খুলোনা এ মুখ
তোমাকে দেখলে ভয় পাই খুব, বুকের ভেতর
অশ্বক্ষুরের প্রখর শব্দ, জাগে কলরব
প্রাকারে প্রকারে। ক্রূদ্ধ মশাল, কাঁপে থরথর
ঘুমধরা হাড়, চোখে ভাসমান বেকসুর শব।
তোমার অমন ভবিষ্যময় চোখে তাকালেই
পারমাণবিক ভস্ম আমাকে করে দ্রুত গ্রাস
হাতড়ে হাতড়ে কোনো সূত্রের পাই না যে খেই,
পায়ের তলায় মাটি অস্থির, বর্বিত ত্রাস।
দোহাই তোমার এক্ষুণি ফের খুলোনা এ মুখ।
ফস ক’রে তুমি কী যে ব’লে দেবে, দেয়ালের দিকে
তর্জনী তুলে স্তোত্র পাঠের উদাত্ত সুখ
চোখে নেবে কিছু হয়তো আনবে কাল-রাত্রিকে।
তোমার ভীষণ ভাবী কথনের নেই কোনো দাম
মাঠে কি পার্কে, কলোনীতে, মেসে, গলির গুহায়।
আত্মাকে ঢেকে খবর-কাগজে যারা অবিরাম
প্রমত্ত তারা দেয়ালে কিছুই দেখে না তো, হায়।
অন্যে বুঝুক না বুঝুক আমি জানি ঐ ঠোঁট
নড়লেই কালবৈশাখী দেবে দিগন্তে হানা,
প্রলয়ের সেনা গোপনে বাঁধবে নির্দয় জোট
হত্যার সাথে, ঝাপটাবে খুব নিয়তির ডানা।
তুমি বলেছিলে, জননী তোমার কুক্কুরী-রূপ
পাবে একদিন, জনক সর্বনাশের বলয়ে
ঘুরপাক খেয়ে হবেন ভীষণ একা, নিশ্চুপ;
নগরে ধ্বনিত হবে শোকগীতি লম্বিত লয়ে।
দেবতা তোমার জিহ্বায় কেমন অভিশাপ ঘিরে
দিয়েছেন, তার ছায়ায় প্রতিটি গহন উক্তি
ধ্বংস রটায় আধা-মনস্ক মানুষের ভিড়ে
খুলবে না মুখ-এলো করি এই চরম চুক্তি।
গন্ডার গন্ডার
বাঁচতে পারবে? কী করে বাঁচবে? চৌদিকে ক্রূর
কী একটা যেন তোমার গন্ধ বেড়াচ্ছে শুঁকে;
বুঝি ছায়াটাও কালো ইস্পাতী নখর-ফলায়
ফেলবে উপড়ে। বাইরে সদাই কতো সুচতুর
ফাঁদ পাতা থাকে, কন্টকময়; সুখে কি অসুখে
নির্বান্ধব, বেখাপ্পা তুমি চলায় বলায়।
কাদায় নুড়িতে এবং খোয়ায় নিজের রক্ত
দেখেও তোমার শিরায় গলিতে তুহিন প্রবাহ
বয় না, শুধুই লোহার অনেক হিজিবিজি শিক
চোখে এঁটে দেয় খাঁচার নকশা। আর অলক্ত
ভ্রান্তিবশতঃ মগজের ঝোপে হানে দাবদাহ।
জটিল ধোঁয়াটে স্বপ্নগুহায় ঘোরে বৃশ্চিক।
আত্মগোপন করতে কি চাও পাতার লুকোনো
সবুজ দুর্গে? বৃক্ষ মাচায় পাবে আশ্রয়?
সঙ্গ নেবে কি পাতালনিবাসী কাঁকড়া কোনো?
নিসর্গপ্রীতি আর বিপদের বিবাদ চুকোনো
সহজ তো নয়। বস্তুত তুমি খুঁজছো অভয়
তীব্র সত্তা-সঙ্কটে এই বিজনে এখানে।
বাদামের খোলে ঢুকেও তোমার নেই নিস্তার।
অলিগলি আর সদর রাস্তা, বাস ডিপো আর
জাহাজঘাটের মাটি ফুঁড়ে ঐ আসছে কেবল
আসছে উড়িয়ে ধুলোবালি ক’রে ত্রাস বিস্তার।
চৌদিক থেকে আসছে নিয়ত রাগী গন্ডার
হাজার হাজার; রৌদ্রে খড়্গ করে ঝলমল।
বৃথাই লুকোনো, বরং পাতার দুর্গপ্রাকার
গাছের কোটর কিংবা শুকনো বাদামের খোল
থেকে দ্বিধাহীন বেরিয়ে আসাই শ্রেয় অবশ্য।
গন্ডার শুধু গন্ডারে আজ সব একাকার,
খণ্ডিত তুমি নিরুপায় শোনো ধ্বংসের রোল;
তোমার বিলয়ে ফলবে অন্য কারুর শস্য।
গৌণ শিল্প
আমার ব্যর্থতা, কালো, সাংকেতিক ব্যর্থতা কখনো
লতাপাতা কিংবা পাখপাখালির আড়ালে লুকিয়ে
থাকে, কখনো-বা
ওষ্ঠের কিনারে তিক্ত স্বাদ রেখে যায়।
আমার নৈবেন্য নেয় বারবার ব্যর্থতার হা হা এভেনিউ।
শব্দ কতিপয়,
অসফল, দিশেহারা, বুঝি পিতৃমাতৃহীন পথের সন্তান,
এলেবেলে খেলে মৃত অন্ধকারে, ঘুমায় কবরে।
লতাগুল্মময় কবরের পাশে নতজানু কম্পমান, ডাকি
বারবার ঝোড়ো হৃদয়ের তীব্র আর্তি নিয়ে, ওরা
নিঃস্পন্দ নিঃসাড় যেন মেঘের আড়ালে বিকলাঙ্গ চন্দ্রকণা
অথবা এমন লখিন্দর যার গলিত শরীরে
পারবে না চল্কে দিতে প্রাণধারা বেহুলা কখনো।
ওদেরতা চমৎকার সেজেগুজে, শার্টের কলার
উল্টিয়ে শোভন আর টুপিতে পালক গুঁজে পথে
বেরুনোর কথা ছিলো,
কথা ছিলো, ওরা যাবে ড্রইংরুমের সুশীতল পরিবেশে,
বসবে সোফায়, লাল গালিচায়, দেবে জুড়ে নিভৃত আলাপ,
কথা ছিলো, ওরা যাবে ভেজা-ভেজা অন্ধকারময় গ্রন্থাগারে,
মেলাবে আপন হাত তত্ত্বপরায়ণ, তথ্যঠাসা অধ্যাপকদের সঙ্গে,
তরুণ তরুণীদের ভিড়ে করবে রগড় পার্কে করিডরে
আলো আঁধারিতে
কাফেটারিয়ায়,
কথা ছিলো, ওড়াবে অজস্র টিয়ে বাণিজ্যিক এলাকার লাল
পেট্রোল পাম্পের কিছু সম্ভ্রান্ত ওপরে,
মধ্যবিত্ত ছাদে, চিলেকোঠায় গলির মোড়ে আর
খবরের কাগজের হুজুগে পাড়ায়,
অথচ এখন ওরা লতাপাতা কিংবা পাখির ডানার
অথবা ঠোঁটের ছায়াচ্ছন্নাতায় গভীর লুকোনো
এবং তাদের সঙ্গে আমার শ্যামল শৈশবের কিছু বেলা
যৌবনের অলৌকিক রথ,
দীপ্র, ভগ্ন, স্মৃতি আচ্ছাদিত, শ্যাওলায় কারুময়,
আমার আশার কীর্তনিয়া
করেছে প্রস্থান গৌণ শিল্পের আড়ালে।
চতুর্দপদী
পায়রার পালকের রোদ তোমার হাতেরও রোদ,
দেয়ালের শ্যামলিমা তোমার মুখেরও শ্যামলিমা।
যখন দোয়েল শ্যামা ডাকে, অস্তিত্বের চতুঃসীমা
তোমার সঙ্গীতময় হয় অনুরূপ; অনুরোধ
করে চন্দ্রমল্লিকার কোমলতা তোমার নিকট
বিশদ থাকার জন্যে, অথচ সত্তায় হু হু চিতা
সর্বদা বেড়াচ্ছো ব’য়ে হে বিষাদময়ী, হে বনিতা
নৈঃসঙ্গ্যের। ধোঁয়াক্লিষ্ট হৃদয়ের কাটেনা সঙ্কট।
চাইনা তোমাকে বন্দী করুক অসিত হাহাকার।
আমিতো নির্লিপ্তিপ্রিয় নই; নিশ্চিত আমিও চাই
ঝরুক আমার বৃষ্টি তোমার চিতার রূপানলে,
তোমার সত্তায় হোক ব্যাপ্ত বকুলের শিষ্টাচার।
দু’হাতে কুড়িয়ে স্বেদমুকুলিত প্রহরের ছাই
বলবো না, প্রেম মুঞ্জরিত কেবল দাহঘ্ন জলে!