- বইয়ের নামঃ মানব এসেছি কাছে
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ নিউ বুক প্যালেস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমি কেন এ-রকম
আমি যেন কী রকম সব কিছুতেই কী রকম
একটা ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব
একটা দুঃখিত দুঃখিত ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব,
বুকের ভিতর আমি ধরে রাখি দুঃখের শিশির
পিতৃপুরুষের সেই বাক্যহীন অন্ধকার,
সেই ডুবুন্ত নৌকার দৃশ্য
আমার এ-বুক যেন ভুবন মাঝির সেই শ্যাওলা-পরা ঘাট
আমি প্রতি রাতে শেষ তারা ডুবে যাওয়া লক্ষ্য করে কাঁদি
তবু প্রকাশ্যে এমন আমি এ-রকম
এই ছেলে মানুষি মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব!
আমি দুঃখিত হলেও লোকে ভাবে ও কিচ্ছু না শুধু
দুঃখ দুঃখ ভাব
আমি কাঁদলেও কান্না কান্না ভাব বলে ভাবে,
ভালোবাসলেও আমি ধরে নেয় মাত্র ছেলেখেলা
আমি কেন এ-রকম
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব
আমি কেন অহঙ্কারে হাঁটতে পারি না
দশ হাত ফুলিয়ে বুকের ছাতি,
আমার দুঃখের কথা, লালসার কথা, এই নারীলিপ্সার কথা
কেন সিঃসঙ্কোচে বলতে পারি না,
কেন অবিশ্বাসী হাসি হেসে বলতে পারি না
পাপ বলে কিছু নাই, ধর্ম বলে কিছু নাই,
আমি ক্ষতিগ্রস্থ হলে, অপমান হলে
জল ছুঁয়ে, ভূমি স্পর্শ করে, নারীর অঙ্গ ছুঁয়ে
কেন আমি কাউকে পারি না দিতে ভয়ঙ্কর ক্রূর অভিশাপ!
আমি কেন এ-রকম সব কিছুতেই
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লাজুক লাজুক ভাব।
» আমি তো তোমারই বশ
আমি তো পাখিরও বশ, ভ্রমরের বশ
কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও সুস্মিত গোলাপ
বিষণ্ন বাবুই, হে পাখি, হে উদাসীন সরুযুর কাক
তোমরা ছাড়িয়া যাও!
আমাকে ছাড়িয়া যাও সন্ধ্যার শায়িত মাঠ
আজানের হে সুবে সাদেক, আমি তো তোমারই বশ,
তোমাদের সকলেই বশ
তোমরা দুজন বড়ো অভিমানী নারী
আমি তো তোমারই বশ
কালিন্দীর কোন কূলে ভরেছো কলস, কোন তমালের মূলে
ছয়টি কালিমা খুলে করেছো ভূষণ!
সাক্ষী থাকো তুমি হে তৃষ্ণার নদী, হে রাখাল, অশত্থু বাউল
আমি তো তোমারই বশ ওই যে সাতটি হরিৎ তৃণ, সোমত্ত সাতটি তারা
কামিনীর সাতগুচ্ছ চুল, আমি তোমাদেই বশ
টিলায় দাঁড়ানো চাঁদ, যুবক পাহাড়, কালো ধেনু, হে কালো তমসা
আমি তো তোমারি বশ হে শয্যা, হে কালো নয়ন
তবু কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও ও দুজন সবুজ রমনী
ও কালো মাঠের গাঁও, ধানের উচ্ছব
কেন তোমারা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
কেন তোমরা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
আমি তো তোমারই বশ,
হে নারী, হে তৃণ, হে পরমা প্রকৃতি!
একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ, আহা ও কালো কুঠার,
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, আহা এ বড়ো নিঠুর, উহাদের
করো না আঘাত
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ
জলেরও ভিতরে আছে, মাটিতেও আছে, জড়ত্বেও আছে
এ প্রাণের বীজ
অগ্নিমন্ত্র, এই গুচ্ছ গুচ্ছ প্রাণ, মধ্যমার সনাতন সখা
বৃক্ষেও আছেন প্রাণ, শিলায়ও আছেন
সমুদ্র তাহারও কন্ঠের কাছে ধিকি ধিকি জ্বলে যে আগুন
সেই শিখাটিই প্রাণ
পাথরের মধ্যে যা স্ফটিক ধ-ধু অশ্রুজল
সাত তাল জলের নিম্নে খুঁজে তাকে ও কালো কুঠার
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, ও রক্তমাখা হাত
ছেঁড়ো খেঁড়ো যা কিছুই করো
একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান!
নির্বপিত কুসুমেরও মধ্যে ফোটে ঘ্রাণ, খোলে মায়া
ওই শুয়ে আছে শিশুর চেখের থির হ্রদে
সকল বস্তুতে আছে বস্তুরঅধিক সেই প্রাণ,
মৃত্যুর পরেও তাই যায় একটি ভ্রমর
আহা ও কালো কুঠার, ঘাতকের বিষমাখা ফলা
উহাদের দিও না ছোবল, ওরা প্রাণ, ওরা প্রাণ!
ওই শিশুর ভিতরে প্রাণ, প্রাণীর ভিতরে, ওই শিলায় অগ্নিতে জলে
একটি ভ্রমর ওরা উহাদের সাতটি পরান।
এসেছি অঘ্রানে এক আমি আগন্তুক
অঘ্রানে আমার জন্ম হবে যদি মরে যাই
ঠিক ঠিক গালের জরুল নিয়ে চেয়ে দেখো
এসেছি অঘ্রানে এক আমিআগন্তুক!
তোমাদের স্থির মানব্ স্থিতির মাঝখানে
এসে দাঁড়াবো আদ্যন্ত এক মানুষী সংবিৎ
শস্যের সুঘ্রাণ লেগে রবে এই সারা চক্ষুময়
সারাদেহ রোমাঞ্চিত হবে যদি মরে যাই
ফিরে এসে ঠিক চিনে নেবো তাকে প্রাক্তন প্রেমিকা
পায়রার খোপ এই, শস্যক্ষেত্র, উদাসীন আবাল্য বাউল,
অঘ্রানে আমার জন্ম হবে
আমার চুলের গন্ধ শুঁকে দেখো, নখ দেখো
গায়ে গেঁয়ো জনি-পাতার রস লেগে রবে
তখনো আদিম বন্য ঘ্রাণ কিছু পাবে
আমি সেই সনাতন মানুষী সংবিৎ দেখো
এসেছি অঘ্রানে এক আমি আগন্তুক!
কতো নতজানু হবো, দাঁতে ছোঁবো মাটি
কতো নতজানু হবো, কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি
এই শিরদাঁড়া হাঁটু ভেঙে
কতোবার হবো ন্যুব্জ আধোমুখ?
আজীবন সেজদার ভঙ্গিতে কতো আর নোয়াবো শরীর?
এক রকম স্পষ্ট দাঁড়ানো দৃঢ়ভাব
কারো কারো সহজাত থাকে,
মানুষের মধ্যে থেকে তাহাদের পাঁচফুট নয় ইঞ্চি মাথা
মানুষের চে’ও কিছু উঁচু
আমি কতো আর নতজানু হবো
দাঁতে ছোঁবো মাটি?
আমার জনক সে কি জন্ম থেকে নিয়েছেন এই ভিক্ষা,
এই শিশুপালনের ব্রত
ওরে তুই জন্ম নতজাঁনু হয়ে বেড়ে ওঠ
সবাই যখন পায়ের পাতায় ভর করে
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি মাথা আরো উচ্চে তুলে দম্ভে দাঁড়াবে
আমার বালক তুই তখনো লুকাবি মুখ
নিজেরই পায়ের তলদেশে;
আমি তাই জন্ম নতজানু, নতমুখ
মাথা তুলে বুক খাড়া করে কোনোদিন দাঁড়ানো হলো না
বুকভাঙা বাঁকানো কোমর আমি নতজানু লোক
কতো আর নতজানু হবো কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি!
তখন সুবর্ণ হবে ঘাস
যাই হোক, কুসুম ঝরিয়া যাক, খুলে যাক শিশুর পালক
উজ্জ্বলতা তাহাও নিভিয়া যাক, জলরাশি হয়ে যাক খাঁখাঁ বালিযাড়ি
যাই হোক তাহার বিশ্বাস রাখো, একদিন পরিত্রাণ হবে
পরিশুদ্ধ হবে মাটি, জল, জলের
কুচ্ছিত মুখচ্ছবি, ছায়া,
সেই পীত নষ্ট জরে ফিরে পাবে বণৃহীন ঘ্রাণ
তাহার বিশ্বাস রাখো
চক্ষুষ্মান হবে সভ্যতার এই অন্ধ রাজা
বিবর্ণ গোলাপ পুনরায় আয়ুষ্মতী হবে
তখন সুবর্ণ হবে ঘাস, ঘাসের মহল।
যাই হোক চারদিক ছেয়ে যাক ক্রূর অভিশাপে
পাহাড় টলিয়া যাক, যাই হোক, রাখো, শুদ্ধ বিশ্বাস রাখো
একদিন অন্ধকার ভেদ করে আশাতীত সূর্যোদয় হবে
পরিশুদ্ধ হবে জল, মাটি, তারও মধ্যকার মজা প্রাণ
তাহার বিশ্বাস রাখো,
অভিভূত আদিম মানব হয়ে দেখো,
দেখো তিনি তো আগুন, তাহাকে বিশ্বাস করো, অগ্নিকে বিশ্বাস
করো, নতজানু হও
তাহাকে বিশ্বাস করো তিনি জল, বৃক্ষকে বিশ্বাস করো,
আগুনে বিশ্বাস রাখো, জলে রাখো,
জলের অতীত আরো সুদর্শন তাহাকে বিশ্বাস রাখো
শুদ্ধ বিশ্বাস রাখো একদিন শাপমুক্ত হবে।
তাই মিথ্যা বলা
তুমি ভয় পাবে, ভয়ে ভীত হবে বলে কোনোদিন
মৃত্যুর বর্ণনা করি নাই,
কোনো দুঃখের প্রসঙ্গ উত্থাপন
করি নাই, মুতি ম্লান হবে, তুমি অশ্রুসিক্ত হবে
তাই কোন রাজার দুলাল গেলো বনে, কোন
বৃক্ষের মাথায় হলো বজ্রপাত, কোনখানে ভূমিকম্পে
কতো মানুষের প্রাণহানি হলো
এসব কিছুই ব্যক্ত করি নাই, ব্যাখ্যা করি নাই।
তুমি লজ্জায় হেঁট হবে তাই বলি নাই কুৎসিত কাহাকে বলে,
পথের ভিক্ষুক, অন্ধ, অশ্লীল মাতাল
এসবের নামোল্লেখ করি নাই-
বলি নাই পৃথিবীর তিনভাগ জল মাত্র এক ভঅগ স্থল।
তুমি ভীত হবে, আতঙ্কিত হবে বলে বলি নাই দোজখ কেমন
সংসারের নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা কি কি
তুমি দুঃখ পাবে, মর্মাহত হবে বলে বলি নাই
পৃথিবীর তিন ভাগ জল মাত্র এক ভাগ স্থল।
সর্বদাই গোলাপের প্রতি চেয়ে তোমাকে বলেছি এই
পৃথিবী এমন
নির্দোষ পূর্নিমার প্রতি অঙ্গুলি নিদেৃশ করে
বলেছি এই পৃথিবী
এমনি শিশুর দিকে চেয়ে, সুন্দরের দিকে চেয়ে
বলেছি পৃথিবী এই এমন এমন;
তুমি ভয় পাবে, ভীত হবে বেল কোনো মৃত্যু, শোক
ও দুঃখের উচ্চারণ করি নাই,
এই সত্য কোনোদিন বলি নাই
পৃথিবীর তিনভাগ জল মাত্র একভাগ স্থল।
দক্ষিণ সমুদ্রে যাবো
দক্ষিন সমুদ্রে যাবো
একা যাবো, সমুদ্র সান্নিধ্যে যাবো
একা যাবো, একাকীই যাবো
সেখানে সমুদ্র গড়ে মাটির ত্রিপল খুলে
ছাউনি বিছাবো
জলেরই বিছানা হবে, কাঁথা হবে, পাড়সুদ্ধ হবে
হাতের মুদ্রায় ওই সবুজ বর্ষাতি
তাও হবে
আঙুলেই বাড়ির নকশা হবে,
চৌচাল মেলানো ওই দেয়াল কার্ণিশ হবে
সমুদ্র্লানের আগে
হাতের মুষ্টি খুলে ঝরোকা বানাবো।
দক্ষিণ সমুদ্রে যাবো কি কি আমি জাদু জানি
সমস্ত দেখাবো
সাগরবালিকা আসবে, উড়ন্ত মাছেরা আসবে
জলের মূর্তিও আসবে, ওরা আসবে,
সেখানে রঙিন জলে সকলের শরীর ধোয়াবো
ওই জলে গা ধুয়ে রমণী পুরুষ হবে, পুরুষ রমণী
আহা সে কেমন হবে? বেশ
হবে! ভালোই তো হবে।
আমি কি কি জাদু জানি
ওসব দেখাবো,
আঙুলে আরশি করে চাঁদের চেয়েও ভালো চন্দ্রিমা দেখাবো
নারীর চেয়েও নারী প্রতিমা দেখাবো
দক্ষিণ সমুদ্রে যাবো, সমুদ্রেই যাবো।
বদলবাড়ি চেনা যায় না
তোমার কালো চোখের মতো
পাল্টে গেছে বসতবাড়ি
উদোম চড়া, গাছগাছালি বট-বিরিক্ষ
ওলটপালট সারা বাড়ি একলা এখন,
বাড়ির মধ্যে কালো গাড়ি, এলোমেলো
ভাঙা চাঁদ ও শূলন্য তাঁবু,
শূনো বাড়ির চিহ্ন, চিহ্ন।
তোমার কালো চোখের মতো পাল্টে গেছে শহরতলী
শহরবাড়ি চেনা যায় না, চেনা যায় না
দেয়ালগুলি বদলে গেছে মাটির নিচে
লাল কবরে
শহরতলীর মধ্যে মিশাল এবড়োখেবড়ো
কালো গাড়ি, লাশভরা ট্রাক,
চেনা যায় না বসতবাড়ি, শহরতলী
চেনা যায় না।
তোমার কালো চোখের মতোই
চেনা যায় না, চেনা যায় না।
সারা বাড়ি, সারা শহর
মধ্যে মিশাল এবড়োখেবড়ো
বসতবাড়ি, সারা শহর
নাকাল বাতাস একা একা কেমন ভারী
চেনা যায় না বদলবাড়ি
ভরদুপুরে কোন উড়ো কাক।
ভালোবাসা মরে গেছে গত গ্রীষ্মকালে
ভালোবাসা মরে গেছে গত গ্রষ্মকালে
উদ্যত বাহুর চাপে, ধুলোমাটি কাদা লেগে গায়ে
শীতেতাপে ঝরে গেছে তার বর্ণ, মেধা
স্পর্শ করে আশি এই প্রেমহীন নারীর শরীর
মৃত চুল, উত্তাপবিহীন কিছু বয়সের ধুলো,
নীলাঞ্জনশোভিত নারীর মুখ
ফিকে থির পলকবিহীন
দুই চোখ খেয়ে গেছে পৌষের দুই বুড়ো কাক
তাহাকেই ধরে আছি, বেঁধে আছি
অসহায় স্তব্ধ আলিঙ্গনে ;
সহু বছরের এই রোদবৃষ্টিজলে, ঝড়ে, কুয়াশায়
নষ্ট হয়ে গেছে প্রেম, মুখের গড়ন তার, দেহের বাঁধন
অজন্তা মূর্তি লাস্য, শিল্পের মতন
সেই গূঢ় সম্ভষণ
তার কতোখানি বাকি আছে?অবশিষ্ট আছে?
তাহারা কি থাকে কেউ অনাদরে উপেক্ষায়
সারাদিনে একবেলা জলঢালা মৌন কেয়ারিতে
অজ্ঞাত নফর, তাহারা কি থাকে?
স্পর্শহীন, পরিচর্যহীন একাকী নিঃসঙ্গ আর কতোকাল
দগ্ধ হবে প্রেম।
মাটি দে, মমতা দে
তুলে যে এখান থেকে তরতাজা এই কালো ঘ্রান
আমি নিয়ে যাবো
উঠোনে রোপণ করা পুঁইশাক, সবজির গাঢ় সজীবতা
তুলে দে একটু মাটি, একটু মমতা দে, মমতা তুলে দে
আমি নিয়ে যাবো
আমি অভিমান ভুলে এসেছি মানুষ তোর কাছে
আমাকে তুই তুলে দে একটু মাটি, মাটি দে মাটি দে
আমাকে মন্ত্র দে, ধুলোয় ছড়ানো বীজ তুলে দে তুলে দে
আমি নিয়ে যাবো
করাঞ্জলি পেতে আছি বুক ভরে তুলে দে তৃষ্ণার জল
জলবন্দী অজ্ঞাত বর্ণের মাছ আমি নিয়ে যাই
আমাকে তুই তুলে দে তুলে দে
তুলে দে একটু মাটি,
মাটিতে ছড়ানো বীজ, কালো ঘাম,
কালো কৃষকের শ্রম,
আবার এসেছি ফিরে তোর কাছে মধুর মানব
আমাকে তুই মাটি দে মাটি দে
মাটির মমতা দে, মন্ত্র দে
তুলে দে তুলে দে!
মানব তোমার কাছে যেতে চাই
মানব তোমার কাছে গড় হয়ে করেছি প্রণাম
ওই ধুলোঘ্রাণ নিয়ে, ওই ধুলোভারসুদ্ধ বুকে নিয়ে
আমি একবার তোমাদের আরো কাছে যেতে চাই
একবার ছুঁতে চাই সর্বমধ্যসীমা।
এ বুকে জমেছে বহু গ্রীষ্ম, বহু শ্যন্য গোলাকার একাকীত্ব
এতো একা ভালো নয়, এমন একাকী ভালো নয়
জনশ্যন্য ভ্রমণের নেশা ছেড়ে
আমি তাই মানবী সংসার তোকে করেছি প্রণাম
ওই সবুজ আহ্বান,নীল আমন্ত্রন,
টুলে বসে কোল জুড়ে উদোম শিশুর হিসি করা
বাদামের খোসা খুলে খুনসুটি, চেলেখেলা
কাঁটায় পশমবোনা, এইগুলি,
তোমাদের মানবী স্বভাব
পাহাড়ে টিলায় একা নির্জন ভ্রমণ ভুলে
এইবার তার কাছে আত্মসমর্পণ
এই ধুলোঘ্রাণ নিয়ে ধুলোভারসুদ্ধ বুকে নিয়ে
আমি একবার তোমাদের কাছে যেতে চাই
মানব তোমার অতি কাছে যেতে চাই।
মানুষ
মানুষ মানে জন্মতারিখ, কোষ্ঠীখাতা
বাসস্থান ও বধ্যভূমি
কাগজপত্র, ঘরগেরস্ত, পিতামাতা, নামঠিকানা
অন্যবিধ জাতিগোষ্ঠী আত্মীয়তা
স্ত্রী-পরিবার, নুনমরিচ ও খাদ্যদ্রব্য
মানুষ মানেই জীবনযাপন
এই একাকী বন্দীদশা!
মানুষ মানে হাতের পিঠে ওলটপালট
হিজিবিজি, লিখন
এসব ভাগ্যলেখা,
নদীর জোয়ার, চাঁদের ভাঙন,
চিরকালীন এ সমস্ত শীতসন্ত
ভুলভ্রান্তি
কান্নাকাটি, দুঃখসুখের দালানকোঠা
কৃষিকার্য, জমিজমা, শীতলশাদা বৃষ্টিধারা
হলুদ মাটি, সবুজ তৃণ,
এই বাড়িঘর, এই মনিষ্যি
বিদ্রোহ কি রণসজ্জা
মানুষ মানুষ ভুলভ্রান্তি!
মানুষ মানে আমরা তোমরা
মাথার চুল কি হাতের এ নখ
এই সর্বাঙ্গ চোখকান না জন্মকালীন
নগ্ন শরীর
মানুষ মানে মুখের আদল, এই
আমাকে দেখতে যেমন
আহার-নিদ্রা ঘোরাফেরা রাত্রিকালে
নীরব মৃত্যু!
মানুষ মানে আর কিছু নয়
হস্তাক্ষর ও নীল ফটোগ্রাফ!
মানুষের মধ্যে কিছু অভিমান থাকে
সব মানুষেরই মধ্যে কিছু অভিমান থাকে,
এইটুকু থাক, এইটুকু থাকা ভালো
এই অভিমান জমে জমে মানুষের বুকে হবে নক্ষত্রের জল।
মমতা মমতা বলো অভিমান তারই তো আকার
তারই সে চোখের আঠালো টিপ, জড়োয়া কাতান,
মমতা মমতা বলো অভিমান তারই একনাম
একদিন অভিমান জমে জমে
সব বুকে স্বর্ণখনি হবে ;
মানুষের মধ্যে কিছু অভিমান থাকে, চোখের
ভিতরে থাকে, হৃৎপিণ্ডে থাকে
তাহাকেই গোপনতা বলে, মানুষের মধ্যে
আরো মানুষের অবস্থান বলে,
কেউ কেউ ইহাকেই মানুষের বিচ্ছিন্নতা বলে
আমি তা বলি না
আমি বলি অভিমান, মানুষের প্রতি মানুষের শুধু অভিমান,
আর কিছু নয়,
এই অভিমানই একদিন মানুষকে পরস্পর কাছে এনে দেবে।
সব মানুষেরই মধ্যে কিছু অভিমান থাকে
অভিমান থাকা ভলো, এইটুকু থাক,
একটি নারীর প্রতি পুরুষের স্বাভাবিক অভিমান থাক,
শিশুদের প্রতি থাক, গোলাপের প্রতি
এই অভিমান থাক
নারী ও গোলাপ এই একটি শব্দের প্রতি
মানুষের সনাতন অভিমান থাক,
সব মানুষের মধ্যে কিছু অভিমান থাকে, সেইটুকু থাক।
স্পর্শ
তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা স্পর্শ করে
ভূমণ্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন
মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়
জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর
দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী
নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়
নিসর্গ উন্মুক্ত করে সারাদেহে নগ্ন শরীর
কোন খানে রাখি তুলে দেহের বিস্তার
তোমার শরীরে হাত দীর্ঘতর আমার শরীর;
তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র
জন্মান্তর আমার আবার;
তোমার শরীরে হাত একদিন, এই জন্মে শুধু একবার!
স্বভাব
আমি কি কিছুর মতো? কারো মতো? কোনো
সদৃশ বস্তুর মতো? যে
আমাকে মেলাবে,
সোনালি ঝর্নার সাথে, সবুজ বৃক্ষের সাতে,
নদী বা তারার সাথে?
আমি কি কিছুর মতো? শিশু ও শিল্পির মতো?
রদাঁর মূর্তির মতো?
হয়তোবা পাখি, হয়তোবা ফুল, হয়তো সে দরবেশ
আমি এ কিসের মতো?- যে
আমাকে মেলাবে;
চাঁদের বর্ণের মতো? টিয়ার চোখের মতো?
অরণ্যে শিলার মতো?
আমি ঠিক কিসের মতন
না ঝর্ণার সদৃশ, পাখির সমান, না বৃক্ষের তুলনা
আমি কি নদীর শব্দ, পাতার শিশির
নাকি কোনো যুবতীর রাঙা অভিমান!
আমাকে যা ভাবো, ধরো হাতের অঙ্গুরি
মেঘ, ভাঁটফুল, সিংহের আকৃতি,
আমি ঠিক কিসের মতন, কার মতো? কোনো
সদৃশ বস্তুর মতো?
আমাকে যা ভাবো, ধরো নদী, ধরো স্তল, ধরো অগ্নি,
আমি বস্তুত স্বভাব।