- বইয়ের নামঃ কোথা সেই প্রেম, কোথা সে বিদ্রোহ
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য ভবন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার আকাশ জুড়ে
আর কোনো চাঁদ নেই,
আমার আকাশ জুড়ে তুমি,
আলোকিত হয় তাকে
এই সত্তা, এই পটভূমি!
আর কোনোদিন হইনি এমন মর্মাহত
এর আগে আর কোনোদিন আমি
হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন তোমার চোখে প্রথম দেখেছি আমি জল,
অকস্মাৎ মনে হলো নিভে গেলো সব পৃথিবীর আলো
গোলাপবাগান সব হয়ে গেলো রুক্ষ কাঁটাবন।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি
মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম পথে দেখলাম অনাথ কিশোর এক
ক্ষুধায় কাতর কেঁদে মরে,
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীতে কোথাও
তেমন আর সুখ কিছু নেই
ফুলের দোকানগুলি হয়ে গেছে অস্ত্রের গুদাম।
আমি আর কোনোদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম দেখি
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় রক্ত লেগে আছে,
যেদিন প্রথম সবুজ বৃক্ষের দিকে চেয়ে দেখলাম
সেখানে লুকিয়ে আছে বিষধর সাপ, নদীর গভীরে
চোখ ফেলে দেখি এই জলে দূষণের বিষ, হাঙর-কুমির
তখনই দুহাতে ঢেকে মুখ বুঝলাম কতোখানি দুঃখী
এই কাছের পৃথিবী।
যেদিন প্রথম আমি আকাশেল দিকে চেয়ে দেখলাম
মেঘে বজ্র, ক্রূর ঘূর্ণিঝড়
অরণ্যে ভীষণ সব পশু, লোকালয়ে খুনী আততায়ী
তখনই আমার মনে হলো পৃথিবীর আলো অস্তমিত।
এর আগে আমি আর কোেেনাদিন মর্মাহত হইনি এমন
যেদিন প্রথম শুনি প্রেমিক অক্লেশে বসিয়েছে ছুরি প্রেমিকার বুকে
তখন বুঝেছি পৃথিবীতে দুঃখ ছাড়া চাষবাস হবে না কিছুই।
এর আগে কোনোদিন এমন হইনি মর্মাহত
যেদিন বৃক্ষের কাছে গিয়ে দেখলাম রক্ত ঝরে বৃক্ষের শরীরে
নদীর নিকটে গিয়ে দেখি নেই তার বুকে এতোটুকু তৃষ্ণারও জল
তখনই বুঝেছি কতোটা নির্দয় হতে পারে এই ভালোবাসার পৃথিবী।
সত্যি এর আগে আর কোনোদিন আমি হইনি এমন মর্মাহত
যেদিন দেখেও তুমি চোখ তুলে ফিরে তাকালে না।
একবার ভালোবেসে দেখো
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
এই মুখে কবিতা ফুটবে না,
এই কণ্ঠ আবৃতি করবে না কোনো প্রিয় পঙ্ক্তিমালা
তাহলে শুকিয়ে যাবে সব আবেগের নদী।
আমি আর পারবো না লিখতে তাহলে
অনবদ্য একটি চরণ, একটিও ইমেজ হবে না রচিত,
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো তবে
কবিতার পান্ডুলিপি জুড়ে দেখা দেবে ঘুরে ঘুরে অনাবৃষ্টি, খরা।
তুমি যদি না তাকাও এই চোখ দেখবে না কিছু
উজ্জ্বল আলোর ভোর ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাবে,
সন্ধ্যাতারা মনে হবে মৃত নিষ্পলক চোখ
যদি ফিরে না তাকাও মর্মে আর পল্লবিত হবে না কবিতা।
তুমি যদি না দাও চুম্বন এই মুখে ফুটবে না ভাষা
মরা গাঙে জাগবে না ঢেউ, দুই তীরে প্রাণের স্পন্দন,
হবে না শস্যের মাঠে শ্রাবণের ব্যাপক বর্ষণ
হৃদয়ে হৃদয়ে আর অঙ্কুরিত হবে না কবিতা, বাজবে না গান।
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
প্রকৃতই আমি আগের মতন পারবো না লিখতে কবিতা
আমার আঙুলে আর খেলবে না জাদুর ঝিলিক,
এই শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটবে না জুঁই আর চাঁপা।
একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ
অনায়াসে কীভাবে আবার অনুভূতি করি সঞ্চারিত,
একবার ভালোসেবে দেখো আবার কীভাবে লিখি দুহাতে কবিতা।
কবিতা বাঁচে ভালোবাসায়
তোমার কাছে আমি যে কবিতা শুনেছি
এখন পর্যন্ত তা-ই আমার কাছে কবিতার সার্থক আবৃত্তি;
যদিও তুমি কোনো ভালো আবৃত্তিকার নও, মঞ্চেও
তোমাকে কেউ কখনো দেখেনি,
তোমার কণ্ঠস্বরও এমন কিছু অসাধারণ নয়
বরং তুমি অনেক সাধারণ শব্দই হয়তো এখনো ভুল উচ্চারণ করো
যেমন …… না থাক, সেসব তালিকা এখানে নিষপ্রয়োজন,
অনেক কথাতেই আঞ্চলিকতার টান থাকাও অস্বাভাবিক নয়
কিন্তু তাকে কিছু এসে যায় না,
তোমার এসব ত্রুটি সত্ত্বেও তোমার কাছেই আমি
কবিতার উৎকৃষ্ট আবৃত্তি শুনেছি।
এমনকি ভুল উচ্চারণ ও আঞ্চলিক টানেও কবিতা যে কখনো
এমন অনবদ্য ও হৃদয়গ্রাহী হতে পারে
তা আমি এই প্রথম তোমার কাছে কবিতা শুনেই বুঝলাম।
কবিতা যে কতোটা আবৃত্তিযোগ্য শিল্প
আর কতোখানি মন্তআকুল-করা ভাষা
তাও আমি এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম
যেদিন তুমি আমার কানের কাছে মুখ এনে একটি কবিতা শোনালে।
সেদিন থেকেই বুঝলাম
কবিতার সার্থক আবৃত্তি আসলে বুকের ভিতর
কেবল তুমিই সেই আবৃত্তি করতে পারো।
কোনো কবিতার এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আর কিছুই হতে পারে না
যদি সেই কবিতা তোমার মতো কোনো সহৃদয় পাঠিকা আবৃত্তি করে
কবির কানে কানে
তখন একসঙ্গে দশ লক্ষ মৌমাছি বুকের মাঝে ওঠে গুঞ্জন করে
এক লক্ষ প্রজাপতি এসে ঋড়ে বসে কঁঅধে আর বাহুতে
আরো এক লক্ষ পাখি একসাথে ওঠে গান গেয়ে,
এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আমি আর কোথাও শুনিনি
যদিও তুমি কোনো ভালো আবৃত্তিকার নও
সেদিন খুব ভয়ে ভয়ে আর সঙ্কোচ
ধীরে ধীরে আবৃত্তি করেছিলে আমার একটি ছোট্ট কবিতা
তার সবটিুকু শেষ করেছিলে কি না তাও আজ আর ঠিক মনে নেই,
কিন্তু এটুকু মনে আছে
এর চেয়ে ভালো আবৃত্তি আর কিচু হতে পারে না
তোমার সেই সলজ্জ গোপন আবৃত্তির মধ্যেই
সম্পূর্ণ ও সফল হয়েছিলো কবিতাটি;
কবিতা বাঁচে ভালোবাসায়, কেবল ভালোবাসায়।