- বইয়ের নামঃ কী সুন্দর অন্ধ
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ কলি প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আবুল হাসানের জন্য এলিজি
আমারও শীতকাল আসে, আসে হুহু প্রকৃতির জ্বর
কুয়াশায় ভেজে জমি, ভিজে ওঠে তোমার কবর
মনে হয় এই শীতে আমিও বিদেশী!
আমারও সঞ্চয় ছিলো লাল মোজা, পশমের টুপি
ছিলো কাশ্মীরি শালের মিহি কাজ, কিছু হাতে বোনা উলের আদর
আর উষ্ণ জল, সহিষ্ণু যুবতী একজন
ছিলো তার রক্তিম রাখাল;
এই শীতে সেই যে রাখাল গেলো দূর বনে, একজন কবি
গেলো কুয়াশায়
হাতের তালুতে তারা শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে
কই আর কখনো ফিরলো না! আর কখনো ফিরলো না!
শহরে শীতকাল বেশ স্বাস্ত্যকর পিকনিকে পার্টিতে কেটে যায়
সবুজ সবজির ঘ্রাণে হয় ভালো ময়দানে ক্রিকেট
ভোরের রোদুদর মেখে চলে যায় ইস্কুলের ছাতা;
আমারও শীতকাল আসে পাতা ঝরে, পাতা ঝরে যায়!
মনে পড়ে সেই যে রাখাল আর ঘরে ফেরে নাই
সেই যে ব্যথিত কবি বলে গেলো,
আবার আসবো আমি চুলে মেখে কুয়াশার দাগ
তার পথে কতো ঝরলেঅ শিশির, কতো শিউলির শোক ….
আমারও শীতকাল আসে, আসে হুহু প্রকৃতির জ্বর
পাতা ঝরে, পাতা ঝরে যায়!
এমন শৈশব কেন আমি আছি আর তুমি নাই!
একেক সময় মানুষ এতো অসহায়
এই মানুষকে ছাড়া আর কাউকে কখনো আমি
এতো অসহায় হয়েছে দেখিনি
শীতে ভিজে প্রাণিকুল, পাখিরাও কাঁপে
কিন্তু মনস্তাপে শুধু জ্বলে ভগবান, তোমার মানুষ!
আর কেউ কখনো এমন গভীর কুয়াশা পিঠে চেপে
একা ঘরে ফেরে নাই মানুষের মতো!
কিংবা তাদের বেদনা আমি কতোখানি জানি, এই পশুপ্রাণী
পাখিরা তো পাখিদের জীবনী লেখেনি
গাছের জীবনকথা কিচু লিখেছেন জগদীশ বসু
তাতে যতোটুকু জানা যায়
কোনো পাখি, কোনো গাছ রাখেনি কোথাও কোনো
তাদের ব্যথিত শিলালিপি!
শিকারীর গুলিবিদ্ধ বাঘ কী কাতর হয়ে পড়ে
কতোখানি অসহায় হয় এই গাছ ঘাতকের কুঠারের ঘায়ে
কিংবা কখনো প্রকৃতি কতো রুক্ষ কি বিষণ্ন হয়,
আবহাওয়াবিদের ব্যাখ্যা কিংবা জিম করবেট যা কিচু বলেন
আপাতত তাতেই সন’ষ্ট হয়ে থাকি
বাকি মানুষের মুক দেখে বুঝি!
দেখি এই মানুষ ব্যতীত আর কেউ
এতো অসহায় হয়নি কখনো
কখনো কখনো তারা এতো অসহায়
সেই শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে যেমন ছিলো এখনো তেমনি আছে
কিংবা তারও বেশি;
কখনো কখনো একেকটি মানুষ এতোই নির্জন শূন্য
প্রাণের অস্তিত্বহীন গ্রহ যেন অধিবাসীহীন কোনো দ্বীপ,
হিমমগুলের সমস্ত তুষার তার কাঁধে
একটি বিশাল ব্যাগ-চাপা!
এই মানুষকেই কখনো দেখেছি কতো স্বেচ্ছাচারী
কখনো দাম্ভিক তাকে
হিংসাপরায়ন আরো বহুবার
কখবো সে নিমর্ম ঘাতক!
তবু এই মানুষকে ছাড়া আর কাউকে কখনো আমি
এতো অসহায় হয়েছে দেখিনি
এতো ভাবান্তর শুধু তার, এমন কাতর শুধু ভগবান,
তোমরা মানুষ!
কফিন কাহিনী
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিলো হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বললো দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষ ছিলো মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই!
চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে!
চারজন দেবদীত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী
রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি!
কিছুই দেয়ার নেই
মেঘ নই আমি জলধারা দেবো তোমাদের তৃষিত মানুষ!
আমি অসীম নীলিমা নই ছাড়া দেবো,
মায়অ দেবো ব্যথিত মানুষ, এমন হৃদয়ভরা
ভালোবাসা কই!
তোমাদের কারো ঘরে কোনো ফুল ফোটাবো কখনো
হাসিরাশি দেবো উপহার
তার মতো কিচুই তো নেই,
আমার আঙুলগুলি এতো বেশি আলোকিত নয়
অসুখী মানুষ, ছোঁবে আর সেরে যাবে তোমার অসুখ!
আমার তো বুক নয় নক্ষত্রখচিত কিংবা জ্যোৎ্লাজড়ানো
তোমাদের গৃহে আলো দেবো, অন্ধকারে আনত মানুষ
এমনকি মাটির প্রদীপ যদি হতো এই বুক
টিমটিম তোমাদের ঘরে জ্বলতাম!
আমি তো শিশির নই তোমাদের রুক্ষ পথ স্নেহসিক্ত করি
শালবন নই আমি তোমাদের শ্যামল আতিথ্যটুকু দেবো!
কোনো কুলকুল নদী নই আমি তোমাদের শস্রক্ষেতে
উর্বরতা প্রবাহিত হবো
অরণ্যউদ্ভিদ নই তোমার দুঃখের পাশে
ফুটে থাকবো চাঁপা কি বকুল!
আমি তো শিউলি নই তোমাদের জন্য ভোরে
শুভ্রশয্যা বিছাবো তেমন
তৃণ নই বুক পেতে দেবো শাথা রেখে অবসাদে শোবে,
কোনো ঝরাপাতা নই বোন হবো,
ভালোবেসে টুপটাপ সারারাত ঝরবো শিথানে।
ব্যথিত মানুষ, আমি ছায়া দেবো বনভূমি নই!
আমি শুধু দিতে পারি শোভাহীন একগুচ্ছ গান।
চিঠি দিও
করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও
সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল, পাখি, সবুজ পাহাড়
বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখর মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে।
এক কোণে শীতের শিশির দিও একফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে
তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল!
ওই তো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,কাঁধে ব্যাগ,
হাতে কাগজের একগুচ্ছ জীজন ফ্লাওয়ার
কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোপ, কারো নিবিড় বকুল
এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ
হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনো কিছু নাই?
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোটো নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো
করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি।
জাহাজের মতো
জাহাজ যেমন ডাকে সেইভাবে ডাক দিও তুমি
তোমার ছাড়ার আগে একবার হর্নখানি দিও
সকল বন্ধন ছিঁড়ে তোমার বন্ধন তুলে নেবো,
একটি সামান্য ব্যাগ কিংবা তাও ফেলে দিতে পারি।
তুমি তো জাহাজ নও জলের টিকিট কেন নেবে
অধিক ইলিশপ্রিয় ছিলে যদি জলে বাসই ভালো
তবুও পারো না তুমি, দূরের জাহাজখঅনি পারে।
আমার জন্মের আগে জল ছিলো জাহাজও কি ছিলো?
হয়তো এমনি ছিলো সমুদ্রের স্বাভাবিক সাঁকো
হয়তো এমনি ছিলো সমুদ্রের স্বাভাবিক সাঁকো
মানুষের কিছু নেই ঘরবাড়ি জলেরই তো পাড়ে,
তুমি যদি ডাক দাও জাহাজের ডেক খুব প্রিয়।
ডেকে তো উদ্ভিদ নেই জলের উদ্বেগ কিছু আছে
তবু তো উদ্বেগ আছে দূরের জাহাজখানি জানে
তুমি তো ডাকোনি কাছে, ভালোবেসে জাহাজই ডেকেছে!
তোমার ব্যাকুলতাগুলি নিয়ে
কখন যে এভাবে তোমার ব্যাকুলতাগুলি ভরে দিয়োছো
আমার বাক্সে
হয়তো মনের ভুলে শীতবস্ত্রের সাথে এ-কনকচাঁপার ঝাড়
আর সঙ্গোপনে চোখের জলের এই উদাত্ত ফোয়ারা!
বার্লিনে তোমার এই ব্যাকুলতাগুলি দিয়ে আমি কী করবো!
এতো মনোযোগ দিয়ে তুমি কিনা শেষে সব ভুল দ্রব্যে
ভরে দিলে এই বাক্স
কোথায় শীতের জামা দেবে কিচু এতো দেখি কেবল আমার
বাক্সভর্তি দাউদাউ করছেসবুজ,
ডালা খুলে তাকাতেই একঝাঁক রাঙা মেঘ আর শাদা জুঁই
আমাকে বিহ্বল করে তোলে।
কোথায় তোমার টুথব্রাশ আরে শেভিং ক্রীম কোথায় সেন্টের শিশি
সোপকেস জুড়ে কী শাদা গোলাপ ফুটে আছে,
কোথাও তোমার আশঙ্কায় আঙুল কেঁপেছে কোথাও উলের
গেঞ্জিটির পাশে পড়ে আছে একগুচ্ছ ভীরু চুল
কতোবার যে লুকাতে চেয়েছো তোমার কান্না
আর তুমি তো জানো না তখনই যে কীভাবে শিশিরসিক্ত হয়ে
উঠেছে রুমাল!
বার্লিনে তোমার এই ব্যাকুলতাগুলি নিয়ে আমি কী করি!
আমার এ-উদাসীন বাক্সের ভিতর কখন যে তুমি
এই প্রজাপতিটিকে বসিয়ে রেখেছো
জামার ভাঁজের নিচে দেখি গুনগুন করছে মৌমাছি,
বাক্সে হাত দিতে সাহস করিনে আর
পাছে বিজন ঘুঘুর কণ্ঠে কোনো উদাস দুপুর বেজে ওঠে
তুমি আর কিছুই পেলে না
খুঁটে খুঁটে এইসব বেদনায় ভরে দিয়েছো আমার বাক্স!
আর একি বিদেশী মুদ্রাই বা কই
তোমার ভালোবাসার ব্ল্যাঙ্ক চেকখানি বাক্সের তলায়
এককোণে কেমন অযত্নে পড়ে আছে!
অবশেষে তুমি কখন যে একখানি বাংলাদেশের আকাশ
এমন নিখুঁত ভাঁজ করে ভরে দিয়েছো আমার বাক্সে
আর তোমার এ-ব্যাকুলতাগুলি, বলো তো বার্লিনে এই নিয়ে
আমি কী করবো!
দেশপ্রেম
তাহলে কি গোলাপেরও দেশপ্রেম নেই
যদি সে সবারে দেয় ঘ্রাণ,
কারো কথামতো যদি সে কেবল আর নাই ফোটে রাজকীয় ভাসে
বরং মাটির কাছে ফোটে এই অভিমানী ফুল
তাহলে কি তারও দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ উঠবে
চারদিকে!
গাছগুলি আদেশ অমান্য করে মাঝে মাঝে
যদি তোলে ঝড়
অতঃপর তাকেও কি দেশদ্রোহী আখ্যায়িত
করে ফেলা হবে!
যদি তারা বাধ্যানুগতের মতো ক্ষমতাকে
না করে কুর্নিশ
তাদের সবুজ শোভা বরঞ্চ বিস্তৃত থাকে
নিষেধের বেড়া ভেদ করে
তাহলে কি গাছগুলি দেশপ্রেম বর্জিত বড়োই!
পাখিরা কি পুনরায় দেশপ্রেম শিখবে সবাই
আর তাই তাদের নিজস্ব গান ছেড়ে তাদেরও শিখতে হবে
দেশাত্মবোধক গানগুলি
যদি তারা অসীম আকাশে উড়ে মাঝে মাঝে ভুলে যায়
আকাশের ভৌগলিক সীমা
তবে কি নীলিমা তারও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন
তুলবে এমন?
কিংবা এ-আবহমান নদী কতোটা দেশকে ভালোবাসে
কোনো ভাবোচ্ছ্বাসে তাও কি জানাতে হবে তাকে?
যদিও সে কখনো কখনো ভাঙে কুল, ভাসায় বসতি
তা বলে কি এই নদী দেশপ্রেমহীন একেবারে?
কোকিলও কি দেশদ্রোহী যদি সে আপন মনে কারো
নাম ধরে ডাকে
কুলও দন্ডিত হবে যদি কেনা সেও কোনো নিষিদ্ধ কবরে
একা নিরিবিলি ঝরে
আর এই আকাশও যদি বা তাকে অকাতরে দেয় স্নিগ্ধ ছায়া,
তাহলে কি আকাশেরও দেশপ্রেম নিয়ে কেউ
কটাক্ষ করবে অবশেষে!
দৈন্য
কিনেছি অনেক দামী উপহার
বহু মনোহর কাগজের ফুল;
ভালোবাসা দিয়ে হয় নাই কেনা
একখানি মেঘ একটি বকুল!
জমাজমি আর গৃহ আসবাব
অধিক মূল্যে করে রাখি ক্রয়,
শুধু কিনি নাই কানা কড়ি দিয়ে
একজোড়া চোখ একটি হৃদয়!
পাখির শয়ন
কতোটা সতর্ক হয়ে জল হয় মেঘের শরীর, ক নিয়মে
মুয়ে থাকে পাখি
ঘাসে, পুরু বাতাসের ভাঁজে, খোলা পুষ্প পল্লবের ছাদে
এই তো পাখিরা বেশ, হিংসা দ্বেষ কিছু নেই তার।
পাখি বড়ো স্বভাব সজ্জন মেলে আছে শরীরের সীমা
কেমন উদাস নগ্ন ওরা পাখি, তাই মানে অরণ্য-আবাস
এমনটি শব্দ আছে পাখির শয়ন বলো
ভেঙে যাবে ভয়ে!
পাখি তো শয়ন করে যেভাবে জলের বেগ কোনোখানে
হয়ে যায় নম্র নতজানু
যে নিয়মে বৃক্ষের শরীর ফেটে জন্ম নেয় ফুল
দেহের সমস্ত লজ্জা খুলে দিয়ে সেভাবে শয়ন করে পাখি।
ওরা তো শয়ন জানে, শয়নের লজ্জা তাই নেই!
কীভাবে চোখের নিচে অনায়াসে ধরে রাখে ঘুমের কম্পন
ওরা পাখি, সুখূ ওরা
সবুজ শব্দের চিহ্ন পান করে চলে যায় কুয়াশার
গাঢ় কোলাহলে
এই তো শয়ন এই পাকিরই শয়ন
আমার চেয়েও ভালো শুয়ে থাকে পাখি!
এই তো শয়ন শিল্পরীতি, পাখিরাই জানে!
মলয়ের মৃত্যুতে কয়েক পঙ্ক্তি
বলেছিলে চিঠি দিও, চিঠি দিই নাই
তোমাকে না-লেখা চিঠি প্রত্যহ পাঠাই!
তুমি কি পাও না তবে, বোঝো না কি ভাষা,
লেখা কি অস্পষ্ট খুবই! কিন্তু ভালোবাসা
তাও কি যায় না পড়া? বানান কি ভুল?
নদী বয় পাখি গায় তবু ফোটে ফুল!
তুমি কি এতোই দূরে এইসব স্মৃতি
তোমাকে দেয় না কভু অনন্ত উদ্ধৃতি?
লোকে বলে মৃত তুমি আমি দেখি নাই
আমার না-দেখা দিয়ে তোমাকে সাজাই
বন্ধু প্রিয়, জীবনের সঙ্গী প্রতিদিন,
আমাদের কোনো স্মৃতি হয়নি মলিন।
তোমার রুপালি মুদ্রর রেখে গেছো জমা
তাতে যতো জল ঢালি জন্ম নেয় ক্ষমা
প্রেম সুরভিত হয়; উদ্যানে উদ্ভিদ
মেঘ নাম, বষ্যা হয়, ফিরে আসে শীত!
তোমাকে যে চিঠি লিখি রাত্রি তার খাম
আকাশ রঙিন প্যাড তাতে লিখি নাম!
মানুষই মহৎ শিল্প
এতো ধ্বনিময় কণ্ঠ আমি কখনো শুনিনি কোনো
পাখিদের কাছে
কোনো নদী এমন মধুর কলগীতি
শোনায়নি আর কোনোদিন
যা এই শুনেছি আমি চিরদিন মানুষের মুখে
এতো প্রিয় সম্বোধন, এমন হৃদয়বোধ্য ভাষা
কেবল মানুষ ছাড়া কারো কাছে পাইনি কখনো!
এই যে নীলিমা সেও মানুষের মতো এতো স্নেহ
কভু ঝরাবে না
এই যে প্রকৃতি সেও কারো দুঃখে হবে না তো এমন কাতর,
বুক পেতে এমন আঘাত নেবে, হাত পেতে বিষ
কেবল মানুষ ছাড়া আর কোনো
প্রাণী কি উদ্ভিদ কেউ নেই!
কোনো গোলাপের বুকে এতো কোমলতা আমি
কখনো দেখিনি
যা এই দেখেছি আমি চিরদিন মানুষের বুকে!
মানুষের হৃদয়ের মতো এমন সবুজ তৃন
তৃণক্ষেত্র ফোটেনি কখনো
চোখের জে
লর মতো এতো আর্দ্র
কোনো শিশির দেখিনি ঝরে রাতে,
এতো হৃদয়সম্পন্ন কোনো নিবিড় বকুল
আমি পাইনি কোথাও
এমন বেদনা শুধু দেখেছি তো মানুষেরই বুকে
দুঃখে সুখে তাই বারবার ফিরে যাই মানুষের কাছে!
এতো অনুভূতিময় চোখকোনো ভাস্কর্যেরও চোখে আমি
ককনো দেখিনি
কোনো কুসুমের দিকে চেয়ে দেখিনি তো এমন বিষাদ
যা এই দেখেছি আমি চিরদিন মানুষের চোখে
শিল্পের অধিক কিচু দুঃখের অনল!
মৃত্যুর প্রাচীন ভাষ্য
কোনো কোনো মুহূর্তে এই মৃত্যুও হয়ে ওঠে জীবনের গূঢ় অভিষেক
আরো গভীর বাঙ্ময়। সে-মৃত্যু প্রার্থনা করি, সে-মৃত্যু প্রণাম করে যায়
একদিকে তুমি, একদিকে মৃত্যুর মৌনতা যেন বৃক্ষের ছায়ায় আরো
শুদ্ধ পুণ্যশীল
আলোর উপরে আরো কোনো অপার্থিব রোদ এসে
করে যায় সবুজ মার্জনা;
দুধারে পথের পাশে নাম লিখে যাওয়া তো মূর্খতা
মানুষে পথিকে তবু জেনেশুনে রেখে যায় নিজস্ব নিশানা! তারা
নিলামে ওঠেনি!
মৃত্যুর পরেও কিছু সুখ, কিছু প্রাপ্য, কিচু নিশ্চিত ভোগের
আমি হাসিমুখে রেখে যেতে পারি
তাহলে কি নিয়ে যাবো মৃত্যুই মৃত্যুতে? আমি মূর্খদৃঢ় শারীরিক
যদি মরি পৃথিবীরই সুখে মরে যাবো।
একদল কেশরফোলানো সিংহ, মহিষের ক্রূর কালো খাঁক
কিংবা কোনো তারও চেয়ে অজ্ঞাত অনাম্নী অতিশয়
সূর্যের ভিতরে আরো এক লক্ষ বাদামী অশ্বের ছুটোছুটি, ধুলো
অন্ধকার
এভাবে মৃত্যু কি যেতে হবে কতো দূরে, কতো কাছে, কতোটা সংজ্ঞায়!
আমি জানি সে-দূরত্ব শুধু এ স্িমৃতির অতীত আরো অশেষ অগাধ,
কখনো কখনো তাই বাস্তবিক ভয় পাই ঘর ছেড়ে তাঁবুতে লুকাই
বলি মৃত্যুতে যাবো না তার চেয়ে এসো খেলা করি
এসো মধ্যরাতে অজ্ঞাত রাস্তায়
নেমে কোলাকুলি করি, সে-সময় মাথার উপরে আরো বৃষ্টি হবে
গাঢ় মমতায়
এইভাবে স্নান করে এইভাবে ঋণী হয়ে জন্মের দূলত্বে চলো যাবো।
এইখানে ধুলোস্পর্শী পৃথিবীর মায়অ এসে পড়ে
অনন্ত সূর্যাস্ত দেখি কী প্রাচীন কী গভীর কমলালেবুর
মতো মধুর মায়াবী
এভাবে মৃত্যুকে দেখি তার সঙ্গে এভাবেই জানা এভাবেই মৃত্যু
আত্মীয়
আমাদের জানালার ধারে এসে কথা বলে যায়,
করে পরম আদর, অন্য কেউ ভাবে নিতান্ত অস্পৃশ্য
তাকে মৃত্যু শিশুর মতোই গালে-মুখে চুমু খায়, ডাকে।
সে-এক মুহূর্ত আসে সে-এক তন্ময়
মধ্যরাতে ফুটপাতের অজ্ঞাত কংক্রিট তারও চোখে ঝরে জল
ধীরে ধীরে কাছে আসে মৃত্যু কোনো প্রিয় কি পথিক!
যদি কবিতা না লিখি
যদি এক পঙ্ক্তি কবিতা না লিখি আমি আজ
তাহলে হযতো কাল অমন সুন্দর রাঙা ভোর এসে
দাঁড়াবে না তোমাদের ঘরে
ফুটবে না অভিমানে কোনো জুঁই, শিউলি, বকুল!
হয়তো আকাশ কালো কুয়াশায় রাখবে নিজের মুখ ঢেকে
দেখা যাবে হাঁটুর ভিতরে তারা মাথা গুঁজে মনঃক্ষুন্ন বসে
আছে গাছ,
সারারাত একফোঁটা ঝরেনি শিশির
ভীষণ তৃষিত তৃণ, লতাগুল্ম বিষণ্ন সবাই
কারো মুখে কথা নাই, মেঘেদেগর রঙ বড়ো ফিকে!
পাখিরা ভুলেছে তার গান, নদী কলতানহীন
এমনিক শিশুরা তাদের সব মনোরম প্রাতঃরাশ পরিহার করে
আর মর্নিং ইস্কুল রম্য খেলাধুলা ছেড়ে চলে যায়,
কবিতা না লিখি যদি আজ তবে
হয়তোবা বিজ্ঞানসম্মত এই বিমানও উড়বে না কাল ভোরে,
ওষুধ হারাবে তার ক্রিয়া, গোলাপও গোলাপ
থাকবে না!
এই যে পরস্ত্রী এতো প্রিয় সেও আকর্ষণ হয়তো হারাবে
চাঁদ হবে রুগ্ন ও পীড়িত
ফুল রুক্ষ টিলা!
আমার কবিতা ছাড়া একটি শ্রমিকও তার কাজে যাবে না যে!
কবিতা না লিখি যদি তবে
সংসারের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হবে!
শীতের সেবায় তবে সেরে উঠি
আমার অসুখ নেই আর ; কাল সারারাত
থোকা থোকা মৃত্যু পান করে আমি সুস্থ হয়ে গেছি
আর কোনো অসুস্থতা নেই আজ,
আজ ভালো আছি!
এই হাসপাতালও ভালো আছে বেশ
দিব্যি সেজেগুজে পরেছে গাউন, আর গুনগুন সারাক্ষণ লেগে
আছে ঠোঁটে
আভা আলমের সব গান কেউ কি ক্যাসেট ভরে
রেখেছে এখানে
মৃত্যুর মৃন্ময় মুক থেকে ঝরে সেই ব্যথিত বিহ্বল
প্রিয়হীন কান্না শুনে মনে হয় গান বাজে, পরিচিত গান
আত্মা সে অসুখ থেকে উঠে এসে অনন্তের পাত্র ভরে
মৃত্যু করে পান।
এতো অসুস্থতা এইখানে ভালোবেসে বাসা বেঁধে আছে,
এই আরোগ্যআবাসে
কতোবার মৃত্যুর মর্মর ধ্বনি শুনি
দেখি পায়ে তার পরেছে নূপুর, করিডোরে
ব্যালে কি মাথুর
আর তারই ফাঁকে কখন যে কার ঘরে
লাস্যময়ী মৃদু নক করে!
এই হাসপাতালবাড়ির অলিন্দে উঠোনে টবে
এতো ফুলের স্বাসে’্যর শোভা
এতো স্বাস্ত্যকর ফল, এতো ডেটলের বিশুদ্ধ সৌরভ, এতো
সঞ্জীবনী ওষুধের ঋতু
আর আমি অসুস্থ থাকবো না। আমি সেরে উঠি
আমি অসুস্থ থাকবো না।
অসুস্থতা সেরে ওঠো। শীতের শুশ্রুষা পেয়ে
ভালো হয়ে ওঠো
হাসপাতলনিবাস হলো বেশ দীর্ঘ মনোরম, চলো যাই,
চলো ফিরে যাই
কাষ্ঠ আহরণে সেই এসেছি কখন,
কতো বেলা হলো
অবসাদবোধ আর মোহমূর্ছা ছিলো কিচু আগে
এখন শরীরে আর ব্যাধির স্পর্শ নাই, ভালো হয়ে গেছি।
শীতের সেবায় তবে সেরে উঠি, ভালো হই,
সুস্থ, প্রবাহিত হই!
সবাই ফেরালে মুখ
সবখানে ব্যর্থ হয়ে যদি যাই
তুমিও ফেরাবে মুখ স্নিগ্ধ বনভূমি
ক্ষুধায় কাতর তবু দেবে না কি অনাহারী মুখে দুটি ফল?
বড়োই ব্যথিত যদি কোনো স্নেহ ঝরাবে না অনন্ত নীলিমা!
সবাই ফেরাবে মুখ একে একে, হয়তোবা শুস্ক হবে
সব সমবেদনার ধারা
তুমিও কি চিরপ্রবাহিণী নদী দেবে না এ-তৃষিত অঞ্জলি
ভরে জল?
আমার মাথায় যদি ঝরবে না কোনো শান্তিবারি তবে
কেন মেঘদল!
সব সেবাশ্রম, স্বাস্ত্যনিবাস যদি করে অবহেলা, রোগে একফোঁটা
না দেয় ওষুধ
তোমার ভেষজবিদ্যা দিয়ে আমাকে কি সুস্থ করে তুলবে না প্রকৃতি?
খোলা রাখবে না স্যান্যাটোরিয়াম?
উদ্ভিদ দেবে না ঘ্রাণ নাকে মুখে যাতে পুনরায় জ্ঞান ফিরে আসে।
উৎসবের সব বাঁশি যদি থেমে যায়,
কেউ দয়াপরবশ হয়ে আর না শুনায় গান
পাখি তুমি শোনাবে না তোমার কূজন কলগীতি
পাতার মর্মরে বেজে উঠবে না ভৈরবী বেহাগ!
যদি সবার লাঞ্ছনা পাই, সকলের রুক্ষ আচরণ
তুমিও কি মোছাবে না মুখ, তোমারও আঁচলখানি
হবে নাকি দয়ার্দ্র রুমাল?
সবাই ফেরলে মুখ তুমি ফেরয়ো না, দুঃখ পাবো!
স্মৃতি
স্মৃতি ছাড়া কোনো নোটবুক নাই
টুকে রাখি কোথা ইট বা খোয়াই
ভাঙা বাড়িটার ধূলি-জঞ্জাল
বুক ভরে যারা ছিলো এতোকাল;
কোথা লিখে রাখি এতো প্রিয় নাম
যার পাশাপাশি একদা ছিলা!
কিছু ভালোবাসা কিছু অবহেলা
কোনটা প্রকৃত কোনটা বা খেলা
বুনো ঝাউবীথি উদাসীন শাল
চিরচেনা নদী মোয়াবী রাখাল
কাকে বলি তুমি কাকে নামে ডাকি
অনেক ঠিকানা কাকে মনে রাখি।
এতা পশুপাখি লোক লোকালয়
পরিচিত ঘরে এতো পরিচয়
তুচ্ছ তাকেও কতো দামে জানি
ছেঁড়া কাগজেরও অভিমানখানি
কতোদিন কতো ফুল আর মেঘ
তারও পথা চেয়ে কীযে উদ্বেগ
এই ধূলি কাঠ পাথরের ঘ্রাণ
চিরদিন এই মানুষের গান
লিখে রাখি কোথা এতো প্রিয়নাম
যার পাশে আমি একদা ছিলাম!
স্মৃতি ছাড়া আর নোটবুক নাই
কিছু মনে পড়ে, কিছু ভুলে যাই!