- বইয়ের নামঃ আকাশ আসবে নেমে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অগ্নিপথ
নদীর ঝাপ্টায় চমকে উঠে তাকাই, উপকূলের ঘুম
সত্তা ছেড়ে মেঘমালায় লীনঃ কয়েকটি
পাখি চঞ্চুতে রৌদ্রের অকপট
সততা নিয়ে আমাকে প্রদক্ষিণ করে, ওদের ডানায়
ঢেউয়ের স্বরগ্রাম, চোখে ভবিষ্যতের
নীলকান্ত মণির বিচ্ছুরণ, বন্ধুরা কোথায়? আমারতো
একসঙ্গে স্তব্ধতাকে গান উপহার দিয়ে
বেরিয়ে পড়েছিলাম পর্যটনে।
ডাঙায় নৌযানের টুকরো টাকরা এক
বিপর্যয়ের মূক কথক; দূর দিগন্তের গা ধুইয়ে
উতরোল জলরাশি; সারা শরীরে মাঝ গাঙের
জলজ ঘ্রাণ, মৎস্যঘ্রাণ নিয়ে
অবসাদের বালির চিকচিকে শয্যায়
শুয়ে আছি, সহযাত্রীরা কোন অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে
হিংস্র অতীতের দখলে? পাখির চিৎকারে
চিন্তা তরঙ্গে নেমে আসে আর্তনাদ ছেড়ে যাওয়ার
পরের স্তব্ধতা। গা ঝাড়া দিই
জলচর পাখির মতো। আমাকে ফিরে যেতে হবে
অনেক আগেকার বিস্ফোরণের বলয়ে,
এক অগ্নিপথ থেকে অন্য অগ্নিপথে
যেতে হবে হেঁটে। সেখানে এই বিড়ম্বিত ব-দ্বীপের
ইতিহাস রাজহাঁসের মতো গ্রীবা তুলে দাঁড়ানো।
অব্যক্ত থেকে যায়
আমার চোখে এত পানি নেই যে,
এই দুরন্ত আগুন আমি নেভাতে পারি;
আমার লেখার টেবিলে এত জায়গা নেই যে,
নরখাদক-তাড়িত শত মানুষকে দেবো ঠাঁই।
যে শব্দগুলো আমার দিকে আসছিল
প্রজাপতির মতো উড়ে,
সাঁতার কেটে মাছের মতো, তারার স্রোতের মতো,
মৌমাছির মতো, ওরা ভীষণ পুড়ে যাচ্ছে আগুনে।
শব্দের শ্মশানে দাঁড়িয়ে, চিত্রকল্পের গোরস্তানে বসে
আমি কেবল ছাই ওড়াই, ছিঁড়ি ঘাস।
আমার শব্দগুলোর গলায় জল্লাদ
বেধড়ক ছুরি চালায়; ফিন্কি দিয়ে রক্ত ছোটে
উপমার বুক থেকে। আমার শব্দাবলী
খোলা আকাশের নিচে একবস্ত্রে হি হি কাঁপছে
উপকূল-ঘেঁষা ঘরপোড়া মানুষের মতো শীতের
দাঁত বসানো রাতে প্রাণভয়ে।
এ কোথায় বাস করছে আমার শব্দেরা?
ওদের মাথার খুলিতে দুঃস্বপ্ন ঠাসা,
ওদের চেতনা সারাক্ষণ অপঘাত-শানিত
ওদের চোখে ভেসে ওঠে বারবার ক্রুশকাঠ এবং
ওরা চোখ খুলতে ভয় পায়, পাছে দেখে ফেলে
নিরপরাধ লাশ, ধর্ষিতা নারীর উলঙ্গ শরীর।
আমার শব্দাবলী জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে,
ক্ষুধার্ত আর ভোজতৃপ্তদের মাঝখানে,
ভোর ও সন্ধ্যার মাঝখানে,
হত্যাযজ্ঞের উন্মত্ত উল্লাস আর
শান্তি মিছিলের মাঝখানে স্তম্ভিত,
চোখ রগড়ায়, শান্তির গান গাইতে গিয়ে
দাঙ্গাবাজদের পায়ের তলায় পড়ে
অব্যক্ত থেকে যায় সময়হীনতায়
অভিলাষ
লোকটা ক্ষয়েছে খুব, বেশিদিন বাঁচবে না আর,
বড় জোর টিকে যাবে দু’তিন বছর। ঘুণ ধরা
ফুসফুস নিয়ে পথ হাঁটে, পুরনো কালের ঘড়া,
মেঘের, হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে এবং পাহাড়
সহজে ডিঙিয়ে যায়, নদী পার হয়, দীর্ঘ রাত
জেগে পদ্য লেখে ভাবে কাগজের বুকে হীরে
জ্বলজ্বল করে; লোকে তাকে উপেক্ষার রুক্ষ তীরে
ঠেলে দেয়, কাটে তাকে বার বার কষ্টের করাত।
ভীষণ কেউটে তার নিকটেই থাকে, তোলে ফণা,
খেলা করে বৃক্ষতলে, নদীতীরে। ব্যাপক মড়ক
চেটে নেয় খর জিভে মেধা ও মনন, ওড়ে ছাই
সভ্যতার; খৃষ্টের মাথার জ্যোর্তিমণ্ডলের কণা
মর্চে-পড়া, লোকটা নিভৃতে বলে, ‘হে দীপ্র হীরক,
ও বৃক্ষ ও নারী আমি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে চাই’।
অসুখ
অসুখ আগেও ছিল, কিন্তু আজকাল কষ্ট হয়
খুব, নষ্ট হয় ক্ষয়া শরীরের স্থিতিস্থাপকতা
প্রায়শই। বৃদ্ধ কবিরাজ আয়ুর্বেদীয় ধারায়
ওষুধ দিলেন, যাতে ফুসফুস থাকে ঠিকঠাক।
কৌটো যত্নহীন এক কোণে পুরু ধুলোময়তায়
ঝিমায়, কবিতা আসে অমাবস্যার রাতে, শুষে নেয়
মেদমজ্জা, গড়ে থাকি অবসন্ন; অক্ষয়ের দ্যুতি
পূর্বস্মৃতি হঠাৎ জাগিয়ে তোলে, বাড়ে অসুস্থতা।
নিজের কবিতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে পড়ার সাধ আজ
স্তিমিত, এমনকি বন্ধুর কাছেও পদ্য টদ্য
এগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা বনবাসে গেছে। যতদিন
আয়ু জ্বলে ধিকি ধিকি, ততদিন অন্তরালে বসে
কবিতার মুখ দেখে নিতে চাই গোধূলি বেলায়,
মধ্যরাতে, সভা সমিতিতে গরহাজির থাকব।
খারাপ ভাবছ বুঝি? এখন কী করি আর? এই
অসুখের ধরণই এমন, করে কর্তব্যবিমুখ।
আকাশ আসবে নেমে
বিচলিত হয়ো না এখন, স্থির হও সমুদ্রতলের
মতো, ধাক্কা খাবে, খেতে হবে বহুদিন, ভেঙচি
কেটে চলে যাবে বহু লোক, কেউ কেউ
হানবে আঘাত, সয়ে যাও সবকিছু ধৈর্য ধরে।
তোমার হৃৎপিণ্ড ঠুকরে ঠুকরে খাবে বিমাল শকুন,
খেতে দাও; এরকমই হয় চিরদিন,
পাথরে থাকবে বন্দি তুমি বহুকাল। কেননা তোমার কাছে
মুক্তিবাণী আছে, বয়ে যাও যন্ত্রণার শুরুভার হে নীরবে।
দেবতারা খুব ঈর্ষাকাতর তোমার সাহসের
দীপ্তি দেখে, তোমাকে পোড়ায় তাই উহাদের ক্রোধ।
এভাবে পুড়তে হবে দিনরত্রি, জ্যোৎস্নার প্রলেপ
সহজে পাবে না তুমি মরবার আগে।
বিচলিত হয়ো না এখন, গলা ছেড়ে গাও গান
প্রহরের প্রহরে, পাখি আর লতাপাতা কীট পতঙ্গ শুনুক
কী অমর্ত্য সুর বাজে মর্ত্যবাসীর গলায় দেবনায়;
আকাশ আসবে নেবে শৃংখলিত দু’পায়ে তোমার।
আমন্ত্রণ
তোমাকে একবার এখানে ডেকে নিয়ে
আসতে চাই এ গাছপালার
ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে রাখা বাড়িটার
কাছে। ভেতরে যাবার দরকার নেই হে হাওয়া,
এই লতাপাতার ঘ্রাণ
পাখির গান, তোমার
কেমন লাগবে, জানি না।
খনিক এগিয়ে
গাছের ডাল সরিয়ে একটু ঝুঁকে
যদি দাঁড়াও, কলিং বেল বাজাতে চাও,
তোমার কাঁধে এসে
বসবে ফুরফুরে এক প্রজাপতি,
কিছু মনে করো না।
হাওয়া,
লতাপাতার সবুজ ঘ্রাণ,
নৈঃশব্দ্যের তান, বাড়ির দীর্ঘশ্বাস।
বাড়ির ভেতরে দ্রষ্টব্য
এই আর কি
ভেতরে নানা বয়েসী
ক’জন মানুষের বসবাস,
বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ যিনি
থাকেন চুপচাপ, মাঝে-মধ্যে দু’বছরের
এক শিশু, তাকে জড়িয়ে ধরে
পেছন থেকে, তিনি মৃদু হেসে
কিছুক্ষণ খেলা করেন ওর সঙ্গে। তারপর
তার কলম কাগজে সাজায় অক্ষরমালা।
ভেতরে যাওয়ার কী দরকার?
কী প্রয়োজন ওর নৈঃসঙ্গ্যের মুহূর্তগুলোকে
কাচের গুঁড়ো করে দেওয়ার?
তিনি টেবিলে ঝুঁকে লিখুন,
তাঁকে লিখতে দাও।
নিজের দ্রুত কমে-যাওয়া সময়কে
তিনি শাসন করছেন
শব্দের হিরন্ময় চাবুকে।
হাওয়ায় উডুক ওর শাদা চুল,
তেজী ঘোড়ার মতো
চলুক ওর কলম। একদিন
তিনি এ বাড়িতে হবেন গরহাজির,
ওকে পাওয়া যাবে না কোথাও।
কান্নার রোল উঠবে বাড়িটায়,
একদিন স্তব্ধ হবে মাতম,
হয়ত থাকবে একটি কি দু’টি
দীর্ঘশ্বাস, কিছু ফোঁপানি’।
পঞ্চভূতে নাস্তির অবাধ উৎসব।
ভেতরে প্রবেশ না-ই বা করলে,
লতাপাতার সবুজ ঘ্রাণ,
প্রজাপতির স্পর্শ বুকের ভেতর নিয়ে
খানিক জিরিয়ে চলে যাও
কোথাও চায়ের আসরে।