- বইয়ের নামঃ মহাদেব সাহার বিবিধ কবিতা
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
ঘুম আর স্বপ্নের মহড়া
কত দিন ঘুমের ভেতরে এই অনন্ত এস্রাজ, জলপরিদের
ডানার কল্লোল
বাতাসে উড়ছে তার উত্তাল সোনালি চুল,
এই অস্থির স্বপ্নের মধ্যে হারিয়েছি সুখের শৈশব।
আজ যতই খুলতে যাই ঘুমের তুড়িতে সেই নিঃশব্দ দরোজা
অন্ধ প্রাচীর
নেমে আসে সহস্র উলঙ্গ রাত্রি, উলঙ্গ আঁধার
এইখানে আর কোনো শব্দ ঘ্রাণ উদ্ভাসন নেই।
এই অখণ্ড ঘুমের খাতা, স্বপ্নে খসড়া বই
পরিদের আঙুলের ছাপ
রুপোর মুদ্রার মতো নেমেছে অঝোর বৃষ্টি,
এই মেঘের সৌরভে বুঝি দূরে ভেসে যায়,
ঠিকই জানি, বেঁচে থাকা শুধু এই ঘুম আর স্বপ্নের মহড়া।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৮, ২০১১
জলতৃষ্ণা
পাহাড়ি ঝর্নার কাছে ছুটে যাই গ্রীষ্মের তৃষিত
কাক,
ঠোঁটে স্পর্শ করে দেখি বিষ
তৃষ্ণা এত জল ভেবে এই বিষই খাব;
আমার তৃষ্ণার কাছে বিষই অমৃত হয়ে যাবে,
জেগে উঠবে সপ্তর্ষিমণ্ডল
ঘুমন্ত পাহাড় নেচে উঠবে ঘুঙুর পায়ে
কিশোরীর মতো।
আমি আকণ্ঠ করব বিষজল পান
এই বিষে বিষ নেই, মেলে ধরি
লোকবিজ্ঞান,
শোধন করেছি বিষ, পান করি এই বিষামৃত।
পাহাড়ি ঝরনার কাছে ছুটে যাই,
গলা শুকিয়ে কাঠ
একফোঁটা বিষও যদি পাই করি তাকেই অমৃত,
করি ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডার
নিষেধ মানি না কনিষ্ঠ পাণ্ডব নেমে যাই জলে,
থাক বিষ, থাক কাঁটা, থাক যত দাম
আমি ওই জল, জলপদ্ম নেব;
জেগে ওঠো ঘুমন্ত পাহাড়, জলভূমি, সুপ্ত মেঘদল
সর্বত্র এই যে বিষ, বর্ষণে বর্ষণে পাহাড়ের ঢলে,
বনের নিঃশ্বাসে করো তাকেই অমৃত।
——————–
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
নিজে হও
কারো হাতে বাঁশি নেই, নিজেকে বাজাও
নিজেই পাখির শিস, নিজেকে শোনাও,
কোনোখানে মেঘ নেই, নিজে মেঘ হও
পৃথিবী ফেরায় মুখ, নিজে কথা কও।
কোথায় বর্ষণ পাবে, নিজে হও জল
নিজেই অমৃত হও, সর্বত্র গরল;
সবখানে অন্ধকার, নিজে হও ভোর
কেউ নেই, নিজেই প্রেমিক নিজে তোর।
কে বলো গাইবে গান, নিজে গান গাও
কাকে পাবে? নিজের নিকটে নিজে যাও,
সব শুষ্ক মরু, নিজে হও জলাশয়
প্রেমপত্র নেই, পড়ো নিজের হূদয়।
তোমার জন্য কার আছে অশ্রুজল
নিজের দুইটি চোখই শুধু টলমল,
সেই হোক একবিন্দু তোর ভালোবাসা
এই যে নিজের কাছে নিজে ফিরে আসা।
কে তোর দরদী হবে, বোন হবে, বালিকা কুমারী,
নিজেই পুরুষ হও, নিজেই হ নারী।
——————
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
বসন্তের একটি বাংলা উদ্ধৃতি
চুনা-ওঠা দেয়ালের মতো প্রকৃতির এই খসখসে গালে
আর কী রং মাখাবে চৈত্র,
তোমার পকেটে ভাঁজ-করা শতবর্ষের শীতকাল,
মাতাল হাওয়ায় যতই এই বার্ধক্য ঢেকে দিতে চাও
তার মুখমণ্ডলে জমে আছে
উত্তর গোলার্ধের অনন্ত বরফ
তার শরীর ২৫ ডিগ্রি মাইনাস শীত রাত্রে;
কেনা জ্যেত্স্না, গোলাপ আর সৌরভের জন্য
হাহাকার করে
আমি কতোকাল শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে
এই শীতকাল পেরুব? গুনগুন করা চৈত্রসন্ধ্যা
মধুর দুপুর
এখনো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে,
আমি সাড়া দেই না;
কেন দেব? আমার শীত কখন অস্ত যাবে,
কেউ জানে না।
হয়ত তবু সদ্যফোটা স্তনের গন্ধে, ঠোঁটের লাবণ্যে
জেগে উঠবে ঝিমিয়ে-পড়া দিনরাত্রি,
একুশ শতকের এই দীর্ঘ শীত পাড়ি দেওয়ার জন্য
আর কতো হিমযুগ পার হতে হবে আমাকে,
বসন্ত, তোমার হাতবাক্সে কি সেই উত্তর লেখা আছে?
চলো বসন্তের একটি বাংলা উদ্ধৃতি শোনাতে শোনাতে
আমরা পৃথিবীর সব নদী পার হই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০১০
মুছে যাওয়া নামগুলির জন্য এলিজি
কত নাম মুছে গেছে জলে ভেজা অক্ষরের মতো
কত ছবি হয়ে গেছে মেঘের আকাশ,
এত নাম ধরে রাখা ছিল, মেমোরি কিছুই রাখেনি
সব খালি ডিস্ক, সাদা পৃষ্ঠা
কত নাম ঝরে গেল ঝরাপাতার মতন;
কিছুই পাবে না ফিরে, শৈশব, সৌরভ,
মর্নিং স্কুল
হাতে লেখা চিঠিগুলি কাগজের নৌকা হয়ে
ভেসে গেছে জলে,
ছেড়ে গেছে ইস্টিমার, পদ্মা এক্সপ্রেস
লোডশেডিংয়ের মতো বিষণ্ন স্টেশন,
বন্ধ দরজায় শুধু বারবার ব্যর্থ কড়া নাড়ি।
মুছে গেছে কত উজ্জ্বল অক্ষর, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো
নাম,
ধুয়ে গেছে আঙুলের মিষ্টি গন্ধ, রুমালের ঘ্রাণ
বকুল ফুলের মধুর দুপুরবেলা,
আজ সব খালি ডিস্ক, সাদা পৃষ্ঠা;
কখন যে বুকপকেটে রাখা চিঠিগুলি সব
জলে ভিজে গেছে,
কখন যে হারিয়ে গেছে সমস্ত কয়েন, বাড়ির নম্বর
মুছে গেছে সবটুকু স্লেট, সবটুকু কাগজের
পাতা,
আছে শুধু ক্ষতচিহ্নের মতো জলের করুণ কিছু
দাগ, কত অশ্রুভেজা অবুঝ অক্ষর।
———————-
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯
রেখে দিয়ো
এখানে তোমাদের এই অশ্রুহীন চোখ,
কয়েক লাইন বিদ্যা মুখস্থ করা গম্ভীর মুখ
আর মলাট চিবানো দাঁত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত;
আমি তাই হাত বাড়িয়ে আছি তাদের দিকে
যারা ডোবা বিল আর পুকুরে পদ্মফুল ফোটায়,
বাংলা সন-তারিখ দিয়ে চিঠি লেখে;
আমি তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি, যদি পার
একগুচ্ছ তৃণ আর একফোঁটা অশ্রু
আমার জন্য রেখে দিয়ো;
আমি তার গন্ধে মৃত্যুলোক থেকে জেগে উঠতে পারি।
আজ আর আমার শহরের এই অন্ধ
ফুটপাতের কাছে,
এই সব মুখোশ-পরা মুখের কাছে
কিছুই চাওয়ার নেই;
দাঁত আর নখের গর্বে যারা মত্ত তারা কেন
আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলতে যাবে?
তোমরা যারা ডোবা-বিল খেতখামারের লকলকে
ঘাসের মধ্যে ডুবে আছ,
তোমরা যারা গায়ে মাখ পাকা ধানের গন্ধ,
তাদের বলি, আমার জন্য রেখে দিয়ো
একফোঁটা অশ্রু।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০
শপিং মল কিংবা হাটখোলা
তোমরা নতুন বাড়ি, আমি পুরাতন
তোমরা স্বয়ংক্রিয়, আমি ম্যানুয়াল
তোমরা টুরিস্ট পার্ক, আমি ঝাউবন
তোমরা স্পিডবোট, আমি ছেঁড়া পাল।
তোমরা সুদৃশ্য লেক, আমি মজা বিল
তোমরা উদ্দাম পপ, আমি ভাটিয়ালি,
তোমরা নভোযান, আমি গাঙচিল
তোমরা দূরের বাদ্য, আমি করতালি।
তোমরা আকাশচারী, আমি নৌপথ
তোমরা কৃত্রিম ঝরনা, আমি বৃষ্টিজল,
তোমরা উড়ন্ত জেট, আমি ভাঙা রথ
তোমরা মেগা সিটি, আমি বনাঞ্চল।
তোমরা সেলফোন, আমি ডাকঘর
তোমরা আইপড, আমি খালি গলা,
তোমরা হার্ডডিস্ক, আমি হস্তাক্ষর
তোমরা রেকর্ডার, আমি মুখে বলা।
তোমরা শপিং মল, আমি হাটখোলা
তোমরা সমুদ্রপোত, আমি গন্ডোলা।
——————
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯