- বইয়ের নামঃ যদুবংশ ধ্বংসের আগে
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আকাশ কাঁদে, নদীটি নির্জন
দুপুর যেন তন্দ্রাহত বন
শান্ত নদী, একাকী নির্জন,
আকাশ বলে মেঘের উপাখ্যান
দুচোখ বুজে দেখার নামই ধ্যান;
আমি বৃথাই জলের দিকে চাই
হৃদয়ে চড়া, সোঁতাও কাছে নাই-
দেখি কেবল দগ্ধ পোড়া বালি
ছঅয়ারা দেয় শূন্যে হাততালি,
জীবন জুড়ে দুঃখ লেখে নাম
শূন্যতাই কি সবার পরিণাম?
ভালোবেসে যেদিকে হাত বাড়াই
ধরার মতো কোথাও কিছু নাই,
দেখি শুধু পাহাড় ভেঙে পড়ে
কেন নবীন পাতারাও যে ঝরে!
দুপুর যেন মর্মাহত বন
আকাশ কাঁদে, নদীটি নির্জন।
আমাকে কি ফেলে যেতে হবে
এই আকাশ কি আমার নয়
আমি তার শুশ্রূষা হারাবো?
এই ভোরের শিশির, উদাসীন মেঘ,
স্নিগ্ধ বনভূমি
আমি তার সান্নিধ্য পাবো না?
আমাকে কি ফেলে যেতে হবে এই নদীর কল্লোল
ভাটিয়ালি গান, কাশফুল, চেনা ঝাউবন
এই দিঘি, জলাশয়, প্রিয় সন্ধ্যাতারা-
ফেলে যেতে হবে এই স্মৃতির উঠোন
প্রেমিকার মুগ্ধ চোখ, মায়াময় দিব্য হাতছানি?
ফেলে যেতে হবে শৈশবের স্মৃতিময় দিব্য হাতছানি?
ফেলে যেতে হবে শৈশবের স্মৃতিময় মাঠ,
হাটখোলা
বৃক্সের পবিত্র ছায়া, তৃণক্ষেত্র, গ্রামের অথই বিল
শহরের এই ফুটপাত, উত্তাল রেস্তরাঁ।
এই নদ িকি আমার নয়, বৃক্ষ কি আমার নয়,
এই নদী কি আমার নয়, বৃক্ষ কি আমার নয়,
ভাঁটফুল, বর্ষার কদম,
নতুন ধানের গন্দ, বৈশাখের মেলা,
রুপালি ইলিশ?
ফেলে যেতে হবে মায়ের মধুর স্মৃতি
পিতার অন্তিম শয্যা,
বোনের আদর, ভঅইফোঁটা, তুলসীমঞ্চ
সন্ধ্যাপ্রদীপ-
বাউলের গান, সুফী দরবেশের ধ্যানী দৃষ্টি
শরতের শুভ্র সকাল, বৃষ্টিভেজা দোয়েল-শালিক?
আমাকে কি অবশেষে ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তর মতো
ফেলে যেতে হবে এই বাস্তভিটা, ভদ্রাসন,
রাইসরিসার ক্ষেত,
ফেলে যেতে হবে পান্ডুলিপি, কবিতার খাতা!
চাই না কোথাও যেতে
আমি তো তোমাকে ফেলে চাই না কোথাও যেতে
পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা মনোরম স্থানে,
সমুদ্র-সৈকতে, স্বর্ণদ্বীপে-
স্বপ্নেও শিউরে উঠি যখন দেখতে পাই
ছেড়ে যাচ্ছি এই মেঠো পথ, বটবৃক্ষ, রাখালের
বাঁশি,
হঠাৎ আমার বুকে আছড়ে পড়ে পদ্মার ঢেউ
আমার দুচোখে শ্রাবণের নদী বয়ে যায়;
যখন হঠাৎ দেখি ছেড়ে যাচ্ছি সবুজ পালের নৌকো,
ছেড়ে যাচ্ছি ঘরের মেঝেতে আমার মায়ের আঁকা
সারি সারি লক্ষ্মীর পা
বোবা চিৎকারে আর্তকণ্ঠে বলে উঠি হয়তো
তখনই-
তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে।
তুমি চলে যাবে বলতেই
তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে
পাড় ভাঙার শব্দ শুনি-
উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের খুব গরম হাওয়া বয়,
মার্সির কাঁচ ভাঙতে শুরু করে;
দরোজা থেকে যখন এক পা বাড়াও আমি
দুই চোখে কিছুই দেখি না-
এর নাম তোমার বিদায়, আচ্ছা আসি, শুভরাত্রি,
খোদাহাফেজ।
তোমাকে আরেকটু বসতে বললেই তুমি যখন
মাথা নেড়ে না, না বলো
সঙ্গে সঙ্গে সব মাধবীলতার ঝোপ ভেঙে পড়ে;
তুমি চলে যাওয়ার জন্যে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকো
তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর আরো কিছু বনাঞ্চল উজাড়
হয়ে যায়,
তুমি উঠোন পেরুলে আমি কেবল শূন্যতা শূন্যতা
ছাড়া আর কিছুই দেখি না
আমার প্রিয় গ্রন্থগুলির সব পৃষ্ঠা কালো কালিতে ঢেকে যায়।
অথচ চোখের আড়াল অর্থ কতোটুকু যাওয়া,
কতোদূর যাওয়া-
হয়তো নীলক্ষেত থেক বনানী, ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট
তবু তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে
সেই থেকে অবিরাম কেবল পাড় ভাঙার শব্দ শুনি
পাতা ঝরার শব্দ শুনি-
আর কিছুই শুনি না।
তোমাকে যাইনি ছেড়ে
তোমাকে যাইনি ছেড়ে আম-জাম
কাঁঠালের বন,
অশ্বত্থ-হিজল-বট, ঘুঘু-ডাকা চৈত্রের দুপুর-
এই খেয়াঘাট পার হয়ে কতো আত্মীয়-বান্ধব
চলে গেছে,
এই গাঁয়ের হালট ধরে চলে গেছে নয়াদা
ও রাঙা বৌদি
আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে
কাকিমা ও তার কিশোরী মেয়েটি;
সেই কবে মামাদের এতো বড়ো রায়বাড়ি
শূন্য হয়ে গেছে-
শিশুদি ও উষা পিসিমার কথা আজকাল
বড়ো মনে পড়ে যায়-
তারা কে এখন কোথায় আছেন, শুনেছি
কয়েক বছর আগে শিলিগুড়িতে গত হয়েছেন
আমার জেঠতুতো বড়ো ভাই,
শৈশবের সেইসব সঙ্গী, কতো প্রিয় মুখ
এভাবে এখন দূর স্মৃতি হয়ে গেছে;
তবু তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই, কার
ভয়ে, কার রক্তচক্ষু দেখে,
লোমশ নখর দেখে বলো-
একুশের বইমেলা, শহীদ মিনার,
পয়লা বৈশাখের বটমূল, রমনার মাঠ-
আমার কতো যে প্রিয় তুমি এই বঙ্গোপসাগর,
করতোয়া, ফুলজোড়, অথই উদাস বির,
পুকুরের শাদা রাজহাঁস,
নিবিড় বটের ছায়া, ঘন বাঁশবন।
তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই পিতার সমাধি
বন্ধুর কবর, আজানের ধ্বনি
বাউলের ভজন্তকীর্তন্ত
তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই ধানক্ষেত, মেঠোপথ,
স্বদেশের সবুজ মানচিত্র,
তোমাকে কেমন করে ছেড়ে যাই প্রিয় নদী,
প্রিয় ঘাস, ফুল।
না-লেখা কবিতাগুলি
পথে পথে ঘুরে দেখি না, না, হারিয়ে যায়নি
একটিও না-লেখা কবিতা-
আছে আগুনে, ইথারে, বাষ্পে,
সবকটি মৌলিক পদার্থে,
তৃণক্ষেত্রে, সমুদ্রে, আকামে আছে এই না-লেখা কবিতা।
দেখি তাকে কারো চোখে হয়ে আছে দুফোঁঃেটা
নিবিড় অশ্রু,
কারো বুকে অবিরাম তপ্ত দীর্ঘশ্বাস্ত
কোথাওবা ফুটে আছে সবচেয়ে সুদৃশ্য গোলাপ
সূনীল আকাশে রাশি রাশি তারা;
সব মানুষের বুকের ভেতরে আছে যে অনন্ত ফল্গুধারা
স্বচ্ছ সরোবর, স্নেহমমতার স্বর্ণখনি
অলিখিত আমার কবিতাগুলি সেই নায়েগ্রার জলের প্রপাত
এই না-লেখা কবিতা দেখি মাঝে মাঝে একাকী ঝর্নার জলে
ভেজায় বিশুস্ক কণ্ঠ যেন তৃষ্ণার্ত হরিণ,
যা কিছু সুন্দর, অপরূপ, কদাকার
তার দিকে তাকিয়েও মনে হয় একেকটি না-লেখা কবিতা;
তারা কখনো দেকেনি মুখ আলো-বাতাসের
কোথায় যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কোথঅওবা
হয়ে আছে সবুজ প্রেইরী,
কোথাওবা ছায়াঘেরা শান্ত বনস্পতি, এই না-লেখা কবিতা।
যদুবংশ ধ্বংসের আগে
এ কী বৈরী যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সকলে
সূর্য নিয়ত ঢাকা চিররাহৃগ্রাসে, মানবিক
প্রশান্ত বাতাস এখন বয় না কোনোখানে
শুধু সর্বত্র বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব;
তাদের কদর্য বেড়ায় নেচে কবন্ধ-দানব;
তাদের কদর্য চিৎকারে ফেটে যায় কান,
চোখ হয়ে যায় কী ভীষণ রক্তজবা, সহসা
দিগন্ত জুড়ে নেমে আসে ঘোর সন্ধ্যার আঁধার।
কিছুই যায় না দেখা চোখে, নিঃশ্বাসও
হয়ে ওঠে পাথরের মতো ভারী, যেন কোনো
পাতালপুরীতে পড়ে আছি নিঃসঙ্গ কয়েদী;
এখানে সতত দেখি কোনো এক
দ্বিপদ প্রাণীর বিচরণ, মানুষের মতো, কখনো
মানুষ নয়, এই ছায়া-মানুষের পাশে
দিন কাটে, রাত্রি শেষ হয়, পাই না তৃষ্ণার
এক ফোঁটা জল, একটু শীতল ছায়া,
মনে হয় কোনোদিন নিভবে না এই দোজখের নৃশংস আগুন।
এ কোন ঘাতক-যুগে এসে দাঁড়ালাম আমরা সবাই,
তবে কি এসব কিছু যদুবংশ ধ্বংসেরই আগের নিশানা।