- বইয়ের নামঃ কোথায় যাই, কার কাছে যাই
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার ভেতরে যেন ফুটে উঠি
স্বপ্নের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, এই
একার ভেতর আমি
অনন্তকাল ডুবে আছি;
বার্চবন, স্নেজগাড়ি, দূরের ঘন্টাধ্বনি
আমার স্মৃতির মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে
সুদূর বাতাস, ধূ-ধূ ঝাউবীথি-
দেখি সূর্যাস্তের ছায়ার ভেতর আরো অশরীরী
নগ্ন নর্তকীরা সব
আরো স্বপ্নের ভেতর
আরো স্মৃতির ভেতর
আরো ছায়ার ভেতর ক্রমাগত ডুব-সাঁতার
দিতে দিতে, ডুব-সাঁতার
দিতে দিতে
এই অপরাহ্নে খুব ক্লান্ত একা একটু বসতি চাই
স্থিতি চাই আমি;
আমি চাই আমার ভেতরে অপরূপ ম্লান কুয়াশায়
যেন ফুটে উঠি।
আমি কথা রাখতে পারিনি
তোমাদের সাথে কথা হয়েছিলো কচি লাউপাতা,
ঘাসফুল, ভোরের শিশির
বর্ষার স্রোতের ঘূর্ণি, ফুলজোড় নদী,
রাতজাগা চাঁদ, শ্রাবণের উদাস আকাশ
দুকূল ছাপানো জল, ঘন মেঘ, বর্ষনের রাত
কথা হয়েছিলেঅ আমি তোমাদের কথা লিখে রেখে যাবো;
যে কৃষাণ প্রত্যহ সকালে উঠে মাঠে যায়
একা বউটিকে ফেলে,
রাখাল সজল চোখ গাভীগুলো চড়ায় একাকী
ভাটিয়ালি গান গেয়ে যে মাঝি যায় দূর দেশে
যে বাউল রোজ ভেঅরে আমাদের আঙিনায়
গেয়ে যেতো গান,
তোমাকের কারো কতা লিখতে পারিনি, আঁকতে
পারিনি তোমাদের হৃদয়ের
অনবদ্য ছবি;
কথা হয়েছিলো আমি তোমাদের কাছে ফিরে যাবো
রঙিন গোধূলি, উদার আকাশ, ধানক্ষেত,
কচি দূর্বাঘাস
শৈশবের পরিচিত প্রিয় মুক, আলতা-পরা
আমার মায়ের সেই পদচিহ্ন
কাঁসার বাসন, উঠোনের শুভ্র আলপনা
কথা হয়েছিলো, ঠিকই আমাদের কথা হয়েছিলো
আমি তোমাদের কাছে ফিরে যাবো
প্রিয় নদী, প্রিয় দানক্ষেত
ক্ষমা করো লাউপাতা, ভোরের শিশির
আমার মায়ের হাতে চাল-ধোয়া জলের সুগন্ধ
আমি তোমাদের কথা রাখতে পারিনি, আমি কথা
রাখতে পারিনি।
এই বয়সে বিশ্ববাউল
শেষ বয়সে বিশ্ববাউল
ভিতর-বাহির আউল-ঝাউল,
বেঁধেছি ঘর
পথের ওপর;
সেই পথও কি মিথ্যা বা ভুল!
কোথায় দুরে নীল সরোবর
পদ্ম ফোটে অষ্টপ্রহর;
পাখিরা গায়
ফুল ঝরে যায়,
মন্দাকিনী মগ্ন নিথর।
নিজের ঘরে নিজেই বাউল
এই বয়সে আউল-ঝঅউল,
যা ছিলো তা
ছিন্ন কাঁথা,
সব হারিয়ে নিঃস্ব বাউল।
এই শীতে আমি হই তোমার উদ্ভিদ
শীত খুব তোমার পছন্দ, কিন্তু আমি
শীত-গ্রীষ্ম-বসন্তের চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালোবাসি;
যে-কোনো ঋতু ও মাস, বৃষ্টি কিংবা বরফের চেয়ে
মনোরম তোমার সান্নিধ্য, আমি তাই
কার্ডিগান নয় বুকের উষ্ণতা দিয়ে ঢেকে দেই
তোমার শরীর-
আমি হই তোমার শীতের যোগ্য গরম পোশাক;
কোল্ড ক্রিম আর এই তুচ্ছ প্রসাধনী রেকে
আমি তোমাকে করতে চাই আরো হই শীত, হই শীতের উদ্ভিদ;
আমি হই সবচেয়ে বেশি তোমার শীতের উষ্ণ কাঁথা,
হই সকালের উপাদেয রোদ, সারো শুভ্র সানবাথ।
আমিজানি নগ্নতাই শীতের স্বভাব, আমি তাই
তোমার নগ্ন গায়ে দিব্য শতিের কামিজ;
তুমি অবহেলা ভরে যাও আমি
শীরেত শিশির হই ঘাসে-
দুপায়ে মাড়িয়ে যাও, তবু তোমার পায়ের রাঙা আলতা
হই আমি
এই শীতে তোমার নিবিড় উষ্ণতা ছাড়া নিউ ইয়ার্স গিফট
কী আর চাওয়ার বলো আছে!
একবার সেই দৈববাণী হোক
কী এমন হয়, কোথায় কী এমন ওলটপালট হয়ে যায়
একবার আমাকে বললে-
ভালোবাসি;
কেবল একটিবার সমস্ত জড়তা, লজ্জা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে
দুকূল ছাপানো বর্ষার নদীর মতো
উচ্ছল ঝর্নার মতো
সব সঙ্কোচ ও নিষেধের প্রাচীর ডিঙিয়ে
আমার কানের কামে মুখ এনে প্রাচীন মন্ত্রের মতো যদি বলো
শুধু চার অক্ষরের একটি অব্যর্থ শব্দ
চারটি শরের এই মৃত্যুবরণ
চারটি ফলার একটি ব্রহ্মাস্ত্র
চারটি পাপড়ির একটি কুসুম
ভালোবাসা;
যদি একবার এই জড় তোলো,এই
ভূমিকম্প আনো
আমার জীবন ছাড়া তাতে আর বলো কোথায়
কী হয়,
কী এমন হয় একবার এইটুকু উন্মোচিত
হলে
মুমূর্ষের কানে একবার এই
সঞ্জীবনী মন্ত্র শোনালে-
ভালোবাসি;
যা কিছুই হোক, ওলটপালট হয়ে
যাক সবকিছু,
তছনছ হয়ে যাক নাহয় জীবন
সমুদ্রে উঠুক ঝড়, মাটিতে কম্পন
যা কিছুই হোক, তবু একবার
তোমার মুখটি থেকে এই চার অক্ষরের সেই দৈববাণী
হোক।
এবার বর্ষার জলে
এবার বর্ষার জলে ধুয়ে নেবো মলিন জীবন
ধুয়ে নেবো আপাদমস্তক এই ভিতর-বাহির,
নববর্ষার জলে পরিপূর্ণ সিক্ত হবো আমি;
এই শ্রাবণের ধারাজলে ধুয়ে নেবো আমার শরীর,
ধুয়ে নেবো এই বুক, ধুয়ে নেবো ব্যর্থতার গ্লানি
নতুন বর্ষার জলে পুনরায় হবো সঞ্জীবিত;
আমি চাই কেবল জীবন জুড়ে অঝোর বর্ষণ
দিনরাত বৃষ্টিজল, দুইকুল ভরা স্নিগ্ধ নদী,
বর্ষার শ্যামল ছায়া, পরিশুদ্ধ বৃষ্টিধারা নব-
এবার বর্ষার জলে ধুয়ে নেবো আমার জীবন।
কোথায় যাই, কার কাছে যাই
আজ বন্ধের দিন; কোথাও কিছু খোলা নেই
সবখানে শুধু বন্ধ, শুধু বন্ধ;
একেকটি দরোজার সামনে বড়ো বড়ো শাটার নামানো
যেন বন্ধ-করা একটি কাঠের বাক্সের মতো সমস্ত শহর,
তালাবন্ধ যেন এই সুনীল আকাশ; আজ
বন্ধের দিন, নিউ মার্কেটের সবগুলো গেটে তালা
সাকুরায় যেন বহুদিনের কারফিউ;
পোষ্টাপিসের হলূদ বারান্দা জনশূন্য,
কাঠের সিঁড়ি শব্দহীন
ব্যাঙ্ক, বীমা, নীলক্ষেত টেলিফোন অফিস
কোথাও কোনো স্বাভাবিক কাজকর্ম নেই,
এই বন্ধের দিনে বেইলী রোডের দোকানগুলোতে
কিছুই পাওয়া যাবে না-
সারা এলিফ্যান্ট রোড যেন কোন এক অচিন ঘুমের দেশ।
আজ বন্ধের দিন, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই,
নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকান বন্ধু,
সাকুরা আজ খুলবে না
স্টেডিয়ামের সবগুলো দোকানে ঝাঁপফেলা,
খবরের কাগরের অফিসে কেউ নেই, টেলিফোন বন্ধ
আমি আজ কোথায় যাই; শহরের একটি রোস্তরাঁ কিংবা
পানশারঅও খোলা নেই,
শিশুপার্ক, কার্জন হল, কলা ভবন
বন্ধ, বন্ধ, সব বন্ধ,
এই বন্ধের দেনে এই জনশূন্য গোধূলিতে
তাহলে আমি কোথায় যাই, কার কাছে যাই!
বন্ধুরা ছুটিতে কেউ গেছে দেশের বাড়িতে, কেউ দেশের বাইরে
যারা ঢাকায় তারাও যে যার গর্তে ঢুকে আছে,
সবখানে এই দরোজা-লাগানো শহরে, এই গেটবন্ধ
নগরীতে আমি কোথায় যাই।
ব্যাঙ্ক, বীমা, পত্রিকার অফিস আজ
সব বন্ধু, কোথাও কেউ নেই,
তাহলে এই একলা রিকশায়, উদাসীন সাইকেলে চেপে
আমি কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো!
এই বিষণ্ন সন্দ্যায় একাকী ঘুরতে ঘুরতে
যদি তোমাদের বাড়ির কাছে চলে যাই-
তোমাদের সেই বন্ধু গেটটিও কি কিছুতেই খুলবে না,
সারারাত ডাকাডাকিতেও কি গুম ভাঙবে না তোমাদের কারো,
এই শহরে একটিবারের জন্যেও কি কেউ এই বন্ধ দরোজা
আর খুলবে না, আর খুলবে না?
তাহলে এই বন্ধের দিনে, এই সর্বত্র তালা-লাগানো শহরে
এই নিঃসঙ্গ সাইকেলে চেপে অবিরাম বেল বাজাতে বাজাতে
বলো আমি কোথায় যাই, কার কাছে যাই,
কোন নরকে যাই!
শুভাশিস, তোমাকে খুঁজছি আমি
শুভাশিস, তোমাকে খুঁজছি আমি
হরিচরনের যতার্থ বানানে লিখে নাম,
উচ্চারণ অভিধান ঘেঁটে সঠিক মাত্রায় ডেকে ডেকে
তোমাকে খুঁজছি আমি শুভাশিস, এই দুঃসময়ে
যখন সকল মানবিক স্রোতদারা মুস্ক হয়ে যায়,
নেমে আসে দিবসে-নিশীথে দীর্ঘ জিরাফের গ্রীবা।
তোমাকে খুঁজছি আমি যেন সেই শৈশবের নদী
আমার মায়ের দুটি স্নেহময় হাত,
যেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ, তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাদীপ
সুফী দরবেমের ধ্যানী দৃষ্টি;
তোমাকে খুঁজছি আমি শুখাশিস সমস্ত জীবন।
শুভাশিস, তোমাকে খুঁজছি আমি সকালের চোখে
নক্ষত্রের নিপুণ মুদ্রায়, মানুষের গাড় কণ্ঠস্বরে,
শ্রাবণের অঝোর বর্ষণে আর চৈত্রের উদাস জ্যোৎ্লায়
তোমাকে খুঁজছি আমি কতো লক্ষ সহস্র বছর।
তোমাকে খুঁজছি আমি শুভাশিস, সবখানে
লোকালয়ে, বৃক্ষপত্রে-
শহরের কংক্রিটের মাঠে
এই দুঃসময়ে কোথায় তোমার দেখা পাই;
শুভাশিস, তুমি নিরুদ্দেশ সেই কবে থেকে।
সুবর্ণ সেই আলোর রেখা
থাকে না এই জলের রেখা
এই জীবনে সবাই একা।
একলা ঘর, শূন্য ফাঁকা
সুখের কোছও বিষাদমাখা,
উদাস বাউল ঘুরছে পথ
ব্যর্থ-বিফল মনোরথ।
দুর আকাশে আলোর রেখা
আর দুজনের হয় না দেখা।
হাওয়ায় ওড়ে বাদামী চুল
স্বপ্ন যেন আকাশী ফুল;
এই জীবনে হয় না দেখা
সুবর্ণ সেই আলোর রেখা।