ফিরে যাও
ফিরে যাও আমার দুয়ার থেকে তোমরা এখন
ফিরে যাও; কিছুতেই তোমাদের দেবো না মাড়াতে
আমার চৌকাঠ! তোমরাতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিয়েছো পাড়ি কতো না সমুদ্র
অথবা বীরভূমে ধু ধু হয়েছো তৃষ্ণার জল তাঁর
প্রহরে প্রহরে আর নজরুল জ্যৈষ্ঠের দুরন্ত
মেঘের মতন বাবরি দুলিয়ে মোহন বলাৎকার
করেছেন তোমাদের ওপর প্রত্যহ। কবেকার।
জীবনানন্দের জন্যে চকিতে করেছো উন্মোচন
করুণ শঙ্খের মতো স্তন এবং সুধীন্দ্র দত্ত
নিখিল নাস্তির মৌনে ডুবে তোমাদের নাভিমূলে
যৌনাঙ্গের অগভীর কেশে রেখেছেন মুখ ভুলতে
মনস্তাপ। তোমরাতো সাজিয়েছো বিষ্ণুদে’র ঘর
রাত্রিদিন, দিয়েছো সন্ধ্যায় তুলে শ্বেত বাহু মুখ।
এখনো তো বুদ্ধদেব বসুর শয্যায় তোমাদের
ব্রার টুক্রো সিঁদুরের রঙ প’ড়ে থাকে ইতস্তত।
ফিরে যাও, আমার দুয়ার থেকে ধিক্কার কুড়িয়ে
ফিরে যাও। তোমাদের চোখে তুলে রাখবার ইচ্ছে
মৃত টিকটিকি হ’য়ে আছে, বুকে নেবো না উৎফুল্ল।
বলে দিচ্ছি, ছলাকলা ব্যর্থ হবে; বিসমিল্লাহ খান
যতই বাজান তাঁর পুষ্পিত সানাই, তোমাদের
হাত ধ’রে আনবো না বাসরে কখনো। তোমরাতো
উচ্ছিষ্ট উর্বশী; ফিরে যাও, ফিরে যাও, যদি পারো
নতুন পাতার মতো সজীব শিহর নিয়ে এসো।
বদলে ফেলি
আমি যে এই আমির খোলস ছেড়ে ছুঁড়ে যখন তখন
বেরিয়ে আসি,
রৌদ্রেপোড়া জ্যোৎস্না মোড়া এই সমাচার তোমার চেয়ে
ভালো ক’রে কেউ জানে না।
ফুটফুটে খুব সকালবেলা কিংবা ধরো পিতামাতার
বুক-কাঁপানো ঘুম-তাড়ানো ডাগর কোনো মেয়ের মতো
মধ্যরাতে
এই যে আমি ঘরে বাইরে কেমন যেন হ’য়ে উঠি,
তোমার চেয়ে বেশি বলো
কেই বা জানে?
আমাকে এক ভীষণ দানো তাড়িয়ে বেড়ায় অষ্টপ্রহর,
তীব্র খাঁ খাঁ খিদের চোটে আমার মাংস
অস্থি মজ্জা চেটে চুটে হরহামেশা সাবাড় করে।
লকলকানো চুল্লিতে দেয় হেলায় ছুঁড়ে,
অথবা সে অগ্নিমান্দ্যে ভুগলে তখন খামখেয়ালি খেলায় মাতে।
তপস্বী এক বেড়াল সেজে ঘুরে বেড়ায় আশে পাশে
আমার ঘরে।
রাত্রিবেলা অনেক দামী রত্ন স্বরূপ দু’চোখ জ্বেলে
আঁধার লেপা চুপ উঠোনে কিংবা কৃপণ বারান্দাটায়
আলস্যময় কোমল পশুর গন্ধ বিলায়
এবং আমি ইঁদুর যেন।
আবার কখন রুক্ষ মরু চতুর্ধারে জ্বলতে থাকে,
বুকের ভেতর শুশুনিয়া, হাতড়ে বেড়াই জলের ঝালর;
মুখের তটে ঝরে শুধুই তপ্ত বালি; কখনো-বা পায়ের নিচে
বেজে ওঠে বেগানা হাড়।
এই যে এমন দৃশ্যাবলি উদ্ভাসিত যখন তখন,
তুমি ছাড়া কেউ দেখে না।
হঠাৎ দেখি, মুখোশ-পরা আবছা মানুষ দু-রঙা ঐ
ঘুঁটিগুলো সামনে রেখে বললো এসে,
‘তোমার সঙ্গে খেলবো পাশা।
জনবিহীন জাহাজ-ডেকে দ্যুতক্রীড়ায় মত্ত দু’জন
ডাকিনীদের নিশাস হয়ে বাতাস ফোঁসে চতুর্দিকে,
মাঝে মধ্যে চোখে-মুখে ঝাপ্টা লাগে লোনা পানির।
প্রতিযোগীর শীর্ণ হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ চমকে উঠি,
যেন আমি ইলেকট্রিকের শক পেয়েছি অন্ধকারে।
প্রতিযোগী কিতাব নিসাড়, নীল-শলাকা আঙুলগুলো
দারুণ শীতে মৃত কোনো সাপের মতো ঠাণ্ড এতো-
শিউরে উঠি।
মুখোশধারীর চক্ষু তো নেই, শুধুই ধু ধু যুগ্ম কোটর।
ভীষণ দানো দুরন্ত সেই পেলব বেড়াল এবং কালো
মুখোশ-পরা আবছা মানুষ আসলে সব
তুমিই জানি।
ভূমন্ডলে তোমার চেয়ে চমকপ্রদ চতুর কোনো বহুরূপী
কে-ই বা আছে?
আপন কিছু স্বপ্ন তোমায় বাট্রা দিয়ে খাট্রা মেজাজ
শরীফ করি।
তোমার জন্যে টুকরো টুকরো সত্তাটাকে নিংড়ে নিয়ে
রূপান্তরের গভীরে যাই কখনো বা কেবল চলি।
জানিনা হায়, সামনে কী-যে আছে পাতা-
ফুল্ল কোনো মোহন রাস্তা কিংবা বেজায় অন্ধ গলি।
তোমার জন্যে সকাল সন্ধ্যা নিজেকে খুব বদলে ফেলি,
অন্তরালে বদলে ফেলি।
তোমার জন্যে চড়ুই হয়ে চঞ্চু ঘষি শ্বেত পাথরে,
কখনো ফের স্বর্ণচাঁপায় এক নিমিষে হই বিলীন।
কখনো বা পিঁপড়ে হ’য়ে দুর্গ বানাই ব্যস্তবাগীশ
ছুটে বেড়াই দেয়াল পাড়ায়।
তোমার জন্যে হই শহুরে শীর্ণ কুকুর, দীর্ণ বুকে গাড্ডা থেকে
পান করি জল;
তোমার জন্যে হই আসামী ফাঁসির এবং নোংরা সেলে
ব’সে ব’সে নিষিদ্ধ ঐ বহর্জীবন নিয়ে কেমন জ্বরের ঘোরে
উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখি, ক্বচিৎ কোনো শব্দ শুনি।
তোমার জন্যে যখন তখন নিজেকে খুব বদলে ফেলি, আমূল আমি
বদলে ফেলি।
বিচার
সে জানে বিচার হবে তার। কেন? সে-কথা অজ্ঞাত
জানে না কী তার অপরাধ। এ কেমন্ কাঠগড়া,
সাক্ষী সাবুদও বা কী রকম? বিচারক অনাগত, শুধু
চৌদিকে বোলেল্লা হল্লা। কেউ কেউ চোখের ঠোকর
মারে তাকে, কেউ কেউ ইতর ভাষায় কী-যে বলে,
মলিন ছাতার বাট কিংবা ছড়ি দিয়ে মাঝে-মধ্যে
কেউ বা খোঁচায়। ধন্দে করুণ সে, অসহায় আজ
ভুলেছে নিজের নামধাম। অকস্মাৎ ফিসফাস,
হয়তো বা এসেছেন তিনি, মানে বিচারক। সে-ও
চালায় নিস্পৃহ দৃষ্টি, তার রুক্ষ চুল, চার দিন
না-কামানো দাড়ি, শিরদাঁড়া বেয়ে মুহূর্ত গড়ায়।
না, ধর্মাবতার আসেন নি। পুনরায় হট্রগোলা,
অট্রহাসি, একজন তাকে ক্ষিপ্র চিমটি কেটে দূরে
সরে যায়, অন্যজন নিপুণ ধাক্কায়
হঠাৎ মাটিতে ফেলে ছোঁড়ে লাথি, যেন সে টিনের
কৌটো; কেউ কর্কশ মধ্যাহ্নে তার মুখের নিকট
টলটলে জলভরা গ্লাশ নিয়ে পর মুহূর্তেই
ঝটিতি সরিয়ে নেয় হাত।
তৃষ্ণা বাড়ে আরো, দ্যাখে, মৎস কন্যা সমস্ত শরীরে
অভ্রের মতন জলকণা নিয়ে অদূরে দাঁড়ানো
এ অশ্লীল ভিড়ের মধ্যেই।
দ্যাখে কযেকটি হাড়, হয়তোবা নাবিকের, নেচে
নেচে আসে, দ্যাখে মৃত ভস্ম ঝেড়ে ফিনিক্স আবার
জেগে ওঠে। বিচারক অনাগত। অধৈর্য, অশান্ত
দর্শকেরা মেতে ওঠে অলৌকিক দাঁড়িপাল্লা হাতে,
দেয় রায়-তাকে শত কুটি করে রক্ত গোধূলিতে
নদীতে ভাসাতে হবে। তার শরীরের টুকরোগুলো,
দেখলো সবাই, দ্রুত হয়ে গেলো এক শো গোলাপ।
‘এমন মামলা ঘটে, এতে কিছু নতুনত্ব নেই;
ব’লে তারা গোলাপের পাপড়ি
কুটি কুটি ছিড়ে ফের ওড়ালো অনেক ধূলো-ধোঁয়া।