করাঘাত হওয়া চাই
আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই,
করাঘাত হওয়া ভালো। যদি
কোনো বন্ধু-বান্ধব হকার কিংবা গয়লা
আমার আপন দরজায় এসে কড়া নাড়ে কখনো সখনো,
খুব ভালো হয়।
কিন্তু কেউ চুপচাপ এসে চলে গেলে বন্ধ দোরে
রেখে গেলে এক গুচ্ছ ফুল
কিংবা চিরকুট শব্দহীন,
আমি সেই উপহার কখনো গ্রহণ করবোনা।
আমি তো আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে আচমকা
করাঘাত চাই।
নইলে চতুর্দিকে ব্যস্তবাগীশ উইয়ের ঝাঁক ‘প্রভু প্রভু’ শব্দে
গড়বে বল্মীক কতো, আমি
অতিশয় ঢাকা পড়ে যাবো।
বৃক্ষের ছায়ায় ভিন্ন গাছ
পক্ষীর ডানায় অন্য পাখি
তটিনীর গহনে অপর নদী দেখে, মৃত্তিকায়
নক্ষত্রের গুঁড়ো মেখে, গন্ডদেশে ধেনো শিল্পরসের উদাস
চটচটে দাগ নিয়ে খোয়ারিতে ম’জে
বসবাস করতে করতে আজীবনের সঙ্গে তুই তোকারিতে মেতে
অনেক সোনালি সুতো ছিঁড়ে খুঁড়ে
জীবনেরই বিরুদ্ধে বিপ্লবী হয়ে যাই।
তখন আমার দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই।
কৃষ্ণকলি নৈঃসঙ্গ্যের ওষ্ঠ থেকে ওষ্ঠ তুলে
কখনো বলিনা-
লোকালয় আমার ভেতর
প্রবেশ করুক।
আমার নিজের মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্যের মতন
রেখেছি যেসব উপদ্রব জমা, তাড়ানো সহজ নয় তাদের কখনো;
ওদের বিশদ তাড়নায় আমি রণক্ষেত্রে পারতাম যেতে
পারতাম মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ফোয়ারা খুলে দিতে,
পারতাম মেরু অভিযানে হতে স্কটের দোসর, পারতাম
সইতে ক্রূর তুষার-কামড়।
কিন্তু শুধু সারাবেলা মগজে ভ্রমর নিয়ে পুরোনো চৌকাঠে
চন্দন বুলোই, ফুলপাতা হয়,
কখনো কারুর
অলৌকিক মুঠোয় নিমেষে চলে যাই বার-বার।
সেই মুঠো থেকে
কখনো সখনো আমি নিষ্কৃতি প্রার্থনা করি ব’লে
আমার আপন দরজায় মাঝে-মধ্যে করাঘাত হওয়া চাই।
কিংবদন্তী
ধারে কাছেই একটা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে,
সেখানে রোজ নিরিবিলি চাইতো যেতে।
কিন্তু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
ফটকে নেই দৈত্যপানা মুখের মানুষ,
কুকুর টুকুর নেইকো কিছুই;
সকালবেলা কিংবা কোনো রক্তজবা-কমান গোধূলিতে
কিংবা ঝোড়ো হাওয়ার রাতে সেই বাড়িতে
তবু আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
সেই বাড়িতে থাকে যারা, নয়তো তারা শত্রু আমার।
তীক্ষ্ম ছুরি, কিংবা ধরো বিষের পাত্র
আমার জন্যে রাখে না কেউ।
কিন্তু তবু এই আমিটার সত্যিমিথ্যে
সেখানে হায় হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
সেখানে এক নিরুপমা বসত করে
চারদেয়ালের অন্তরালে।
সুরের মিহি নকশা দিয়ে সাজায় প্রহর মনের মতো,
শূন্যে ফোটায় রক্তগোলাপ হৃদয় যেন।
গাছের পাতায় আদর রাখে ইতস্তত।
শেখায় কথা কেমন সুরে দাঁড়ের সবুজ পাখিটাকে।
নিরুপমার ভোরের মতো হাসির ছটায়
দেয়ালগুল এক পলকে
উৎসবেরই নামান্তর।
কখনো ফের সেই বাড়িটা রাত্রিমাখা
উদাসী এক মেঘ হ’য়ে যায়
যখন সে তার কান্নাপাওয়া শরীরটাকে
দেয় লুটিয়ে শূন্য খাটে।
সিংদরজায় অদৃশ্য দুই পশু আছে,
তাদের মুখে লুপ্ত চাবি।
কোন্ খাবারে তৃপ্ত কেবা, নেই কো জানা;
তাইতো দুয়ার বন্ধ থাকে
এবং আমার হয় না যাওয়া কোনোদিনই।
কী পরীক্ষা নেবে?
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
হাতে জপমালা নেই, তবু
আমি তো তোমার নাম মন্ত্রের মতন
করি উচ্চারণ সর্বক্ষণ। যেখানে তোমার ছায়া
স্বপ্নিল বিলাসে
অপূর্ব লুটিয়ে পড়ে, সেখানে আমার ওষ্ঠ রেখে
অনেক আলোকবর্ষ যাপন করতে পারি, তোমারই উদ্দেশে
সাঁতার না জেনেও নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন
গহন নদীতে নেমে যেতে পারি।
তোমার সন্ধানে ক্রোশ ক্রোশ দাউ দাউ পথ হেঁটে
অগ্নিশুদ্ধ হতে পারি, পারি
বুকের শোণিতে ফুল ফোটাতে পাষাণে।
যখন পাথরে হাত রাখি,
পাথর থাকে না আর অরূপ পাথর,
হয়ে যায় প্রতিমা তোমার।
যখন বৃক্ষের দিকে দৃষ্টি মেলে দিই,
বৃক্ষ হয় তোমার শরীর।
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায় এক বুক উপদ্রব নিয়ে থাকি,
ব্যাকুলতা বারবার সিঁদ কেটে ঢোকে,
হৃদয়ের ঘরগেরস্থালি, বনস্থলী
লুট হয়ে যায়
প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায়, আমি তাই তুমি ছাড়া কারুর জন্যেই
পারি না অপেক্ষা করতে আর।
ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার ওষ্ঠজাম, তুমি না থাকলে
আমার সকল চুমো যাবে বনবাসে,
তোমার অমন হাত স্পর্শ ক’রে ছুঁয়েছি স্বর্গের
মল্লিকাকে, তুমি চ’লে গেলে
আমার ছোঁয়ার মতো অন্য কোনো হাত থাকবে না আর।
এর পরও অনুরাগ নিক্তিতে মাপতে চাও, চাও
আমার পরীক্ষা নিতে নানা অছিলায়?
আর কি ভোগ চাও? এক একে নির্দ্বিধায়
সবি তো দিয়েছি।
হৃদয়ের আসবাবপত্তর সবি তো
স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে চাই, তবু কেন যাবতীয়
সম্পদ আমার
ক্রোক করবে বলে নিত্য আমাকে শাসাও?
আমি তো তোমাকে সুখ দিতে চয়ে কেবলি নিজের
অসুখ বাড়াই।
মাটি ছুঁয়ে বলছি এখন,
এই বৃক্ষমূলে আমি শীর্ণ হই, অন্ন আনি নিজে,
কান্নায় ধোওয়াই পদযুগ।
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার?
আমার সম্মুখে তুলে ধরো বিষপাত্র,
নিষ্পলক দ্বিধাহীন নিমেষে উজাড় করে দেবো।
কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ
সকল সময় নয়, কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ
তোমাকে হাওয়ার পাই, পাই সিগারেটের ধোঁয়ায়।
কখনো দরজা খুলে দাঁড়ালেই স্মিত অন্ধকারে,
কখনো বা সুরভিত বারান্দায় মৃদু চন্দ্রলোকে,
গোলাপের অন্তঃপুরে, কখনো সড়কে, মৃত্যু আর
জীবনের গুঞ্জরণময় হাসপাতালের বেডে
সহসা তোমাকে দেখি। গাছগাছালির অন্তরালে
মেঘের উড্ডীন দ্বীপে, এমন কি গোষ্পদেও তুমি।
তুমি এলে আমার চৌদিকে অবলীলাক্রমে দৃশ্য
কেবলি পাল্টাতে থাকে, তুমি এলে হাজার হাজার
নক্ষত্রের তোড়া আমার সম্মুখে দীপ্র উপস্থিত,
সুনীল সমুদ্র ওঠে দুলে, দিগন্তের পাড় চিরে
উদ্ভাসিত জাহাজের গর্বিত মাস্তুল; নীল জলে
কুহকের কেশপাশ, জাগে প্রতিধ্বনিময় দ্বীপ।
তুমি এলে একরাশ ভেলভেটপ্রতিম গোলাপ
মোহন আলাপে মাতে বেহালার সাথে, মাথাভরা
অজস্র উকুন নিয়ে রুক্ষ্ম, একাকিনী ভিখারিনী
খিস্তি খেউড়ের মধ্যে অকস্মাৎ পুঁটলি দুলিয়ে
গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান এবং ভাগাড়ে কতো
পোকাকীর্ণ পশুর নিথর চোখে ভাগবত লীলা!
তুমি এলে কংকালের দশটি আঙুল ঘুণধরা,
হিহি অন্ধকারে নেচে ওঠে অর্গানের রীডে রীডে।
কতদিন তোমার জন্যেই ধুই সিঁড়ি অনুরাগে,
সযত্নে সাজাই ফুল করোটিতে, পোড়াই লোবান,
জ্বলে বাতি পিলসুজে কিন্তু তুমি আসো না তখন।
যখন প্রস্তুতি নেই, আয়োজন-রহিত যখন
আমি, এলোমেলো, বিভ্রান্তির চক্রে ঘূর্ণমান রুক্ষ,
তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ো কী প্রবল আমার ওপর।
চুমোয় চুমোয় রক্তে বাজাও দীপক, দৃষ্টি মেলে
তোমার উদ্ভিন্ন দিকে ভাবি শুধু, তুমি কি এমনই?
তোমার সুগন্ধে আমি এতো বার হই সমাচ্ছন্ন,
তোমারই ভেলায় ভাসি, তবু আজো তোমাকে বুঝি না।