লেনদেন
হঠাৎ তিনি আমার স্মৃতির বনস্থলি রোমাঞ্চিত
করলে আমি প্রবেশ করি ছেলেবেলার শ্যামল মুঠোয়।
চোখের কোণে হারিয়ে-যাওয়া সুদূর চোখের, শীর্ণ হাতের,
তাঁর সে গায়ের হলদে কোটের ইতস্তত ঝলক লাগে।
হলদে কোটে কেমন যেন চুরুট চুরুট গন্ধ ছিলো,
চোখের কোণে সে কোন্ ঝিলের ইস্পাতী এক ঝিলিক ছিলো।
টাঙ্গি হাতে ভালুক টালুক খুব মেরেছেন হেলায় ফেলায়-
তাঁর বিষয়ে আরো বহু এমনিতরো গল্প ছিলো।
হলদে কোটের সিংহপুরুষ সুদূর আমার ছেলেবেলায়
দিয়েছিলেন হাতে তুলে একটি পুতুল, মনে পড়ে।
মনে পড়ে, পুতুলটাকে কোথায় যেন, কখন যেন
হারিয়ে ফেলে সেই ছেলেটা দুঃখ খুবই পেয়েছিলো।
তেমন পুতুল আর দেখিনি ভূভারতে, দোকান-পাটে
তন্ন তন্ন করেও আমি পাইনি খুঁজে দেশ-বিদেশে।
তেমন পুতুল ঝরে শুধু অলৌকিকের মুঠো থেকে?
স্মৃতির সুতোয় লটকে থাকে নীল্চে নীল্চে দুর্বলতা।
সেই যে তিনি পুতুল দিয়ে সাত সকালে নিলেন বিদায়
আর দেখিনি তাঁকে আমি এই শহরে, অন্য কোথাও।
তখন থেকে খুঁজছি তবু দেননি তিনি আমায় দেখা,
জ্বলছে মনে ভিন্ন কালের হলদে কোটের উদাস আভা।
যদি তাঁকে একটা কিছু দিতে পারার একটুখানি
সুখের সময় পেতাম তবে ধন্য হতাম রুক্ষ বেলায়।
তাঁরই জন্যে দুঃখ-সুখের পদ্য বিছাই দোরে দোরে,
হঠাৎ যদি বিবাগী সিএ বর্ষীয়ানের চোখে পড়ে!
শান্তি পাই
যখন তুমি অনেক দূরে থেকে
এখানে এই গলির মোড়ে আসো,
উঠোনে দাও পায়ের ছাপ ত্রঁকে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি দেহের বাঁকে বাঁকে
স্মৃতির ভেলা ভাসাও, তোলো পাল,
মুক্ত করো যমজ পায়রাকে
শান্তি পাই।
যখন তুমি আমার পিপাসায়
নিমেষে হও আঁজলাভরা জল,
দৃষ্টিজাল ছড়াও কী আশায়,
শান্তি পাই।
যখন তুমি ঠোঁটের বন্দরে
বিছিয়ে দাও গালিচা রক্তিম,
প্রভাত জ্বালো চোখের কন্দরে,
শান্তি পাই।
ঝঞ্ঝাহত উজাড় এ বাগানে
আন্দোলিত তুমিই শেষ ফুল!
জাগাও তুমি সবুজ পাতা প্রাণে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি দুপুরে ঘুমে আসো,
তোমার বুকে অতিথি প্রজাপতি;
থম্কে থাকে ভয়ে সর্বনাশও,
শান্তি পাই।
যখন তুমি জলের গান হয়ে
আমার দেহে আমার মজ্জায়
কী উজ্জ্বল জোয়ারে যাও ব’য়ে,
শান্তি পাই।
যখন তুমি আমার ঠোঁটে রাখো
একটি লাল গোলাপ, আত্মায়
ঝরাও পাতা আবেগভরে ডাকো,
শান্তি পাই।
যখন তুমি হাওয়ায় দাও মেলে
তিমির-ছেঁড়া আমার এ পতাকা,
কিংবা আসো বিরূপ জল ঠেলে,
শান্তি পাই।
সে-রাতে আমার ঘরে
সে-রাতে আমার ঘরে এক ঝাঁক উৎফুল্ল জোনাকি
বললো এসে-একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অন্তর্হিত জোনাকির পরে একটি বাদুড় খুব
আনন্দে ঘনিষ্ঠ হয়ে কড়িকাঠে জানালো সস্নেহে-
একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে। অনন্তর
একজন মহিলার মুখ জানালায় ফুটে ওঠে,
নীলিমানিমগ্ন সুর তার ভাসে, যেন সমুদ্রের
ফেনাময়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
সেই স্বর ডুবে গেলে কতিপয় প্রাচীন কংকাল
কবরের মাটি ফুঁড়ে, ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে এসে
বললো গাঢ়ঃ একটি কবিতা দিতে এসেছি তোমাকে।
অথচ শব্দের দূত ওড়ায়নি তখনো নিশান,
তখনো অদৃশ্য ওরা প্রেতলোকে, জীবাশ্মের মতো
স্তব্ধ, আমি প’ড়ে থাকি এক কোণে, ব্যর্থ অসহায়।
হে প্রিয় কল্পনালতা
কখনো কখনো ওরা আসে না, আবার কখনো বা
যুদ্ধ-ফেরতা সৈনিকের মতো এসে পড়ে, রচে শোভা
শূন্যতায়; মগজের পুকুরে সাঁতারপ্রিয় হৃদয়ের তন্ত্রী
কী রুদ্র ঝংকারে ছিঁড়ে সুবিস্তৃত রৌদ্রের ভেতরে যায়, যন্ত্রী
হ’য়ে ঘোরে, শাড়ির পাড়ের মতো রাঙা পথে, পতিত বাগানে।
বাউল বাউল ব’লে রসালো জ্যোৎস্নায় খুব মেতে ওঠে গানে।
ওরা অলৌকিক ম্যানিফেস্টোর ডানায় ভর ক’রে
দ্রুত বিলি হ’য়ে যায় শহরের আনাচে কানাচে। গুঞ্জরিত ঘরে ঘরে
এবং স্থানীয় আঁদ্রে ব্রেতো করলে কৃপা বেহদ গাঁওয়ার সব
লজিকের বুকে-পিঠে রূপালি চাবুক হেনে আনকোরা রব
তুলে খিল ভরপুর জ্যোৎস্নায় বেবাক স্বপ্নাহত হয়।
দুস্থ চন্ডীমন্ডপের বুলির আড়ালে কতিপয়
শব্দ জাগে বলীয়ান নব্যতায়, কবিসংঘ পেয়ে যায় বিরল ভুবন,
স্বপ্নাদ্য বলাই যায়। রঙিন কুপন
হাতে নিয়ে টপলেস পরীরা আঁধারে পরিচারিকার মতো
ব্যস্ততায় সঞ্চারিণী; মেঝে ফুঁড়ে ভৌতিক আলোয় উঠে আসে
অবিরত
অপরূপ শব আর শুয়োরের মুণ্ডু। পিরিচে যুল স্তন, যাত্রী
সবুজের দিকে ক্রমাগত। বইয়ের কবরে কে ঘুমায়? রাত্রি
চোলিতে নক্ষত্র গেঁথে চন্দ্রমাকে আনে বুদোয়ারে
নিরিবিলি প্লুত দৃষ্টি হেনে; অতিশয় মৌন হাড়ে
জ্যোৎস্না বোনে অন্তহীন কিংবদন্তী। এই তো প্রফুল্ল জোনাকিরা
গুল্মলতায় খেলে লুকোচুরি-বনময় কী আদিম ক্রীড়া।
হে প্রিয় কল্পনালতা এসো তুমি উন্মাদিনী ওফেলিয়া সেজে
আমার এলসিমোরে, হে দয়িতা, পাখাবতী, শবাকীর্ণ ষ্টেজে।