজরাইলের ডানার ঝাপটে হবে না উধাও।
অথচ এখন স্বাধীনতা তুমি নিজেই একাকী।
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার মতো ক্রাচে ভর করে
হাঁটছ তিমিরে। চোখের পাতায় কোন স্বপ্নের
ভস্ম জমছে, এই অবেলায় কে দেবে জবাব?
কে যেন দিয়েছে রুয়ে
বেশ কিছুকাল অস্থিরতা আমাকে কয়েদ করে
রেখেছে সকাল-সন্ধ্যা। অভিযুক্ত মানুষের মতো
অন্নজল বড় উদাসীনতায় প্রত্যহ গ্রহণ
করি, নড়ি-চড়ি নিজ ঘরে, সহজে যাই না কারো
নিবাসে এবং গালে সেফটি রেজরের ব্যবহার
মাঝে-মধ্যে আলস্যে স্থগিত রাখি। দেখি আসমানে
থরে থরে সফেদ গোলাপ ফোটে, রাত্রিবেলা চাঁদ
অর্ধভুক্ত কুলি কামিনের ঘুমে মমতা ছড়াতে
চলে যায়। দূরে ঘণ্টা কোলাহল করে, মধ্য যামে
চক্ষুদ্বয় ঘুমের আঠায় বন্ধ হতে চায়, যেন
ফাঁসির আসামি সেলে চোখ বোজে নিদ্রার আশায়।
শিশুর মতন সাদা সারল্যের পথে ক্রীড়াপ্রিয়
কখনো, কখনো রঙধনু ছড়াতে ছড়াতে আমি,
সঙ্গমজনিত পুলকিত ক্লান্তি আসে, শয্যা খুঁজি-
বিছানায় কে যেন দিয়েছে রুয়ে আগুনের বীজ।
কেবল একটি শব্দ
যাবতীয় মনোহারি সুখ-সুবিধার
পাঁচালি শুনিয়ে ওরা তাকে তাড়াতাড়ি
কার যেন বাগানবাড়িতে
পাঠাতে চাইল সগৌরবে, জয়ঢাক
বাজিয়ে, সাজিয়ে
আপাদমস্তক তাকে জরির পোশাকে।
নিজেকে অত্যন্ত ভারি
মনে হলো তার, বিশেষত এরকম ধরাচূড়ো
এর আগে কোথাও দেখেছে
বলে তার কিছুতেই মনে পড়ল না।
হঠাৎ কী মনে করে এক ঝটকায়
মহামূল্যবান পোশাকটা ছেড়েছুড়ে
উলঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা অটল।
তারপর কণ্ঠস্বরে
সমুদ্র-কল্লোল এনে বলে,
কস্মিনকালেও আমি কারো কোনো বাগানবাড়িতে
যাবো না এবং অস্তিত্বকে করব না
কলংকের চন্দনে চর্চিত।
‘না’ শব্দটি বোমার ধরনে
ভীষণ পড়ল ফেটে সভাগৃহে; কেননা সেখানে
যারা দণ্ডমুণ্ডু কর্তা আর যত কর্তাভজা, তারা
‘না’ শব্দটি শুনতে কখনো
তেমন অভ্যস্ত নয়, কেবল একটি শব্দ সে ঘরের সব
আসবাবপত্র আর ঝাড়লণ্ঠনকে ভীষণ দুলিয়ে দিল,
যেরকম আচানক ভূমিকম্পে ঘটে।
কোথায় দাঁড়াবে?
অতিকথনের পরগাছাময় ঝুঁটি
হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে খুব কুটি কুটি
মানিক বাড়ুজ্জে তাঁর একটি গহন উপন্যাসে
বলেছেন শিল্পিত বিন্যাসে-
ওরা টের পায়।
কোন অপচ্ছায়া শিলীভূত মূর্তির মতন ঠায়
কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে, বাসুকি কখন ফণা তুলে।
দেবে দোলা শ্যামল মাটির মর্মমূলে,
কখন হাওয়ায় বিষ গচ্ছিত অথবা
অকস্মাৎ নিসর্গের শোভা
হবে তছনছ, ওরা ঠিক জেনে যায়, ওরা মানে পশুপাখি,
তখন আমরা বড় বেখেয়াল থাকি।
পাথরের নিচে থাকে
খাদ্যান্বেষী পিচ্ছিল যে-কীট কিংবা ডালে বসে ডাকে
যে-চন্দনা তারাও বাঁচাতে প্রাণ করে
ছোটাছুটি এদিক সকলের অগোচরে।
তাণ্ডবের ছায়াচ্ছন্ন পৃথিবীতে অসহায় শিশুরা কীভাবে
কোথায় দাঁড়াবে?
ঘুড়ে দাঁড়ালাম
কিছুকাল ধরে কী ভীষণ মনোভার
নিয়ে আছি। জীবনকে অগাধ কাদায় ডোবা কোনো
শুয়োরের মতো মনে হচ্ছে ইদানীং। ভালো লাগবার
মতন কিছুই আর নজরে পড়ে না। ঘরবাড়ি,
সারি সারি গাছ, ঝিল, উড়ে যাওয়া
পাখির মনে আনে না খুশির ঢল। শুধু
ধু-ধু মরুভূমি চোখে ভাসে,
মরীচিকা সকল কিছুই যেন, জনমনিষ্যির
সঙ্গ বিষবৎ, রবিশঙ্করের সেতারের গৎ
কেমন অসার ঠেকে, এমনকি শাগালের ছবি
দেয় না ছড়িয়ে
স্বপ্নাভা আমার চেতনায়।
ভাবি মাঝে-মাঝে-
যে আমার পেছনে পেছনে হাঁটে, থেমে
যায় হাত রেখে দরজায়,
তার প্ররোচনা মেনে নিয়ে মাথা রাখি
ট্রেনের চাকার নিচে, ঝুলে পড়ি ফ্যানে
অথবা সেবন করি প্রচুর ঘুমের বড়ি প্যাঁচা-ডাকা রাতে।
একদিন কোনো এক হাই-রাইজ দালানে পোঁছে
বারো তলা থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়ার মৃদু ইচ্ছাটিকে অনেক গোঁয়ার
করে তুলে সিঁড়ি খুব কায়ক্লেশে ভাঙতে ভাঙতে
দ্বাদশ তলায় উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার
মুহূর্তে তোমার মুখ মনে পড়ে গেল
অকস্মাৎ, না পড়াই ছিল বাঞ্ছনীয়-
কে যেন আমার ঘাড় ধরে টেনে জমিনে নামিয়ে নিয়ে এলো
আর আমি তক্ষুণি আবার
জীবনের দিকে তীব্র ঘুরে দাঁড়ালাম।
চর্যাপদের হরিণী
ভুল বোঝাবুঝি, ঘেন্না, বিবাদ-
এ কেমনতরো কাহিনী?
ফ্ল্যাটবাড়িটায় হানা দেবে জানি
মিশ্র স্মৃতির বাহিনী।
নকল সোনার সিংহাসনের
অধিকারীটিকে দেখেছি;
তার অকারণ তাচ্ছিল্যের
ভস্ম শরীরে মেখেছি।
চক্রান্তের জাল সব দিকে
বলো তো পা রাখি কোথায়?
কারো কারো ক্রূর বিষথলি, হায়,
নিমেষে উজাড় কথায়।
তবে কি আমিও ফিরে আসব না
শুভার্থীদের ডেরায়?
চলে যেতে হয়, শেষমেশ তবু
আনন্দ ফোটে ফেরায়।
কার্তিকে পাই একটি কদম
ফুলের শিহর শিরায়,
হাসিঝলসিত দৃষ্টি বুলায়
প্রলেপ মনের পীড়ায়।
হাতে মৃদু চাপ, চোখের কোথায়
হৃদয়াবেগের বেহাগ।
বুকডোবা পাঁক থেকে উঠে দেখি
মনোজ পদ্ম বেদাগ।
যাবার সময় বস্তুত কারো
দোষক্রটি আমি ধরিনি;
বৈরী ঋতুতে কোমল তাকায়
চর্যাপদের হরিণী।