নো এক্সিট
আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। কাঁধে
ক্রূশকাঠ থাকতেই হবে কিংবা কাঁটার মুকুট
মাথায় পরতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা না।
এসব মহান
অলংকার আমার দরকার নেই। বাস্তবিক আমি
এক হাত নীল ট্রাউজারের পকেটে রেখে অন্য হাত নেড়ে নেড়ে
সিঁড়ি বেয়ে ‘আচ্ছা চলি, তাহলে বিদায়’ ব’লে একটি উচ্ছিষ্ট
রাত্রি ফেলে রেখে
নির্জন পেছনে
অত্যন্ত নিভৃত নিচে, শিরদাঁড়াময়
নক্ষত্রটোলার পত্রপত্রালির ঈষৎ দুলুনি নিয়ে
খুব নিচে চলে যেতে চাই।
অবশ্য সহজ নয় এভাবে চকিতে চলে যাওয়া। ত্র্যাশট্রেতে
টুকরো টুকরো মৃত সিগারেট, শূন্য গ্লাশগুলো
বৈধব্যে নিস্তব্ধ আর টেবিলে বেজায় উল্টোপাল্টা পান্ডুলিপি
-প্রস্থানের আগে
এই সব খুঁটিনাটি বেকুব অত্যন্ত আর্তস্বরে কিছু ডাক দেয়।
তখন আমার বুকে তিন লক্ষ টিয়ে
তুমুল ঝাঁপিয়ে পড়ে, কয়েক হাজার নাঙা বিকট সন্যাসী
চিমটে বাজাতে থাকে চতুর্ধারে, পাঁচশো কামিনী
দুলুনিপ্রবণ স্তন বের করে ধেই ধেই নাচ শুরু করে।
আর আমি চোখ-কান বন্ধ ক’রে সাত তাড়াতাড়ি
বিদায় বিদায় ব’লে ক্ষিপ্র দৌড়বাজের মতন
ছুটে যাই, ছুটে যাই দূরে অবিরত। ইচ্ছে হলেও প্রবল
কাউকে দিই না অভিশাপ; এতদিনে জেনে গেছি
আমার কর্কশ অভিশাপে
কোনো নারী গাছ কিংবা প্রতিধ্বনি হবে না কখনো,
অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় ফেলবে না হারিয়ে নৌকোয় কোনো শকুন্তলা,
এমন কি খসবে না একটিও পালক বিবাগী মরালের।
সার্কাস ফুরিয়ে গেলে এক্রোব্যাট অথবা ক্লাউন
সবাই বিষণ্ন হয় অগোচরে হয়তো বা। কেউ ছেড়ে চুল,
অন্ধকার তাঁবুর ভেতর কেউ খায় হাবুডুবু
দুঃস্বপ্নের ক্ষুধার্ত কাদায়,
কেউ বা একটি লাল বলের পেছনে
ছুটতে ছুটতে কৈশোরের সমকামী প্রহরে প্রবেশ করে,
বমিতে ভাসায় মাটি কেউ, কেউ উত্তপ্ত প্রলাপে!
হে আমার বন্ধুগণ, দোহাই আপনাদের, দেরি সইছে না;
দিন বলে দিন,
তা’হলে আমি কি এই সার্কাসের কেউ? আপনারা
যে যাই বলুন, এই গা ছুঁয়ে বলছি মাঝে-মধ্যে,
না, ঠিক হলো না, প্রায়শই বলা চলে,
নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়। স্বজনের লাশ
কবরে নামিয়ে চটপট
ঢোক ঢোক গিলতে পারি মদ খুব ধোঁয়াটে আড্ডায়,
প্রিয়তম বন্ধু
আত্মহত্যা করেছে শুনেও নিদারুণ
মানসিক নিপট খরায়
অবৈধ সংগম ক’রে ঘামে নেয়ে উঠতে পারি সহজ অভ্যাসে।
আমাকে যেতেই হবে যদি, তবে আমি
যীশুর মতন নগ্ন পদে চলে যেতে চাই। অথচ হঠাৎ
একজন তারস্বরে বলে ওঠে, ‘নো এক্সিট, শোনো
তোমার গন্তব্য নেই কোনো’। না থাকুক, তবু যাবো,
দিব্যি হাত নেড়ে নেড়ে চলে যাবো, কেউ
বাধা দিতে এলে
বিষম শাসিয়ে দেবো, লেট মি এলোন, স’রে দাঁড়াও সবাই……
লক্ষ্মী কি অলক্ষ্মী আমি চাই না কিছুই, চাই শুধু যেতে চাই।
পেয়ে যাই
কখনো কিছু না কিছু পেয়ে যাই, বন্ধু উপহার
পাঠান হঠাৎ কিংবা প্রবাসী ভায়ের চিঠি আসে
সুদূর শহুরে ঘ্রাণ নিয়ে, কখনো দেয়ালে এসে
বসে সুদর্শনা পোকা, যেন তার কপালের টিপ।
কখনো বা পেয়ে যাই অন্ধকারে আমার ঠোঁটের
তীরে তার দীপ্ত তন্বী অধর তরণী। অন্য ঘর
থেকে ভেসে-আসা চঞ্চল চুড়ির কাচরেলা শব্দে
বুকে জেগে ওঠে লক্ষ অশ্বারোহী; ক্ষুরধ্বনি পাই।
কোনো কোনোদিন খুব শান্ত হরিদ্রাভ অপরাহ্নে
সেলাইয়ের কাজ ছেড়ে কখনো মা এমন তাকান
নিবিড় আমার দিকে, সমস্ত শৈশব দুলে ওঠে-
চকিতে আবার পাই তাঁকে কাছে সতেজ তরুণী।
কখনো গলির খঞ্জ কিংবা বন্ধ নীলাভ দরজা
আমার মগজে কবিতার কিছু পঙ্ক্তি গুঁজে দেয়।
পোস্টার
পথে বেরুলেই পড়ে চোখে। সকাল দুপুর কিংবা
বিকেলের খরচা-হ’য়ে-যাওয়া রোদে অত্যন্ত গোচরে
আসে ওরা, যেমন দোকানপাট, রাস্তার কুকুর,
রঙিন সাইনবোর্ড, কৃষ্ণচূড়া, গম্বুজের পায়রা অথবা
ট্রফিক পুলিশ। বুকজোড়া দাবিদাওয়ার নানা
উল্কি নিয়ে ওরা স্পষ্ট উপস্থিত দেয়ালে দেয়ালে,
প্রগলভ্ পোস্টার, বারো মাস তেরো পার্বণের সাজ
এই শহরের; রৌদ্রে জলে চেয়ে থাকে অপলক।
এবং চলতি পথে বেকার যুবক বাসযাত্রী কেউ কেউ,
ক্লান্ত কবি, মেজো সেজো কর্মচারী নানা দপ্তরের,
সিমেমাগামিনী তন্বী, ফেরিঅলা, দুস্থ বুড়োসুড়ো
লোক, ভিড়ভাট্রা অপছন্দ যার- সবাই পাঠক
দারুণ মুখর সব পোস্টোরের। অলজ্যান্ত কিছু
অক্ষর নক্ষত্র হ’য়ে ভাসে তাদের নিজস্ব নীলিমায়।
আমারও বিষম ইচ্ছে, সমস্ত শহরে দেবো সেঁটে
একটি পোস্টার গরীয়ান, শুধু করবো সে লৌকিক
ভাষার কিছুটা হেরফের- আমার একান্ত দাবি,
চাই, তাকে চাই, শুধু তাকে উৎসবে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র-
বিপ্লবে তাকেই চাই সর্বদাই। আমার পোস্টার
মেলবে সুস্নিগ্ধ চোখ, হ’য়ে যাবে নবীন মাথুর।
প্যারাবল
নাড়েন সবল হাত ছুটে আসে নফরের দল
তড়িঘড়ি চতুঃসীমা থেকে। তাঁর প্রবল নির্দেশে
সমুদ্রে জাহাজ ভাসে, অবিরাম চাকা ঘোরে কল-
কারখানায়, তৈরি হয় সেতু দিকে দিকে; দেশে দেশে
নিমেষে জমান পাড়ি রাষ্ট্রদুতগণ, কারাগারে
জমে ভিড়, সৈন্য বাড়ে রাতারাতি, কানায় কানায়
ভ’রে ওঠে অস্ত্রাগার, এমন কি আগাড়ে ভাগাড়ে
শকুনের বসে ভোজ। কিন্তু ছোট কোমল ডানায়।
ভর ক’রে পাখি আসে ডালে তাঁর নির্দেশ ছাড়াই-
বিখ্যাত কোকিল। ডাকে অন্তরালে, নির্ভীক স্বাধীন।
হঠাৎ বলেন তিনি, ‘পাখিটাকে কী ক’রে তাড়াই?
থামা তোর গান, নইলে দেবো শাস্তি ওরে অর্বাচীন।
তবু সুর আসে ভেসে। কোকিল নয়কো কারো দাস,
কখনো পারে না তাকে স্তব্ধ করতে কোনো সর্বনাশ।