বিচ্ছেদ
রোল কল করলেই সাড়া দেবে, এমন তো নয়।
কিন্তু আছে, একমুঠো রাঙা কোমলতা।
লিখবে না, শিখবে না কিছু, নয় ছয়
ইত্যাদি কিছুই নয়, ঐতো মাঝে-মধ্যে মাথা নাড়ে
ঈশ্বর জপালে কোন শ্লোক। ওখানে থাকারই কথা
তার যতক্ষণ থাকা যায়। কখন কে কাড়ে,
ভয়, এই ভয়।
রেখো না ফ্লাওয়ার ভাসে, হায়
প্রকৃতির থেকে বিচ্ছিন্নতা হেতু ফুল
কী বিপুল
শূন্যতায় অবেলায় অতিশয় জীর্ণ হ’য়ে যায়।
ব্যক্তিগত রাজা
ব্যক্তিগত রাজার কাছে হাঁটু গেড়ে
যাচঞা করি একটি কিছু
ইতল বিতল।
দৃষ্টিতে তাঁর চন্দ্র ধরে, সূর্য ধরে;
জ্বলছে হাতে রক্তজবা
চমৎকার।
শস্য ক্ষেতে তাঁর পতাকা নিত্য ওড়ে,
ফুলের তিনি খুব উদাসীন
অধীশ্বর।
সকাল যখন সকাল থেকে
যাচ্ছে স’রে অনেক দূরে
কিংবা কাছে,
রাত্রি আবার রাত্রি থেকে,
আমার করুণ অঞ্জলিতে
অন্ধকারে উঠবে ফুটে পদ্ম কোনো?
বুকের ভেতর মাছরাঙা আর
দীপ্ত আঁশের মৎস্য নিয়ে
ঐতো আমার সন্ত রাজা
ফুটপাতে নীল একলা হাঁটেন।
পার্কে ব’সে বেলুন ছাড়েন,
কিংবা বাসের পাদানিতে
ঝুলে ঝুলে যান যে কোথায়!
কখনো ফের জনসভায়
অনেক মুখের একটি মুখে
যান মিশে যান,-
আবার কখন চিমটে বাজান বৃক্ষতলায়।
ব্যক্তিগত রাজা যিনি তিনি বেবাক পোশাক খুলে
ঐ চলেছেন ভেসে ভেসে
জ্যোৎস্নাস্রোতে, রৌদ্রমায়ায়।
আমি কি তাঁর অমন গহন ছায়া তুলে
আমার চোখে পাগল হবো?
ঘোর দুপুরে দিলেন ছুঁড়ে কাঁটার মুকুট
নগ্ন হাতে আমার মাথাআ লক্ষ্য ক’রে।
ব্যক্তিগত রাজা আমার অগাধ রোদে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
সত্তাজোড়া অসুখ নিয়ে
একলা হাঁটেন।
বৈতরণী অন্ধকারে বনবাদাড়ে
পায়ের রক্তে যন্ত্রণারই পুষ্প এঁকে
একলা হাঁটেন, একলা হাঁটেন
ধূসর কোনো ইস্টিশানে,
মেঘে মেঘে একলা হাঁটেন।
মন্তাজ
এই তো হরিণ ছোটে, রত্নরাজি ওড়ায় সুতীক্ষ্ম খুরে, ফুলের মেঘের
নরম সংকেত জেগে ওঠে; মুঞ্জরিত গুপ্ত ক্ষেত। আবেগের
গলায় পা রেখে দেখেছিতো, তবু জলজ্যান্ত স্বর
সোনালি ঘন্টার মতো বাজে চতুর্দিকে আর ঘর
বাড়ি উল্টোপাল্টা ছুটে যেতে চায় আকাশের সুনীল মহলে।
আপিশ ফটক ছেড়ে পথে নামি, ঠিক সন্ধে হ’লে,
কখনো বা আরো পরে বাড়ি ফিরি, বাসের টিকিটে
আলতামিরার চিত্র, শিং উঁচানো রৈখিক বাইসন, খিটখিটে
বুড়োটা ভীষণ উক্তিময়, হঠাৎ চোয়ালে তার গাছের বাকল পরা
রমণী ঝিকিয়ে ওঠে, নিসঙ্গ আমার কাঁধে। কড়া
নাড়লেই দরজাটা যাবে খুলে যথারীতি, জামা-
জুতো ছেড়ে লম্বা হবো কিছুক্ষণ। ঘনিষ্ঠ পা’জামা
চোখের পলকে শূন্যে তাঁবু হয়, ওড়ে; কী প্রাচীন হ্ণদে ঝুঁকে
মজি ছায়াবিলাসে, সহসা কারা যেন লাঠি ঠোকে
কঠিন মাটিতে, আসে তেড়ে দুর্বার চাদ্দিক থেকে।
আমি তো নিবিয়ে আলো শুয়ে পড়ি চাদরে গা ঢেকে।
চোখ বুজলেই দেখি পিতৃপুরুষের কবরস্থানের খুব
ডাগর ডোগর ঘাস, সবুজ ছাগল; ডাবা হুঁকো ক্ষিপ্র ডুব
দিয়ে সরোবরে মানস হংসের মতো প্লুত শোভা
রচনার পরে নাচতে নাচতে দোতারার কুয়াশায়
আমার বাড়িটা একি প্রকাশ্যেই মহিলার মুখ হ’য়ে যায়।
মাইফেলে
সে রাতে ছিলেন তিনি মাইফেলে। আশি বছরের
ম্লান খড়কুটো তাঁর সমগ্র সত্তায়।কী উদাস
চক্ষুদ্বয়, শিরাপুঞ্জে বয় মাঘ, শুধু দীর্ঘশ্বাস
ঘিরে রয় তাঁকে; দেখছেন ঘরে ঝাড় লণ্ঠনের
শোভা নেই; মনে পড়ে, বাইজীর ব্যস্ত নূপুরের
মতো বেজেছিলো কত প্রহর এবং বারোমাস
ছিলো বেনো সুরের নক্শায়! অন্য নিবিড় আকাশ
চকিতে উঠতো জেগে আড়ালে ধামার, খেয়ালের।
ঈষৎ নোয়োনো মাথা তুলে প্রতিপক্ষ শূন্যতার
মূক পটে আঁকলেন উদারার গান্ধার মধুর-
তখন বাইরে অমাবস্যা, ঘরে অঝোর পূর্ণিমা।
দেখি না পাঞ্জবি কিংবা কালো মখমলের টুপি তাঁর,
এমন কি চোখ-মুখ। এখন তো নিজে তিনি সুর,
শুধু সুর, অজর তরুণ এক, লুপ্ত সব সীমা।
মাতামহীর মধ্যাহ্ন
ত্র্যালবামের এই চেনা জানা
সংসারে আজ নেই যে তিনি।
কেমন ধূসর, কতো ধূসর ক্রমান্বয়ে
হলেন তিনি, বলতে পারো মনো-মুকুর?
গলির কোলে আটচালাটা
অষ্টপ্রহর আদর খেতো
রৌদ্র ছায়ার। কখনো বা উঠতো কেঁপে
বদমেজাজী হাওয়ার ভীষণ ধমক খেয়ে!
আটচালাটা তাঁরই ছোঁয়ায়
হয়েছিলো আয়ুষ্মতী।
সেই কবেকার খেজুর পাতার ঝিলিমিলি
ঝালর রচে আজো এমন দূর দশকে।
একলা দুপুর উদাস হতো
আমার মাতামহীর বুকে।
রৌদ্র যখন পারদ হ’য়ে টলটলাতো,
বলতেন তিনি, ‘দুপুর তুমি কার বলো তো?’
শীতল পাটির স্নিগ্ধতাকে
নিতেন শুষে দেহের ভেতর।
হঠাৎ কখন বুক জুড়ে তাঁর উঠতো কেঁপে
প্রাচীন কোনো পথের রেখা, জানতো না কেউ।
এক নিমেষে শীতলপাটি
বদলে হতো কাঁটার ভুবন।
কখনো ফের তাঁর আয়ত চোখের নিবাস
যেতো ভেসে কংকাবতীর চোখের আলোয়।
যাদব চক্রবর্তী মশাই
হিশেব টিশেব শেখান নিকো,
তবুও তার কাঠের বাক্সে মুদ্রাগুলো
হিশেব মতো উঠতো নেচে পরীর মতো।
কিন্তু যখন বেহিশেবী
নাছোড় দুপুর আলু থালু
করতো তাঁকে, তখন স্মৃতির পরগণাতে
উড়তো শুধু পাগলা ঘোড়ার ক্ষুরের ধূলি।
যায়না দেখা কোথাও তাঁকে
সকাল সন্ধ্যা দ্বিপ্রহরে,
মাঝে-মধ্যে বিষাদ সিন্ধু ছাপিয়ে উঠে
উদ্ভাসিত মাতামহীর মুখের রেখা।
মুকুট
কোত্থেকে এলেন তিনি? কন্টকিত দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া
থেকে না কি? যেন এ শহরে প্রবেশের ছাড়পত্র
পান নি এখনো কিংবা পেলেও জরুরি সে দলিল
হাতছাড়া হয়ে গেছে। খুঁজছেন শ্যামা ও মুনিয়া,
খুঁজছেন খরগোশ ফের কি সব দু’চার ছত্র
আওড়ান, বোঝা দায়। কখনো-বা ইতস্তত ঢিল
দেন ছুঁড়ে, গায়ে তাঁর শতচ্ছিন্ন অদ্ভুত পিরান,
পদযুগ নগ্ন ধূলিম্লান। পিরানের ভাঁজে ভাঁজে,
দ্যাখে পুরবাসী, ঝলসিত কী যে নক্ষত্রের মতো
সর্বক্ষণ। গাত্রাবাস আমোদিত অনেক বিরান
প্রান্তর এবং জলাভূমির প্রাচীন গন্ধে। বাজে
শরীর বীণার মতো; মুকুট শোভিত সমুন্নত
মাথা তাঁর। ব্যবসায়ী, ফড়ে, হা-ঘরে, চাকুরে
লোলুপ তাকিয়ে থাকে; উদাসীন তিনি যান দূরে।