- বইয়ের নামঃ কী সুন্দর অন্ধ
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ কলি প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আবুল হাসানের জন্য এলিজি
আমারও শীতকাল আসে, আসে হুহু প্রকৃতির জ্বর
কুয়াশায় ভেজে জমি, ভিজে ওঠে তোমার কবর
মনে হয় এই শীতে আমিও বিদেশী!
আমারও সঞ্চয় ছিলো লাল মোজা, পশমের টুপি
ছিলো কাশ্মীরি শালের মিহি কাজ, কিছু হাতে বোনা উলের আদর
আর উষ্ণ জল, সহিষ্ণু যুবতী একজন
ছিলো তার রক্তিম রাখাল;
এই শীতে সেই যে রাখাল গেলো দূর বনে, একজন কবি
গেলো কুয়াশায়
হাতের তালুতে তারা শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে
কই আর কখনো ফিরলো না! আর কখনো ফিরলো না!
শহরে শীতকাল বেশ স্বাস্ত্যকর পিকনিকে পার্টিতে কেটে যায়
সবুজ সবজির ঘ্রাণে হয় ভালো ময়দানে ক্রিকেট
ভোরের রোদুদর মেখে চলে যায় ইস্কুলের ছাতা;
আমারও শীতকাল আসে পাতা ঝরে, পাতা ঝরে যায়!
মনে পড়ে সেই যে রাখাল আর ঘরে ফেরে নাই
সেই যে ব্যথিত কবি বলে গেলো,
আবার আসবো আমি চুলে মেখে কুয়াশার দাগ
তার পথে কতো ঝরলেঅ শিশির, কতো শিউলির শোক ….
আমারও শীতকাল আসে, আসে হুহু প্রকৃতির জ্বর
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে যায়!
এমন শৈশব কেন আমি আছি আর তুমি নাই!
একেক সময় মানুষ এতো অসহায়
এই মানুষকে ছাড়া আর কাউকে কখনো আমি
এতো অসহায় হয়েছে দেখিনি
শীতে ভিজে প্রাণিকুল, পাখিরাও কাঁপে
কিন্তু মনস্তাপে শুধু জ্বলে ভগবান, তোমার মানুষ!
আর কেউ কখনো এমন গভীর কুয়াশা পিঠে চেপে
একা ঘরে ফেরে নাই মানুষের মতো!
কিংবা তাদের বেদনা আমি কতোখানি জানি, এই পশুপ্রাণী
পাখিরা তো পাখিদের জীবনী লেখেনি
গাছের জীবনকথা কিচু লিখেছেন জগদীশ বসু
তাতে যতোটুকু জানা যায়
কোনো পাখি, কোনো গাছ রাখেনি কোথাও কোনো
তাদের ব্যথিত শিলালিপি!
শিকারীর গুলিবিদ্ধ বাঘ কী কাতর হয়ে পড়ে
কতোখানি অসহায় হয় এই গাছ ঘাতকের কুঠারের ঘায়ে
কিংবা কখনো প্রকৃতি কতো রুক্ষ কি বিষণ্ন হয়,
আবহাওয়াবিদের ব্যাখ্যা কিংবা জিম করবেট যা কিচু বলেন
আপাতত তাতেই সন’ষ্ট হয়ে থাকি
বাকি মানুষের মুক দেখে বুঝি!
দেখি এই মানুষ ব্যতীত আর কেউ
এতো অসহায় হয়নি কখনো
কখনো কখনো তারা এতো অসহায়
সেই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে যেমন ছিলো এখনো তেমনি আছে
কিংবা তারও বেশি;
কখনো কখনো একেকটি মানুষ এতোই নির্জন শূন্য
প্রাণের অস্তিত্বহীন গ্রহ যেন অধিবাসীহীন কোনো দ্বীপ,
হিমমগুলের সমস্ত তুষার তার কাঁধে
একটি বিশাল ব্যাগ-চাপা!
এই মানুষকেই কখনো দেখেছি কতো স্বেচ্ছাচারী
কখনো দাম্ভিক তাকে
হিংসাপরায়ন আরো বহুবার
কখবো সে নিমর্ম ঘাতক!
তবু এই মানুষকে ছাড়া আর কাউকে কখনো আমি
এতো অসহায় হয়েছে দেখিনি
এতো ভাবান্তর শুধু তার, এমন কাতর শুধু ভগবান,
তোমরা মানুষ!
কফিন কাহিনী
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিলো হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বললো দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষ ছিলো মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে!
চারজন দেবদীত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী
রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি!
কিছুই দেয়ার নেই
মেঘ নই আমি জলধারা দেবো তোমাদের তৃষিত মানুষ!
আমি অসীম নীলিমা নই ছাড়া দেবো,
মায়অ দেবো ব্যথিত মানুষ, এমন হৃদয়ভরা
ভালোবাসা কই!
তোমাদের কারো ঘরে কোনো ফুল ফোটাবো কখনো
হাসিরাশি দেবো উপহার
তার মতো কিচুই তো নেই,
আমার আঙুলগুলি এতো বেশি আলোকিত নয়
অসুখী মানুষ, ছোঁবে আর সেরে যাবে তোমার অসুখ!
আমার তো বুক নয় নক্ষত্রখচিত কিংবা জ্যোৎ্লাজড়ানো
তোমাদের গৃহে আলো দেবো, অন্ধকারে আনত মানুষ
এমনকি মাটির প্রদীপ যদি হতো এই বুক
টিমটিম তোমাদের ঘরে জ্বলতাম!
আমি তো শিশির নই তোমাদের রুক্ষ পথ স্নেহসিক্ত করি
শালবন নই আমি তোমাদের শ্যামল আতিথ্যটুকু দেবো!
কোনো কুলকুল নদী নই আমি তোমাদের শস্রক্ষেতে
উর্বরতা প্রবাহিত হবো
অরণ্যউদ্ভিদ নই তোমার দুঃখের পাশে
ফুটে থাকবো চাঁপা কি বকুল!
আমি তো শিউলি নই তোমাদের জন্য ভোরে
শুভ্রশয্যা বিছাবো তেমন
তৃণ নই বুক পেতে দেবো শাথা রেখে অবসাদে শোবে,
কোনো ঝরাপাতা নই বোন হবো,
ভালোবেসে টুপটাপ সারারাত ঝরবো শিথানে।
ব্যথিত মানুষ, আমি ছায়া দেবো বনভূমি নই!
আমি শুধু দিতে পারি শোভাহীন একগুচ্ছ গান।
চিঠি দিও
করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল, পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখর মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
এক কোণে শীতের শিশির দিও একফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে
তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!
ওই তো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ জীজন ফ্লাওয়ার
কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোপ, কারো নিবিড় বকুল
এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ
হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনো কিছু নাই?
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি।