চেয়ার অস্বস্তিকর
চেয়ার অস্বস্তিকর, উঠে দাঁড়ালেও স্নায়ুতন্ত্রী
হয়না ঝংকৃত নিরাপদ মৃদু তালে, ফুলগুলি
ব্যর্থ আজ। উদ্বেগের খচখচে কাঁটা ক্রমাগত
বিঁধছে আমার মনে; ক্ষণে ক্ষণে হাওয়ায় হাওয়ায়
কেমন পাশব গন্ধ ভাসে, আমার দু’কাঁধে কিছু
বিসদৃশ ঘটে যাবে যেন! পাখনা গজাবে নাকি
অকস্মাৎ? আমি, শামসুর রাহমান, অবশেষে
কাফকার গ্রেগর শামসা হয়ে যাবো? আমি বড়ো
বেশি ছোটো হয়ে যাচ্ছি, মনে হয়; কীট পতঙ্গের
মতোই আমি কি তবে দেয়ালে বসবো? মৃত্তিকায়
খাবো লুটোপুটি কিংবা নোংরা শুঁড়ে নিয়ে নিরুদ্বেগ
নর্দমার ধারে উড়ে যাবো আবর্জনা ভালোবেসে?
ভাগ্যিস এসেছো তুমি এ মুহূর্তে, তোমার দৃষ্টির
স্পর্শে আজ আমার মনুষ্যরূপ রয়ে গেলো শেষে।
জীবশ্ম
ঘরের জন্যেই ঘুরি, সারাদিনমান ঘুরি, অথচ কোথাও
চার দেয়ালের কিংবা জ্যোৎস্না-ছাওয়া, রৌদ্রের গুঞ্জনময় কোনো
ছাদের নিশ্চিন্তি নেই। থিয়েটার গিয়ে দেখি, হায়,
এ কেমন বেয়াড়া উদ্ভট স্থান? মঞ্চ নেই, অভিনেতা নেই,
নেই দর্শকের ভিড়। একজন বিড়বিড় বিষম অস্পষ্ট
কী একটা পড়ছেন, খুব দ্রুত ওল্টাচ্ছেন পাতা, হয়তো বা নাট্যকার,
কিন্তু পান্ডুলিপি তাঁর বর্ণমালাহীন। কী-যে হয়,
আমি বাগানের কাছে যেতে চেয়ে নিষ্পাদপ মরুন গভীরে
চলে যাই। নক্ষত্রপ্রতিম পত্রপূর্ণ
গাছ দেখবো না কোনখানে, এ কেমন বেখাপ্পা বসতি?
ওখানে কে পড়ে আছে, অধো মুখ, দোমড়ানো টিনের মতন?
কাটা সেপাইয়ের ভাগ্যের ভূগোল কাঁটাতার-দীর্ণ,
নির্দয় কর্দমময়। তার কাছে ফুল হাতে যাই,
ফুল ধুলো হ’য়ে যায়। তবে কি আমিও
ধস্-আতংকিত
খনি-শ্রমিকের মতো ভূ-গর্ভস্থ কয়লার দেয়ালে
ভীষণ আটকা পড়ে গেছি উদ্ধারের অতীত? তবে কি
আঙুল রক্তাক্ত ক’রে লুপ্ত হবো খনিজ আড়ালে?
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে-জমিনও আজ
যথেষ্ট অনড় নয়, খুঁটিগুলো কেবলি এলিয়ে পড়ে। দৃঢ়
ভূমি কোথাও কি নেই? যেদিকে তাকাই,
সাগর শুকিয়ে যায়, ঝরনা রূপান্তরিত পাষাণে,
মায়ের সিন্দুক প্রতিধ্বনিময় গুহা, অশরীরী
তান্ডবে দুঃস্বপ্নাকীর্ণ। তাকালে গাছের দিকে, পাতা
পোড়া মাটি হয়ে ঝরে, শেকড় সাপের মতো ফণা তুলে আসে।
এমন কি তোমাকেও দেখি না মিটিয়ে তৃষ্ণা, পাছে
তোমার গহন ঐ নয়ন পল্লব ভস্মীভূত হয়, তুমি
নিমেষে জীবাশ্ম হয়ে যাও।
তক্ষক
আমার ঘরে ডাকে, রাত্রিদিন ডাকে
ভয়াল সুরে এক চতুর তক্ষক।
স্বস্তি নেই মনে, ঘুরছি এলোমেলো,
অথচ সে-ই নাকি আমার রক্ষক!
নানান ছলে তার সঙ্গে অবিরাম
খুঁজছি বস্তুত সুযোগ সন্ধির।
ভীষণ তার ডাকে নিয়ন্ত্রিত আমি,
বাস্তবিক এ জীবন বন্দীর।
অন্ধকার যেন জ্যান্ত অতিশয়,
চতুর্ধারে আলো এখন কী দুস্থ।
ধ্বস্ত চোখ মুখ, চৈতন্যে আঁধি;
ঘুরছি নরলোকে একাকী, অসুস্থ।
রক্তে জমে শুধু তুষারকণা, প্রাণে
শংকা সর্বদা গুপ্ত হত্যার
দিগ্বলয়ে ঘোর মত্ত বৈশাখী,
কাঁপছে থরোথরো ভিত্তি সত্তার।
দুঃস্বপ্নে চেনা শহর লুণ্ঠিত;
অগ্নি ক্রমাগত করছে বনগ্রাস।
রণচন্ডী মাটি দেয় না নির্ভর,
নিখিল প্রাণীকুলে ব্যাপক সন্ত্রাস।
এড়াতে পারিনা যে ঘরের শক্রুকে;
আড়াল থেকে দ্যাখে চতুর তক্ষক।
দেয়ালে ঠুকি মাথা, কখনো ঢাকি মুখ,
তবে কি সে-ই হবে আমার ভক্ষক?
তবে মননেও
আড়ালেই থাকি, ত্রস্ত সর্বদাই; ব্যস্ত ভিড় ঠেলে
কবুই ভরসা ক’রে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া আজো
হলো না আমার। পাদপ্রদীপের আলো কোনোদিন
পড়বে না মুখে জানি। তা ব’লে ভাগ্যের কথা তুলে
বারোমাস কাউকে দিই না দোষ। হাটে মাঠে নয়,
মৃদু আলো-আঁধারিতে গৃহকোণে একা একা কাটে
প্রায়শ আমার বেলা। খেয়ালের বশে বাস্তবের
সঙ্গে খেলি কানামাছি-লেখার টেবিলে অকস্মাৎ
দেখে ফেলি ডোরাকাটা উদ্দাম জেব্রার দল কিংবা
গন্ডারের একরোখা দৌড়, কখনো লেগুন নম্র
ওঠে জেগে আদিম জলের মায়া নিয়ে। স্নানার্থিনী
কটি থেকে দেয় ছেড়ে প্রাচীন বাকল, প্রেমবিদ্ধ
বংশীবাদকের সুরে পাথর, মরাল আসে ছুটে,
সিংহ আর মেষ থাকে শুয়ে পাশাপাশি, কখনো বা
জিরাফ বাড়ায় গলা বইয়ের পাহাড় ফুঁড়ে, দেখি
বারংবার টেবিলের ইন্দ্রজালঃ ট্রয়ের প্রাচীর
শালের ঘর্মাক্ত আলোয় বড়ো বেশি নিঃস্ব, যেন
প্রেতপুরী; এক কোণে বাংলার মাটিলে ঘর
প্রস্ফুটিত, অন্যদিকে পদ্যাক্রান্ত নিশি-পাওয়া কাফে।
বইয়ের পাতায় খুঁজি মুক্তির সড়ক বদ্ধ ঘরে
প্রত্যহ, তত্ত্বের ঢক্কা নিনাদে কখনো কানে মনে
লাগে তালা; অহর্নিশ মননের রৌদ্রজলে বাঁচা
সার্থক মেনেছি, তবু জানি সারাক্ষণ দর্শনের
গোলক ধাঁধায় ঘুরে তথ্যের খড়-বিচালি ঘেঁটে
ক্লান্ত লাগে, বুদ্ধির সম্রাট ভয়ানক মুখোশের
আড়ালে প্রচ্ছন্ন থেকে হানেন সন্ত্রাস। বাস্তবিক
মননে থাকলে মেতে সর্বদা অথবা শিল্পে ম’জে
রইলে অগোচরে মনে জটিল অরণ্য জেগে ওঠে,
জীবন-বিরোধী শ্বাপদের খুরে মগজের কোষ
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। তাই বদ্ধ ঘর ছেড়ে দূরে
মাঝে-মধ্যে যাওয়া ভালো, ভালো সূর্যাস্তের স্তবময়
টিলায়, নদীর শান্ত বাঁকে যাওয়া। তবে মননেও
খেলবে উদার হাওয়া, শিল্প হবে দীপ্র, মানবিক।
তিনি সূর্যাস্তের লোক
তিনি সূর্যাস্তেরই লোক; অবশ্য অজস্র সূর্যোদয়
সত্তায় রেখেছে জমা অন্তর্লীন আভা, ছড়িয়েছে
প্রাণবীজ পলে পলে তন্তুতে তন্তুতে আন্তরালে,
তবু অস্তরাগ
ডাক দেয় তাঁকে বারবার। এত যে কুহক আছে
সেই বর্ণময় নিরুচ্চার ডাকে, তিনি
জানেন নি আগে।
বেশভূষা জীর্ণ আভিজাত্যের সুদূর ঘ্রাণে ভরপুর, চোখে
দেয়ালে দেয়ালে খোজে চিত্রমালা পূর্বপুরুষের। কখন যে
চোখের দিগন্তে মেঘ জমে ম্লান রক্তজবার মতন, প্রাণে
সুরেলা ধ্বনির প্রেত নেচে ওঠে, দর্পণে দর্পণে
প্রতিবিম্ব নানা দোলাচলে ভাসমান অপসৃত।
কখনো-বা ফ্রয়েডীয় লোকে
নিজের অস্তিত্ব কী উদ্ভভট
ঘেরাটোপে ছায়াচ্ছন্ন দেখে চমকে ওঠেন খুব, বারবার
পালা ক’রে দ্বৈত সত্তা যায় হেঁকে কর্কশ প্রান্তরে,
কখনো নদীর বাঁকে কখনো অরণ্যে, কখনো বা
বালিয়াড়ি ঘেঁষে, চোরাবালিতে কখনো।
রুমালে চাপেন নাক যখন তখন। পচা গন্ধে
টেঁকা দায় ভেবে নক্শাময় আলমারি খুলে তিনি
আতরের উজাড় শিশিটা নেড়ে চেড়ে হয়ে যান
দীর্ঘশ্বাস, দুর্গন্ধের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন ক্রমশ,
অথচ নাছোড় গন্ধ করছে বিব্রত তাঁকে রাত্রিদিন।
বুঝি এই স্বস্তি তাড়ানিয়া
গন্ধ তাঁর অস্তিত্বেরই। তবে কি নিজেরই শব ব’য়ে
বেড়াচ্ছেন ভাবলেশহীন? ধ্বংস্তূপ
অথবা পাখির
দগ্ধ বাসা চোখে পড়লেই স্বগৃহের কথা মনে পড়ে তাঁর।
এখনতো চোখ নেই গ্রন্থের পাতায় কিংবা জরুরি দলিলে,
আপাতত নিসর্গের মিতালিতে নিস্পৃহ, কী এক
নিষ্করুণ শোভাযাত্রা দৃষ্টির সম্মুখে। দেখছেন অতিদ্রুত
গজাচ্ছে বিষাক্ত প্রাণীভুক গাছ বসতবাটির
চতুর্ধারে, আর পরগাছা ক্রমশ উঠছে বেড়ে
নিজেরই শরীরে তাঁর, কংকালের বুকে কাক জুড়েছে পাঁচালি।
বারান্দায় পায়রার ঝাঁক
বাজপাখি হয়ে তেড়ে আসে, নিরীহ পুতুলগুলো
হয়ে যায় ঘাতকের মতো অবিকল, দেখছেন
তিনি; শয্যাতল থেকে কতিপয় মৃত নীল হাত
শূন্য পেয়ালার দিকে কেবলি পৌঁছুতে চায়, পদহারা
জুতোগুলো নৃত্যপর চতুর্দিকে, কড়িকাঠে অসংখ্য যুবতী
দমবন্ধু ক্রূর অবেলায়
উদ্বন্ধনে ভয়ানক নিষ্প্রভ এবং আশেপাশে
পুরোনো সিঁড়ির ধাপে বারান্দায় ছাদে দন্তহীন
বৃদ্ধেরা ক্রন্দনরত, উন্মত্ত শিকারী কুকুরের
পাল ক্রমাগত
খুঁড়ছে ঘরের মেঝে, তিনি দেখছেন। চোখে তাঁর
উৎসবমুখর নৌবহর ডুবে যাচ্ছে এবং বুকের মধ্যে
ভস্মীভূত ঘরবাড়ি, জঠরে ক্রোধান্ধ বাঘ, রুক্ষ
মরুভূমি প্রসারিত ঘরে।
আতংক বিলাস নয় তাঁর, বাস্তবিক
ভীতির পেরেকে কন্টকিত সত্তা, কবন্ধের দল
স্মৃতির ওপরে কুচকাওয়াজ করছে অবিরাম।
তিনি তো দর্পণ স্বকালের।
শোনেন অবাক হয়ে কতো
নতুন শব্দের ঝাঁক, নব্য গায়েনের নীলাম্বর-ছোঁয়া স্বর
কেমন অস্বস্তিকর অথচ বাঁচার মীড়ে মীড়ে
ঝংকৃত পথের ধারে। কেউউ ‘সূর্যাদয় চাই’ বলে
চৌরাস্তায় আকর্ষণ করে ভিড় আর
বিষাদের প্রতিমূর্তি তিনি
জনশূন্যতায় বন্ধ আপন প্রকোষ্ঠে
নিজেকে মেশান শুধু দূরগামী মেঘে, তিনি সূর্যাস্তেরই লোক।