- বইয়ের নামঃ মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ এশিয়া পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার কণ্ঠ কেউ থামাতে পারবে না
যতোই চাও না কেন আমার কন্ঠ তুমি থামাতে পারবে না,
যতোই করবে রুদ্ধ ততোই দেখবে আমি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়।
আমার কন্ঠকে কেউ কোনোদিন থামাতে পারেনি
যেমন পারেনি কেউ কোনো কালে ঠেকাতে অরুনোদয়,
চাও বা না চাও নৈঃশব্দ্যেও যদি কান পাতো
শুনবে আমারই কণ্ঠস্বর।
কীভাবে আমার কণ্ঠ সম্পূর্ণ রাখবে রুদ্ধ করে
আমি তো পাখির কলস্বরে হই উচ্চারিত,
কখনো নদীর শব্দেম কখনোবা শস্যক্ষেতে বাতাসের ছন্দে
বেজে উঠি
আমার নিষিদ্ধ কণ্ঠ দেখবে তুমুল ওঠে বেজে,
আমার কণ্ঠকে কেউ থামাতে পারেনি, পারবে না।
আমাকে নিষিদ্ধ করে লাব নেই, আমি নিষেধ মানি না
সমস্ত নিষিদ্ধ পোস্টার আমি লাগিয়েছিবুকে, কেউ
সরাতে পারেনি
আমার কণ্ঠেই তবু অবিরাম স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা;
তোমাদের সাধ্য নেই আমার কণ্ঠকে কেউ রুদ্ধ করে রাখো।
তোমাদের কোনো অস্ত্রে আমার কণ্ঠকে তুমি থামাতে পারবে না
যতোই আমাকে তুমি পরাবে মিকল, যতোই করবে রুদ্ধ
এই কণ্ঠস্বর,
দেখবে ততোই আমি শব্দহীন নীলিমার মতো ধ্বনি-
প্রতিধ্বনিময়, বিচ্ছুরিত
আমার কণ্ঠকে তাই ঠেকাতে পারবে না, কখনো পারবে না।
আমার ফেলতে হবে আরো অশ্রুজল
আমার ফেলতে হবে আরো অশ্রুজল, আমাকে ভাঙতে হবে
আরো দীঘৃ পথ
আমি জানি আমার ঝরাতে হবে আরো রক্ত ঘাম;
অন্য কারো কথা আমি বলতে পারি না, তবে আমার ঠিকই জানি
আরো অনেক মোছাতে হবে নগ্ন পদতল,
সবার পায়ের নিচে আরো বহু হতে হবে ঘাস
আমাকে সরাতে হবে আরো অনেক পথের তীক্ষ্ণ কাঁটা;
আমি জানি না হলে আমার এই ব্যর্থ হাতে ফুটবে না কোনো তুচ্ছ ফুল,
আমাকে সরাতে হবে অনেক পাথর, আমাকে খুলতে হবে অনেক
দরোজা
আমার পেরুতে হবে অনেক বন্ধুর গিরি-খাত, আমার করতে হবে
একা জেগে অনেক দুঃখের রাত্রি ভোর;
আর কারো কথা আমি বলতে পারি না তবে এ ছাড়া আমার কোনো
পরিত্রাণ নেই
গহীন জঙ্গলে হিংস্র বাঘের সামনে কতো আমাকে পড়তে হবে আরো
ভয়াল দৈত্যের মুখে বুক বেঁধে সাহসে দাঁড়াতে হবে জানি,
না হলে আমার হাতে ফুটবে না একটি কমল।
আমাকে মাড়াতে হবে আরো অনেক দুয়ার, পথে পথে
আমাকে ছড়াতে হবে চেরি
আরো আমাকে মোছাতে হবে চোখ, আমার করতে হবে
আরো বহু ক্ষতের শুশ্রূষা,
আরো আমাকে ছড়াতে হবে পথে পথে, আরো নিঃশেষে
পোড়াতে হবে নিজের জীবন
আমার সইতে হবে আরো কঠিন আঘাত, আমার বইতে হবে
আরো দুঃখভার,
আমার ফেলতে হব আরো অশ্রুজল, আমার করতে হবে
আরো লণ্ডভণ্ড ঘর ও সংসার
আরো ছিন্নভিন্ন করতে হবে এই গেরস্থালি, ভিতর-বাহির।
আমার তাহলে ছেড়ে ছুঁড়ে নেমে যেতে হবে সব ফেলে, বুদ্ধের মতন
চলে যেতে হবে সব ফেলে,
যদি একটিও তুচ্ছ ফুল ফোটাতে চাই তাহলে ফেলতে হবে
আরো অশ্রু
তাহলে আমার তুলে নিতে হবে হাতে ভিক্ষাপাত্র, ছিড়ে
ফেলতে হবে সব প্রিয় আকর্ষণ, সব স্নেহমায়ার বন্ধন
ভুলে যেতে হবে সন্তানের অশ্রুভেজা চোখ
তাহলে আমার আর একবারও পেছন ফিরে তাকালে চলবে না,
চলে যেতে হবে।
আমার স্বপ্নের মধ্যে
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ দ্রুত পায়ে
হেঁটে যায়,
কোনোদিন দেখি তাকে ব্যতিব্যস্ত সাইকেল-আরোহী
ঘরে ঘরে বিলি করে আরক্তিম চিঠি
তাতে খুব বড়ো করে লেখা দুটি শব্দ-স্বাধীনতা এবং বিপ্লব।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ আছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে,
আবর কখনো দেখি একাকী লিখছে বসে বিশাল পোস্টার
কখনো আঁকছে তাতে উত্তেজিত মানুষের মুখ
কখনোবা আঁকছে সে মানুষের পাশে দাঁড় করিয়ে মানুষ
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতম সেতু;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ হেঁটে যায় ছায়াছন্ন পথে
কোনাদিন দেখি তাকে রৌদ্রদগ্ধ পথের ওপর,
তাকে মনে হয় ভীষণ সাহসী যেন
স্পার্টাকাসের মতো ছিঁড়ে ফেলে সমস্ত শৃঙ্খল।
কোনোদিন দেখি তাকে আশাহত বসে আছে
একটি আঁধার ঘরে একা
চারপাশে পড়ে আছে অসংখ্য ধূসর পান্ডুলিপি
আর ছবির মলিন অ্যালবাম;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ কোনোদিন দেখি তাকে
ক্ষুব্ধ হাতে ভাঙছে সকল কারপ্রাচীরের লোহার দরোজা।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ ছন্নছাড়া কেমন উদাস
কখনো বিষণ্ন চোখে কেবল তাকিয়ে আছে
আকাশের দিকে-
কোনোদিক দেখি মায়াকোভস্কির সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে
লিখছে সে মানুষের দুঃখের কবিতা,
কোনোদিন দেখি তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে আঁকছে সে
বেগবান বিদ্রোহের পাশে দীপ্তিময় লেনিনের মুখ।
আমি চাই
আমি আজ প্রাণখোলা অট্টহাসি চাই
বৈশাখের ঝড় চাই, উদ্দামতা চাই।
ফিসফিস কানাকানি চাই না মোটেও,
যার যা বলার খুবই স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে বলা চাই।
অশ্রু ও আর্দ্রতা নয় আজ আমি খর চৈত্র চাই
সেতু ভেঙে আজ চাই দীর্ঘ ব্যবধান,
আজ শুধু দূরত্ব চাই নৈকট্য চাই না
চাই না শীতল ছায়া, চাই দগ্ধ রৌদ্রের দুপুর।
আজ চাই শক্ত মাটি, ইট-কাঠ, লোহা
কাদামাটি, ঘাস্তফুল, এসব চাই,
আজ আমি সমুদ্রগর্জন চাই, জলোচ্ছ্বাস চাই
ওলটপালট-করা ভূমিকম্প চাই।
আকাশের মতো খোলা বুক চাই
দুরন্ত সাহস আর অফুরন্ত প্রাণাবেগ চাই,
পাহাড়ী নদীর সেই তুমলি ক্ষিপ্রতা চাই
উত্তাল তরঙ্গ চাই, বিস্ফোরণ চাই।
আমি চাই অধিক বিরহ আজ, মিলন চাই না
বন্ধন চাই কোনো, মনপ্রাণে স্বাধীনতা চাই,
কোনো ঘোমটা চাই না আর, খোলামেলা দেখাশোনা চাই
চাই না সামান্য স্থিতি, আজ চাই অনন্ত সাঁতার।
আমি যখন বলি ভালোবাসি
আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন শুদ্ধ হয় জীবন
তখন ভাঙা ঘর আবার জোড়া লাগে,
শিশুদের কচি মুখের ঘ্রাণে বাতাস ভরে যায়
হলুদ চোখ সব সবুজ দেখতে শুরু করে
নদী তীরে জেগে ওঠে নতুন চর;
খরা মেষে বৃষ্টি নামে, আমি যখন বলি ভালোবাসি।
আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন শান্তি-আন্দোলন শুরু হয়
জাতিসঙ্ঘের প্রাসাদচূড়ায় গলতে থাকে বরফ,
লেবাননে বোমা বর্ষণ বন্ধ হয়, প্যালেস্টাইনে ওঠে উল্লাসধ্বনি
রুশ-মার্কিন দীর্ঘ বৈঠকে গৃহীত হয় ক্ষেপণাস্ত্র হ্রাসের সিদ্ধান্ত
তখনই সবচেয়ে নিরাপদ হয়ে ওঠে মানুষের ভবিষ্যৎ;
বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কমে আসে, আমি যখন বলি ভালোবাসি।
আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন শীতের দেশে আসে বসন্ত
তখন মরা গাঙে ডাকে জোয়ার, চৈত্রের মাঠে শস্যের হাতছানি,
তখন দুকূল-ছাপানো-বর্ষার চলে পাল তোলা নৌকো
অনেকদিন পর ব্ল্যাক আউটের নিষিদ্ধ শহরে আসে পূর্নিমা
সব কাঁটাতারের বেড়া হয়ে ওঠে মাধবলিতার বন;
ঘাতকের হাত থেকে ছিটকে পড়ে অস্ত্র, আমি যখন বলি ভালোবাসি।
আমি যখন বলি ভালোবাসি তখন পৃথিবীতে সব যুদ্ধ থেমে যায়
দুর্ঘটনায় পতিত বিমানের যাত্রীরা নিরাপদে ফিরে আসে,
বড়ো বড়ো শহরগুলোর সবচেয়ে কন্টকিত যানজট মুহুর্তে খুলে যায়
বিবাহ-বিচ্ছেদের সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেয় সব দম্পতি
মা শিশুর গালে চুমু খায়, ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকারা আবার ঘর বাঁধে;
নবজাতকের কান্নায় ভরে ওঠে পৃথিবী, আমি যখন বলি ভালোবাসি।
এই চৈত্রে
এমন চৈত্রের রাতে আমি লিখি শ্রাবনের গান
বর্ষণ থামেনি আজো দুই চোখ জলে ভাসমান,
সবাই উল্লাসে মাতে, চৈত্রনিশি করে উদ্যাপন
আমর ফাল্গুন নেই চৈত্রে নামে অঝোর শ্রাবণ।
এই চৈত্রে আমি বড়ো ভয়ানক মনঃকষ্টে আছি
এতো যে ফুটেছে ফুল আমি তবু দুঃখ পেয়ে বাঁচি,
সকলেই চৈত্রে সব দেখে-শোনে, আয়োজন করে
আমি এই চৈত্রে আরো মরে যাই বাহিরে-ভিতরে।
সবাই এনেছে ফুল, সকরেই শুনেছে আহ্বান
আমাকে ডাকেনি কেউ আমি কারো শুনি নাই গান,
এমন চৈত্রের রাতে দুঃখ পাই, কাঁদে বড়ো মন
সবার ফুলের মাস এই চৈত্রে আমার শ্রাবণ।
একটি বিষণ্ন চিঠি, মাকে
তোমাকে ডাকার মাগো বড়ো ইচ্ছা করে
বড়ো সাধ জাগে আজ মা তোমাকে একবার ডেকে কথা বলি
কিন্তু কেন উত্তর মেলে না, নৈঃশব্দ্য আমাকে বিদ্ধ করে?
আমি তো করিনি কোনো দোষ, না বলে যাইনি কোনোখানে
তোমার অবাধ্য হয়ে একাকী নদীতে নেমে কাটিনি সাঁতার,
তবু কেন অযথা এমন ক্ষমাহীন ক্রোধে তুমি ফিরিয়েছো মুখ?
এমন তো হয়নি কখনো ঘরে ফিরে
তোমাকে ডেকেও আমি পাই নাই সাড়া,
বাড়ির উঠোনে আমি পা দিয়েই যতোবার তোমাকে ডেকেছি
যেখানেই থাকো তুমি আমার একটি ডাকে
ঝরেছে তোমার কন্ঠে অপার করুণাধারা যেন
সেই তুমি আজ কেন পাষাণের স্তব্ধতা এমন?
মন চায় আজ শুধু তোমাকেই প্রাণ ভরে ডাকি
কিন্তু দেখো মানুষের এতোই সময় কম, মাকেও ডাকার তার
সময় মেলে না
তোমাকে ডাকার পালা শে হয়ে গেলো,
আর আজো আমি ভালো করে কথাই শিখিনি।
তুমি কি ভেবেছো আমি বড়োসড় হয়ে গেছি খুবই,
তোমাকে এখন আর ব্যাকুল শিশুর মতো ডাকবো না আমি?
কিন্তু মা এখনো আমি তোমার কোলের সেই শিশু রয়ে গেছি।
আজো তো তেমনি মাগো বয় পায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা পায়
কেউ একবিন্দু জলও দেয় না;
তুমি তো জানোই মাগো একলা আঁধার ঘরে
কী ভীষণ ভয়ে জড়সড় তোমারই বুকে লুকাতাম মুখ
আজ আঁধারের চেয়েও আঁধার চারদিকে
সামান্য মেঘের ডাকে যার ঘুম ভেঙে যেতো
আজ তরই মাথায় মাগো ভেঙে পড়ে বাজ,
তবু কারো এতোটুকু সরে না আঙুল;
ইঁদুরের শব্দে পাশে ভয় পাই তাই ঘুম পাড়িয়েছো তোমার কোলেই
আজ শ্বাপদসঙ্কুল এই অরন্যে বাস করি;
মাগো, তুমি নেই, তাই কেউ নেই
ভয়ার্ত শিশুর মতো আজো আমি সবটুকু শক্তি দিয়ে
যতোই তোমাকে শুধু ডাকি,
দেখি এই শব্দময় পৃথিবীতে বিশাল মৌনতা এসে গ্রাস করে
কেবল আমাকে।
ঘৃণার উত্তরে চাই ক্ষমা
হে মানুষ, তোমাদের ঘৃণার বদলে আমি
ভালোবাসার গোলাপ ছড়াবো,
তোমাদের উপেক্ষার মাটি ভেদ করে তুলবো সবুজ চারাগাছ
তোমাদের আলপিন-আঁটা বুটের তুলায় এই নগ্ন বুক পেতে দেবো
হে মানুষ, তোমাদের ঘৃণায় ফিরিয়ে-নেয়া কঠিন মুখের দিকে চেয়ে
আমি একাকী উড়াবো এই স্মৃতির রুমাল;
হায়রে মানুষ, তোমাদের ঘৃণার বল্লম আর হিংসার কুঠারে
ভীষণ রক্তাক্ত এই বুক,
তবু এই হিংসার বদলে চাই কেবল বিছিয়ে দিতে
হৃদয়ের গভীর আবেগ
তোমাদের বিদ্রূপের ঝাঁঝালো হাসির মুখে
এখনো ছড়াতে চাই প্রীতির কুসুম,
হে মানুষ, দাম্ভিক মানুষ তোমাদের তাচ্ছিল্য দেখেও আমি
এখনো আগের মতো বন্ধত্বের উষ্ণ হাত
তেমনি বাড়িয়ে দিতে চাই,
তেমনি ছড়িয়ে দিতে চাই তোমাদের পথে পথে জুঁই, চাঁপা,
শিউলি বকুল
তোমাদের নির্দয় কটাক্ষ ভুলে আমি দিতে চাই গাড় আলিঙ্গন;
হে মানুষ, তোমাদের কপটতা দেখে যদিও বা মর্মে মরে গেছি
তবু তোমাদের কুটিলতা ভুলে আমি সারল্যের সুকুমার পাপড়ি
ছড়াবো।
তোমরা ঘৃণায় যারা নিয়েছো ফিরিয়ে আজ মুক
সম্পূর্ণ করেছো প্রত্যাখ্যান,
আমার নামের ঠিক উপরে দিয়েছো ঢেলে কালিভরা একটি দোয়াত
তোমরা হিংসায় যারা বিছিয়েছো আমার পথের মাঝে
তীক্ষ্ণ তারকাঁটা,
যারা চাও আমাদের মাঝখানে বয়ে যাক শুধু হিমঝড়-
তোমাদের সকলের ঘৃণার বদলে আর উপেক্ষার বিনিময়ে আমি
হে মানুষ, ব্যথিত-ব্যাকুল এই ভালোবাসা আর দুই চোখভরা
এই আলুথালু অশ্রুজল ছাড়া কিছুই আনিনি;
হে মানুষ, দুর্পিত মানুষ, তোমাদের কুৎসা আর ঘৃণার বদলে
আমি সহিষ্ণু বৃক্ষের মতো দেখো বুক চিরে এখনো ফোটাই ফুল,
আজো আরক্তিম ভালোবাসা তোমাদেরই সমর্পণ করি
তোমাদের ঘৃণার উত্তরে বলি প্রিয়, হাত জোড় করে চাই ক্ষমা।
তুমি যখন প্রশ্ন করো
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি কে তোমায় ভালোবাসি?
অন্ধকারে লুকিয়ে মুখ
আমি নিজের মনেই হাসি।
উত্তরে কি বলবো বলো
বিশ্বকোষেও হয়তো নাই,
উথালপাতাল খুঁজে মরি
কোথায় যোগ্য শব্দ পাই।
জানো কি এই প্রশ্নে তোমার
হঠাৎ থামে নদীর ধঅরা
আকাশখানি কালো করে
মেঘে ঢাকা সন্ধ্যাতারা,
তার চেয়েও গভীর ঘন
লজ্জা ঢাকে আমার মুখ
পাইনে খুঁজে একটি কথাও
শঙ্কা-ভয়ে কাঁপে বুক;
এতোদিনেও বোঝেনি যে
আজ বোঝাবো কোন ভরসায়
না-বলা সেই ছোট্ট কথা
বলিনি কি কোনো ভাষায়?
বলিনি কি এই কথাটি
তোমার দিকে নীরব চেয়ে,
এই গান কি সারাজীবন
জীবন দিয়ে যাইনি গেয়ে?
সেই কথা তো জানে ভালো
শিশির-ভেজা ভোরের ফুল,
তুমি যখন প্রশ্ন করো
আমি করি অধিক ভুল।
পানুর জন্যে এলিজি
তোমাকে পানুই বলি, খুব ছোটো প্রিয় ডাকনাম
ভালো নাম তোমার জানি না; তবু নও তুমি কোনো
অচেনা মানুষ, খুব পরিচিত, খুব কাছের, পাশের
তুমিই হারিয়ে গেলে বহুদূরে অজানা আকাশে;
যতোই তোমার কথা ভাবি মনে হয় ফিরে এসে ঠিক
আবার বসবে কাছাকাছি, শধানে কুশল। হয়তোবা
এ-রকমই হবে, নিশ্চিতই হবে, মনে মনে ভাবি
কিন্তু তুমি আর বুঝি কথাই রাখবে না কোনোদিন।
তোমার টিকিট ছিলো, হ্যাণ্ডব্যাগ ছিলো, তবু কেন
মানুষ এমন তুমি ফিরে এলে কারগো-আরোহী
কেন হলে চলন্ত মানুষ তুমি স্তবির লাগেজ, কেন হলে,
তোমার টিকেট ছিলো, জামাজুতো ছিলো, সবকিছু ছিলো।
তুমি তো ভালোই ছিলে সামাজিক স্বচ্ছন্দ মানুষ
তোমার মমতা ছিলো, বুকভরা ভালোবাসা ছিলো,
তাই কি নিজেই তুমি হলে এই প্রেমের শহীদ
ভালোবাসা বেঁচে থাক, মানুষ মরেও যদি যায়।
হায়রে তোমাকে নিয়ে বেহুলার মতো সেই যে ভাসায়
তার ভেলা দূর নীলিমায়; মাদ্রাজ-সমুদ্র থেকে
বাংলাদেশে লালমাই পাহাড়ের কোলে, এই দীর্ঘ শবযাত্রা
শেষ হয়ে যায়, লখিন্দর উঠে বসে, কিন্তু তুমি
তবুও ওঠোনা। তোমাকে পানুই বলি, প্রিয় ডাকনাম
গোলাপ ফুটেছে আজো, দেখো চেয়ে ক্রিসানথিমাম।
পৃথিবী আমার খুব প্রিয়
ঢাকা আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি থাকি
আজিমপুর নামক একটি গ্রামে; খুবই ছোটোখাটো
একটি গ্রাম, বলা চলে শান্ত-স্নিগ্ধ ছোট্ট একটি পাড়া
এখানেই এই কবরের পাশে আমি আছি; বস্তুত এখান থেকে
ঢাকা বহুদূরে, আমি সেই ঢাকা শহরের কিছুই জানি না
আমাকে সবাই জানে আমি ঢাকার মানুষ,
কিন্তু আমি বাস করি খুবই ছোট্ট নিরিবিলি গ্রামে
আমি এই ঢাকার খুব সামান্যই চিনি, সামান্যই জানি।
এখনো আমার কাছে ঢাকার দূরত্ব ঠিক আগের মতোই
রয়ে গেছে, এখনো ঢাকায় যেতে বাসে চেপে, ট্রেন ধরে,
ফেরি পার হতে হয় রোজ, এমনটি
তারপরও ঢাকা গিয়ে পৌঁছতে পারি না; ঢাকার মানুষ
তবু বিশটি বছর এই একখানি গ্রামেই রয়েছি,
খুব চুপচাপ, নিরিবিলি, একখানি অভিভূত গ্রাম।
ঢাকা আমার খুব প্রিয় শহর, কিন্তু আমি পছন্দ করি গ্রাম
আজিমপুরের এই খোলা মাঠ, এই সরু গলি,
ঢাকার মানুষ তবু আজিমপুরের এই ছোট্ট গ্রামেই থাকতে ভালোবাসি
পৃথিবী আমার খুব প্রিয়, কিন্তু আমি বাংলাদেশ ছেড়ে
কোথাও যাবো না।
মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না
সবাই কলহে পটু, মানুষ বড়ো পছন্দ করে না
তবু দেখো মা তোমার উদ্দেশ্যে নীরবে এই
কবিতার দীঘৃ অশ্রুপাত
কেউ সে-কথা জানে না, শুধু আমি জানি এই কবিতা
তোমারই জন্য কতো ভাসিয়েছে বুক।
যাদের ব্যথিত ভেবে এতোদিন প্রকৃতিকে উপেক্ষা করেছি
ভেবেছি যাদের চোখ শ্রাবণের জলভরা নদী,
আজ দেখি তাদের চোখে একবিন্দু শিশিরও জমেনি
অনুভূতিহীন সেইসব চোখে শুধু ধু-ধু মরুভূমি;
তাই সবাই যখন দেখি অশ্রুর চেয়েও এই তীরকেই বেশি
ভালোবাসে
তখন নিজেই মুখ ঢেকে তোমার উদ্দেশে শুধু ফেলি অশ্রুজল।
তোমার সন্তান আমি তীর ছোঁড়া কখনো শিখিনি
শৈশবেও তীরন্দাজ হওয়ার ইচ্ছা কোনোদিন হয়নি আমার,
তাই তোমর উদ্দেশে এই অশ্রুপাত ছাড়া আর কোনো
যোগ্য ভাষা নেই
সবই যখন আজ বড়ো বেশি ব্যস্ত শুধু যার যার প্রাপ্য
বুঝে নিতে
যে যেমন পারে আজ টেক্কা দিয়ে চলে যেতে চায়,
তখন মা একান্ত বৈভবহীন আমি তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছি
আমার এই অশ্রুভেজা দীন পঙ্ক্তিমালা;
তাদের কারো মতো আমার তো মূল্যবান মণিমুক্তো নেই
এই ব্যর্ততার অশ্রুবিন্দু দিয়ে তাই তো তোমার জন্য বসে
মালা গাঁথি
তাই রাত জেগে জেগে আমি লিখে রাখি এই দীর্ঘশ্বাস।
রাত্রির আকাশ জানে তোমার উদ্দেশে কতো করি অশ্রুপাত,
মানুষ জানে জানে, ক্রন্দন জানে না।
মানুষ সহজে ভুলে যায়
মানুষ সহজে ভুলে যায়, আমি ভুলতে পারি না
এখনো শিশির দেখে অশ্রুভেজা চোখ মনে পড়ে,
সবুজ অরণ্য দেখে মনে পড়ে স্নেহের আঁচল
ভোরের শিউলি দেখে শৈশবের স্মৃতি চোখে ভাসে।
মানুষের মতো আমি এতো বেশি স্বাভাবিক নই
আমার নিশ্বয় কিছু স্নেহমায়া, পিছুটান আছে,
শোকদুঃখ, ভালোবাসা আমাকে এখনো দগ্ধ করে
পাথরের মতো এতোটা নিস্পৃহ আমি হতে পারি নাই।
মানুষ সহজে ভুলে যায়, বেশ ভুলে যেতে পারে
আমি এ-রকম ভুলতে পারি না। শুধু মনে পড়ে,
জল দেখে মনে পড়ে, মেঘ দেখে মনে পড়ে যায়
আঁধারে হারালো যারা সেইসব হারানো মানুষ।
কোথাও পাবো না তারে বৈশাখে কি ব্যথিত শ্রাবণে
মানুষ সহজে ভোলে, আমি কেন ভুলতে পারি না?
মানুষের সাথে থাকো
যতোই ব্যথিত হও মানুষের সান্নিধ্য ছেড়ো না
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে,
যতোই আঘাত পাও মানুষকে কিছুতে ছেড়ো না
যখন কিচুই নেই মনে রেখো,
তখনো সর্বশেষ আশা এই মানুষ;
সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার পাশে এসে মানুষই দাঁড়াবে
ফুল যখন ফুটবে না, পাখি যখন গাইবে না
কেবল আকাশ-বাতাস মথিত করে আসবে ধ্বংস, আসবে মৃত্যু
তখনো মানুষই তোমার একমাত্র সঙ্গী;
মানুষেল সব নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার পরও
মানুষই মানুষের বন্ধু।
অরণ্য নয়, পাহাড় নয়, সমুদ্র বা তৃণভূমি নয়
মানুষের হৃদয়ই তোমার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়
আর কোথাও নয় কেবল মানুষের হৃদয়েই মানুষ অমর।
মানুষকে এড়িয়ে কোনো সার্থকতা নেই
যতোই আঘাত পাও, যতোই ব্যথিত হও
মানুষের সঙ্গ ছেড়ো না,
মানুষের সাথে থাকো সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে
কেবল মানুষই এই মানুষের চিরদিন বাঁচার সাহস।