- বইয়ের নামঃ মানব এসেছি কাছে
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ নিউ বুক প্যালেস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমি কেন এ-রকম
আমি যেন কী রকম সব কিছুতেই কী রকম
একটা ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব
একটা দুঃখিত দুঃখিত ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব,
বুকের ভিতর আমি ধরে রাখি দুঃখের শিশির
পিতৃপুরুষের সেই বাক্যহীন অন্ধকার,
সেই ডুবুন্ত নৌকার দৃশ্য
আমার এ-বুক যেন ভুবন মাঝির সেই শ্যাওলা-পরা ঘাট
আমি প্রতি রাতে শেষ তারা ডুবে যাওয়া লক্ষ্য করে কাঁদি
তবু প্রকাশ্যে এমন আমি এ-রকম
এই ছেলে মানুষি মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব!
আমি দুঃখিত হলেও লোকে ভাবে ও কিচ্ছু না শুধু
দুঃখ দুঃখ ভাব
আমি কাঁদলেও কান্না কান্না ভাব বলে ভাবে,
ভালোবাসলেও আমি ধরে নেয় মাত্র ছেলেখেলা
আমি কেন এ-রকম
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লজ্জা লজ্জা ভাব
আমি কেন অহঙ্কারে হাঁটতে পারি না
দশ হাত ফুলিয়ে বুকের ছাতি,
আমার দুঃখের কথা, লালসার কথা, এই নারীলিপ্সার কথা
কেন সিঃসঙ্কোচে বলতে পারি না,
কেন অবিশ্বাসী হাসি হেসে বলতে পারি না
পাপ বলে কিছু নাই, ধর্ম বলে কিছু নাই,
আমি ক্ষতিগ্রস্থ হলে, অপমান হলে
জল ছুঁয়ে, ভূমি স্পর্শ করে, নারীর অঙ্গ ছুঁয়ে
কেন আমি কাউকে পারি না দিতে ভয়ঙ্কর ক্রূর অভিশাপ!
আমি কেন এ-রকম সব কিছুতেই
এই ছেলেমানুষি-মানুষি ভাব, লাজুক লাজুক ভাব।
» আমি তো তোমারই বশ
আমি তো পাখিরও বশ, ভ্রমরের বশ
কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও সুস্মিত গোলাপ
বিষণ্ন বাবুই, হে পাখি, হে উদাসীন সরুযুর কাক
তোমরা ছাড়িয়া যাও!
আমাকে ছাড়িয়া যাও সন্ধ্যার শায়িত মাঠ
আজানের হে সুবে সাদেক, আমি তো তোমারই বশ,
তোমাদের সকলেই বশ
তোমরা দুজন বড়ো অভিমানী নারী
আমি তো তোমারই বশ
কালিন্দীর কোন কূলে ভরেছো কলস, কোন তমালের মূলে
ছয়টি কালিমা খুলে করেছো ভূষণ!
সাক্ষী থাকো তুমি হে তৃষ্ণার নদী, হে রাখাল, অশত্থু বাউল
আমি তো তোমারই বশ ওই যে সাতটি হরিৎ তৃণ, সোমত্ত সাতটি তারা
কামিনীর সাতগুচ্ছ চুল, আমি তোমাদেই বশ
টিলায় দাঁড়ানো চাঁদ, যুবক পাহাড়, কালো ধেনু, হে কালো তমসা
আমি তো তোমারি বশ হে শয্যা, হে কালো নয়ন
তবু কেন আমাকে ছাড়িয়া যাও ও দুজন সবুজ রমনী
ও কালো মাঠের গাঁও, ধানের উচ্ছব
কেন তোমারা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
কেন তোমরা ছাড়িয়া যাও হে ভিক্ষু, হে আশ্রমের শুভ্র বালিকা
আমি তো তোমারই বশ,
হে নারী, হে তৃণ, হে পরমা প্রকৃতি!
একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ, আহা ও কালো কুঠার,
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, আহা এ বড়ো নিঠুর, উহাদের
করো না আঘাত
উহারও ভিতরে আছে প্রাণ
জলেরও ভিতরে আছে, মাটিতেও আছে, জড়ত্বেও আছে
এ প্রাণের বীজ
অগ্নিমন্ত্র, এই গুচ্ছ গুচ্ছ প্রাণ, মধ্যমার সনাতন সখা
বৃক্ষেও আছেন প্রাণ, শিলায়ও আছেন
সমুদ্র তাহারও কন্ঠের কাছে ধিকি ধিকি জ্বলে যে আগুন
সেই শিখাটিই প্রাণ
পাথরের মধ্যে যা স্ফটিক ধ-ধু অশ্রুজল
সাত তাল জলের নিম্নে খুঁজে তাকে ও কালো কুঠার
ঘাতকের বিষমাখা ফলা, ও রক্তমাখা হাত
ছেঁড়ো খেঁড়ো যা কিছুই করো
একটি ভ্রমর তার সাতটি পরান!
নির্বপিত কুসুমেরও মধ্যে ফোটে ঘ্রাণ, খোলে মায়া
ওই শুয়ে আছে শিশুর চেখের থির হ্রদে
সকল বস্তুতে আছে বস্তুরঅধিক সেই প্রাণ,
মৃত্যুর পরেও তাই যায় একটি ভ্রমর
আহা ও কালো কুঠার, ঘাতকের বিষমাখা ফলা
উহাদের দিও না ছোবল, ওরা প্রাণ, ওরা প্রাণ!
ওই শিশুর ভিতরে প্রাণ, প্রাণীর ভিতরে, ওই শিলায় অগ্নিতে জলে
একটি ভ্রমর ওরা উহাদের সাতটি পরান।
এসেছি অঘ্রানে এক আমি আগন্তুক
অঘ্রানে আমার জন্ম হবে যদি মরে যাই
ঠিক ঠিক গালের জরুল নিয়ে চেয়ে দেখো
এসেছি অঘ্রানে এক আমিআগন্তুক!
তোমাদের স্থির মানব্ স্থিতির মাঝখানে
এসে দাঁড়াবো আদ্যন্ত এক মানুষী সংবিৎ
শস্যের সুঘ্রাণ লেগে রবে এই সারা চক্ষুময়
সারাদেহ রোমাঞ্চিত হবে যদি মরে যাই
ফিরে এসে ঠিক চিনে নেবো তাকে প্রাক্তন প্রেমিকা
পায়রার খোপ এই, শস্যক্ষেত্র, উদাসীন আবাল্য বাউল,
অঘ্রানে আমার জন্ম হবে
আমার চুলের গন্ধ শুঁকে দেখো, নখ দেখো
গায়ে গেঁয়ো জনি-পাতার রস লেগে রবে
তখনো আদিম বন্য ঘ্রাণ কিছু পাবে
আমি সেই সনাতন মানুষী সংবিৎ দেখো
এসেছি অঘ্রানে এক আমি আগন্তুক!
কতো নতজানু হবো, দাঁতে ছোঁবো মাটি
কতো নতজানু হবো, কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি
এই শিরদাঁড়া হাঁটু ভেঙে
কতোবার হবো ন্যুব্জ আধোমুখ?
আজীবন সেজদার ভঙ্গিতে কতো আর নোয়াবো শরীর?
এক রকম স্পষ্ট দাঁড়ানো দৃঢ়ভাব
কারো কারো সহজাত থাকে,
মানুষের মধ্যে থেকে তাহাদের পাঁচফুট নয় ইঞ্চি মাথা
মানুষের চে’ও কিছু উঁচু
আমি কতো আর নতজানু হবো
দাঁতে ছোঁবো মাটি?
আমার জনক সে কি জন্ম থেকে নিয়েছেন এই ভিক্ষা,
এই শিশুপালনের ব্রত
ওরে তুই জন্ম নতজাঁনু হয়ে বেড়ে ওঠ
সবাই যখন পায়ের পাতায় ভর করে
পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি মাথা আরো উচ্চে তুলে দম্ভে দাঁড়াবে
আমার বালক তুই তখনো লুকাবি মুখ
নিজেরই পায়ের তলদেশে;
আমি তাই জন্ম নতজানু, নতমুখ
মাথা তুলে বুক খাড়া করে কোনোদিন দাঁড়ানো হলো না
বুকভাঙা বাঁকানো কোমর আমি নতজানু লোক
কতো আর নতজানু হবো কতো দাঁতে ছোঁবো মাটি!