- বইয়ের নামঃ চাই বিষ অমরতা
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার হাতে দুঃখ পাচ্ছো
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আঘাত দেওয়ার
কথা ছিলো না, কথা ছিলো না, কথা ছিলো না,
তোমাকে আমার আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, গোলাপ তোমার
খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড এসব আমার একটু সয় না
গোলাপ তোমায় আঘাত দেওয়ার নিষ্ঠুরতা ঠিকই আমি করতে
চাইনি
আমি বড়ো কোমল ছিলাম, গোলাপ তোমার মতোই
আমি কোমল ছিলাম
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আমি কবি, আমি
কোনো নিষ্ঠুরতা দেখতে চাইনি, করতে চাইনি
নারী তুমি কাঁদবে আমার সহ্য হয় না, গোলাপ তুমি কাঁদবে আমার
সহ্য হয় না, মানুষ তুমি দুঃখ পাবে সহ্য হয় না
আমি কবি বাল্যে আমি যীশুর মতোই কোমল ছিলাম, শুদ্ধ ছিলাম
আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, মানুষ তোমাদের
আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না
গোলাপ তোমায় ভ্রষ্ট করার, নারী তোমায় নির্যাতনের
মানুষ তোমায় দুঃখ দেওয়ার আমার মোটেই কথা ছিলো না
তবুও তোমরা আমার হাতে, নারী তুমি আমার হাতে
গোলাপ তুমি আমার হাতে
সবচেয়ে কঠিন আঘাত পাচ্ছো, দুঃখ পাচ্ছো।
ইচ্ছা করে, কেন ইচ্ছা করে
ইচ্ছা করে, কেন ইচ্ছা করে, একদিন উড়ে যাবো
ফিরেও আসবো না
শুধু পড়ে রবে খাঁচা, খাঁচাতেই সম্ভব করেছি বাঁচা
এই উড়ে যাওয়া, আর ফিরেও আসবো না।
তবু ইচ্ছা করে, কেন ইচ্ছে করে, একদিন
উড়ো যাবো, ফিরেও আসবো না,
পাবে না জলের তৃষ্ণা প্রত্যক্ষ রোগের ক্লানি-, গাঢ় নিদ্রা
উড়ে যেতে যেতে এই পাখিত্বেই মেলাবো অধিক, হবে প্রেম গভীর প্রণয়
আমি আর কতোটুকু এই নামমাত্র ছায়া, কায়াটা তো মেকি
একদিন যেতে হবে ঠিকই অতি এক ক্ষুদ্র পাখি হয়ে
তাকে চোখেও দেখিনি
তবু স্বভাবে বুঝেছি পাখি উড়ে যাওয়াটাই তার ধ্যেয়,
সহজ বৃষ্টির মধ্যে অধিকন’ যায় তারা মেঘের প্রতীক
উড়ে যায়, কিন্তু কেন উড়েও যায় না, একদিন
উড়েও যায় না
তাদের আকাশ ছোট্ট খাঁচা তাও পড়ে থাকে, আর
উড়েও যায় না,
কিন্তু আমি উড়ে যাবো কিংবা উড়ে উড়ে ফিরেও
আসবো না
ইচ্ছে করে, শুধু ইচ্ছে করে আমি উড়ে যাই তবু তুচ্ছ এই
খাঁচাখানা থাক।
ইচ্ছাবৃষ্টি
আমার ভেতর কেমন পাতা থর থর হাওয়া কাঁপছে
কাউকে বলবো না আমি কিছুকে বলবো না
আমার এখন ইচ্ছে জাগছে!
নিজের দিকে চাইলে আমি ধরতে পারি এই রহস্য
কোথাও ওলটপালট হচ্ছে কোথাও কোমল মাটি কাঁপছে
বুকে কঠিন হাওয়া লাগছে, হাওয়া লাগছে
কী রহস্যে জড়িয়ে এমন মেঘ করেছে
বৃষ্টি হবে, আমার ধানী জমি জুড়ে রহস্য মেঘ বৃষ্টি হবে
আমার এখন ইচ্ছে জাগছে!
এই সারাদিন
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবে ছিলাম, সারাদিন
আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে
এই সারাদিন আমার শরীর ফেটে বেরিয়েছে ঘ্রাণ,
ঘাসের মতোই গভীর ও কোমল ভালোবাসা
আমার সারা শরীর ছেয়ে গেছে ঘ্রাণে ঘাসপাতার ঘ্রাণে
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবেছিলাম, সারাদিন
সারাদিন আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে
এই সূর্যাস্ত, এই পৃথিবী, দুয়ার খোলা ঘর
একজন দরবেশ এসে আমাদের অধঃপতনের কথা বলে ফিরে
গেলো
একজন আগন্তুক, একজন প্রেমিক, একজন বাউল
গেলো পথ বেয়ে,
এই সারাদিন আমি গাছের মধ্যে ডুবেছিলাম
সারাদিন আমি নারীর মধ্যে ডুবেছিলাম, তোমার মধ্যে।
কিছুদিন শোকে ছিলাম, মোহে ছিলাম
কিছুদিন শেকে ছিলাম, মোহে ছিলাম, কিছুদিন নারীতে
শোকাচ্ছন্ন ছিলাম
আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন
কিছুদিন এদিক সেদিক কিছুদিন ঘোরাফেরায় কিছুদিন
চাঁদ দেখতে দেখতে গোল মাঠের মধ্যে বুনো শিকারী
শসন্য তোলার কথা যেমন ভুলে গিয়েছি, ঘরে ফেরার কথা যেমন
তোমাদের মহুয়া মধুর স্মৃতির সঙ্গী হতে হতে নেমে গিয়েছি
বেশ করেছি, বেশ করেছি, বেশ করেছি। কিছু করিনি।
আজ নাহয় দু’চারদিন এদক সেদিক, কিছুদিন এমন তেমন,
কিছুদিন
চলতে ফিরতে চলতে ফিরতে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় কোনো
মায়াভরা মেয় ধুলোরমধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছি, বসে পড়েছি
পড়তে পড়তে ধরে উঠেছি একটা করুণ লতার মতো প্রসন্নতা
একটা কোনো কিছুর মতো কিছুদিন জড়িয়ে ছিলাম
কিছুদিন সুষে ছিলাম, স্নেহে ছিলাম,
সুখে দুঃখে সম্পন্ন ছিলাম
চলতে চলতে বসে পড়েছি এইখানে এই জলের ধারে
তোমাদের গোলাপ তোলার এই উৎসবে আমি পিছন ফিরে দেখিনি
কিছুদিন নারী কেমন,
লুটিয়ে ছিলাম, কিছুদিন
কাম ও কান্তি চঞ্চলতা অধীর তাকেই অঙ্গে রাখি, কিছুদিন
নারীত্বকে
কিছুদিন শিশুর গন্ধ, কিভছুদিন দীর্ঘ দাহ, কিছুদিন
অধীনতা
কিছুদিন এই কিছুদিন
চলতে চলতে চলতে চলতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছি
লোকে বলে এইখানে এই মায়াদিঘি, বসন্তকাল,
আমি কোনো মূর্তি চাই না
আরো কিছুদিন চন্দ্রাসক্ত, আরো কিছুদিন ঘুমিয়ে পড়বো,
আরো কিছুদিন।
গোলাপের বংশে জন্ম
আমরা কেউ সঙ্ঘসেবকের দলে নেই, আমরা চিরদহনদাহনপ্রিয়
মানুষের জন্ম সহোদর
আমরা কবি ও কামুক আমরা পূণ্যাত্মা সন্ন্যাসী
আমরা সামাজিক স্বাস্ত্যসুখবঞ্চিত স্বাধীন
আমাদের হাতে শুদ্ধ-সংরক্ত গোলাপ তবু কাঁটার আঘাতে
ক্ষত আহত অস্থির
এই শোকে সুখে বড়ো ভালো আছি, বড়ো ভালো আছি যেন
এই ছায়াতে মায়াতে।
মধ্যরাতে আমাদের দাম্পত্যবিবাহ, সবুজ শরীর সেই
মেয়েদের সঙ্গে সমারোহ
কিন্তু পুনর্জন্ম নাই; একবার জন্মাই মরে যাই।
গোলাপ ও কবির মধ্যে এটুকু সৌহার্দ, এইটুকু মিল
এইভাবে হাওয়ায় হারাবে।
এই ভাঙা ইট, পাথরের ধুলো, পরিপার্শ্ব এই মলিন মধুর
তারা কতো অদম্য উড্ডীন, কতো পূর্ণতার দিকে যাত্রা
কতো সিংহবাহী
সেসবে চাঞ্চল্যহীন আরো সহজ ও গভীর উদাসীন
আমরা চিরগহনগাহনপ্রিয় তোমাদেরই জন্ম সহোদর!
আমরা বন্দী কোথঅও নিশ্চিত বন্দী তবু ঠিক কারো কাছে নয়
ফেরার সময় কিছু জন্মমৃত্যু খেলা, কিছু প্রাকৃত তন্ময়
পথের উপরে সেই লাটবন্দী দাম্পত্যবিবাহ
সেইখানে পাথর কুপিয়ে কিছু নদী খাল বন্দর বানানো,
তা ছাড়া তেমন কোনো সপষ্ট বাসা নেই, যা আছে তা
উশকো খুশকো গলির ভিতর
তেমন গরিব নই ভাঙা বাসা রেখেছি অম্লান
আমাদের অসীম অনন্ত অপচয় মধ্যরাতে দাম্পত্য বিবাহ
আর প্রাকৃত তন্ময়
জমিসুদ্ধ কেঁপে ওঠে কোনো কোনো রাতে এই বিবাহবাসর
কিন্তু কোনো প্রাপ্তির অধিক কাম্য গচ্ছিত রাখিনি
বিদায়ে কাঁদাবে!
শুধু ফেরার সময় মায়া মানুষের মতো, যেন সুখস্পর্শ
যেন অন্ধকারে সম্ভাব্য আলোর এক অদৃশ্য আগ্রহ
যেন সবুজ শিকারী
আমাদের এই বুকে এতোটুকু মায়া শুধু স্পর্শ করে আছে
এতোটুকু ভালোবাসায় খেয়েছে
হয়তো এইখানে কোনো এক ছায়াতে মায়াতে
আমরা বন্দী হয়ে আছি!
তা ছাড়া অন্য কোনোখানে স্বচ্ছ চিহ্ন রাখি নাই
আমাদের পা বড়ো মায়াবী হেঁটে যায় চিহ্নও রাখে না।
দেয়অলে যেটুকু পড়ে মুখ থেকে মধ্যবর্তী দুপুরের ছায়া
সে-ছায়াও অপরাহ্নে মেলাবে,
আমর জন্মাই মরে যাই আত্ময়ি আত্মজ কিছু নাই
গোলাপের বংশে জন্ম আমাদের, আমরা কবি, আমরা
সকাম সন্ন্যাসী, আমরা অসংলগ্ন গৃহস্ত মানুষ
কোনো কোনো রাতে কেঁপে ওঠেআমাদের অনন্ত বাসর
আমরা কবি আমর চিরদহনদাহনপ্রিয় তোমাদেরই জন্ম সহোদর!