- বইয়ের নামঃ আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অঙ্গীকার
ফিরে যাবো? কেন ফিরে যাবো বারবার?
জানি সিংহদ্বার
পেরুলেই পেয়ে যাবো আকাঙ্ক্ষিত সব
উপচার, যার জন্যে ভীষণের স্তব
করেছি সকালসন্ধ্যা, পেরিয়েছি ঝড়মত্ত নদী, কতো সিঁড়ি,
রক্তাপ্লুত, বারংবার নেমেছি খনিতে। আজো ফিরি
পথে পথে কেইনের মতো। ফিরে যাবো? প্রহরীর
রক্তচক্ষু দেখে ফিরে যাবো? তুমি তবুও বধির
হ’য়ে থাকবে সর্বক্ষণ? ডাকবে না সেখানে, যেখানে
আমার ব্যাকুল পদচ্ছাপ পড়েছিলো স্বপ্নে, মানে
অলৌকিক অভ্যন্তরে। এই রুদ্ধ সিংহদ্বার থেকে
হতাশায় ভগ্নরথ ফেলে রুক্ষ ক্লান্ত মুখ ঢেকে
গেছেন আমার পিতামহগণ ফিরে। আমার শপথ,
প্রাপ্য ছাড়া আমিতো যাবো না ফিরে, থামাবো না রথ।
অপরাধী
আমি তাকে অকস্মাৎ তারস্বরে গেট আউট গেট আউট ব’লে
তাড়িয়ে দিলাম।
সদর দরজা দিয়ে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি অন্যমনস্কতা
বিড়ি ফুঁকে চ’লে গেলো। দালানের অভ্যন্তরে যেতে চেয়ে পথ
দীর্ঘ পথ বেয়ে
যথারীতি চ’লে যাবে খোলার ছা-পোষা ঘরে সূর্যাস্তের পরে।
আমি কি নির্দয় কোনো জীব? ঠিক তা’না, তাকে জাহান্নামে যেতে ব’লে অনুতাপের বিবরে
ব’সে আছি। অথচ তক্ষুণি তাকে, মানে
সেই অপদার্থ লোকটাকে না তাড়ালে লোকচক্ষুর আড়ালে
আমাকে অরণ্যে
আস্তনা গাড়তে হতো। লোকটা অর্থাৎ
সেই কম্পোজিটার আমাকে বিরক্তির খানাখন্দে
কেবলি দিচ্ছিলো ঠেলে যখন তখন।
একটি নিটোল স্বপ্ন তাকে কম্পোজ করতে দিয়ে দেখি,
স্বপ্নের জায়গায় দিব্যি দুঃস্বপ্ন দিয়েছে বসিয়ে সে,
সুস্থতার জায়গায় অসুখ আর উন্মত্ততা। তার
হাতের অস্থির স্পর্শে সুবিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর
কারাগার হয়ে যায়, শিশুর চিৎকারধন্য মৃদু আলোময়
একটি আঁতুড়ঘর গোরস্থান। পরিপাটি গ্রাম,
মুখর শহর তাকে কম্পোজ করতে দিলেই সে
টাইপে সাজাতো দগ্ধ, বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম আর
আলো চাইলে তড়িঘড়ি ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে নিখুঁত
অন্ধকার শব্দটি বসিয়ে দিতো বারবার। একি
দারুণ অবজ্ঞা তার? না কি বৈপরীত্যবিলাসী সে
ভ্রান্তির কোটরে খোঁজে স্বস্তি অহর্নিশ?
এখন তাড়িয়ে তাকে নিজেই টাইপ কেস নিয়ে
বসে গেছি চমৎকার; দেখবো এবার
কী ক’রে তুমুল ভুল শব্দ যথার্থ শব্দের জায়গা
জুড়ে বসে। কিন্তু আমি স্বপ্ন কম্পোজ করতে গিয়ে, ভারী
অপ্রস্তুত, দেখছি দুঃস্বপ্ন হ’য়ে যাচ্ছে অবিকল
এবং সুস্থতা
ভীষণ অসুখ; আশা নৈরাশ্যের জুতোয় গলিয়ে দিচ্ছে ঠিক
পদযুগ পরিপাটি গ্রাম,
মুখর শহর হয়ে যাচ্ছে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম
এবং টাইপ কেস তন্ন তন্ন ক’রে আলো শব্দটি পাচ্ছিনা খুঁজে আর,
পাচ্ছি না কোথাও-
ছত্রিশ পয়েন্ট বোল্ড টাইপে অত্যন্ত দ্রুত শুধু
ভীষণ হাভাতে এক অন্ধকার বানিয়ে ফেলছি!
অমন তাকাও যদি
অমন তাকাও যদি একবিন্দু অনন্তের মতো চোখ মেলে,
আমি বারবার
তোমার দিকেই ছুটে আসবো প্রত্যহ।
যেখানে তোমার দৃষ্টি নেই,
তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না যেখানে কেনোদিন
সেখানে কী করে থাকি? তোমাকে দেখার জন্যে আমি
যশের মুকুট
ছুঁড়ে দেবো ধূলায় হেলায়, তাকাবো না ফিরে ভুলে
কস্মিনকালেও আর। মেনে নেবো হার, এই খর
মধ্যাহ্নেই হয়ে যাবো স্বেচ্ছায় সূর্যাস্ত; জেনে রাখো,
তোমাকে দেখার জন্যে বেহেস্তী আঙুর আর কয়েক ডজন
হুরীর লালচ আমি সামলাতে পারবো নিশ্চিত।
তোমার নিদ্রার ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাবো বেয়ে ছিপ নৌকো
এবং লাফিয়ে প’ড়ে তোমার স্বপ্নের তটে আবিষ্কারকের
মতো দেবো পুঁতে
আমার নিঃশ্বাসে আন্দোলিত এক পবিত্র নিশান।
কখনো নিদ্রার রাজপথে, কখনো-বা জাগরণে
বাগানে কি পার্কে
সড়কে ট্রাফিক দ্বীপে, বাসে
গোলাপ শ্লোগান হাঁকে একরাশ, উড়ন্ত কপোত
অকস্মাৎ দিগ্বিদিক লুটোয় নিষিদ্ধ
ইস্তাহার হ’য়ে,
পড়ি, ‘নরকেও ভালোবাসা ম্যানিফেস্টো হিরন্ময়।
অমন দাঁড়াও যদি নিরিবিলি পা রেখে চৌকাঠে,
সমর্পণ করতে পারি আমার সমস্ত আয়ুষ্কাল
তোমারই আঁচলে।
যদি পাপ তোমার শরীর হ’য়ে নত নয়, হয় উন্মোচিত,
দ্বিধাহীন তাকে খাবো চুমো গাঢ়, বাঁধবো ব্যাকুল আলিঙ্গনে।
আমি আমার স্বপ্নগুলি
আমি আমার স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
কৃষক যেমন চায় বাঁচাতে ধানের চারা,
পক্ষী যেমন শাবকগুলো দেয় পাহারা,
তেমনি আমি স্বপ্নগুলি বাঁচিয়ে রাখতে চাই।
সকল স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?
জমি জিরেত নেইতো কিছু, আমার কাছে
নেই তো কড়ি, শুধু কিছু স্বপ্ন আছে।
সেসব স্বপ্ন এক নাগাড়ে হয়ে যাবে ছাই?
এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?
দাও বেচে দাও স্বপ্ন তুমি, বলছে ওরা,
‘নইলে পিঠে পড়বে হাজার হিংস্র কোড়া।
এমন বিশ্বে স্বপ্নগুলি কী করে বাঁচাই?
স্বপ্ন দেখায় তেমন কোনো নতুনত্ব নাই।
কিন্তু একলা বুকের ভেতর স্বপ্নগুলি
লালন ক’রে ঘোরা ফেরা নয় মামুলি।
স্বীকার করি, স্বপ্ন দেখায় নতুনত্ব নাই।
স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।
পাথর টাথর, গাছের পাতা, এসব নিয়ে
কে যেন এই স্বপ্নগুলি দেয় বানিয়ে।
স্বপ্নে আছে উল্টাপাল্টা স্মরণের রোশনাই।
এত স্বপ্ন করবো বলো কী করে বাছাই?
উজান ঠেলে তাদের কেবল বাঁচিয়ে রাখতে চাই!