- বইয়ের নামঃ মানুষ বড়ো ক্রন্দন জানে না
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ এশিয়া পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার কণ্ঠ কেউ থামাতে পারবে না
যতোই চাও না কেন আমার কন্ঠ তুমি থামাতে পারবে না,
যতোই করবে রুদ্ধ ততোই দেখবে আমি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়।
আমার কন্ঠকে কেউ কোনোদিন থামাতে পারেনি
যেমন পারেনি কেউ কোনো কালে ঠেকাতে অরুনোদয়,
চাও বা না চাও নৈঃশব্দ্যেও যদি কান পাতো
শুনবে আমারই কণ্ঠস্বর।
কীভাবে আমার কণ্ঠ সম্পূর্ণ রাখবে রুদ্ধ করে
আমি তো পাখির কলস্বরে হই উচ্চারিত,
কখনো নদীর শব্দেম কখনোবা শস্যক্ষেতে বাতাসের ছন্দে
বেজে উঠি
আমার নিষিদ্ধ কণ্ঠ দেখবে তুমুল ওঠে বেজে,
আমার কণ্ঠকে কেউ থামাতে পারেনি, পারবে না।
আমাকে নিষিদ্ধ করে লাব নেই, আমি নিষেধ মানি না
সমস্ত নিষিদ্ধ পোস্টার আমি লাগিয়েছিবুকে, কেউ
সরাতে পারেনি
আমার কণ্ঠেই তবু অবিরাম স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা;
তোমাদের সাধ্য নেই আমার কণ্ঠকে কেউ রুদ্ধ করে রাখো।
তোমাদের কোনো অস্ত্রে আমার কণ্ঠকে তুমি থামাতে পারবে না
যতোই আমাকে তুমি পরাবে মিকল, যতোই করবে রুদ্ধ
এই কণ্ঠস্বর,
দেখবে ততোই আমি শব্দহীন নীলিমার মতো ধ্বনি-
প্রতিধ্বনিময়, বিচ্ছুরিত
আমার কণ্ঠকে তাই ঠেকাতে পারবে না, কখনো পারবে না।
আমার ফেলতে হবে আরো অশ্রুজল
আমার ফেলতে হবে আরো অশ্রুজল, আমাকে ভাঙতে হবে
আরো দীঘৃ পথ
আমি জানি আমার ঝরাতে হবে আরো রক্ত ঘাম;
অন্য কারো কথা আমি বলতে পারি না, তবে আমার ঠিকই জানি
আরো অনেক মোছাতে হবে নগ্ন পদতল,
সবার পায়ের নিচে আরো বহু হতে হবে ঘাস
আমাকে সরাতে হবে আরো অনেক পথের তীক্ষ্ণ কাঁটা;
আমি জানি না হলে আমার এই ব্যর্থ হাতে ফুটবে না কোনো তুচ্ছ ফুল,
আমাকে সরাতে হবে অনেক পাথর, আমাকে খুলতে হবে অনেক
দরোজা
আমার পেরুতে হবে অনেক বন্ধুর গিরি-খাত, আমার করতে হবে
একা জেগে অনেক দুঃখের রাত্রি ভোর;
আর কারো কথা আমি বলতে পারি না তবে এ ছাড়া আমার কোনো
পরিত্রাণ নেই
গহীন জঙ্গলে হিংস্র বাঘের সামনে কতো আমাকে পড়তে হবে আরো
ভয়াল দৈত্যের মুখে বুক বেঁধে সাহসে দাঁড়াতে হবে জানি,
না হলে আমার হাতে ফুটবে না একটি কমল।
আমাকে মাড়াতে হবে আরো অনেক দুয়ার, পথে পথে
আমাকে ছড়াতে হবে চেরি
আরো আমাকে মোছাতে হবে চোখ, আমার করতে হবে
আরো বহু ক্ষতের শুশ্রূষা,
আরো আমাকে ছড়াতে হবে পথে পথে, আরো নিঃশেষে
পোড়াতে হবে নিজের জীবন
আমার সইতে হবে আরো কঠিন আঘাত, আমার বইতে হবে
আরো দুঃখভার,
আমার ফেলতে হব আরো অশ্রুজল, আমার করতে হবে
আরো লণ্ডভণ্ড ঘর ও সংসার
আরো ছিন্নভিন্ন করতে হবে এই গেরস্থালি, ভিতর-বাহির।
আমার তাহলে ছেড়ে ছুঁড়ে নেমে যেতে হবে সব ফেলে, বুদ্ধের মতন
চলে যেতে হবে সব ফেলে,
যদি একটিও তুচ্ছ ফুল ফোটাতে চাই তাহলে ফেলতে হবে
আরো অশ্রু
তাহলে আমার তুলে নিতে হবে হাতে ভিক্ষাপাত্র, ছিড়ে
ফেলতে হবে সব প্রিয় আকর্ষণ, সব স্নেহমায়ার বন্ধন
ভুলে যেতে হবে সন্তানের অশ্রুভেজা চোখ
তাহলে আমার আর একবারও পেছন ফিরে তাকালে চলবে না,
চলে যেতে হবে।
আমার স্বপ্নের মধ্যে
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ দ্রুত পায়ে
হেঁটে যায়,
কোনোদিন দেখি তাকে ব্যতিব্যস্ত সাইকেল-আরোহী
ঘরে ঘরে বিলি করে আরক্তিম চিঠি
তাতে খুব বড়ো করে লেখা দুটি শব্দ-স্বাধীনতা এবং বিপ্লব।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ আছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে,
আবর কখনো দেখি একাকী লিখছে বসে বিশাল পোস্টার
কখনো আঁকছে তাতে উত্তেজিত মানুষের মুখ
কখনোবা আঁকছে সে মানুষের পাশে দাঁড় করিয়ে মানুষ
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতম সেতু;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ হেঁটে যায় ছায়াছন্ন পথে
কোনাদিন দেখি তাকে রৌদ্রদগ্ধ পথের ওপর,
তাকে মনে হয় ভীষণ সাহসী যেন
স্পার্টাকাসের মতো ছিঁড়ে ফেলে সমস্ত শৃঙ্খল।
কোনোদিন দেখি তাকে আশাহত বসে আছে
একটি আঁধার ঘরে একা
চারপাশে পড়ে আছে অসংখ্য ধূসর পান্ডুলিপি
আর ছবির মলিন অ্যালবাম;
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ কোনোদিন দেখি তাকে
ক্ষুব্ধ হাতে ভাঙছে সকল কারপ্রাচীরের লোহার দরোজা।
আমার স্বপ্নের মধ্যে একটি মানুষ ছন্নছাড়া কেমন উদাস
কখনো বিষণ্ন চোখে কেবল তাকিয়ে আছে
আকাশের দিকে-
কোনোদিক দেখি মায়াকোভস্কির সেই অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে
লিখছে সে মানুষের দুঃখের কবিতা,
কোনোদিন দেখি তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে আঁকছে সে
বেগবান বিদ্রোহের পাশে দীপ্তিময় লেনিনের মুখ।
আমি চাই
আমি আজ প্রাণখোলা অট্টহাসি চাই
বৈশাখের ঝড় চাই, উদ্দামতা চাই।
ফিসফিস কানাকানি চাই না মোটেও,
যার যা বলার খুবই স্পষ্টাস্পষ্টিভাবে বলা চাই।
অশ্রু ও আর্দ্রতা নয় আজ আমি খর চৈত্র চাই
সেতু ভেঙে আজ চাই দীর্ঘ ব্যবধান,
আজ শুধু দূরত্ব চাই নৈকট্য চাই না
চাই না শীতল ছায়া, চাই দগ্ধ রৌদ্রের দুপুর।
আজ চাই শক্ত মাটি, ইট-কাঠ, লোহা
কাদামাটি, ঘাস্তফুল, এসব চাই,
আজ আমি সমুদ্রগর্জন চাই, জলোচ্ছ্বাস চাই
ওলটপালট-করা ভূমিকম্প চাই।
আকাশের মতো খোলা বুক চাই
দুরন্ত সাহস আর অফুরন্ত প্রাণাবেগ চাই,
পাহাড়ী নদীর সেই তুমলি ক্ষিপ্রতা চাই
উত্তাল তরঙ্গ চাই, বিস্ফোরণ চাই।
আমি চাই অধিক বিরহ আজ, মিলন চাই না
বন্ধন চাই কোনো, মনপ্রাণে স্বাধীনতা চাই,
কোনো ঘোমটা চাই না আর, খোলামেলা দেখাশোনা চাই
চাই না সামান্য স্থিতি, আজ চাই অনন্ত সাঁতার।