তুমিই গন্তব্য
সকালে গলির মোড়ে, দ্বিপ্রহরে রেস্তোঁরায়, অপরাহ্নে পার্কে,
সন্ধেবেলা বাস-স্টপে, মধ্যরাতে ইস্টিশানে কিংবা
গিজগিজে বাণিজ্যিক এলাকায়, দরজির দোকানে, ঘ্রাণময়
সেলুনে বকুলবনে, যেখানেই যখন ডাকোনা কেন তুমি,
তোমার কাছেই যেতে হয়।
কী শীত কী গ্রীষ্ম
সকল ঋতুতে
তোমার কাছেই যেতে হয়। নিমেষেই কী বিপ্লব
বিস্ফোরিত অস্তিত্বের নিঝুম পাড়ায়। অকস্মাৎ
অন্তরাল থেকে নীল পতাকা উড়িয়ে দাও আর
রক্তচক্ষু ট্রাফিক বাতির মতো পিতার নিষেধ,
মাতার কাতর অনুনয়,
হৈ হুল্লোড়ময় রাস্তার কিনারে ফেলে রেখে
তড়িঘড়ি পা বাড়াই তোমারই উদ্দেশে। বার-বার
ঝঞ্ছাহত চৈতন্যের দায়ভাগ নিয়ে
তোমার কাছেই যেতে হয়।
কোনো কোনো রাতে কাক না জাগার আগেই কী ছলে
আমাকে জাগিয়ে দাও। শোচনীয় পিপাসায় গলা
কাঠ হ’য়ে যায়, তুমি জলের বদলে স্পঞ্জ থেকে
বিন্দু বিন্দু সির্কা নিংড়ে দাও। কখন যে হেলাভরে
আমাকে দেয়াল ঠুকে খুন করো কর্কশ পেরেকে,
চৈত্য থেকে টেনে এনে আবার বাঁচাও-বোঝা দায়।
নিজের রক্তের নক্শা দেয়ালে মেঝেতে দেখে দেখে
কতো যে নিষ্ফল বেলা কাটে, পাই না তোমার সাড়া
বহুদিন। যেন তুমি নেই
ত্রিলোকে, ছিলে না কোনোদিন।
পুনরায় অকস্মাৎ বেজে ওঠে রক্তের ভেতর
সোনাটার মতো
তোমার গোপন টেলিগ্রাম।
আলুথালু গৃহিণী নদীকে
প্রবল আনেন ডেকে চোখে,
আমার পায়ের তটে আছড়ে পড়েন বার-বার,
মেয়েটা কেবলই টানে পাঞ্জাবির খুট আর আমি
যেন শক কিংবা হুন, দু’পায়ে মাড়িয়ে
আঁচল, পুতুল ছুটে যাই ভূতগ্রস্ততায়
যা’ কিছু সম্মুখে পাই
লন্ডভন্ড ক’রে সব ছুটে যাই। জানি,
তুমিই গন্তব্য চিরদিন।
কোন্ ইন্দ্রজাল ধরো অক্ষি তারকায়?
হাতের মুদ্রায়?
বাসি স্বপ্নে মশগুল তাজা যুবা, বিবেচক প্রৌঢ়,
এমনকি শ্লেষ্মা-কবলিত বেতো বৃদ্ধ,
যাঁর ভূরুসুদ্ধ কী রকম শাদা হয়ে গেছে, তারা
তোমার পেছনে ছোটে দিগ্ধিদিক, তবে
কেন আমি মিছেমিছি দাঁড়াবো সংকীর্ণ কাঠগড়ায়?
খেলাচ্ছলে ফেলে যাও আমার দুয়ারে
কী উজ্জ্বল রাঙা চিরকুট, বুঝি তোমারই ঠিকানা।
এবং আড়াল থেকে দ্যাখো খুঁজে পাই কিনা, দ্যাখো
অপার কৌতুকে
আমার সকল কিছু পাতালে ভাসিয়ে।
আমি তো কুড়িয়ে সেই লিপি সংসার শ্মশান ক’রে ছুটি।
বুকের ভেতর কম্পমান বেয়াল্লিশ বছরের ভীতু হাড়,
যদি বনবাদাড় পেরিয়ে, সারা রাত খাদ ঘেঁষে
হাঁটার পড়েও,
টপ্কে অজস্র কাঁটাতার
বৈদ্যুতিক বেড়া
আখেরে সেখানে গিয়ে তোমাকে না পাই,
যদি পৌঁছে যাই, হায়, ভুল ঠিকানায়!
নাটক
নাটক চলছে সগৌরবে আর দর্শকে দর্শকারণ্য, তিল
ধারণের ঠাঁই নেই কোনোখানে। কুশীলবদের অবয়ব
দৈত্যমার্কা নয়, যমদূত নয় ওরা, বাস্তবিক
মাটির মানুষই বলা চলে। দৃশ্যে আছে কিবা নেই,
বোঝা দায়। উইংস-এর আড়ালে নিপুণ
নেপথ্য-কথক অনর্গল আওড়ায় বাক্য বাক্যাংশ এবং
সেই মতো নানা কুশীলব কী যে বিড়বিড় করে প্রতি অঙ্কে।
দৃশ্য আছে ঠিকঠাক, অথচ তেমন নাটকীয়তাই নেই।
আমিও দর্শক এই নাটকের। জড়োসড়ো, বোকা ভঙ্গিমায়
আছি এক কোণে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি মেলে। কখবো না
চোখ বুজে থাকি, শুনি, বলে কেউ-নাটকটা মজাদার বুঝোছা বান্ধব?
প্রতি পদে ত্র্যাকশন দেখছো না? বিষম রোমাঞ্চকর লাগে।
নাটকের বিষয় বাস্তবধর্মী চমৎকার, মানে হত্যা।
রূপক প্রতীক নেই, ব্যাপারটা খোলামেলা খুবই।
এ নাটকে আগাগোড়া প্রতিটি দৃশ্যেই মনোহর
নানান খেলার সাজে হত্যা করে পায়চারি। কখনো সে করে
নান্দীপাঠ, কখনো বা ভূমিকা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়
নৈপুণ্যে বাড়ায় হাত, পিয়ানো বাজায়, মোমগন্ধী সুরে গায়
গান, ছড়ি নেড়ে নেড়ে স্বগত ভাষণে ওঠে মেতে,
মাথায় টুপিটা খুলে নিয়ে করে বাউ। হত্যা যেন
ফুরফুরে চড়ুইভাতি চৌরাস্তায় কিংবা বন-বাদাড়ে, টিলায়।
কখন যে গুলি কার খুলি চকিতে উড়িয়ে দেবে,
শীতল মাথায় কে বা খুন করতে করতে হেসে হবে খুন ,
পড়বে লুটিয়ে কৌচে অথবা ভায়ের
বন্ধুর গরম ঝটিতি রুমালে মুছে নিয়ে
গুনগুনিয়ে ফিরবে নিষিদ্ধ আস্তানায় ট্রালা লালা-
সঠিক যাবে না বলা। এ নাটকে হত্যা মানে চৈত্রে কি আশ্বিনে
বিকেলে পুকুর পাড়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরা অথবা ফুলের
পাপড়ি কিংবা গাছের সবুজ পাতা ছেঁড়া,
দাঁতে ঘাস কাটা।
এ নাটকে কুশীলব যখন তখন ছোঁড়ে পিস্তল, বন্দুক,
যেমন বালক সুখে বাগিয়ে সাধের টয় গান
যথেচ্ছ ট্রিগার টেপে। রুমাল চাপে না কেউ চোখে,
হেসে যাচ্ছে গড়াগড়ি; দর্শকেরা দেয় তালি কী উল্লাসে!
আমিও কি তাদের সামিল হবো? নিজের অজ্ঞাতে
তুমুল বাহবা দেবো পাত্র-পাত্রীদের? নাকি দ্রুত
সিট ছেড়ে চলে যাবো? লতার আড়ালে যাবো অলক্ষ্যে সবার
অথবা খুঁড়বো গর্ত, তুলবো মিনার? কিংবা নাট্যকার সমীপে ব্যাকুল
হাঁটু গেড়ে করজোড়ে করবো নিবেদন-নাটকের
বিষয়টা আগাগোড়া পাল্টে দিন হে দ্রষ্টা, হে স্রষ্টা দয়াময়!
নিরুপমার কাছে প্রস্তাব
বকুলতলায় যাবে? তুমি বড়ো সন্দেহপ্রবণ,
সেখানে, বিশ্বাস করো, সাপখোপ নেই, মাস্তানের
আড্ডা নেই। বিপদের আবর্তে তোমাকে কোনোদিন
ডোবাতে পারি না। পাখি আসে সেখানে এবং
কয়েকটি প্রজাপতি হয়তো-বা। কবিতার বই
ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পাশাপাশি পড়বো দু’জন।
সেকেলে টেকেলে যা-ই ভাবো, প্রাণ খুলে যত দুয়ো
দাও আধুনিকা, তবু তোমাকেই বকুলতলায়
নিয়ে যাবো; করো না বারণ। যদি পাখি না-ও ডাকে,
না-ও থাকে এক শিখা ঘাস সেই বকুলতলায়,
তবু নিয়ে যাবো। না, ওভাবে ফিরিয়ে নিও না মুখ,
ভেবো না আমার নেই কালজ্ঞান। বস্তুত আমিও
অনেক উত্তাল দীপ্র মিছিলে শামিল হ’য়ে যাই,
যখন ভিয়েতনামে পড়ে বোমা, আমায় হৃদয়
হয় দগ্ধ গ্রাম মেঘে মেঘে খুনখারাবির চিহ্ন
খুঁজে পাই; উপরন্তু বসন্তের পিঠে ছুরি মেরে
হত্যাকারী সেজে বসে আছি। কেন এ প্রহরে
তোমাকে হঠাৎ দূরে বকুলতলায় যেতে বলি?
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
আমার ভেতর এক দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া পরিব্যাপ্ত,
ভয়াল নখরময় প্রাণীকুল অন্তর্গত তন্তু
ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় সর্বক্ষণ এবং জীবাশ্মগুলো
জ্যান্ত হয়ে ওঠে ভয়াবহভাবে হঠাৎ কখনো।
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
বকুলতলায় ব্যাপ্ত আমার উধাও শৈশবের
উন্মুখর দিনগুলি, সেই রাঙা পবিত্রতা তোমার সত্তায়
মেখে দিতে চাই। তবু, হে মহিলা, তুমি কি যাবে না?