- বইয়ের নামঃ এসো তুমি পুরাণের পাখি
- লেখকের নামঃ মহাদেব সাহা
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার জীবন
আমার জীবন আমি ছড়াতে ছড়াতে
এসেছি এখানে,
আমি কিছুই রাখিনি-
কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা,
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো
সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্মৃতি,
আমি এই হারানো জীবন আর খুজি নাই
সেই ফেলে আসা পথে;
ছেঁড়া কাগজের মতো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি আমাকে।
পথে পড়ে থাকা ছিন্ন পাপড়ির মতো
হয়তো এখানো পড়ে আছে
আমার হাসি ও অশ্রু,
পড়ে আছে খেয়ালি রুমাল, পড়ে আছে
দুই এক ফোঁটা শীতের শিশির;
এখনো হয়তো শুকায়নি কোনো কোনো অশ্রুবিন্দুকণা,
বৃষ্টির ফোঁটা
চঞ্চল করুণ দৃষ্টি, পিছু ডাক,
হয়তো এখনো আছে সকালের মেঘভাঙা রোদে,
গাছের ছায়ায়
পদ্মাপকুরের স্থির কালো জলে,
হয়তো এখনো আছে হাঁসের নরম পায়ে
গচ্ছিত আমার সেই হারানো জীবন
সেই সুখ-দুঃখ
গোপন চোখের জল।
এখনো হয়তো পাওয়া যাবে মাটিতে
পায়ের চিহ্ন
সেসব কিছুই রাখিনি আমি
ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে
এখানে এসেছি;
আমি এই জীবনকে ফ্রেমে বেঁধে রাখিনি কখনো
নিখুঁত ছবির মতো তাকে আগলে রাখা হয়নি
আমার,
আমার জীবন আমি এভাবে ছড়াতে ছড়াতে এসেছি।
আমার সঞ্চয় আজ কেবল কুয়াশা, কেবল ধূসর
মেঘ
কেবল শূন্যতা
আমি এই আমাকে ফ্রেমে বেঁধে সাজিয়ে রাখিনি,
ফুটতে ফুটতে ঝরতে ঝরতে আমি এই এখানে
এসেছি;
আমি তাই অম্লান অক্ষুণ্ন নেই, আমি ভাঙাচোরা
আমি ঝরা-পড়া, ঝরতে ঝরতে
পড়তে পড়তে
এতোটা দীর্ঘ পথ এভাবে এসেছি
আমি কিছুই রাখিনি ধরে কোনো মালা, কোনো ফুল,
কোনো অমলিন স্মৃতিচিহ্ন
কতো প্রিয় ফুল, কতো প্রিয় সঙ্গ, কতো উদাসীন
উদ্দাম দিন ও রাত্রি
সব মিলে হয়ে গেছে একটিই ভালোবাসার
মুখ,
অজস্র স্মৃতির ফুল হয়ে গেছে একটিই স্মৃতির গোলাপ
সব সাম মিলে হয়ে গেছে একটিই প্রিয়তম নাম;
আমার জীবন আমি ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে
এখানে এসেছি।
আমার সবুজ গ্রাম
কতেদিন হয়নি যাওয়া আমার সবুজ গ্রামে
সোনাবিল, পদ্মাদিঘি, উত্তরকঙ্গের
সেই ধুলোওড়া পথ, বিষণ্ন পাথার,
আখ মাড়াইয়ের দৃশ্য, ক্লান্ত মহিস
কতেদিন হয়নি দেখা; কতেদিন হয়নি
শোনা দুপুরে ঘুঘুর ডাক, হুতোম পেঁচার
শব্দ : হয়তো এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে
প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গ্রামের নদীটি, কখনো
শহরে সবুজের সমারোহ দেখে এই প্রিয় গ্রামটিকে
মনে পড়ে যায় : কোনো পুরনো দিনের
গান শুনে, দোয়েল-শালিক দেখে
আমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি;
ফিরে যাই আমার সবুজ গ্রামে, হাটখোলাটিতে
এখনো টিনের চালে কখনো
বৃষ্টির শব্দ শুনে উত্তরবঙ্গের
সেই দুঃখিনী গ্রামটি মনে পড়ে।
এমন কী আছে তার মনে রাখবার মতো
তবু এই উলুঝুলু বন, বিষণ্ন পাথর
নেহাৎ খালের মতো শুকনো নদীটি, এখনো
আমার কাছে রুপকথার চেয়েও বেশি রুপকথা।
এ জীবন আমার নয়
এ জীবন আমার নয়, আমি বেঁচে আছি
অন্য কোনো পাখির জীবনে,
কোনো উদ্ভিদের জীবনে আমি বেঁচে আমি
লতাগুল্ম-ফুলের জীবনে;
মনে হয় চাঁদের বুকের কোনো আদিম পাথার আমি
ভস্মকণা,
ভাসমান একটু শ্যাওলা আমি;
এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়
আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে,
পাখি, ফুল, ঘাসের জীবনে।
আমি তো জন্মেই মৃত, বেঁচে আছি
অন্য এক জলের উদ্ভিদ-
আমার শরীর এইসব সামদ্রিক প্রাণীদের
সামান্য দেহের অংশ,
আমি কোটি কোটি বছরের পুরাতন একটি
বৃক্ষের পাতা
একবিন্দু প্রাণের উৎস, জীবনের
সামান্য একটি কোষ;
এ জীবন আমার নয় আমি সেইসব অন্তহীন
জীবনের একটি জীবন,
আমি বেঁচে আছি অন্য জীবনে, অন্য
স্বপ্ন-ভালোবাসায়।
একলা আমি
একলা আমি কীভাবে এই
আকাশ বলো ছুই,
কীভাবে এই পাতালে যাই
স্পর্শ করি ভুঁই।
একলা আমি কীভাবে এই
দুঃখ করি জয়-
কীভাবে এই মরণ রুধি
দূর করি এই ভয়!
একলা আমি কীভাবে এই
ঠেকাই চোখের জল,’
কীভাবে এই রক্ষা করি
দগ্ধ বনাঞ্চল;
একলা আমি কীভাবে এই
বাঁচাই কিশলয়
কীভাবে এই বাঁচিয়ে রাখি
স্বপ্নসমুদয়!
কবিত্ব
ঝর্নাকে আমি কখনো থামতে দেখি না
নদীকে দেখি না,
বৃক্ষকে কখনো আমি নিঃশেষিত হতে
মোটেও দেখি না;
আকাশকে কখনো দেখি না আমি শেষ হয়ে যেতে
সমুদ্রকে ফুরিয়ে যেতে কখনো দেখি না,
আমি এই চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখাকে বলি
কবিত্ব, কবিত্ব;
অনিঃশেষ এই অগ্নি বুকে নিয়ে জেগে থাকে কবি।
এই অফুরন্ত শোকের উৎসব, এই অবিরাম
আনন্দের অনন্ত মূর্ছনা
এই রাত্রিদিন বেয়ে চলা নদীর অন্তর সত্তাকে বলি
কেবল উৎসকে
কেবল কবিত্ব বলি আমি।
এই অনিঃশেষ অগ্নিশিখা, এই অনন্ত অশেষ
জলপ্রপাত
এই চিরপ্রস্ফুটিত আলোকিত ফুল
এই অনন্ত বিদ্যুৎদুতি,
আমি একেই কবিত্ব বলি,
বলি মানুষের সৃষ্টিপ্রতিভা।
কবির কী চাওয়ার আছে
কবির কী চাওয়ার আছে এই রুক্ষ
মরুর নিকট
কী আছে চাওয়ার তার অস্ত্র আর বারুদের কাছে।
নেকড়ের চোখের মতো হিংসা ও লোভের
কাছে কী তার চাওয়ার থাকতে পারে,
বলো, নিষ্পত্র বৃক্ষের কাছে কী তার চাওয়ার আছে
কী আছে চাওয়ার তার অনুভুতিহীন এইসব
হৃদয়ের কাছে;
তেজস্ক্রিয়তার মেঘে ঢাকা এই আকাশের কাছে
কী সে প্রত্যাশা করে বলো।
কী সে চাইবে এই দুষিত নদীর কাছে,
নোনা জল, শূন্য মৌচাকের কাছে-
কী তার চাওয়ার আছে লোহার খাঁচার কাছে,
গরাদের কাছে?
কবির কী চাওয়ার আছে এই রক্তাক্ত হাতের কাছে
তীর, তরবারি আর জল্লাদের কাছে,
এই নখদন্তের নিকট কবির কী চাওয়ার
থাকতে পারে আর।
এই বিষাক্ত নিঃশ্বাসের কাছে কবি কী
চাইতে পারে-
কী তার চাওয়ার আছে বলো, এই সূর্যাস্তের কাছে,
আঁধারের কাছে!